নার্সিসাস - আহমেদ ফারুক মীর (গল্প )
নার্সিসাস - আহমেদ ফারুক মীর (গল্প )


[] এক

ভাগ্য বিন্যাসের কথা ভাবতে ভাবতেই আমার চলে গেল বহু বছর। আমি যাকে কাল্পনিক দেখি, সে থাকে পাক্ষিনাশা গ্রাম থেকে দূরবর্তী এক সার্কাসে। সে থাকে গান শোনানোর জন্য। সে থাকে হুজুরের মনোরঞ্জনের জন্য। সে থাকে অনিচ্ছাকৃত মর্ষকামীতার জন্য। সে থাকে পালানোর জন্য অপেক্ষারত।

আমার বাড়িটি হলো কুন্তলদিঘির দক্ষিণের কেয়াবনের কাছাকাছি।

ওখানে আমার এক বড় বাড়ি। সমস্ত বাড়ি জুড়ে আম কাঠালের গাছ। বাড়ির লম্বা দরজা। দরজার মাথায় পুরোনো ইটে বাঁধাই করা গেইট। গেইটের দু'পাশে দু'টি কনকচাঁপার গাছ। বৈশাখ হলুদ ফুলের ঘ্রাণে মায়াসাপেরা এসে বসে গাছের তলায়। আমার দাদু মীর হাসিম সাহেব গেইট পত্তন করেছিলেন ১৮০০ শতাব্দীর শেষের দশকে।

গেইটের ভেতর থেকে দুই দিকে বাগান। বাগানের মধ্যে দিয়ে ঘরমুখী লম্বা রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে পাতাবাহারী গাছ। রাস্তার উপরে কাঠাল পাতার পাতলা ছায়া। পাতলা রোদের ছটা। আলোগুলো নাচে।

হাঁটতে হাঁটতে আমি আলোর নাচন দেখি। তারপর পাতার ছায়ার ফাঁক দিয়ে আলোর নাচনে পা ফেলে আমি হাঁটি। ঘরে আসি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেই। তখন ঘরের চারদিক আরও নির্জন হয়ে ওঠে। তখন কাঠাল পাতা ঝরার শব্দ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে হয় খোলা দরজা দিয়ে সার্কাস রমনী দৌড়ে ঘরে ঢোকে। আমার পাশে বসে। আবার দৌড়ে ছুটে যায় লম্বা দরজা দিয়ে, পোড়া ইটের গেইট পাড় হয়। একটি কনকচাঁপার ফুল খোঁপায় গুঁজে নিতেই বোধহয় সে আসে। ভুল করে ঘরে ঢুকে যায়। একটু বসে'ই আবার ফিরে যায়।

ঘরে থাকি আমি একা। চারদিকে গাছের ছায়ার ফাঁক দিয়ে নরম হালকা রোদ ঘরেও এসে পড়ে। মীর হাসিম সাহেবের হাতে বানানো ঘর। দেখলে মনে হয় আর্যদের প্রথম ডেরা। ইটের সাথে ইট গেঁথে প্রথম যে ঘর বানাতো মানুষ, তার সাক্ষর বহনকারী আমার ঘর। চারদিকে ক্ষয়ে যাওয়া পলেস্তারা। এক সময় লাল রঙ ছিল দেয়াল জুড়ে। বোঝা যায়। এখন ঘরের ভেতর বারমাসি অন্ধকার। ঘরের চালে টুপটাপ পাতা ঝরার শব্দ। মাঝে মাঝে আলোছায়ার দুপুরবেলা দাদাজানের পায়ের আওয়াজ। বাইরে তখন প্রখর রোদ। শুনশান। গ্রামে ইরিধান কাটার মৌসুম।

আমি এ ঘরে থাকি। ঘরে আছে দুটি তক্তপোশ। এখন ওগুলো জাদুঘরের কাঠের আসবাবের মত। আমার চলে যায়। আমি একা। একদমই একা। একা'ই আমার ভালো লাগে। আমি খাটে শুয়ে থাকি। ছাদের নিচে ওরেসারে এঁটে থাকা কালো কাঠ দেখি। আমার একটিমাত্র আলমারি দেখি, যেখানে আছে আমার প্রাগৈতিহাসিক কালের সমস্ত বই, দাদাজানের পুথিপুস্তক। প্রতিটি বইয়ের পাতায় যেন আদরের ঘুঁণ লেগে আছে। ওরা ওদের ভালোবাসে, যেমন আমি ভালোবাসি আমার ঘর।

