প্রভুগৃহ ।। সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক
প্রভুগৃহ ।।  সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক

০৬.

সে সময় ঠাকুর লালের বয়স খুব বেশী ছিলো না। বড় জোর ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশের মধ্যেই ছিলো ওর বয়স। শরীরে শক্তি সামর্থও ছিলো যথেষ্ঠ। কুড়ি বছর বয়সেই বিয়ে করেছিলো ঠাকুর লাল। বিয়ের দু বছরের মাথায় ঠাকুর লালের স্ত্রী একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দান করে। কন্যাটির শরীরের রংটি প্রায় হলুদ বর্নের মতো হওয়ায় ওর ণাম রাখে ঠাকুর লাল “বাসন্তি”। বাসন্তি ধীরে ধীরে বয়োঃপ্রাপ্ত হতে থাকে। বাসন্তির বয়স বারো বছর না পেরুতেই ওর বিয়ে দিয়ে দেয় ঠাকুর লাল ওদেরই গোত্রের রাম দেবের সঙ্গে। সে সময় সামাজিক প্রথাটি এমনই ছিলো যে মেয়েদের বিয়ের বয়স কখনই বারো বছর অতিক্রম করতে পারবে না। আর সে প্রথাটিকে মেনেই বারো বছর পূর্ণ না হতেই বাসন্তির বিয়ের পর্বটি সম্পন্ন করা হয়। এবং বিয়ের পর থেকে বাসন্তির স্বামী রাম দেব স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ীতেই থেকে যায়। শ্বশুর বাড়ীতে থেকেই ওর বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখে রাম দেব। ওর বাবা মা এতে কোনো বাধার সৃষ্টি করে না। বরং উৎসাহিতই করে। কেননা বিয়ের পূর্বেই উভয় পক্ষের মধ্যে একটি অলিখিত মৌখিক চুক্তি হয়েছিলো যে, বিয়ের পর রাম দেব শ্বশুর বাড়ীতেই স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করবে। যেহেতু ঠাকুর লালের একটি মাত্রই সন্তান কন্যা বাসন্তি সেই চুক্তির আলোকেই রাম দেব আজ অবধি রয়ে গেছে শ্বশুর বাড়ীতেই। এই হলো ঠাকুর লালের সাংসারিক জীবনের মোটামুটি অদ্যপান্ত বর্ননা।  

তখনও সকাল হয়নি তবে সকাল হবার খুব বেশী দেরীও নেই। ওরাও কেউ ঘুম থেকে ওঠে নি। যদিও ওদের নারীদেরকে ভোর হবার আগেই ঘুম থেকে উঠতে হয় এটিই ওদের চিরাচরিত নিয়ম। পুরুষরা খানিকটা দেরী করেই ওঠে। নারীরা ঘুম থেকে উঠে সবার আগে ওদের পশুগুলির খোঁজ খবর নিয়ে তারপর গৃহস্থালির অন্যান্য কাজ কর্মে ব্যপৃত হয়ে পড়ে। ঠাকুর লাল সারা রাত না ঘুমোলেও বিছানা ছেড়ে ওঠে নি। অন্যান্যদেরকেও ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে নি। গত কালকে যে ধকল ওদের জীবনের ওপর দিয়ে গেছে তাতে ওদের আরও কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নেয়া উচিত বলে মনে করেছে ঠাকুর লাল। এর মধ্যে গৃহকর্তা ঘুম থেকে উঠে ছেলের বৌকে ডাকতে শুরু করেছে “কই বৌমা ঘুম থাইক্যা উইঠ্যা পড়। ভোর অওনের তো আর খুব বেশী দেরী নাই। অহনই তো নবীউল্লাহ্ আইস্যা পড়বো। অর খাওনের ব্যবস্থা করতে অইবো তো। ওঠো মা, উইঠ্যা পড়ো, আর দেরী কইরো না।” বলে আর দাঁড়ালো না। বাইরে যাবার জ্েরন্য পা বাড়ালো গৃহকর্তা কলিমুল্লাহ্। আর ঠিক সেই সময়ই বাড়ীতে প্রবেশ করলো গৃহকর্তার পুত্র তরুণ নবীউল্লাহ্। বাড়ীর উঠানে দাঁড়িয়েই পিতা পুত্রের মধ্যে সামান্য কিছু কথা বার্তা হলো মাছ ধরা সম্পর্কিত বিষয়ে। পিতা পুত্রের কথা বার্তার শব্দের মধ্যেই বৌটিরও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। বৌটি ঘুম থেকে উঠে ঘরের দরোজা খুলে দিয়ে ঘরের বাইরে এসেছে। ও বাইরে বেরিয়ে আসবার পর নবীউল্লাহ্ ওর হাতে থাকা কাপড়ের ছোটো ব্যাগটি বৌটির হাতে দিলো। ব্যাগটির ভেতর নবীউল্লাহ্র ভেজা লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছা ইত্যাদি রয়েছে। মাছ ধরা শেষে নবীউল্লাহ্ নদীতেই গোসল করে নিয়েছে। রাত্রি অথবা দিনে মাছ ধরতে গেলে ওরা ওদের শুকনো কাপড় চোপড় একটি ছোটো ব্যাগে ভরে সাথে করেই নিয়ে যায়। বৌটি নবীউল্লাহ্র হাত থেকে ব্যাগটি নেবার পর ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো নবীউল্লাহ্।। ঘরে প্রবেশ করে শুধু একটি শুকনো গামছা নিয়ে আবার বাইরে এসে চলে গেলো ওদের বাড়ী থেকে কিছুটা দূরের একটি পুকুরে মুখ হাত ধোবার জন্যে। নবীউল্লাহর যাবার পূর্ব মূহুর্তে বাবা ওকে বললোÑ “মুখ হাত ধুইয়্যা ইট্টু জলদি কইর‌্যা আয়, তর লগে আমার কিছু কতা আছে।” নবীউল্লাহ মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। কলিমুল্লাহ্ও বাইরে বেরিয়ে গেলো বাড়ীর চারদিকটি দেখতে। রাতে সৈন্যরা বাড়ীর পেছনের পথ দিয়েই চলে গেছে। বলা তো যায় না বাড়ীর কোনো ক্ষতি............।

