লেখক ও গবেষক ড. এম. আল-মামুন (বাউ) এর ‘ডোং ডোং ১’ নামের এই ত্রিমাত্রিক ছোট গল্পের বইয়ে এক নতুন আঙ্গিকে স্মৃতি, রম্য ও মনস্তত্ত্বের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের মফস্বলে, ছেলেদের আদরীয় ডাকনাম হিসেবে ‘বাউ’ শব্দটি আমার অত্যন্ত প্রিয়। আমাদের গ্রামদেশে অত্যন্ত আদরের ছোট (ছেলে, ভাই, ভাতিজা, ভাগিনা এমনকি পাড়াতো বা আত্মীয়তার সূত্রে) ছেলেদের এ নামে ডাকা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এই আদরের ছেলেটি বৃদ্ধ হলেও বড়রা তাকে ‘বাউ’ বলেই ডাকেন। অর্থাৎ সেই ‘বাউটি’ কখনো তার প্রিয়জনদের কাছে বড় হয়না, আজীবন ছোট থাকে, এমনকি মৃত্যুর পরেও। আবার এমনটাও হয়েছে যে, ‘বাউ’ ডাকতে ডাকতে অনেকেই তার আসল নামই ভুলে গেছেন।
যাই হোক ‘ডোং ডোং ১’ বইটি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে এবং একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে অনুভূতি কিছুটা এরকম। এই বইটির বিশেষত্ব হলো, বইটি রুহিয়া (ঠাকুরগাঁও, বাংলাদেশ) এর গ্রামীন আঞ্চলিক ভাষায় লেখা। আমার জানামতে এর আগে রুহিয়ার আঞ্চলিক ভাষার লেখ্যরূপ আর কোন বইয়ে লেখা হয়নি। ভবিষ্যতে এই বইটি রুহিয়া, ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের গ্রামীন ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করবে। এই জন্য লেখক তার কর্মের জন্য অনেকদিন আলোচিত হবেন বলেই আশা করি। পাশাপাশি অঞ্চলিক ভাষার লেখ্য রুপ যে অনেক সুন্দর ও সাবলীল হতে পারে, তা এই বইয়ের পরতে পরতে অনুভব করা যায়। এই বইখানা পড়ে অনেকেই হয়ত আঞ্চলিক ভাষায় লিখতে উৎসাহিত হবেন, যেটা হতে পারে আঞ্চলিক কথ্য ভাষা লিপিবদ্ধ করার এক মহৎ প্রয়াস।
বইটি আঞ্চলিক ভাষায় হাস্য-কৌতুক, রঙ্গরসে, মজা করে লেখা হলেও, মোটাদাগে অনেকগুলি সিরিয়াস বিষয়ও উঠে এসেছে। এই যেমন, ভুটুকের বিচি বা পাঁটের কচি পাতা দিয়ে ভুটুক ফুটানোয় যে সাদা ধোঁয়ার আবির্ভাব হয়, সেটা বিচির উপরের অতিউদ্বায়ী রাসায়নিক দ্রব্য থেকে উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে। যা কেউ কখনো এভাবে ভেবে দেখেছে বলে মনে হয়না। আবার ‘লাফা শাক’ দিয়ে মোটা চালের ভাত খাওয়ার সঙ্গে সমসাময়িক কালের গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে এক সুন্দর সাবলীল বর্ণনায়।
কিছু কাল্পনিক কিন্তু সামাজিকভাবে বাস্তব চরিত্রসমূহের (চাকু, পাকু, শাকু) মধ্যে ‘পাকু’কে দিয়ে সমাজের সেইসব মানুষের চরিত্র তুলে ধরেছেন, যারা সবার সাথে তাল মিলিয়ে (ভালো-মন্দ সব) চলে নিজের সুবিধা আদায়ের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। ইনারা চাটুকার বা তেলবাজ ধরণের লোক এবং সমাজের জন্য ভয়ঙ্কর। ঢ্যাঁড়স নামক সবজির পিচ্ছিল বৈশিষ্ট্যকে উপমায় নিয়ে, সমাজের নানান কিসিমের ছেঁচড় লোকদের চরিত্র চিত্রায়ন করেছেন খুবই সুনিপুণ কারুকার্যে।