[] দুই

আমি বহু রাত জেগে থাকি। এই ঘরে আসবাব দেখি। দেখি মেঝে এবং কল্পিত নারীর ছবি। যে হাঁটাহাঁটি করে, আমার প্রাগৈতিহাসিক কাঠের চেয়ারে বসে, আমার কপালে হাত রাখে। আমি উঠে বসি। তার হাত ধরি। হাত ধরে বসেই থাকি। বসেই থাকি।

কল্পিত নারীর হাতে কাঁসার ঘটি। দূরে এবং কাছে সে হাঁটে। সে গুনগুন করে এবং অদৃশ্য হয়। আমার তখন অস্থির লাগে। তার নাম "জুয়াইরিয়া"। আমি তাকে ডাকি জুয়া। তার সাথে আমি জুয়া খেলি। সে সহ্য করে। আমি জিতি। সে হারে।

আমি বলি আমার ঘরের গল্প। গল্পটি থেমে থেমে বলি। লিমার কাছে বলি। ও ভালো শ্রোতা। ভালো শ্রোতার কাছে সব গল্পই ভালো। ভালো শ্রোতার কাছে সব গল্প বলিয়ে'ই সাউথ ওয়েলস্ এর  'বোয়াল ডাল'। লিমার কাছে আমিও "বোয়াল ডাল"। আমার সব গল্পই ওর কাছে কালজয়ী নাটক, সিনেমা। ও ঘন্টার পর ঘন্টা চুপ করে শুয়ে ছিল। ও তখন একসাথে কয়েক ঘন্টা উপুর হয়ে শুয়ে থাকার অভ্যাস করত। আমি লিখতাম। রাতের পর রাত। "একটি মাত্র গল্প"।

আমার যে বাড়িটি এখন আছে তার দুয়ার পূর্বমুখী। তার দক্ষিণের দিকে দিঘি। মীর হাসিম সাহেব নয়, তার দাদা মোবারক আলী মীরের কাটানো দিঘি। দিঘির চারদিকে তালগাছ। গল্পটি আমার ঐতিহাসিক ঘরের। যে ঘরে থাকে আমি ছাড়াও অন্য এক কল্পিত নারী।

নারীর চোখে আমায় শাসন করার মন্ত্র। আমি অবাধ্য, সে বাধ্য। সে রবীন্দ্ররমনীর মত। আমি বিচ্ছিন্ন। আমার কোমলতা নেই। আমি বৃষ। সে নমনীয় আমি কর্কট। আমার ঘরের তক্তপোশ ভাঙা। রাতে শব্দ করে। ক্র্যাক ক্র্যাক... শব্দ করে। রাতে তেলাপোকা গল্প করে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

আমার ঘরের দক্ষিণের দরজা দিয়ে স্বর্ণকামিনী ফুলের সুবাস আসে। আমার চলে যায়। আমার কল্পনা আছে। কল্পিত নারী আছে। তেলাপোকা আছে। আমার চলে যায়...। আমার ঘরে যে বইগুলো আছে সেগুলো আমি প্রায়ই রোদে দেই। বইগুলোয় রোদ পড়ে এক অদ্ভূত গন্ধ আসে। আমি বুক ভরে পুরোনো বইয়ের গন্ধ নেই। বই উল্টেপাল্টে দেখি। বই থেকে খসে পড়ে পাতা। খসে পড়ে মানুষ ও যৌবন।

আমি আমার দাদা মীর হাসিমের চিবুকের গন্ধ পাই। গন্ধ পাই তার প্রেমিকার ওষ্ঠের।

[] তিন

পক্ষীনাশা গ্রামে আর কুন্তলদীঘির কাছাকাছি আমার দাদা হাসিম মীর সাহেবের বাড়িটিতে বসে আমি চেয়েছিলাম আমার ভাগ্যবিন্যাসের গল্পটি বলতে। ওটি  ছিল একটি গল্প হয়ে ওঠার গল্প।

কীভাবে আমি অপেক্ষা করতাম এবং কীভাবে অসংখ্য রাতে এক সার্কাস নারীর সাথে গল্পটি বলতে বলতে জেগে থাকতাম! তারই গল্প হতো অন্য এক কল্পিত নারীর সাথে। আমি দেখতাম,  একটু একটু করে গল্পটি একটি শান্ত এবং ঠান্ডা গল্প হয়ে উঠছিল!