তবে কলিমুল্লাহ্র এ বিশ্বাসটুকু ছিলো যে, ইংরেজ সৈন্যরা অন্ততঃ কলিমুল্লাহ্র পরিবার অথবা বাড়ীর কোনো ক্ষতি করবে না। কারণ, ওই এলাকার ইংরেজ সৈন্যদের সাথে একটি ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলছিলো কলিমুল্লাহ্। তারপরেও শত হোক বিজাতিয় তো! সে কারণে সন্দেহটি পুরোপুরি মনে থেকে একেবারে যায় না। কিছুটা রেশ থেকেই যায়। আর এই সন্দেহের বশবর্তী হয়েই বাড়ীর চারদিকটা দেখতে গেলো কলিমুল্লাহ্। 

গত রাতে নবীউল্লাহ্’রও যথেষ্ঠ পরিশ্রম হয়েছে। সারা রাত ব্যপী মাছ ধরেছে; সাথে একটি ছেলেকে নিয়েছিলো ওকে সাহায্য করবার জন্যে শ্রমিক হিসেবে, বাবা সাথে যেতে পারে নি বলেই এই ব্যবস্থা। রাতে প্রচুর মাছ ধরা পড়েছে ওর জালে। মাছ ধরা শেষে নৌকোর ওপড়েই সে মাছগুলির শ্রেণী বিন্যাস করবার পর মাছগুলিকে ওজন করে আড়তে দিয়ে তবেই বাড়ীতে ফিরতে হয়েছে ওকে। কিছুক্ষণ পরে গিয়ে মাছের দাম নিয়ে আসতে হবে আড়ত থেকে। গত রাতেই কলিমুল্লাহ্ ছেলের বৌকে ঠাকুর লালদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলেছে। বৌটিও শ্বশুরকে সমর্থন করেছে। সব কথা শুনবার পর শ্বশুরের চাইতে বৌটি যেন নিজেই ঠাকুর লালদের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত বৌটির কোনো সন্তানাদি জন্মায় নি। অবশ্য বিয়ে হবারও খুব বেশী দিন হয় নি। মোটে এক বছর পেরিয়ে বারো দিন মাত্র। বৌটি লিকলিকে হলেও সুন্দরী। আর সব সময়ই হাসিখুশি। শ্বশুর অত্যন্ত ভালোবাসে ওকে। শ্বাশুড়ী নেই, অনেক আগেই গত হয়েছে। শ্বশুরের হ আর শ্বাশুড়ীর আদর দুটি দিয়েই কলিমুল্লাহ্ ভালোবাসে পুত্রবধুকে। বৌটির যত আব্দার সবই শ্বশুরের কাছে। স্বামীকে ও কিছুই বলে না। বরং নবীউল্লাহ্ বৌয়ের জন্যে কিছু  আনলে বৌটিই বরং স্বামীকে বলেÑ“আমার জন্যি আনলা ক্যান, বাবায় কিছু কইবো না? বাবার জন্যি কী আনছো?” নবীউল্লাহ্ উত্তর দেয় “দুর পাগলী, এক বছর ধইর‌্যা বাবারে তুই এই-ই চিনলি? বাবার জন্যি কিছুই আনতে অইবো না। বাবার জন্যি বাবাই আনবো। আর বাবায় কিছু কইবো ক্যান? একডিই তো পোলা তার আমি!’বলে বৌটির মুকটি দু হাতের তালুতে নিয়ে নিজের মুখের একেবারেন কাছাকাছি এনে বললো ‘আর আমার “তালের গুড়ের ক্ষীর”- একডিই বৌ তুই আমার। বাবায় কিছুুই কইবো না কুনোদিন। উল্টা আমারেই কইবো ‘মাঝে মইধ্যে বৌমারে অর সখ আহ্লাদের কিছু কিছু আইন্যা দিস। এইডি তো তরই কাম, আমার তো না। এ্যার আগে বাবায় আমারে ম্যালা বারই কইছে। আমিই তরে কই নাই।” অহন বুঝবার পারলি তো বাবায় আমারে কী কইবো আর কী কইবো না।” বৌটি আর কিছু বলে না শুধুই স্বামীকে জড়িয়ে ধরলো। ভালো লাগার অশ্র বৌটির চোখ দুটির তারায় চিক চিক করছে। আসলে স্বামীর কথাগুলি শুনে কিছুটা আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছে বৌটি।     

নবীউল্লাহ্ বেরিয়ে যাবার পর বৌটি মাটির কলসিতে রাখা পানি দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে সবার জন্যে সকালের খাবার তৈরী করতে বসলো। খাবার খুব বেশী কিছু না।  কয়েকটি সাদা রুটি আর গতকাল রাতের অবশিষ্ট বাসি সবজির তরকারী। রুটি ক’টি খুব দ্রæতই তাওয়ায় ভেজে নিলো বৌটি। তরকারীগুলি বেড়ে তিনটি বাটিতে পরিমান মতো রাখলো। এ সবের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুটা সময় অতিক্রান্ত হলো। এর মধ্যেই নবীউল্লাহ্ ফিরে এসেছে মুখহাত ধুয়ে। এসেই বৌকে জিজ্ঞাসা করেছে বাবা ফিরে এসেছে কিনা। বৌটি উত্তর দিয়েছে “না, অহনও আহে নাই।” বৌয়ের কথা শুনে নবীউল্লাহ্র উত্তর “ঠিক আছে বাবা আইয়্যা লইক, তিনজন এক লগে বইস্যাই খামুনে আইজ। খাবার তৈয়ের করছস তো?” বৌটি মাথা ঝাঁকিয়ে জানিয়ে দিলো খাবার তৈরী হয়ে গেছে। বৌটি কিছু একটা বলবার জন্যে স্বামীর দিকে তাকিয়ে যেই বলতে শুরু করেছে “কাইল রাইতে একডি ঘটনা ঘটছে আমাগো বাড়ীতে------।” ঠিক তখনই বাবার কণ্ঠস্বর কানে এলো “কই গো বৌমা নবীউল্লাহ্ আইছে?” বৌটি উত্তর দিলো “হ বাবা আইছে।” স্বামীকে বলবার কথাগুলি আর বলা হলো না। কলিমুল্রাহ পুত্রবধুকে খাবার তৈরী করতে বলে ওর শোবার ঘরে গিয়ে কিছু একটা রেখে আবার বেরিয়ে এসে রান্না ঘরে প্রবেশ করলো। সাধারণতঃ ওরা সবাই রান্না ঘরেই খাবার খায় পিড়িতে বসে। তবে এক সঙ্গে বসে খাবারের সুযোগ ওদের সব সময় জোটে না।          

আজকেও পিতা পুত্র দুজনই পাশাপাশি বসেছে। বৌটি বসে নি। ওদেরকে খাবারগুলি এগিযে দিচ্ছে। কিন্তু বাবা কিছুতেই মানলো না। পুত্রবধুকে এক প্রকার জোর করেই ওর পাশেই খেতে বসালো। বৌটি লজ্জায় যেন কুঞ্চিত হয়ে পড়ছিলো বারবার। তারপরেও বাধ্য হয়েই বসতে হলো বাবার পাশেই। আসলে আমাদের সমাজে বিশেষ করে গ্রামীন সমাজে তো স্বামীর সামনে স্ত্রী কখনও কোনোভাবেই অন্য কিছু খেলেও ভাত অথবা ওই জাতিয় কিছুই খায় না। এমন কি স্বামী অনুরোধ করলেও খায় না। বিভিন্ন কৌশলে হাসি মুখেই এড়িয়ে যায়। কিন্তু আজকে আর সেটি হলো না। স্বামী শ্বশুরের সঙ্গে একসাথে বসতেই হলো খেতে। খেতে খেতেই কলিমুল্লাহ্ গতকাল রাতের পুরো ঘটনাটি খুলে বললো পুত্র নবীউল্লাহ্কে। সবকিছু শুনবার পর নবীউল্লাহ্ বেশ কিছুটা সময় নিয়ে কী যেন ভেবে নিলো। সম্ভবতঃ ইংরেজ সৈন্যদের ক্রিয়া কলাপ নিয়েই ওর ভাবনাটি আবর্তিত হলো হয়তো। হয়তো ভেবে নিলো যদি কোনো নেতিবাচক কোনা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেই যায় তাহলে ইংরেজ সৈন্যদেরকে কিভাবে এবং কত পরিমানে সামাল দিতে পারবে ওরা। প্রশ্নটি অমীমাংসিত রেখেই সিদ্ধান্ত গ্রহন করলো নবীউল্লাহ্। এবং তাৎক্ষণিকভাবে ওর সিদ্ধান্তের কথাটি দৃঢ়ভাবে বাবাকে জানিয়ে দিলো “বাবা, যদিও ইংরেজগো দিক থাইক্যা সোমইস্যার কারণ অনেকডি রইছেই হ্যার বাদেও হেই সোমইস্যার ঝুঁকিডি লইয়াই অগো আমগের বাঁচাইতে অইবো। এই ইংরেজগো লাইগ্যাই তো তোমার সন্তানডিরে একদিন তোমারে হারাইতে অইছিলো! হ্যার পরেও তো আমরা বাইচ্যা রইছি। আমরা যদি বাইচ্যা থাকবার পারি তয় হ্যারাও পারবো।”  আরও একটু ভেবে নিয়ে আবার কথা বললো নবীউল্লাহ্ “আইচ্ছ্যা বাবা একডি কাম করলে কেমুন অয়” ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পশ্ন্র করলো বাবা “কি রকুমের কাম?” বাবার প্রশ্নের উত্তর দিলো পুত্র “অমাগো বাড়ীডি তো অনেকডি জমির উপরে। বাড়ীর চাইর দিকে অনেকডি খালি জমি তো পইড়্যাই রইছে। হেই জমিরই এক কোণায় দুইডি চালা ঘর                                                                                                                  তুইল্যা অরা থাকতি পারবো না? অগো সাথে তো একদিনের একডি শিশু রইছে আবার তিন চাইর বছর বয়সের একডি পোলাও আছে- হ্যাগো কি বিপদের মুখে জাইন্যা শুইন্যা ঠেইল্যা দেওন আমাগো উচিত অইবো নাকি ঠিক কাম অইবো? হ্যার থাইক্যা অরা যদি আমাগো লগে থাইক্যাই যায় তাইলে অরাও বাঁইচ্যা যাইতে পারবো আমাগোরেও উপকার অইবো।”নবীউল্লাহ্র কথার শেষে কলিমুল্লাহ্ প্রশ্ন করলো পুত্র নবীউল্লাহকে“আসলে তুই কী কইবার চাইতাছস; হ্যারা ভিন জাতের মানুষ, হ্যাগো পেশাটিও ভিন্ন, ধ্বর্মডিও এক না। হ্যারা আমাগো কী উপকারে আইবো? তর কতা তো আমি ঠিক মতো বুঝবারই পারতাছি না।”                       

 

 

 

 

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান