প্রথম অংশ। (ধারাবাহিক)
০১.
হে প্রভু
হে জন্মান্ধ ঈশ্বর,
কাক চক্ষুর জলরাশি বিহীন
মত্ত আঁধারে নিমজ্জিত ঘনঘোর বিবমিষা আক্রান্ত পীযুষ;
হাল ভাঙ্গা নাবিকের অমর্য প্রলাপ তুমি
অথচ তবুও রাজদন্ড হাতে নিয়ে বসে আছো কী অসভ্য নির্বিকার!
তবুও পূর্ণ অঞ্জলীপুট ভরি যাঞ্চা কর বিপুল উপঢৌকন
তোমার আন্দোলিত তীব্র আনন্দাকাক্সক্ষা পূরণে
আমাদের কাছে লজ্জাহীনের মতো;
আমাদেরকেও প্রদান করতে বাধ্য হতে হয়
বাকহীন অসার বৃদ্ধের জড়তা নিয়ে
তোমারই প্রনতি করে তোমার করুণার,
উচ্চারিত হয় আমাদের মর্ম দীর্ণ করে
হে মহাপ্রভু,
আমাকে বৃক্ষের সৌন্দর্য দাও
আমাকে বৃষ্টির বিদগ্ধতা দাও
আমাকে নীলিমার স্বাধীনতা দাও
আমাকে মৃত্তিকার পেলবতা দাও
আমাকে শষ্যদানা জন্মাবার সক্ষমতা দাও।
আমাকে দান করো সেই মহান সহিষ্ণুতা
যা আমাকে উত্তুঙ্গ অগ্নির উচ্ছৃত দহন থেকে বাঁচিয়ে রাখবে,
যা আমাকে অস্পৃশ্য ‘ অনঙ্গ-কন্যা‘র রিরংসিত প্লাবনের
অভ্রান্ত বাধভাঙ্গা কামনার সর্পিল বাহুপাশ থেকে রক্ষা করবে,
যা আমার অস্তিত্বের অনুসন্ধানকে লক্ষ বছর দান করবে
আর যে অনুসন্ধান বিঘ্নর প্রতিটি গ্রন্থি ভেঙ্গে ভেঙ্গে
তোমার অস্তিত্বের অনুভবকে
আমার হৃৎপিন্ডের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেবে।
তোমার নিঃসীম নিঃশ্বাসের অসংবৃত আলিঙ্গন-স্পর্শে
আমি হয়ে উঠবো অমৃতের সন্তান
মৃত্যুহীন, চিরঞ্জীব,
অনাগত মানবকুলের শ্বেত-শুভ্র মুক্তির অসামান্য মেঘদুত।
প্রলম্ব-প্রান্তর জুড়ে সৃষ্টি করবো আমি
আত্মার্থ না হয়ে কেবলই সজীব শষ্যদানা
জন্ম থেকে জন্মান্তরে
শুধু তোমার আত্মজা
অযুত নিযুত নিপীড়িত নির্যাতীত
নিগৃহীত সন্তানদের জন্যে।
একটি ক্রিশ্চিয়ান চার্চের ভেতর স্থাপিত ক্রুশ বিদ্ধ অবস্থায় দণ্ডায়মান যীশু খ্রিষ্টের ব্রোঞ্জ নির্মিত মুর্তির সম্মুখে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়সী একজন যাজক তার দুটি হাতকে ক্রস চিহ্নের মতো করে আড়াআড়িভাবে বুকের ওপর রেখে প্রার্থনা করছে। এবং কিছুটা নিচুস্বরে উদ্ধৃত কথাগুলি কবিতার মতো করে উচ্চারণ করছে। যাজকের পেছনে অনেক নিম্ন বর্ণের দলিত, মথিত এবং নিগৃহীত মানুষও সারিবদ্ধভাবে যাজকের ভঙ্গিতে দুহাত আড়াআড়িভাবে বুকের ওপর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মাথাগুলি শুধু নিচের দিকে নোয়ানো। (এখানে ” ঈশ্বর”-শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিকীভাবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতিভূ হিসেবে। প্রত্যক্ষভাবে যীশু খ্রিষ্টকে নয়)।
০১.১.
এখানে ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টি ফেরাতে হবে। যেহেতু অনেক বছর আগে গোটা ভারতবেের্ষ ঘটে যাওয়া বহু সংখ্যক ঘটনা-প্রবাহের মধ্যে দিয়ে যে সামাজিক প্রেক্ষিত নির্মিত হয় এবং সেই নির্মিতির ধরাবাহিকতায় নির্যাতীত নিপীড়িত অসহায় মানুষগুলির চৈতণ্যের মর্মমূলে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা আর ক্ষোভ দানা বাঁধতে বাঁধতে এক পর্যায়ে সেই ঘৃণা আর ক্ষোভ স্বাধীনতার আকাঙ্খায় রূপ লাভ করে সে প্রেক্ষাপটের আলোকেই এ উপন্যাসটি রচিত।
‘রামানুজ’- নামের এক ব্যক্তি চতুর্দশ শতাব্দির প্রথম দিকে দাক্ষিনাত্যে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ‘ শ্রী সম্প্রদায়’- নামীয় একটি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সম্প্রদায়ের মাধ্যমে তিনি যে ধর্মের মর্মবানী প্রচার করেন তা হলো ‘প্রেম ও অনুরাগ।’ এই প্রেম এবং অনুরাগ ছাড়া মানুষের মুক্তির ভিন্ন কোনো পথ নেইÑ এই তত্তে¡ তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। সে সময়ে সৃষ্ট ‘ভক্তি আন্দোলন’-এরও তিনি ছিলেন প্রধান পুরোহিত। এই ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি তার সম্প্রদায়কেও একটি শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠা করবার প্রাণপন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন তার মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত।
এই রামানুজের তত্ত¡কে মনে প্রাণে বিশ্বাস এবং অনুসরন করেন ‘রামানন্দ’-নামের আর একজন বিশেষ ব্যক্তি। বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে তাকে উল্লেখ করা হলো এ কারণে যে, তার সময়ে তার এলাকার সাধারণ মানুষ তাকে ‘ পণ্ডিত রামানন্দ’- নামেই আখ্যায়িত করেছিলো যিনি জন্ম গ্রহন করেন চতুর্দশ শতাব্দির মধ্যভাগে বর্তমান ভারতের এলাহাবাদে। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সে সময়ে ভারতের জাতিভেদ প্রথার প্রবল বিরোধিতা করেন। বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকে তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। এই মতের জন্যে তাকে যথেষ্ট দূর্ভোগও স্বীকার করে নিতে হয়েছিলো। এক পর্যায়ে তিনি ইসলামের ‘ সুফিবাদ’-এ নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। যেহেতু ‘ সুফিবাদ’- সকল মানুষের মধ্যে সাম্যের কথা বলে, মানুষে মানুষে প্রভেদকে ঘৃণা করে এবং পরমাত্মার সঙ্গে আত্মার লীন হয়ে যাওয়া অর্থাৎ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সৃষ্টিকর্তার আরাধনার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভকেই পরম মোক্ষ বলে বিশ্বাস করে সেইহেতু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিপুল সংখ্যক মানুষ পর্যায়ক্রমিকভাবে সুফিবাদকে স্বীকার করে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করে। সুফিবাদ পÐিত রামানন্দ’কে অনুপ্রানিত করে সুলতানী শাসনের কাল থেকে। খলজি এবং তুঘলক শাসনামলে রামানন্দ তার অভেদ জাতিস্বত্তার বানী প্রচার করেন। যেহেতু তিনি ওই সময়ের প্রখ্যাত সুফি ফকির শেখ নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার প্রচারিত বানী থেকে অনুপ্রানিত হয়ে করেছিলেন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমন করে সেইসব দেশের ধর্মীয় এবং সামাজিক পরিবেশ এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এ ধরণের একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, হিন্দু ধর্মের বিশেষ পরিবর্তন ছাড়া ওই ধর্মের কোনো প্রকার সংস্কার সাধনই সম্ভব নয়। পরবর্তীতে গজনীর সুলতান মাহমুদ যতবার ভারতে এসেছেন ততবারই তিনি বিপুল সংখ্যক সুফি সাধক এবং যোদ্ধাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। সে সময় তারাও হিন্দুদের জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে ইসলামের হিন্দু মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেছিলেন। এতে ইসলামের প্রভূত বিস্তৃতি লাভ সম্ভব হয়েছিলো। হাজার হাজার হিন্দু সম্প্রদায়ে মানুষ ইসলামের ভ্রাতৃত্বের বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলো। মুহম্মদ ঘুরী যখন ভারতে আগমন করেন তখন তিনিও অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন যাদের প্রচারের মাধ্যমেও ইসলাম ধর্মের ব্যপক প্রসারলাভ সম্ভব হয়ে উঠেছিলো।
ইসলামের এই ব্যাপক প্রসার লাভের নেপথ্যে ইসলামের মানব জাতির ভেদাভেদ বিহীন ভ্রাতৃত্বের বানী প্রচারের বিষয়টি মুখ্য হলেও আর একটি বিশেষ বিষয় ক্রিয়াশীল ছিলো যেটি হলো দলিত, মথিত, দরিদ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ওই হিন্দু সম্প্রদায়েরই উচ্চবিত্ত অভিজাত এবং বর্ণগতভাবে উচ্চ বর্ণ বলে স্ব-স্বীকৃত ব্রাহ্ম শ্রেণীভুক্ত ব্রাহ্মন সমাজের নিপীড়ন, নির্যাতন এবং চরম বঞ্চনার অভিশাপ। এই অভিশাপের অখণ্ড যন্ত্রণা থেকে ওরা প্রতি মুহুর্তে মুক্তি কামনা করে আসছিলো। কিন্তু কোনোভাবেই ওরা ওদের সে কাক্সিক্ষত মুক্তির উপায় খুঁজে বের করতে পারছিলো না। ঠিক এ রকম একটি অবস্থায় ইসলাম ওদের কাছে এসেছিলো সেই মুক্তির বানী নিয়ে। ওরাও আর কাল বিলম্ব না করে অতীত এবং বর্তমানের সবকিছুকে বিবেচনায় নিয়ে ওদের সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অকুন্ঠ চিত্তে শান্তি এবং ভ্রাতৃত্বের ধর্ম হিসেবে ইসলামকেই সানন্দে গ্রহন করেছিলো। এবং পরবর্তীতে বহুকাল ধরে এর ধারা অব্যাহতভাবে প্রবহমান ছিলো।
০১.২.
এলাকাটি জঙ্গলাকীর্ণ। ঘোরতরভাবে জঙ্গলাকীর্ণ। বিশাল বিশাল বৃক্ষরাজির ক্ষুদ্র বৃহৎ ঘন সবুজ পত্র পল্লবের দুর্ভেদ্য আবরণÑযা মুক্ত নীলাকাশকেও বলা যায় পূরোপুরি এক ধরনের অবর”দ্ধই করে রেখেছে। সেই গাঢ় আবরনকে ভেদ করে যেখানে সূর্যের তীক্ষ্ন রশ্মির প্রবেশ করাই দুঃসাধ্য সেখানে সূর্য রশ্মির আলোক-স্পর্শ ব্যতীতই সে সব বৃক্ষের ফাঁক ফোকর দিয়ে জন্মিত অগনিত, অসংখ্য উদ্ভিদ জাতীয় ছোটো ছোট গাছের লতা গুল্মের অযত্বে অথচ অক্লেশে বেড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠার ক্ষণে ক্ষণে বৃক্ষ গুলির কাণ্ড সমুহকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে উর্ধ্ব পাণে ধাবিত হয়ে সর্বোচ্চ শাখার পল্লবের সাথে মিশে একাকার হয়ে গিয়ে ওদের সাথে কানাকানি করা, ওদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক তৈরী করে মৃদু সমীরনের দোলায় দোলায়িত হওয়াÑদেখলে প্রকৃতই মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়, অন্তরে সৃষ্টি হয় এক পৃথক ধনণের ভালোলাগার উন্মাতাল অনুভূতি। কিছুতেই দৃষ্টি ফেরানো যায় না, চোখের পলক পড়তে চায় না। মনে হয় যেন ওদের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থেকে ওদের অনুভূতির ঝরনা ধারার সাথে নিজের অনুভূতিগুলিকে একেবারে লীন করে দিতে পারলে হয়তো আত্ম-সুখের ভাণ্ডটি পূর্ণ হতে পরতো। কিন্তু যা কখনই সম্ভব নয়। কখনই হবার নয়। কেবল নিজের উপলব্ধির তীব্রতাই ওদের এ নিটোল সৌন্দর্যকে অনুভব করবার একমাত্র উপায়। তীব্র উপলব্ধির বোধ হৃদয়ের গভীরে ধারণ করতে না পারলে ওই সৌন্দর্যের কণা পরিমাণও অনুভব করা যাবে না। অনুভবের পিপাসা মিটবে না। অতৃপ্তই থেকে যেতে হবে।
বিশাল এলাকা জুড়ে এ অরণ্যলোক। সম্মুখে যত দুর দৃষ্টি যায় শুধুই অরণ্য আর অরণ্য। অরণ্য ছাড়া এ গোটা ধরিত্রীর আদিগন্ত প্রান্তর জুড়ে আর বুঝি কোথাও কিছু নেই। অতিরিক্ত হিসেবে আছে শুধু এই অরণ্যের ভেতর নির্বিঘেœ বসতি গড়া অসংখ্য ছোটো ছোটো ঝাঁক ঝাঁক পাখির কোলাহল কলরব। এ কলকাকলি যেন গোটা অরণ্যলোককে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনিন্দ্য শ্রবন-মুগ্ধতার এক অবিস্মরণীয় তুলনা বিহীন বিশুদ্ধ সঙ্গীত মুখরতায়। এ সঙ্গীতকেই বোধকরি বলা যায় ‘অরণ্য-সঙ্গীত।’ যদিও অরন্যের ভিন্ন মাত্রার নিজস্ব একটি সঙ্গীত রয়েছে যেটি দক্ষিণের র্ঝিঝিরে বাতাসের স্পর্শে বৃক্ষের শাখায় শাখায় পল্লবিত এবং আন্দোলিত পত্রাবলীর মর্ম বিদীর্ণ করা শব্দপুষ্ট আকুতি। তারপরেও নির্ঝরিনীর অবিশ্রান্ত বয়ে চলা কুল কুল শব্দের সাথে এক লয়ে মিলে গিয়ে পাখিদের মুখরিত কলকাকলি যেন অরন্যের নিজস্ব সঙ্গীতকেও হার মানায়। এই বিপুল বনরাজির সঙ্গীত-বিদগ্ধ সৌন্দর্য-দীপিকার কাছে পূর্ণিমা রাতের পূর্ণচন্দ্র জ্যোৎন্সাকেও যেন বড় দরিদ্র মনে হয়। মনে হয় জ্যোৎ যেন কোনোন্ষমতে বৃক্ষ গুলির পাতার ওপর বড় করুণভাবে গলে গলে ঝরে পড়ে সে পাতার ওপর থেকে ধীরে ধীরে চুয়ে পড়ে বনভূমি স্পর্শ করে কৃতার্থ হতে চায়। পথশ্রমে ক্লান্ত ভিখিরীর মতো ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে অরন্যের কাছে অরন্যেরই দুর্লভ শোভা ভিক্ষে করে। বড় আকালের পূর্ণিমা বলে ভাবতে হয় এ অসহায় চাঁদের আলোকে।
এ অরন্যে হিংস্রর কোনো প্রাণী আছে কিনা জানা যায় না। যদিও থেকে থাকে অরন্যের বাইরে তাদের কখনও দেখা মেলে না। কখনও কখনও অরন্যে খাবার না জুটলে মাঝে মাঝে কেবল দু’একটি শৃগাল বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে খুব দ্রত গতিতে কাছাকাছি কোনো লোকালয়ের দিকে যাবার চেষ্টা করে খাবারের সন্ধানে। কিন্তু কোনো লোকালয়ে পৌঁছুতে না পারলে আবার অরন্যেই ফিরে আসে। আর দেখা যায় দু’একটি শুকর ছানা মায়ের পিছু পিছু বেরিয়ে এসে ধারালো মুখ দিয়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে মাটির নীচে যা পায় তাই গিলতে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় মাথায় গামছা বাঁধা লুঙ্গি অথবা ধুতি পরিহিত দু’তিনজন পূরুষ মানুষ খালি গায়ে অথবা হাটুর সামান্য নীচ পর্যন্ত শাড়ী পেঁচিয়ে তিন চারজন নারী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে ওদেরকে তাড়িযে আবার জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে যায়। আর ঠিক তখনই বোঝা যায় এ নিঝুম জঙ্গলের ভেতর নিশ্চয়ই কোনো না কোনো মনুষ্য বসতি রয়েছে।
অরন্যের ওপর উর্ধ্বাকাশে শকুন, শকুনি, বড় বড় চিল, কাক জাতীয় পাখির প্রবল উচ্ছ¡াস মিশ্রিত হৈ হুল্লোর করে চক্রাকারে উড়তে দেখা যায় তখনই যখন অরন্যের গভীর অভ্যন্তরে কোনো জীব জন্তু মরে পড়ে থাকে। ওদের পচে যাওয়া মাংস ভক্ষনের জন্যে এ পাখিগুলির মধ্যে প্রচণ্ড শোরগোল আর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তখন অরন্যের শান্ত ¯বিদগ্ধ পরিবেশটি আর আগের মতো থাকে না। কেমন যেন একটি সাংঘর্ষিক যুদ্ধ ক্ষেত্রের হিংস্র পরিবেশের ভেতর অন্তরিত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত মৃত পশুটির অথবা পশুগুলির মাংস ভক্ষণ শেষ হলে যে দিক থেকে ওরা এসেছিলো সেদিকেই আবার ফিরে চলে যায়।
পরিবেশ শান্ত হয়ে এলে অরন্যের কিছুটা ভেতরে প্রবেশ করে গভীর মনোযোগ দিয়ে অরন্যের হাওয়ায় কান পাতলে অরন্যের মাঝামাঝি থেকে অথবা তারও কিছু দূর থেকে কোনো নারী কন্ঠের মিষ্টি সুরের কোনো দুর্বোধ্য গান ভেসে আসে। কণ্ঠস্বরটি কোনো কিশোরী অথবা তরুনীর হতে পারে। তবে কণ্ঠস্বরের পুরুত্বের মাত্রাটি ইঙ্গিত করে কণ্ঠস্বরটি কোনো কিশোরীর না হয়ে বরং কোনো তরুনীর হওয়াই স্বাভাবিক বোধকরি হতে পারে তরুনীটি বিবাহিতা অথবা অবিবাহিতা। গানের কথাগুলির পূরো অর্থ বোঝা না গেলেও সুরের আবহটি শ্রবনে আঘাত ক’রে হৃদয়কে আপ্লুত করে দেয় মুহূর্তেই
‘জিয়াকে জঞ্জাল ভইল্ হামরি সুরতিয়া
করে যা ছুয়েলা,
রাহা চল্নে লোগওয়া তো ডগর রোকেলা
হো কি রস্ চুয়েলা।
লাগে ওয়ালি বাতিয়া করো মোরা ছায়েলা
হো করে যা ছুয়েলা
হো কি রস্ চুয়েলা
রাহা চল্নে লোগওয়া তো
ডগর রোকেলা...............।’
গানটি ভোজপুরী ভাষায় রচিত। বাংলায় অনুবাদ করলে মোটামুটি যার অর্থ দাঁড়ায়Ñ
(আমার শরীরের সৌন্দর্য আমার জীবনের একটি জঞ্জাল
পথ চলতে গেলেই লোকেরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে,
আমার পথ চলা রন্ধ করে দেয়,
আমার দেহের সুধা পান করতে চায়,
আসন্ন দীপালিতে
তোমরা আমাকে ঢেকে রেখো.............)।’
এখন বিকেল পেরিয়ে ঝিলিমিলি সন্ধ্যার আগমনী সঙ্গীত বানী খুবই ধীর লয়ে ভেসে আসছে বন-বাতাসের আট বেহারার পালকিতে চড়ে। সূর্যের অস্তরাগ পর্বটি এখনও শুরু হয় নি তবে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বোঝা যায় পশ্চিমাকাশের উত্তর কোণটিতে অস্বচ্ছ রক্ত বর্ণের উদ্ভাসটিকে লক্ষ করলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা পশ্চিমাকাশটি হয়তো অস্তরাগে ঢেকে যাবে। অস্তাচলগামী সূর্যটির রঙ্গিন মূর্তিটি এর মধ্যেই ধূসর হতে শুরু করেছে।
এরই মধ্যে দু’টি শূকর ছানাা ওদের মা’কে নিয়ে ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে খুব দ্রুত বেগে বেরিয়ে এসে শুকনো মাটি খুঁড়তে শুরু করেছে। মাটি খুঁড়ে মাটির নীচে যা পাচ্ছে তাই-ই ভক্ষণ করতে ওদের মোটেই যেন তর সইছে না। গিলে চলেছে সব কিছু। এর পরপরই ওদের পেছন পেছন মাঝারি আকারের একটি সরু বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে একটি তরুণী দৌড়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে ওদেরকে তাড়িয়ে আবার জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। চিৎকার করে উচ্চারণ করছে ‘হে হে, আ আ, ঘর চল্, ঘর চল্।’ চিৎকার শেষে ডান হাতের তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দু’ঠোঁটের ভেতর জিহার নীচে পুরে দিয়ে তীব্র শীশও বাজাচ্ছে। কয়েক বার এ শীশ বাজানোর পর ছানা দু’টিসহ মা শূকরটি মাটি খোঁড়া বন্ধ করে আবার জঙ্গলে প্রবেশ করবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতিমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে তরুনীটির দিকে। মেয়েটি শূকর তিনটিকে নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করবার পরই কেবল নিশ্চিত হওয়া গেলো অরণ্যের ভেতর মনুষ্য বসতি রয়েছে।
তরুনীটির আকৃতিটি মোটামুটি মাঝারি আকারের। একেবারে দীঘলও নয় আবার দৃষ্টিকটু খর্বও নয়। স্বাস্থ্য পরিপুষ্ট। পরনে দেহের নিশে হাঁটুর সামান্য নীচ পর্যন্ত ঝুলে থাকা কতকটা পেটিকোটের মতো এক খণ্ড বস্ত্র। উর্ধ্বাংশে একটি পুরুষ মানুষের রঙ্গিন শার্ট যেটির নিম্নভাগ দিয়ে মেয়েটির ভারী নিতম্বের দু অংশকে ঢেকে দেয়া। এই শার্টটির ওপর দিয়ে কোমরটি একটি লাল রঙ্গের প্যাঁচানো গামছা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। শার্টের ওপর দিয়ে কোমরে এই গামছা বাঁধবার কারণে ওর বক্ষদেশের স্তন দু’টি যেন ঠিক ‘বিল্ব-স্তনী’র আকৃতি প্রাপ্ত। প্রথম দর্শনেই দৃষ্টি যেন ওর ওই ‘ বিল্ব-স্তনী’ বক্ষের ওপরই স্থির হয়ে যায়। সে জায়গাটি থেকে সহসাই দৃষ্টি ফেরানো কোনো পুরুষের পক্ষে মোটেই সহজ হয় না। মেয়েটির গায়ের রং কালো। একেবারেই কালো। এই কালোর প্রকারটি যদি প্রকৃতভাবে বর্ণনা করতে হয় তাহলে অবশ্যই ওই কালো শব্দটির পূর্বে একটি বিশেষণ যোগ করতে হবে। আর যে বিশেষণটির নাম প্রয়োগ-ক্ষেত্র অনুযায়ী‘কুচ্কুচে’ হওয়াই হবে স্বাভাবিক। অর্থাৎ ‘কুচ্কুচে কালো।’ আর এই কুচকুচে কালো মেয়েটির দেহভান্ডের গাঠনিক আকৃতি যে এত শৈল্পিক হবে কল্পনাই করা যায় না। ওর প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালনই যেন পৃথকভাবে একটি একটি করে ছন্দের সৃষ্টি করে যেন প্রাণপূর্ণ ভালোলাগা কবিতার মতো। ওর কালো দেহের এই অসাধারণ শোভাকে প্রকৃতভাবেই আরও কয়েক শত গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ওর দুগ্ধ-সফেদ ছোটো ছোটো ধবল দাঁতের সারিবদ্ধ অপূর্ব বন্ধনী। মেয়েটি যখন কথা বলে অথবা হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে তখন বাংলার বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ বাক্য আপনা আপনিই মনের কোণে ভেসে ওঠে। প্রবাদ বাক্যটি এ রকমের ‘মেয়েটির হাসিতে মুক্তো ঝরে।’ আর এই মুক্তো ঝরানো হাসির বন্যাই মেয়েটির অদ্ভূত সুন্দরতার একটি অনন্য সাধারণত্বের ভেতরে থেকেও ভিন্ন আঙ্গিকের একটি অসামান্য দ্যোতনা।
বাংলার বিশ্র”ত কবি জীবনানন্দ দাশ তার ‘ বনলতা সেন’ নামীয় কবিতাটিতে যখন উদ্ধৃত করেন ‘সিংহল সমুদ্র, মালয় সাগর, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগত’ অথবা ‘ দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগর’ এবং বনলতা সেনের চুলের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি যে উৎপ্রেক্ষা প্রদান করেন ‘ চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ আর মুখশ্রীকে তুলিত করেন ‘ শ্রাবস্তীর কারুকার্য’ এর সাথে। এবং হাল ভাঙ্গা দিশা হারানো নাবিক যখন ‘ দারুচিনি দ্বীপের ভেতর’ ‘সবুজ ঘাসের দেশ’ খুঁজে পান ঠিক তেমনি যেমন খুঁজে পেয়েছিলেন কবি ‘পাখির নীড়ের মতো’ চোখ সমৃদ্ধ ‘ বনলতা সেন’কে ‘দারুচিনি দ্বীপ’এর পরিবর্তে বাংলার এই নাটোরে। এ প্রেক্ষিতে এখানে অবশ্যই বলতে হয় এই যে উপমা আর উৎপেক্ষার সমুহ উপকরণ যার কোনোটিকেই চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করবার সৌভাগ্য হয়তো আমাদের সবার হয় নি। কারো কারো হয়ে থাকলেও সবার