"আমার প্রতিবেশিনী"।

আমি আমার দাদাজানের ঘরের পলেস্তারা ঝরে পড়া দেখতাম আর তাকে গল্পটি বলতাম। গভীর রাতে বাড়ির সামন দিয়ে উড়ে যেত কয়েকটি বাদুড়। কাঠাল গাছে ওদের দাপাদাপি আমার গল্পের খেই হারিয়ে দিত । আমি আলো কমিয়ে রাখা হেরিকেনটি হাতে নিয়ে দরজা খুলতে গেলে মীর হাসিমের বেঁচে থাকা কালের লোহা কাঠের দরজা কোমড়ভাঙা রোগীর মত ক্র্যাক ক্র্যাক শব্দ চিৎকার কররে উঠত।

আমি কান পেতে শুনতাম বাদুড়ের তরপাতরপি, যখন রাত নিশুতি, চারদিকে এই একটিমাত্র অসংখ্য শব্দ। আমার হাত থেকে খসে পড়তে চাইত আমার দস্তানা। আমার গাউনের অস্তিন দমকা বাতাসে উড়তে থাকত। আমি শক্ত করে ধরে থাকতাম আমার লাঠি এবং হেরিকেন।

আমি আবার ক্র্যাক শব্দে দরজা বন্ধ করে ফিরে আসতাম লোহা কাঠের তক্তপোশের উপরে। ওটা শব্দ করত গডজিলার চেয়ে কর্কশ স্বরে। আমি যেন এক অলৌকিক অন্ধকারে ফিরে যাচ্ছি। আমি যেন কোন ঝড়ের রাত্রিতে একা,  অন্ধকার। দূরের স্বর্ণচাঁপা গাছ থেকে মৃদু মাতাল ঘ্রাণ...

ভয় কাটাতে একটি প্রাচীনা বই মেলে পড়তে থাকতাম। পড়া এবং ওল্টানোর সময়টুকুতে বইটির পাতা ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ত। বইটির পিঠে ছিল অন্য একটি নগ্ন পিঠের ছবি। বইটির লেখক "ডি এইচ লরেন্স" বইটিতে এক অসম্ভব সাহসী প্রেম বিন্যস্ত করেছিলেন।

"লেডি চ্যাটার্লি'র" সেই প্রেমিকের মত আমার মনেও তৈরী হত প্রেম। আমার ভেতরেও ফিরে আসতো এক অসংলগ্ন নগ্ন নারী, যাকে আমি কল্পনা করতাম। "আমার প্রতিবেশিনী। সার্কাসের নাচনেওয়ালী। আমারও ছিল পুরোনো একটি ঘর। ছিল লেডি চ্যাটার্লির ঘরের মত ঠান্ডা মেঝে, যেখানে আমিও কল্পিত নারীর সাথে শরীরে শরীরে খেলতে পারতাম। সেই নারীও প্রায়ই উঁকি দিয়ে যেত।

একটি ছবিবছর কেটে যেতে না যেতেই আমার চোখে ভাসতে থাকলো আরও একটি ছবি। বৈশাখের শুরুর দিকে যখন গিয়েছিলাম সার্কাসের মাঠে; তখনই আমার পুরোনো ঘুণধরা ঘরে কাল্পনিক বসবাস করা নারীকে দেখলাম। সার্কাসের ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে সে গান গাইছিল। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।

আমি বাড়ি ফিরে আসলাম। আমার ঘরে তখন জ্যৈষ্ঠের ঝড়। ঘরের চারদিক কাঁচা আমের স্তুপ। এখানে ওখানে কুন্ডলী পাকানো গোখরো। গোখরোগুলোই ছিল আমার সবচেয়ে পুরোনো প্রতিবেশি। গোখরোগুলোই আমার চিরায়ত  প্রেমিকা। ওরা আমার ঘরের দেয়ালের পাশে ছিদ্র করে বাসা বানিয়ে নিরাপদে থাকতো। ওদের মধ্যে আমার মধ্যে একটি পার্থক্য ছিল। ওদের ছিল জোড়া এবং প্রেমিকা। ওদের ছিল সন্তান। আমি ছিলাম আমার পলেস্তারা পড়া ঘরে নিঃসঙ্গ, নিঃসন্তান।

[] চার

হারিয়ে গেছে একটি হাওয়া পাখি,
হারিয়ে গেছে নুপুর ফেলে ঘাটে,
আমার থেকে একটু দূরেই দিঘি,
দিঘির জলে পদ্য ফুলের সাথে,"

আমি যাকে নিয়ে ভাবতাম সে অনেক বছর আগে আমার ঘরেই ছিল। এঘরে ওঘরে ওর ছিল আলোর মত যাতায়াত। "প্রতিবেশিনী"। পক্ষীনাশা গ্রাম আর কুন্তলদিঘীর মাঝামাঝি ছোট্ট মাচার ঘর। "আমার প্রতিবেশিনী"। যে ছিল অনেক বছর আগে। আমার ঘরে ছিল তার অবাধ আসা-যাওয়া। দুপুরে কিংবা রাতে, অথবা সকালে, সে আসে যায়। সে ছিল সার্কাসের। সে ছিল আমার।

এখনও, আমি যখন ঘুমাই, উঁকি দেয়। তার আঁচল আমার চোখে পড়ে। সে আসে যায় দিঘী অভিমুখে। পদ্য ফুলের নিকটে, পদ্ধফুলের পাতার ওপরে বসে থাকে।

আমি একা বসে থাকি। আমি আমার পুরোনো ঘরের বারান্দায় যাই। হাসিম মীর এর বানানো লোহাকাঠের ইজি চেয়ারে বসি। দুলতে থাকি। একটু পরে আবার চেয়ার ছেড়ে উঠি। ঘর থেকে বের হই। পদ্ধফুলের দিঘির ধারে হেঁটে আসি।

গেইটের পাশে গিয়ে দেখি স্বর্ণচাঁপার হলুদ ফুল। আমি নার্সিসাসের মত একা হয়ে যাই। আমার পুরোনো ঘরে আবার ফিরে যাই। একা'ই কাটাই দিন,  রাত এবং বিকেল। নিজের প্রেমেই মুগ্ধ থাকি। গ্রীসের নার্সিসাস। নারীরা যাকে প্রেম নিবেদন করত নিজেকে উৎসর্গ করে...।

বিচিত্র চায়ের কাপে নজর রাখো কানখেঁকো মানুষ। বিচিত্র বন্ধনে আবদ্ধ থেকেও কত মানুষ চিরকালই একা তুমি জানো।

এটি এক নিঃসঙ্গ মানুষের গল্প। এটি একটি উত্তরাধিকারের গল্প। এটি একটি ঘুঁনে ধরা ঘরের গল্প।
যার প্রকৃত মালিক মীর আবুল হাসিম। আমি তার একমাত্র উত্তরাধিকারী। আমি তার পদ্ধদিঘির'ও চুড়ান্ত মালিক। যে দিঘিতে সে হারিয়েছে। হারায় নি। মূলত গা ঢাকা দিয়েছে। এবং প্রায়ই গভীর রাতে এবং ঠিক দুপুরে আসে। পরনে থাকে গোলাপি শাড়ি।

আমি ঘর থেকে বের হই,  দরজার এপাশ থেকে ওপাশে আসি। লম্বা দরজা দিয়ে হাঁটে মানুষের পা। ছাপ পড়ে থাকে। যাকে বলে পদচিহ্ন। শব্দটি যেন একটি ইতিহাস। একটি নয়। একটির সাথে যোগ দেয় অসংখ্য আরও ইতিহাস। অথচ মানুষ নেই। সে দূরে চলে গেছে। "পদচিহ্ন"!

আমি আবার ঘরে ফিরে আসি। দাদার কবরের কথা ভাবি। মীর আবুল হাসিম। যিনি জানতেন, আমার কোনদিন নতুন কোন ঘরের প্রয়োজন হবে না। আমি এই লোহাকাঠের ঘরেই জীবন কাটিয়ে দিবো।

দাদা জানতেন, কারো সাথেই আমার মিলবে না। না বৌ, না প্রেমিকা, না রক্ষিতা। জনপ্রিয় গায়িকার সাথেও না। একজন নর্তকীর সাথে হয়ত আমার মিলতে পারে। কারণ, একমাত্র সে'ই ঈশ্বরকে বুড়ো আঙুল দেখানোর সাহস রাখে। নর্তকীর কোমড় দু দিকে দুলে উঠলে আমার হৃদয় দুলে ওঠে। প্রতিবেশিনীর ছবি আর নর্তকীর ছবি আমি এলোমেলো করে ফেলি।

"কে, কোন জন সে?"

[] পাঁচ

নোনা হাওয়ায় দিঘির জল যে ভাসে,
জলের উপর জলের কণা হাসে,
আমি ছাড়া কেউ দেখেনা তাকে,
পদ্মফুলে লুকিয়ে যে-জন থাকে...

গল্পটি শেষ পর্যন্ত আমার দাদাজানের পলেস্তারা পড়া প্রাচীন ঘর আর পক্ষীনাশা গ্রাম থেকে বের হয়ে আসলো। এখন তার আচ্ছন্নদৃষ্টি দিঘীর পদ্ধজলে। বহুবিধ সম্পর্কের আড়ালে থাকা একাকিত্ত্বের দিকে।  বহুদিন আগে যে জলে অথবা পদ্ম পাতার আড়ালে লুকিয়ে গিয়েছিল আমার প্রতিবেশিনী, সার্কাসের নর্তকী, যে নাচতে নাচতে মুচকি হেসে যেত, তারই দিকে এখন গল্প। নৃত্যরত অবস্থায় তার চোখ থাকত আমার চোখের দিকে স্থির। অথচ তার পায়ের তাল ছিল নিখুঁত। অগনিত দর্শকের চোখে সে ছিল এক মোলায়েম শরীর এবং মেদহীন মাংস। আর, আমি দেখতাম একটি বিপুল ঠান্ডা, কোমল একাকিত্বের গল্প।

নাচ শেষে সে দৌড়ে এসে দেখে যেতো আমার ঘর, আমার একাকিত্বের অবসান করে দিয়ে সে আবার চলে যেত। সে ছিল কাজলা দিদির মত। প্রায়ই লুকোচুরি খেলেছিল। আমি তাকে কোনদিন আটকে রাখতে পারিনি।

আমি স্থির হয়ে বসে থাকতাম আমার প্রাচীন ঘরে, আমার ছিল অনেক বই, আমার ছিল ক্র্যাক শব্দ করা পুরোনো তক্তপোশ , হরিণের শিং, একটি লোহাকাঠের আলমারি আর ছাদের নিচে অসংখ্য কালো কালো কাঠ। আমি মাঝে মাঝে ঘর থেকে বের হতাম। বাড়ির দরজার মাথা পর্যন্ত যেতাম। যেখানে পোড়া ইটের পুরোনো গেইট। সেখানে কনকচাঁপার দু'টি গাছ। থোকা থোকা হলুদ কনকচাঁপা। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম।

সে দৌড়ে এসে আবার ফিরে যেতো। সে সার্কাসে নাচের মুদ্রা শিখতো। সে গল্প শুনতে ভালোবাসতো না।

আমি এখন দিঘির দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার বাড়ির দক্ষিণে যে দিঘি, তার ভেতরে পদ্মফুল। তার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক নিখুঁত শান্ত নর্তকী। দিঘীর চারদিকে তালগাছ। দিঘীর চারদিকে শান্ত ছায়া। আমি ছায়ার ফাঁকে পা ফেলে হাঁটি।

আমি ছায়ার গায়ে অসংখ্য ছবি দেখি। আমি ছায়ার গায়ে একটি ছবি খুঁজি। অথচ আমার ছবিবছর কোনদিন'ই শেষ হয়নি।

গল্পটি একটি বৃদ্ধ ঘর থেকে মোড় নেয় একটি দিঘীর জল আর জলের উপর ভাসমান সৌখিন জলের দিকে। পদ্মপাতার পেছনের আরও লুকানো গল্পের দিকে গল্পটি রূপ নেয়। গল্পটি একটি অদৃশ্য প্রেমিকার দিকে মোড় নেয়।

যে ছিল সার্কাসের নর্তকী এবং আমার প্রতিবেশিনী।

আমাকে যারা বলেছিল, গল্পটির ইতিহাস তারা জানতোই না, তাদেরকে আমি বলতে চেয়েছিলাম নর্তকীর লুকিয়ে থাকার রহস্য এবং আমার একাকিত্ব। অথচ কে গ্রহণ করতে পারতো বিলুপ্তির এমন উপাখ্যান? কে ধারণ করতে পারে মানুষের ক্রমান্বয়িক নীরবতা? মানুষ কি জানে বিপুল সম্পর্কের মাঝেও অধিকাংশ মানুষই খুঁজে ফেরে একজন প্রতিবেশী অথবা একজন প্রতিবেশিনী'কে!

মানুষ কখনোই রাখতে শিখেছে মানুষের মনের প্রকৃত খবরাখবর?

আমার ঘর, আমার প্রতিবেশিনী,  আমার দিঘী এবং তালগাছ, আমার বাড়ির লম্বা দরজা এবং দু'টি স্বর্ণচাঁপা। এছাড়া আমার ছিল একজন কল্পিত প্রতিবেশিনী। এছাড়া ছিল অসংখ্য ছায়া। যার ভেতরে আমি পা ফেলতাম না। আমি হেঁটে যেতাম ছায়ার ফাঁকে পা ফেলে। মানুষ যা'ই বলুক, "বস্তুত মানুষের গল্পের কখনও শেষ হয়না। মানুষের একাকিত্বের কখনও বিনাশ হয়না...।

সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান