আমার
লেখালেখির শুরুটা গান দিয়ে। কেননা আমার দাদা ছিলেন বংশীবাদক এবং একতালে
বাজাতেন জোড়খাই। উনি ভাণ্ডারী ভক্ত ছিলেন এবং ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী। আমি
দেখিনি তবে শুনে আর ফটোতে দেখে আবিস্কার করি যতোটুকু....
দাদা
স্বশিক্ষিত ছিলেন,গান রচিতে পারতেন মুর্শিদের প্রেমে। তবে কোনো লিখিত
ইতিহাস নেই। অথচ নতুন বাড়িতে আসার পরে মায়ের শরীয়তী লেবাসে এই গান,
হারমোনিয়াম একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। যেখানে নিজের লেখাপড়া টালমাটাল
সেখানে গানের তালিম নেওয়া অবাস্তব স্বপ্নের কথা।
তবুও আমার
লেখালেখি জীবনের শুরু পথে পথে হেঁটে গান রচনা করা। কত পথ হেঁটেছি বড় কথা
নয়,একটা গান গেয়ে গেয়ে মানে সুর অটোমেটিক হয়ে পুরো গানটি লেখা হয়ে যাওয়ার
পরে জানতে পারি কতটুকু পথে পেরিয়ে এসেছি।
স্কুলজীবনে থাকতে প্রায়
শ'খানেক গান লিখেছি, স্বভাবতই সুর করাসহ। একদিন বাড়ির পাশে একজন গানের
শিক্ষককে গিয়ে জানাই আমি গান লিখি আর সুরও করতে পারি। তিনি হারমোনিয়াম
বাজালেন আর আমি গাইলাম। এরপরে একটি গান রেকর্ডের কথা আসে ঈদের অনুষ্ঠানের
জন্য। ডেবিট নামের এক ভদ্রলোক অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। আগ্রাবাদ
গোসাইলডাঙ্গায় আব্দুল মান্নান রানার স্টুডিও 'নিপুণ'এ রেকর্ডিং চলছে। হঠাৎ
প্রবাল চৌধুরী এলেন...
আমি সামনের সোফা হতে দাঁড়িয়ে পড়েছি। আমার হৃদয়ে
বেজে উঠলো মুহূর্তে উনার কালজয়ী গান 'সোনা বউ' চলচ্চিত্রে সাবিনা
ইয়াসমিনের সাথে গাওয়া-
ধন্য হয়েছি ওগো ধন্য,
তোমারি প্রেমেরও জন্য....
তিনি আমাকে অতি বিস্ময়াবহে ফেলে আমার পাশে এসে বললেন হাত ধরে- বসো,বসো... তোমার লেখা গানটা শুনেছি,আমার খুব ভালো লেগেছে....
হঠাৎ আমার কাঁধে হাত রাখলেন এবং বলতে লাগলেন- তুমি আমার জন্য গান লেখো,আমি তোমার গান গাইবো...'
আমি
আকাশে উঠেছি নাকি স্বর্গে গড়াগড়ি দিচ্ছি বুঝছিনা। আমি কেবক কলেজে গিয়েছি
সে বছর। দুপুরের বেলা যায় যায়,নিচে নেমে দোকান থেকে কয়েকটা সিঙ্গারা কিনে
এনে খেতে দিলাম প্রবাল চৌধুরীসহ,অনুষ্ঠান পরিচালক এবং নিয়ে যাওয়া সে
শিল্পীকে। আমি কুঁকড়ে আছি একদিকে সোফায় বসে।
সেদিন গানটি রেকর্ড
হলো। ঈদের অনুষ্ঠানে গানটি শুনতে পাবে। কী তুমুল আনন্দের লড়াই আমার মধ্যে।
প্রবাল চৌধুরী আমাকে যাওয়ার সময় বললো- নোমান একটা কথা মনে রাখবে,গানের কথা
হতে হবে সহজ,সহজে যেনো মানুষের হৃদয়ে ঢুকে আর তুমি আমাকে ২৫টা গান লিখে
দেবে,রহমতগঞ্জে আমার বাসা,গান নিয়ে এসো ফোন করে....