যে হয় নিÑ এটি নিশ্চিত। আর সে কারণেই অগনন বর্ণিল চিন্তা-রশ্মির তুলি দিয়ে অন্তরের দৃষ্টি সীমার আয়োতন জুড়ে একটি বিশেষ চিত্রকল্প অঙ্কন করে আজকের এ মুহূর্তের এই তরুণীটির মুখমণ্ডলটিকে যদি শ্রাবস্তীর কার”কাজ হিসেবে অর্থাৎ সে সময়ের ‘ শ্রাবস্তী’ নামীয় একটি নগরের দালান কোঠায় যে দেয়াল চিত্র খোদাই করে অঙ্কন করা হয় সেই দেয়াল চিত্রে অঙ্কিত কোনো তরুনীর মুখোমণ্ডলের সাথে এবং ওর কেশশ্রীকে যদি অন্ধকার বিদিশার নিশার সাথে তুলিত করা যায় তাহলেও বোধকরি এই তরুনীটিই উত্তীর্ণ হবে। কারণ আগেই বলা হয়েছে মেয়েটির প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালনই একটি ক’রে ছন্দময় শিল্পের সৃষ্টি করে। ওর কথা বার্তায় শ্রাবস্তীর কার”কার্যের চেয়ে আরও বেশী কিছু যেন মনে হয় ওর মুখোমন্ডলটিকে। ওর কোমর অবধি প্রলম্বিত দীঘল চুলের ঘনিভুত বর্ণটিকে দেখে যেন মনে হয় ‘ বিদিশার নিশা’র চাইতেও আরও ঘনঘোর অন্ধকারে আবৃত মধ্য-যামের অপরূপ শোভা-বিস্তার। আরও একটি কারণ বনলতা সেনের অঙ্গ-বর্ণ কি ধরনের ছিলো আমরা জানি না। যদিও নারীর শারীরিক সৌন্দর্য বিচারের ক্ষেত্রে শরীরের বর্ণের বিষয়টি কোনোভাবেই মাপ জোঁকের তুলাদণ্ড মুখ্য মানদণ্ড হিসেবে চূড়ান্ত নির্দ্ধারকের ভূমিকা পালন করতে পারে না তবুও সাধারণ মানুষ কালো, শ্যামলা অথবা ফর্সা এ গুলির মধ্যে একটি পার্থক্য খুঁজবার চেষ্টা করে নিয়ত এবং ফর্সা বর্ণটিকেই অগ্রাধিকার প্রদান করে থাকে অন্য দিকগুলি বিবেচনার অযোগ্য হলেও। কিন্তু কালোরও যে সৌন্দর্য হিসেবে ফুটে উঠবার একটি বিশেষ স্বভাবজঃ ( ইনহেরেণ্ট) শক্তি রয়েছে আজকের এ মেয়েটি তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এই মেয়েটির শরীরের কুচকুচে কালো রং আর শুভ্র দাঁতের হাসির অসামান্যতাই মেয়েটিকে বনলতা সেনের উর্ধ্বে স্থাপিত করেছে নিঃসন্দেহে। যদিও আরও একটি কারণে যে¬ ওর চোখ দু’টি বনলতা সেনের ‘পাখির নীড়ের’চাইতেও আরও বেশী কিছু যেন। মেয়েটির দু’চোখের ভ্রæ আর হরিনী-নয়নের মতো বড় বড় অক্ষি-গোলক পাখির নীড়কেও হার মানিয়ে দেয়। এই সৌন্দর্য বিবেচনার ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভাবনায় জীবনানন্দ দাশের চাইতে বরং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গানের কয়েকটি কলিতে যে চিত্রকল্পটি অঙ্কন ক’রে যা বলা হয়েছে সেই বলা কথা ক’টিই বোধকরি মেয়েটির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য
‘কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি,
যে যা বলে বলুক গাঁয়ের লোক
দেখেছি তার কালো হরিন চোখ।
কালো! তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিন চোখ।’
ঠিক যেন রবি ঠাকুরের উল্লেখিত গানের কথায় অঙ্কিত কল্পচিত্রেরে সেই ‘কৃষ্ণকলি’র অবিকল প্রতিকৃতি এই মেয়েটি। মেয়েটির নাম ফুল্লরী