পরিযায়ী পাখির গল্প ০ ২।। মহিবুল আলম
পরিযায়ী পাখির গল্প ০ ২।।  মহিবুল আলম

গত দুই দিন ধরে জাহিদ কাজে যায়নি। প্রথম দিন লাকি ভাবিকে তাওরাঙ্গা সিমেট্রিতে দাফন করা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। দ্বিতীয় দিন সে হেদায়েত হোসেনকে সময় দিয়েছে। আজমল হোসেনও এই দুই দিন কাজে যাননি।

কিন্তু আজ খুব সকালে জাহিদের ঘুম ভাঙে হেদায়েত হোসেনের ফোন পেয়ে। কিউই ফলের বাগানের মালিক তো আর বুঝতে চাইবে না, হেদায়েত হোসেনের স্ত্রী গত পরশু ভোরে মারা গেছে বলে তার বাগানের কাজ থেমে থাকবে। নতুন অরচার্ডের কাজ। কিউই ফলের উইন্টার প্রুনিং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হয়।        

জাহিদ জানে, নিউজিল্যান্ডের মানুষের জীবনযাত্রা এমনই। এদের বাবা মারা গেলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। মা মারা গেলে একটা আহা শব্দ করে। আর স্ত্রী মারা গেলে ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হয়। জাহিদ মাঝেমধ্যে ভাবে, একটা পোষা বিড়াল বা কুকুরের মারা গেল তারা যে পরিমাণ কষ্ট পায়, বাবা-মা বা স্ত্রী মারা গেলে এর সিকি পরিমাণ কষ্ট পায় না। বরং বাবা-মা বা স্ত্রী মারা গেলে সিমেট্রিতে দাফন করতে দেরি, বাসায় ফিয়ে ফিউনারেল পার্টি নামে মদ খেয়ে আমোদফুর্তি করে সেলিব্রেট করতে দ্বিধা বা দেরি করে না।

বাইরে সকালটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। শীতের সকাল বলে বাইরে রোদটা এখনো কুয়াশার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। আজমল হোসেন সেই যে টয়লেটে ঢুকেছেন, এখনো বের হওয়ার নাম নিচ্ছেন না। আজমল হোসেনের এ একটা বড় সমস্যা। যখন তাকে কোথাও তড়িঘড়ি করে যেতে বলা হয় তখনই তিনি সবচেয়ে বেশি দেরি করেন।

জাহিদ ভেবে পেল না, আজমল স্যার কখন টয়লেট থেকে বের হবেন, কখন নাশতা করবেন? কাজের কাপড়চোপড়ও তিনি পরেননি। তাদের স্লিপ আউটে টয়লেট একটাই।

জাহিদ এদিকে নাশতা সেরে দুপুরের লাঞ্চবক্সও সাজিয়ে ফেলেছে। কাজের কাপড়চোপড় পরে বসে আছে। আজমল হোসেন টয়লেট থেকে বের হলে সে একবার টয়লেটে যাবে। তারপর সে মাকিতুর উদ্দেশ্যে বের হবে। তাওরাঙ্গা শহর থেকে মাকিতুর কিউই ফলের অরচার্ড প্রায় আটাত্রিশ কিলোমিটার দূরে। আজ হেদায়েত হোসেন অরচার্ডে যাবেন না। হেদায়েত হোসেনের এক বন্ধু মোজাম্মেল হোসেন আজ সুপারভাইজার হিসাবে সবার কাজ দেখাশোনা করবেন।

ওদের বাসা থেকে বের হতে হতে আটটা বেজে গেল। তাওরাঙ্গা শহর ছাড়তে ছাড়তে সোয়া আটটা। বাইরে ততক্ষণে কুয়াশা ভেদ করে রোদ উঠে গেছে। শীতের রোদ। চারদিকে একধরনের মিষ্টি আমেজ ছাড়াচ্ছে। আজমল হোসেন জাহিদের পাশে বসে ঝিমোচ্ছেন। অথচ গতরাতে তাঁর কিন্তু ভালো ঘুম হয়েছে। রাত আটটার মধ্যেই খেয়েদেয়ে ঘুমোতে চলে গেছেন। এক ঘুমে সকালে উঠেছেন। এদিকে জাহিদ বরং কী এক মানসিক অস্থিরতায় রাত বারোটার আগে ঘুমাতে যেতে পারিনি। সে লেপ মুড়ি দিয়ে লাউঞ্জে বসে অযথাই টিভি দেখছিল। তবে টিভি দেখার চেয়ে হেদায়েত হোসেনের কান্নার দৃশ্যটাই তার চোখে ভাসছিল বেশি।

গাড়িটা যাচ্ছে স্টেট হাইওয়ে টু ধরে মাউন্ট মাঙ্গানুইর বে-ফেয়ারের অভিমুখে। বে-ফেয়ারের সামনে থেকে তারা তাওরাঙ্গা ইস্টার্ণ লিঙ্ক ধরে টিপুকি শহরের পাশে মাকিতু রোডে উঠবে। মাকিতু রোড ধরে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে গেলেই দ্য সিকা অরচার্ড। দিঘল মাকিতু রোডের পুরোটাই দুই পাশে বিশাল-বিস্তৃত কিউই ফলের অনেকগুলো অরচার্ড। তারা আজ দ্য সিকা অরচার্ডে কাজ করবে।

বে-ফেয়ারের পাশ দিয়ে তাওরাঙ্গা লিঙ্ক রোডে মোড় নিয়ে জাহিদ ঘড়ি দেখল। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। নয়টার দিকে সে মাকিতু রোডের দ্য সিকা অরচার্ডে গিয়ে পৌঁছলেও মনে হয় না কাজ বুঝে নিয়ে সাড়ে নয়টার আগে তারা কাজ শুরু করতে পারবে। এমনিতে তারা সাতটা-সাড়ে সাতটার মধ্যে কাজ শুরু করে দেয়।

পাশের সিটে বসে আজমল হোসেন তখনো ঝিমোচ্ছেন। জাহিদ আজমল হোসেনের দিকে তাকিয়ে ভাবল, তাঁকে দেখে কে ভাববে তিনি হাজার একটা সমস্যা নিয়ে দিনযাপন করছেন? কিন্তু তিনি যেখানে বসেন সেখানেই কাঁত হয়ে নাক ডেকে ঘুমাতে পারেন। অথচ তার মাথার ওপর অবৈধ অভিবাসী হওয়ার বিশাল চাপ। যদিও এখানে কেউ শত্রুতাবশত নির্দিষ্ট করে পুলিশ স্টেশানে বা ইমিগ্রেশনে কারও অবস্থান ও ঠিকানা জানিয়ে রিপোর্ট না করলে তারা কাউকে বিরক্ত করে না। কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলে পুলিশ বা ইমিগ্রেশন অফিসার নিজ থেকে খুঁজে খুঁজে অবৈধ অভিবাসী বের করে না। এ জন্য অনেক অবৈধ অভিবাসী আট-দশ বা পনেরো বছর ধরে নির্বিগ্নে কাজ করে যাচ্ছে। ভাগ্য ভালো হলে আজমল হোসেনও তাই করতে পারবেন।

টিপুকি শহরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে জাহিদ শহরটা ভালো করে দেখল। ছোট্ট একটা শহর। কিন্তু বেশ গোছালো। নিউজিল্যান্ডের প্রত্যেকটা ছোটবড় শহরই বেশ গোছালো ও পরিষ্কার। তবে টিপুকি শহরের বিশেষত্ব হলো, এ শহরকে বলা হয়- দ্য কিউই ফ্রুট ক্যাপিটাল অব নিউজিল্যান্ড। শহরটার চারপাশে মাইলের পর মাইল শত শত কিউই ফলের অরচার্ড বিছিয়ে রয়েছে। এই কিউই ফলটা জাহিদ যখন প্রথম দেখে, তখন সে খুবই অবাক হয়েছিল। ছোট্ট আঁশযুক্ত চামড়া। ভেতরে সবুজ সংযুক্ত কোয়া। কোয়াগুলো অবশ্য আলাদা করা যায় না। কিন্তু খেতে গেলে মনে হয়, কী একটা নরম শীতল বস্তু যেন অন্ত্র নালি দিয়ে পেটের ভেতরে ঢুকছে। স্বর্গের নেয়ামত ফল বুঝি এমনটাই হয়।