সমাজকল্যাণমূলক কাজ করতে আগ্রহী মানুষদের পরিকল্পনাবিহীন আন্তরিকতার অসারতার কথা তুলে ধরা হয়েছে এবং সব ভাল-কর্মে সর্বাগ্রে সঠিক পরিকল্পনার কথা গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করেছেন। আবার চমৎকার কিছু সামাজিক উদ্যোগ কিভাবে কিছু মন্দ লোক, তার ক্ষুদ্র রাজনৈতিক বা ব্যক্তিস্বার্থে ভন্ডুল করে দেন সে চিত্রও তুলে ধরে শুভবাদি মানুষকে সাবধান করেছেন। তিনি দীর্ঘসময় পরে বাংলাদেশের রাজনীতির নেতিবাচক দিক নানা বর্ণনায় তুলে ধরেছেন। আমাদের সমাজে শ্যাঁওলার মত ছড়িয়ে থাকা এই অপসংস্কৃতি থেকে উত্তোরণের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন প্রজন্মকে সূশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ‘ব্যক্তিগত মনুষ্যত্ববোধ সংরক্ষণ সহ সামাজিকভাবে মনুষ্যত্বের বনায়নের’ তাগিদ দিয়েছেন।
ঘরের চালের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো দেখা যাওয়ার তুলনায় গ্রামীন দারিদ্রের চিত্র এঁকেছেন কিছুটা কবি সুকান্তের সেই ‘পূর্ণিমার চাদ যেন ঝলসানো রুটি’র মতো’। লেখক তার সময়ে রুহিয়ার শিক্ষার মানের ভালো ও সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন তার শ্রেণিপাঠ সহ প্রাইভেট পড়ার চিত্র বর্ণনার মধ্য দিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের ক্রীড়া, সংস্কৃতির চমৎকার চিত্রও তুলে ধরেছেন তার লেখায় এবং সমাজের সমস্যা দূরীকরণে প্রথমে নিজেদের সীমাবদ্ধতা দূর করার কথা বলেছেন।
গ্রামাঞ্চলে টিউবওয়েল বোরিং করার স্থানীয় কৌশলের চিত্র এঁকেছেন এক নিখুঁত বর্ণনায়। অনেক টানাপোড়েনের মাঝেও পারাবারিক বন্ধনের (স্বামী,স্ত্রী,পুত্র কন্যা) চমৎকার চিত্রায়ন রয়েছে এই লেখায়। বাল্যকালের ছোট-ছোট আনন্দ-কষ্টের অভিজ্ঞতা রম্যরসে বর্ণনা করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোকপাত করেছেন, যা স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। বরং প্রায় ২২/২৩ বছর পর বাল্য অতীতের এই দুর্লভ চিত্রায়ন সত্যিই ধন্যবাদের দাবী রাখে, যা আমিসহ আরো অনেককে জীবনের পিছনের চিত্রকর্ম অন্বেষণে সহায়তা করবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ড. এম. আল-মামুনের লেখা ‘ডোং ডোং ১’ কিংবা ‘ফার্মিয়ন ১ (অ্যান্টিডোট)’ বই দুখানা লেখার আঙ্গিক বা ধরণের পার্থক্য যাই থাকুক না কেনো, লেখক তার ‘জীবনবোধ’ হিসাবে লোভ-লালসা ব্যক্তিস্বার্থ, হিংসা-বিদ্বেষ, এর পরিবর্তে ‘মনুষ্যত্ববোধ’কে জাগ্রত করার তাগিদ দিয়েছেন। বিশ্বাস করি লেখক তার গবেষণাকর্মের পাশাপাশি একটি মানবিক সমাজ তথা মানবিক বিশ্ব গঠনে তার লেখনি শক্তির উন্নতিকরন অব্যাহত রাখবেন, যা মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে সহায়ক ভুমিকা রাখবে।
বইয়ের নামঃ ডোং ডোং ১
ধরণঃ ত্রিমাত্রিক ছোট গল্প (স্মৃতি, রম্য ও মনস্তত্ত্ব)
লেখকঃ ড. এম. আল-মামুন
প্রচ্ছদঃ চারু পিন্টু
পৃষ্ঠাঃ ৯৬
প্রকাশনাঃ পূর্বা প্রকাশনী
মূল্যঃ ২১০ টাকা মাত্র