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
ডাইরিতে ফোন নাম্বারটি লিখলাম। আমার নাম্বারটিও নিলেন। বাড়ি ফেরার সময়
আমাকে নিয়ে যাওয়া শিল্পীকে ৭০০ টাকা দিলাম। গান লিখলে হয়না,গান গাওয়ানোর
জন্যও টাকা দিতে হয়,এটা মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন ভদ্র মানুষটি ঐ সময়েই।
আমি আজ এই মানুষটির নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছিনা।
এরপরে একদিন প্রবাল চৌধুরীর ফোন- নোমান,তুমি প্রেস ক্লাবে এসো কাল--
সত্যিকার
অর্থে, আমি তখন প্রেসক্লাব চিনতাম না। তবে জামাল খানের ঐদিকে কোথাও সেটা
জানি। সেদিন সন্ধ্যায় আমার প্রথম প্রেসক্লাব চিনতে পারা,সেটাও প্রবাল দা'কে
ফোনে ফোনে একরকম জ্বালাতন করে। প্রেসক্লাবের নিচে মিলনায়তনের মুখে হাসি
দিয়ে স্বাগত জানালেন। আমি অবাক। সেদিন অনুষ্ঠানে আমার চেয়ে তখন ২-৩ বছরের
ছোট এক মেয়ের লালনের গান আজো মনে গেঁথে আছে। কী ভাব ভঙ্গি আর গলার কাজ এবং
আমার দিকে গাইতে গাইতে কীরকম যাদুর চোখে তাকাচ্ছে আমি আজো ঐ মেয়েটিকে নিয়ে
স্বপ্নে ভাবি। খুব ভাবি। শ্যামলা রঙের ছিপছিপে গড়নের মেয়ে কিন্তু নামটি
জানা হলোনা। এরকম সেদিন 'নিপুণ' স্টুডিওতেও জানা হলোনা আরেকজন রমণী গায়িকার
নাম। রমণীটি স্বামী নিয়ে এসেছে বোধহয়। সবাইকে ছাড়িয়ে আমার সাথে কথা বলতে
এসেছে - ভাইয়া,আপনার লেখা গান আমি করতে চাই, প্লিজ যদি আজকের লেখাটির মতো
একটা গান লিখে দিতেন.....
অথচ,এই গানটি ঐদিনের ঐ রেকর্ডে থেকে গেছে।
৭০০ টাকা স্মৃতি হয়ে থেকেছে। রহমতগঞ্জের বাসায় তিনবার গিয়েছি। প্রথমবার
প্রবাল চৌধুরী দরজা খোলে সোফায় বসতে বলেন। আমি পৌরাণিক কালের ঐ বাসার সোফায়
বসে দেয়ালের ছবিগুলো দেখছি। হঠাৎ প্রবাল চৌধুরী এলেন- ছবিটা আমার
ছেলের,হকি খেলে....
আমার হাতের দিকে হাত এগিয়ে বললেন- গান আনলে?
আমি গানের পাণ্ডুলিপি এগিয়ে বললাম- ২৫টিই আছে...
- আমি নিজে তোমার নামে সুপারিশ করে ঢাকায় জমা দেবো,আমি নিয়ে যাবো,তুমি টেনশন করোনা।
আমি তখনও চনমনে ছিলাম এবং ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি - আজ আসি দাদা
- না বসো,চা খাও....
- না,দাদা....
গলির
রাস্তার দক্ষিণে উত্তরমুখী দ্বিতীয় তলা থেকে রাস্তায় নেমে সেদিন প্রজাপতি
সুখ ছিলো। এরপরে আরো দুইবার ফোন করে গেলেও পাইনি। হয়তো উনি হাঁটাহাঁটি করতে
গেলেন বা ভুলে গেছেন আমার যাওয়ার কথা। দুবারই দিদি দরোজা খুলে দিলেন। আমিও
দাদা নেই জেনে চলে এসেছি....
এরপরে কয়েকমাস পরে ১৪ই অক্টোবরের
সকালে জয়কালী হাটের মুখে ঔষধের দোকানের পেপার চোখের সামনে ধরতে, বড় বড়
অক্ষরে লেখা - চলে গেলেন প্রবাল চৌধুরী...
আমি কী বলবো নিজেকে বুঝতে
পারছিনা। অসহায়বোধ টের পেয়েছি এবং এখনও পাচ্ছি। আমার ২৫টি গান কোথায় আছে
সেটা জানিনা। সেদিনের 'নিপুণ' স্টুডিওতে রেকর্ডের মতো গানটি - আমাকে পুড়াতে
এসোনা(২)
প্রেমে পুড়ে ছাই হয়ে গেছি(২)
চিতার আগুন জ্বলবেনা....
জানি
কীর্তিমানে মৃত্যু নেই। প্রবাল দাদা'কে চিতা কতটুকু জ্বালালো জানিনা,তবে
আমার হৃদয়ে দাদা বহাল তবিয়তে। আমার কাঁধে হাত রাখা এখনো টের পাই। এখনও মনে
করি রহমতগঞ্জের বাসায় দাদা আছেন। ডাইরিতে লেখা ফোন নাম্বার থেকে কখনে ফোন
করে বলবে - নোমান,তুমি কেমন আছো...? এসো একদিন আমার বাসায়... আর হ্যা,ফোন
করে এসো.... তোমার গানগুলি বেতারে জমা আছে....
আজকের এই দিনে ১৯৪৭
সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন স্বাধীন বাংলা বেতারের এই মহান শিল্পী।
'ভেবো না গো তোমার ছেলেরা হারিয়ে গিয়েছে কবে' গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের
অভূতপূর্ব প্রেরণা যুগিয়েছিলো....