নিউজিল্যান্ডের কৃষি অর্থনীতির একটা বড় অংশ আসে এই কিউই ফল থেকে। আপেল, কিউই ফল ও ডেইরি ফার্ম- এই তিনটা সেক্টরের ওপরই নিউজিল্যান্ডের কৃষি অর্থনীতি নির্ভর করে।

জাহিদ আবার আজমল হোসেনের দিকে তাকাল। আজমল হোসেন এখনো ঝিমোচ্ছেন। ঝিমানোর তালে তাঁর ঘাড়টা একবার বামে ঝুঁকে পড়ছে তো পরক্ষণই ডানে ঝুঁকছে।

আজমল হোসেনকে এভাবে ঝিমোতে দেখলে জাহিদের প্রথম প্রথম বেশ বিরক্ত লাগত। কিন্তু আস্তে আস্তে তা গা সহা হয়ে গেছে। হকস বে অঞ্চলের আপেল বাগানগুলো হেস্টিংস শহর থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। পনেরো-বিশ মিনিট ড্রাইভ করেই একেকটা আপেল অরচার্ডে চলে যাওয়া যেত। কিন্তু বে অব প্লেন্টির কিউই ফলের অরচার্ডগুলো তাওরাঙ্গা শহর থেকে অনেক দূরে দূরে। কোনো কোনো কিউই ফলের অরচার্ডে যেতে এক ঘণ্টার মতো লেগে যায়।

জাহিদ টিপুকি শহর পেছনে ফেলে মাকিতু রোডে উঠে আবার আজমল হোসেনের দিকে তাকাল। এরই মধ্যে আজমল হোসেন ঝিমোনি থামিয়ে উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। তিনি কিউই ফলের একেকটা অরচার্ড দেখছেন।

জাহিদ মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, স্যার, ঘুম ভেঙেছে?

আজমল হোসেন মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকালেন। মুখে কিছু বললেন না।

জাহিদ দুই পাশের কিউই ফলের প্রতিটা অরচার্ডের দিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে এগোচ্ছে। সে দ্য সিকা অরচার্ডটা চেনে না। আগে কখনো সেই অরচার্ডে কাজ করেনি। মাকিতু রোড কান্ট্রি সাইডের রাস্তা বলে পথটা প্রায় ফাঁকা।

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, স্যার, কী ভাবছেন?

আজমল হোসেন হাসলেন। বললেন, না, তেমন বিশেষ কিছু না। তবে একটা কিছু যে ভাবছি, তা ঠিক।

- কী সেটা?

- নিউজিল্যান্ড দেশটা এত সুন্দর, কিন্তু কাজগুলো এত কঠিন কেন?

জাহিদ বলল, কাজগুলো কী এমন কঠিন স্যার? হয়তো আমার-আপনার কাছে কঠিন। কিন্তু অনেকে তো বিশ-পঁচিশ বছর ধরে এই কাজটা করছে। এ দেশের বহুলোক আছে, যারা সারাজীবন এই কাজটা করে পরে অরচার্ডের মালিক হয়েছে।

আজমল হোসেন মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ।

- আপনি তো এই কাজটা বেশ সুন্দরভাবেই করতে পারেন, তাই না?

- হ্যাঁ, আপেল অরচার্ডের কাজের চেয়ে কিউই ফ্রুট অরচার্ডের কাজ সহজে করতে পারি। আসলে মই বাইতে হয় না তো, তাই...!

- জি, ঠিক বলেছেন।

মাকিতু রোড ধরে খানিকটা যেতেই জাহিদ দেখল, এক বাঙালি কন্ট্রাক্টর একটা কিউই ফলের অরচার্ডের গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। বিশাল-বিস্তৃত কিউই ফলের অরচার্ডে শ্রমিকরা যাতে হারিয়ে না যায়, এ জন্যই সেই কন্ট্রাক্টর গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আরও খানিকটা এগিয়ে যেতেই জাহিদ সিকা অরচার্ডের মুখে মোজাম্মেল হোসেনকে দেখল।

জাহিদ গেটের মুখে গাড়ি থামাতেই মোজাম্মেল হোসেন বললেন, আমি তোমাদের জন্যই এখানে দাঁড়িয়ে আছি। অন্য ওয়ার্কাররা কাজ শুরু করে দিয়েছে। এখানে অনেকগুলো ব্লক, তোমরা যদি খুঁজে না পাও?

জাহিদ বলল, আমি বুঝতে পেরেছি। আজ কোন ব্লকে কাজ?

- এ-ব্লক থেকে শুরু হবে।

- আমরা নম্বর ধরে ধরে খুঁজে বের করতে পারতাম। আপনি শুধু শুধুই আমাদের জন্য এখানে কষ্ট করে দাঁড়িয়েছিলেন।

- আরে, না। কষ্ট কীসের? তোমরা টিপুকি বা মাকিতু এরিয়ায় নতুন কাজ করতে এসেছ তো, যদি ভুল অরচার্ডে চলে যাও?

জাহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল। বলল, ঠিকই বলেছেন। এর আগে ওমাহোর দিকে কয়েকটা অরচার্ড ভুল করে ফেলেছিলাম। হেদায়েত ভাই গাড়ি নিয়ে এসে আমাদের খুঁজে বের করেছেন।

মোজাম্মেল হোসেন হেসে বললেন, আসলে হেদায়েত ভাইই আমাকে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন।

- ও, তাই! আচ্ছা মোজাম্মেল ভাই, গাড়ি কোথায় পার্ক করব?

- ওই তো, গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে শেডের সামনে পার্ক করবে।

- আপনি গাড়িতে উঠে বসুন। শুধু শুধু হাঁটবেন কেন?

- না না, অসুবিধা নেই। ওই তো গেটের পাশেই শেড। তুমি ওখানে গিয়ে গাড়ি পার্ক কর।

জাহিদ আর দ্বিরুক্তি না করে গাড়িটা শেডের কাছে নিয়ে পার্ক করল। সেখানে সারি করে আরও কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা। জাহিদ ও আজমল হোসেন লোপার ও গ্লাবস হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল।

মোজাম্মেল হোসেন হেঁটেই গেট থেকে তাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। পাশাপাশি সিকা অরচার্ডের এ-ব্লকের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলেন, হেদায়েত ভাইয়ের খবর কী?

জাহিদ বলল, খবর আর কী, মোজাম্মেল ভাই। ভাবি মারা গেছেন দুই দিন হয়নি। এরই মধ্যে হেদায়েত ভাই আর কতটুকু ভালো থাকতে পারবেন?

- তুমি ঠিকই বলেছে, জাহিদ। তবে ভাবিকে নিয়ে হেদায়েত ভাই সারাটা জীবনই টেনশনে কাটিয়েছেন। 

- কেন, কোনো সমস্যা ছিল নাকি?

- সমস্যা মানে, বড় সমস্যা।

- কী সমস্যা?

- ভাবি তো মেন্টালি অসুস্থ ছিলেন। বলতে পার, তিনি মানসিক রোগী ছিলেন।

- বলেন কী! আমি তো গত দেড় মাসে তা দেখিনি? বরং লাকি ভাবিকে আমার একজন চমৎকার চুপচাপ ধরনের মহিলা বলে মনে হয়েছে।

- হঠাৎ করে দেখলে তাই মনে হয়। তিনি সব সময় যে মেন্টালি অসুস্থ থাকতেন, তা নয়। বছরের দুই মাস বা তিন মাস অসুস্থ থাকতেন। বিশেষ করে শীতকালে। মাঝেমধ্যে তিনি মানুষজন দাওয়াত দিয়ে বাসা থেকে উধাও হয়ে যেতেন। রাতের বেলায় তিনি চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কখনো কখনো তিনি মধ্যরাতে হেঁটে সমুদ্রের সৈকতে একা একা চলে যেতেন। তখন হেদায়েত ভাই এখানে-সেখানে খুঁজে বেড়াতেন। তুমি মনে কর না, তিনি এবারই প্রথম ওষুধ খেয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। এর আগেও এমনটা হয়েছে। তবে এবার তিনি অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ খেয়ে ফেলেছিলেন।

জাহিদ একটা ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ব্যাপারটা সত্যি খুব দুঃখজনক।

মোজাম্মেল হোসেন মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছে।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান