ট্রাকের পেছনে পড়ে থাকা শেষ নিঃশ্বাস,
টেলিভিশনের স্ক্রিনে শুধু “ব্রেকিং”— বিজয়ের মুখ নেই।
পাঞ্জাবির কোঁচড়ে ঝুলে ছিল এক মা’র ডাক,
জানালার ফাঁকে পলা— “সে তো ফিরবে আজ”।
কেউ ফুল ফোটালো না সেই প্রভাতে,
শুধু রাস্তায় ছিল পাঁজরের জখম স্মৃতি।
মাইকে ঘোষণা— “শান্ত থাকুন,”
আর আমরা শিখে গেলাম কেমন করে
শান্ত থাকা যায় এক লাল সকালের মাঝে।
আমি দেখেছি,
জুলাই রক্ত নিয়ে গান গেয়েছে,
কিন্তু বিজয়ের সুর এখনো শিখিনি।
ছয়.
আমি রক্তাক্ত জুলাই দেখেছি, বিজয় দেখিনি- ১
আমি না কোনো সৈনিক, না কোনো ভাষ্যকার,
আমি সেই প্রাচীন দেয়াল, যেখানে রক্তের ছাপ আজও স্পষ্ট।
জুলাইয়ের সকাল আমার চোখে জন্ম নিয়েছিল—
এক
জ্বলন্ত প্রশ্নচিহ্ন হয়ে।
বুলেটের শব্দে কেঁপে উঠেছিল হৃদয়,
না সাহসে, না ভয়ে—
শুধু মানুষের আত্মার লাঞ্ছনায়।
আমি দেখেছি,
কিভাবে নেতা এসেছেন ফুল হাতে,
কিন্তু রেখে গেছেন প্রশ্নবিহীন বিবৃতি।
আমি সে মা,
যার কোল খালি
আর আশ্বাস ভরা।
আমি সেই শিশুর চোখ,
যে পাঠ্যবইতে বিজয়ের গল্প খোঁজে,
কিন্তু ইতিহাসের রক্তাক্ত পৃষ্ঠা পায়।
আমি কাঁদি, কিন্তু নীরবে,
আমি হাঁটি, কিন্তু প্রতিরোধে।
আমি, Harun,
রক্তাক্ত জুলাই দেখেছি—
আর বিজয়... এখনো পথ হারায়।
সাত.
প্রিন্সিপালের ঘর- ১৯৭৫ এর ৬ই আগষ্ট
রাত ছিল থমথমে, চট্টগ্রামের আকাশে বিস্ফোরণ,
একটি চাওয়া—পরীক্ষা পেছাও,
একটি না বলা উত্তর—“না”,
আর
তারপর ছুঁড়ে দেওয়া এক গ্রেনেড
ভুল করে ঢুকে পড়ে নিষ্পাপ শয়নকক্ষে।
রক্তের ছোপে লেখা হলো ইতিহাস,
একটা বড় মেয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন,
একটা ছোট মেয়ের নিঃশ্বাস টিউবের ভেতর বন্দী—
হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর দোলনায় দুলে ওঠে।
প্রিন্সিপাল যেন দেশের বিবেক ছিলেন,
চাকরি ছেড়ে কোথায় গেলেন,
কেউ জানলো না,
শুধু সেই প্রহরটা রয়ে গেল
যেখানে সভ্যতা নিজেই নিজেদের খণ্ডিত করে।
সাক্ষী ছিলাম, আমি, তুমি,
তবে সাক্ষ্য দিল না কোনো আদালত,
কার্যক্রম স্থগিত, বিচার অনুপস্থিত,
শিক্ষিত যুবকের হাতে ছিল
শিক্ষার বদলে অস্ত্রের আদর্শ।
এই জাতির নাম যদি লিখি কোথাও,
সঙ্গে চাই ক’টি শব্দ:
অসভ্য, বর্বর, পিশাচ, অভিশপ্ত—
তবু এই কবিতা শোক নয়,
এটি স্মৃতি রক্ষার প্রতিশ্রুতি।
আট.
দিনটা ছিল ধনপুরের জন্য বেশ ব্যতিক্রমী। পঞ্চায়েত ভবনের সামনে লাইন পড়ে গেছে ভোটারদের,
কেউ সাইকেলে এসেছে, কেউ ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে।
তবে গাঁয়ের বাতাসে শুধু নির্বাচন নয়,
একটি
প্রশ্নও ভেসে বেড়াচ্ছে:
“এই ভোটে নজাবতের নাম ফেরে কি?”
শাফিন দাঁড়িয়ে আছে দাদার স্মৃতিতে,
ভোট কেন্দ্রে ঢোকার আগে চোখ রাখে তালিকায়—
নাম নেই সেখানে, কিন্তু সে ভোট দিচ্ছে
মনে মনে নজরবন্দি ইতিহাসের পক্ষেই।
মিলা ক্যামেরা হাতে, তাঁর প্রতিবেদন আজ আরও গুরুত্বপূর্ণ।
এক বুড়ো বলেন, “আমরা ভোট দিই,
কিন্তু কি পাই?
নজাবতের ঘড়ি তো বাজে না আমাদের নামে।”
একটি বুথে দেখা যায় আয়েশা আপা,
নিজের ভোট দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন,
তাঁর চোখে যেন হাজার বীরের ছবি।
নির্বাচনের শেষে ঝকঝকে ফলাফল আসে,
কিন্তু ধনপুরের মানুষের মনে বাজে এক নতুন সুর—
“জয় কোনো প্রার্থীর নয়,
জয় হলো সেই ঘড়ির, যেটা আবার সময়ের দাবিতে বাজে।”
নয়.
শ্লোগানে মোড়া শহর জাগে,
তবু গাঁয়ের কাক ডাকে আগের মতোই,
জন্মসনদের ভুলে কাগজে
এক
বুড়োর নাম হয়নি তালিকায়।
সাংবাদিকের কলমে কালির ঘ্রাণ নেই,
নিরপেক্ষ শব্দে চুপ থাকে পৃষ্ঠা,
এক প্রার্থীর পোস্টার হাসে দেয়ালে
কিন্তু জনতার মুখ থাকে গম্ভীর।
‘আপনার অধিকার’ বলে চিৎকার,
কিন্তু সিল মারে ভয়, আর অভ্যাস,
নির্বাচন যেন এক অভিনয়
দশ.
ভোটের ঢাক বাজে দূরে,
প্রতিশ্রুতির মালা ঝুরে,
নবচিন্তার নামে এল,
ডালিম রঙের ক্যানভাসে,
জানতে চাই কে কাকে হাসে,
ভোটার শুধায়, কী পেলাম?
সংবিধান কি আর বেঁচে আছে?
ভয় আর প্রলোভনের খেলা,
বুথের গানে নীরব মেলা,
ঘুষে ঘোরা বাতাস গুম,
স্বপ্ন দেখে মর্যাদার সুম।
নেতা এলেন সোনার বলে—
কিন্তু কথা কেবল গলে,
আগামী বলেও শেষের গান,
আসলে কোথায় জনের প্রাণ?