পরিমিত-বোধ - সাইফউদ্দিন আহমেদ বাবর।
শ্যাডওয়েলের মাছ বাজারে ঢুকে জহিরুল্লার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।
এখানে আসলে,প্রতিবারই তাঁর এরকম মন খারাপ হয়।
মানুষের দেউলিয়া পনা দেখেই,বিষাদে তাঁর মনটা-বিষাদিত হয়ে যায়।মানুষের অপরিমিত বোধটা তাকে আহত করে।তিনি মনে মনে বলেন’আহারে,বাছারা তোমরা এ্যাতো দেউলিয়া হয়ে গ্যাছো কেনো’!
তিনি দেখেন,নানান বয়সের নারী,পুরুষরা,হুরো হুরি করে ট্রলি ভর্তি করে মাছ নিচ্ছে।বিশাল বিশাল সাইজের সব মাছ।
মাছ কাটানোর জন্যও বিশাল লাইন।
সেখানে চারজন লোক মেশিনে-মেশিনের মতো মাছ কেটেও কূল পাচ্ছে না!
কার আগে কে মাছ দিয়েছে-তা নিয়েও এইতো কিছুক্ষণ আগে,কিঞ্চিৎ গন্ডগোল হয়ে গেলো দু’জন ক্রেতার মাঝে!
জহিরুল্লাহ দেখলেন,পে কাউন্টারেও বিশাল লাইন।হিসাব নিকাশ নিয়ে ওখানে তিনজন লোক রিতীমতোন হিমশিম খাচ্ছে।
তিনি প্রত্যেকের ট্রলি আর বাস্কেটের দিকে তাকালেন-উপচে পড়ছে বিভিন্ন ধরণের মাছ।
আমাদের মানুষ এ্যাতো মাছ খায়!
‘এক্সকিউজ মি আংকেল,একটু সরে দাঁড়াবেন প্লীজ’
জহিরুল্লা একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলেন।
পেছন থেকে এক লোকের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাকালেন।
সত্যি সত্যি তিনি পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছেন।
মাছ বাজারে ফ্রীজারের চাপা চাপিতে হাঁটার পথটুকু গেছে সরু হয়ে।তার উপর উপচে পড়া ভীড়।
তিনি এক পাশের ফ্রীজারের সঙ্গে চেপে দাঁড়ালেন।
লোকটা তার ট্রলি নিয়ে কোনো রকম তাঁর পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো।
লোকটার ট্রলি ভর্তি মাছ।বিশাল সাইজের একটা কাতল,একটা বোয়াল,একটা মৃগেল আর ব্লকের মনে হলো হিসাবই নেই!
বিস্মিত জহিরুল্লা একবার ভাবলেন জীজ্ঞাসা করেন’সারা বছরের জন্য মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছো নাকি ভাতিজা’?
নিজেকে কন্ট্রোল করলেন।
ভাবলেন,কী দরকার আর জীজ্ঞাসা করার?
ঐ লোক এতোগুলো মাছ,এক বছরে কি এক মাসে,কি এক সপ্তাহে খাক,সে তার পরিবার নিয়ে,কি আত্মীয় স্বজন নিয়ে খাক-তাতে তাঁর কি?
এসব ভেবেও তিনি স্বস্তি পেলেন না।কখনোই পান না।
কেনো মানুষ খাওয়ার জন্য এতো দেউলিয়া হয়ে উঠবে?
আরে বাবারা,পরিমিত খাদ্য গ্রহনের কথা তো আমাদের ধর্মেও আসছে।তাহলে?
তাহলে মানুষ কেনো বুঝেনা?
কেনো সবাই খাবার কিনে কিনে ঘর ভর্তি করে ফেলে?
জহিরুল্লার ভাবনায় ছেদ পড়লো,মাছ কাটার ওখানের চেঁচামেচিতে।
লেগে গেছে গন্ডগোল।
কি নিয়ে লাগলো-সেটি জানার আগ্রহে তিনি এগিয়ে গেলেন।
দেখলেন একটি মেয়ে,বয়স ত্রিশই হবে,খুব রেগে রেগে ইংলিশ,বাংলা মিক্স করে বলছে,
- আই টল্ড ইউ মাছটারে স্লাইস করে কাট করে দিবেন।আর আপনি এটা কি করলেন?
মাছ কাটার লোকটা গম্ভীর স্বরে বললো,
- জ্বী না আপনি এ কথা বলেননি।আপনাকে আমি জীজ্ঞাসা করেছি,মাছটা বড়ো।স্লাইস করে মাঝ বরাবর কাটবো?নাকি আরো ছোট করে কাটবো?আপনি বলেছেন হ্যাঁ।
লোকটার কথায় মেয়েটার রাগ মনে হয় আরো বাড়লো।সে গলার স্বর আরো চড়িয়ে বললো,
- হোয়াট ইউ সেইড?আমি বলেছি?আমি লায়ার?
মাছ কাটার লোকটাও বড়ো ত্যাদড়।সে বললো,
- আমি আপনাকে লায়ার বলিনি।আপনাকে যখন জীজ্ঞাসা করেছিলাম তখন আপনি ইংরেজীতে ইয়েস বলেছিলেন।
এ পর্যায়ে মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো লোকটা,সম্ভত মেয়েটির স্বামী,বললো,
- ভাই শোনেন,আমরা নিয়মিত এখান থেকে মাছ কিনি।বড়ো মাছ কিনি।আর বড়ো মাছের বড়ো বড়ো টুকরাই আমরা রান্না করে খাই।আপনার এই মাছ আমরা নেবো না।
এরা বলে নেবে না,ওরা বলে নিতেই হবে।গন্ডগোল চরম পর্যায়ে।
জহিরুল্লা আর দাঁড়ালেন না।’খা ব্যাটা।বড়ো বড়ো টুকরা কেনো,গোটা বড়ো মাছটাই গিলে খা’মনে মনে বলে অফারের ফ্রীজারের দিকে এগিয়ে গেলেন।
গত সপ্তাহেই দেখে গেছেন-ছোট মাছের তিনটি ব্লক দু’পাউন্ডে পাওয়া যায় আজ তিনটি ব্লক নেয়ার জন্যই এসেছেন।
ফ্রীজারের কাছে গিয়ে তাঁর মনই খারাপ হলো।এক সপ্তাহেই এরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।এখন তিন ব্লকের দাম-তিন পাউন্ড!
জহিরুল্লাহ ঘর থেকেই হিসাব করে এসেছিলেন-দু’পাউন্ড দিয়ে তিন রকম মাছের তিনটি ব্লক নিবেন।ঐ তিন ব্লক দিয়েই এক সপ্তাহ চালাবেন।
ঘরে ভাত মাছ খাওয়ার লোক বলতে তিনি এবং তাঁর বুড়ি।
দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক গুলো বছর আগে।তিন ছেলের একজন বউ বাচ্চা নিয়ে আলাদা ঘরে থাকে।বাকি দু’জন তাঁদের সঙ্গে থাকলেও ভাত,মাছ তেমন একটা খায় না।চিকেন অথবা ভেড়ির মীট হলে মাঝে মাঝে খেতে বসে।এরা বেশির ভাগ দিন কাজ থেকে ফেরার সময় বাইরে থেকেই খেয়ে আসে।
জহিরুল্লা মনে মনে হিসাব করে দেখলেন,তিন পাউন্ড দিয়ে তিন ব্লক মাছ না নিয়ে ছয় সাত পাউন্ড দিয়ে একটা ব্রীডার চিকেন কিনে নিলে,কম হলেও তাঁদের দশ দিন চলে যাবে।এবং চিকেন খাওয়াও হয়ে যাবে।
তিনি চিকেন কেনার সিদ্ধান্তই নিলেন।
জহিরুল্লা মাছ বাজার থেকে বেরিয়ে পাশের এক দোকানের পরের দোকান,মীট বাজারে গেলেন।
মাবুদে এলাহী!
সাইজে ছোট এ দোকানেও লোকে লোকারণ্য।
তিনি দরোজার কাছ থেকে উঁকি দিয়ে আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন,একটা চিকেন কিনতে কতক্ষণ সময় লাগবে।দেখলেন সাত আটজন লোক শুধু মীট,চিকেনই কাটছে।
ইয়া মাবুদ!মানুষ এ্যাত্তো,এ্যাত্তো ভেড়ি আর চিকেন খায়!
একটা দু’টা চিকেন অথবা এক কেজী ভেড়ি নিয়ে,সব্জি আর ডাল দিয়ে খাওয়া যায় না?
এ্যাত্তো মাছ,এ্যাত্তো ভেড়ী,এ্যাত্তো চিকেন-সত্যি সত্যি মানুষরা সব দেউলিয়া হয়ে উঠেছে।
জহিরুল্লা চিকেন কেনার প্লানও বাদ দিলেন।
তিনি হেঁটে হেঁটে মাছ বাজারের অন্য পাশের সব্জির দোকান কাঁচা বাজারে গেলেন।
কাঁচা বাজার দোকানটি আরো ছোট।
তবে নামের মতোই কাঁচা সব্জীতে ঠাসা।সবুজে সবুজ ময় দোকানটিতে বাংলাদেশের কোন সব্জি নেই?
জহিরুল্লা লোকজনের ফাঁক ফোকর গলে সব্জী দেখে দেখে এগিয়ে গেলেন।কিছু সীম আর একটা লাউ নেয়ার খুব ইচ্ছা হলো।কিন্তু দামের কথা চিন্তা করে ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রেখে,একটা কাগজি লেবু নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
অনেক দিন হয় তিনি কাগজি লেবুর স্বাদ গ্রহন করেন নি।
লেবুর ত্বাকের সামনে অনেক লোক।তিনি চারজনের পেছনে।সেখান থেকে দেখলেন,সামনের লোকজন তিনটা চারটা করে বড়ো বড়ো লেবু নিচ্ছে।কী আনন্দ তাদের চোখে মুখে!
একজন নিলো ছয়টা।
জহিরুল্লা চমকে উঠলেন।
ব্যাটা এতো লেবু দিয়ে কি করবে?লেবুর ভাজি বানিয়ে খাবে না কি?
এক টুকরা লেবু দিয়েই তো এক বউল ভাত সাবাড় করা যায়।তাহলে?
লেবুতে টক রস ছাড়া আর আছেই বা কি?
জহিরুল্লা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে,লেবু না নিয়েই কাঁচা বাজার থেকে বেরিয়ে এলেন।
মানুষের অপরিমিত বোধ তাঁকে অপরিমিত যন্ত্রণায় জ্বালাতে লাগলো।
তিনি হাঁটতে লাগলেন।
টি এফ এলের মালিকাধীন,ট্রেন লাইনের নীচের,ঘুপচি ধরণের এই ছাপটা গুলোকে,ঘরের মতো করে,গত দশ,বারো বছর ধরে বাংগালীরা রেন্ট করে,দোকান সাজিয়ে জম জমাট ব্যাবসা করে আসছেন।
বেশির ভাগই গ্রোসারী দোকান।
ফুটপাথ জুড়েও কোনো কোনো দোকানের পণ্য সাজিয়ে রাখা।
খালি ট্রলি একটা টেনে টেনে খুব সাবধানে হাঁটছিলেন জহিরুল্লা।
এক দোকানের সামনে দেখলেন বউলে করে নানান ধরণের সব্জী রাখা।
তিনি একটা সীমের বউল হাতে নিয়ে দোকানের একজনকে জীজ্ঞাসা করলেন দাম কতো।
লোকটা প্রচন্ড বিরক্তিতে জবাব দিলো ‘এক পাউন্ড’।
তিনি বউলটা নেড়ে চেড়ে দেখে বললেন,
- সীমের অর্ধেক ই তো পচা।পঞ্চাশ পেনি ই তো এর জন্য বেশি।
লোকটা খ্যাক করে উঠে বললো,
- এক পাউন্ডের জিনিষ দেখছেন চাচা,এর চেয়ে ভালো আর পাবেন কি করে?ভালো সীম দোকানের ভেতর আছে,যান,পাঁচ পাউন্ড কেজি করে কিনে নিয়ে আরাম করে খান।
লোকটার ভাব ভঙ্গি জহিরুল্লার ভালো লাগলো না।
তিনি হোয়াইট চ্যাপেলের দিকে হাঁটতে লাগলেন।
পাঁচটা এখনো বাজেনি।দ্রুত হেঁটে গেলে ওখানের মার্কেট থেকে এর চেয়ে ভালো সব্জী কিনতে পারবেন।
জহিরুল্লা হাঁটার গতি বাড়ালেন।
হোয়াইট চ্যাপেলে পৌঁছতে তবু তাঁর দেরী হয়ে গেলো।
ফুটপাথের মার্কেট তখন উঠে যাবার পথে।
সবাই যার যার দোকানের মাল পত্র গোটানোতে ব্যাস্ত।
জহিরুল্লা দেখলেন একটি দোকানে এখনো কিছু বউল গোটানোর অপেক্ষায় আছে।
তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন।
কিছুক্ষণ ভালো করে দেখে এক বউল ঢেঁড়শ আর এক বউল কাঁকরোল পছন্দ করলেন।
বউল দুটি হাতে নিয়ে তিনি অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।দোকানের লোক গুলো দোকান গুটানোতে ব্যস্ত।কেউ এদিকে খেয়াল করছে না।
বেশ কিছুক্ষণ পর বউল গুলো উঠিয়ে নিতে একজন এদিকে আসলো।
জহিরুল্লার হাতে বউল দেখে বললো,
- দোকান বন্ধ চাচা,এখন আর কিছু বেঁচা যাবে না।
তিনি বললেন,
- মাত্র এ দুটিই।
- তাড়াতাড়ি করেন।
লোকটা একটা ব্যাগ নিয়ে এসে ত্রস্ত হাতে সব্জী গুলো ঢেলে দিয়ে বললো,
- দুই পাউন্ড দেন।
জহিরুল্লা অবাক হয়ে বললেন,
- দুই পাউন্ড!ঢেঁড়শ গুলো তো নেতিয়ে গেছে।কাঁকরোলের অবস্থা তো আরো করুন।আপনি দুটি বউলের জন্য এক পাউন্ডই রাখেন।
তাঁর কথা শোনে শেষ মুহুর্তের দোকান গোছানোতে ব্যস্ত,বিরক্ত লোকটা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো।
চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
- এক পাউন্ডের জিনিষেও দরা দরি!
- আপনি দিতে পারবেন কি না বলেন।
- জ্বী না পারবো না।
ঐ সময় ভেতরের দিকের একজন তাগাদা দিয়ে হাঁক ছাড়লো।
- কিরে?দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?তাড়াতাড়ি কর।
সে বললো,
- এই চাচা দুই বউল ভেজিটেবলের জন্য এক পাউন্ড দিতে চাচ্ছেন ভাই।
সে অদ্ভুত ভাবে হাসতে লাগলো।
ভেতরের লোকটা একবার এদিকে তাকালো।তারপর বললো,
- দিয়ে দে,তাড়াতাড়ি কর।
জহিরুল্লাহ এক পাউন্ড দিয়ে এক বউল ঢেঁড়শ আর এক বউল কাঁকরোল কিনে হৃস্ট চিত্তে বাস স্টপের দিকে হাঁটতে লাগলেন।
কিছু দূর হাঁটার পর হঠাৎ তাঁর মনে হলো-বিরাট একটা ভুল তিনি করে ফেলেছেন।
শেষ মুহুর্তের বাজারে-ঐ দুটি বউলের মূল্য এক পাউন্ড না বলে,পঞ্চাশ পেনী বললেও দিয়ে দিতো।
এ কথা মনে আসতেই তাঁর খুব আফসোস হতে লাগলো।ইস্ কেনো যে তিনি এক পাউন্ড বলতে গেলেন!
নিজের উপর তাঁর প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো।
পঞ্চাশ পেনী বেশি দেয়ার কষ্টে মন তাঁর উসখুস করতে লাগলো।