প্রখর দাবদহে অবসন্ন বিদায় মধুমাসের। বিরহ বর্ষা, বিরহ কাব্য। কিন্তু কাব্য শুষ্কতায় আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে থেমে থেমে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে আকাশ। ছপাৎ ছপ্ ছপাৎ ছপ্ মাছধরার শব্দে প্রাণ প্রাচুর্যে ভরে বর্ষা। সোনাব্যাঙের নীল কন্ঠে প্রাণ প্রাচুর্যে ভরে কাব্য। কাব্যিক রূপরেখা দানা বাঁধে মনে । বর্ষায় প্যাচপ্যাচে কর্দমাক্ত বেয়ে নাইয়র আসে কাব্য।
পাঠক কাব্যতত্ত্বের অনুসন্ধানী। কবিতায় শ্রেষ্ঠ ঋতু বর্ষা। বর্ষার আমোদ প্লাবণে পথিক। সবক’টা জানালার রুদ্ধ নিঃশ্বাসে পথিক উন্মুুক্ত। দিগম্বর ভাবনায় পথিক ভাবুক পাঠক।
আমি পাঠ করছি অতীতকে, বর্তমান বর্ষায়। বাতায়নের ভেজা পর্দা দুরন্ত বাতাসে এলোমেলো। অতীতও ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে এলোমেলো ছন্দে সিক্তপর্দায় ।
কাঁচা উঠোন। কাঁচা উঠোনে নগ্ন পায়ের নরম ছাপ। ডিঙ্গিতে করে নাইয়র এসেছে নববধু। আমার কাঁচা উঠোন হয়ে যাচ্ছে বাপের বাড়ি। শুনেছি, প্রথমে নাকি ডোঙ্গা নৌকার ব্যবহার প্রচলিত হয়। সে সময় চামড়ার নৌকার ব্যবহারও ছিল। এরপর মিশরের প্যাপিরাসের ভেলা ব্যবহার করা হতো। এরও অনেক পরে ভূমধ্যসাগরে এবং সম্ভবত আরব সাগরে পালতোলা জাহাজ চলাফেরা করত। সেও খৃষ্টপূর্ব তিন হাজার শতাব্দীর কথা। বর্তমান সময়। সে অনেক শতাব্দীর পরের কথা। নববধু ডিঙ্গিতে বাপের বাড়িতে এসেছে। যেমন রবীন্দ্রনাথ সম্পন্ন গৃহস্থটি হয়ে আরামে সন্তোষের অর্ধনিমীলিতলোচনে যে গৃহটুকুর মধ্যে বাস করছিলেন, কালিদাসের ‘মেঘ আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ হঠাৎ এসে তাঁকে সেখান হতে ঘর ছাড়া করেছিলেন। তদ্রুপ আমাকে নববধু ঘর হতে বাইরে বের করে মেঘঝরা নেংটা আকাশের নিচে ছেড়ে দিল।
কালিদাসের মেঘদূত ‘মেঘ’ আষাঢ়ের মেঘদূত হয়ে নির্বাসনে দণ্ডিত বিরহী যক্ষের মনে চৈতন্য সঞ্চারণ করেছিল এজন্য যে, প্রিয়ার খবরাখবরে একমাত্র বাহক মেঘ। আর আমার একমাত্র বাহক হল বিরহ কাব্য। এ বিরহ কাব্য বিদ্যাপতির মতো তার বিরহ কথামালা-
এ সখী হামারী দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর নাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর।
খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে রবিঠাকুরের মতো ভাবতে পারি বর্ষাকে। মেঘমালার তেমন ফাঁকা দরিদ্র চেহারা দেখ্ছিনে, বাবুদের মতো দিব্যি সজল শ্যামল টেবো টেবো নধর নন্দন ভাব। কাব্যধর্মী কথামালা আষাঢ় বা শ্রাবণ তত্ত্বে সজীবসত্ত্বার এক-একটি উপকরণে এক-একটি কবিতাÑ যা ভাবুক পাঠকের কাব্যিক চৈতন্য।
মেঘ বৃষ্টির ঘনঘটা। বর্ষণ মুখর প্রকৃতি নারীর মতোন। বর্ষা বর্ষণ, প্রবাহমান জলস্রোতে পললভূমি আকৃষ্ট করে নৃতাত্ত্বিক ও ভূতাত্ত্বিক গবেষকদের। উর্বর জমি কৃষকের উপজীব্য। গ্রাম বাংলার স্নায়ুতে অঙ্গুরোদ্গম শিহরণ জাগায়।
নারীর ভ্রুণে কবিতা ফুটে। নারীসত্তা ও নারী প্রকৃতি নৈকট্যে স্বজাত। বৃষ্টি রাতের আঁধারে এক ফালি জ্যোৎস্নার হাসিই নারী প্রেমের উদ্ভাস সজীবতার ঝিলিক।
আমি ভালোবাসি নারীকে।
নারী ভালোবাসে জল, আষাঢ়ের নিদ্রাহীন ভেকের সরব ডাক, শ্রাবণের রাতভর বৃষ্টি।
আমি ভালোবাসি নারীর গভীরতা।
নারী ভালোবাসে রাত্রির গভীরতা।
রাতের গভীরতায় কবিসত্তা। এ গভীরতায় অব্যক্ত ট্র্যাজেডি ।
আমি বুঝাতে চেয়েছি নববর্ষার নববধুকে। বর্ষা নারী রূপে বৈচিত্র্যময়ী। অশ্রুসিক্ত ফোঁটা ফোঁটা জ্বালা। আমি বোঝাতে চেয়েছি বর্ষা প্রেমের মিলন ক্ষেত্র। বর্ষাই প্রকৃত প্রেমিক য়ুগলের প্রকৃত পথ প্রদর্শক।
আমার মনে বর্ষার এখোন অযুত কবিতা। যেমন ভরে উঠেছে স্নেহময়ী আদরে বাংলা সাহিত্যে অজস্র কবিতা। বর্ষার কবি মহাকবি কালিদাস, বর্ষার কবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ক্ষণিকা কাব্যের আর্বিভাব কবিতায় রবিঠাকুর
বহু দিন হল কোন্ ফাল্গুনে
ছিনু আমি তব ভরসায়
এলে তুমি ঘন বরষায়।
অথবা,
আমার পরানে যে গান বাজবে সে গান তোমার করো সায়
আজি জল ভরা বরষায়।
আমার শৈশব, তখন বলতে শিখিনি ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘন ঘোর শিশুদের দিগি¦দিক উল্লাসিত কাগজের নৌকা কিংবা কলাগাছের ভেলায় যখন বইছিল বরিষায়।’ এখন কৈশোর মন্থন করছি। কৈশোরে ফিরে যেতে চাই। প্রিয়া সম্পর্কে অবুঝ থাকতে চাই শিশুর মতোন।
নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।
রবীন্দ্রনাথ আঁটকাতে পারেন নি ঘরে। মা’র অপলকে শাড়ি কাপড় ছিঁড়ে দাঁড়কিনা আর পুঁটিমাছ ধরতে নেমেছি জলে। কাদামাখা দেহে বাড়ি ফিরে মা’র বকুনি কী ভয়ানক! সে কথা বিলকুল ভুলে গেছি মা’র শাড়ি কাপড় ছেঁড়ার আগে। তাই শিশুর মানস আনন্দে উদ্বেলিত বেগম সুফিয়া কামালের মতো বলতে চাই
নব বর্ষায় অবগাহি জলে কভু পুলকিত মনে
গান গাহিয়াছি মল্লার রাগে বাদলের ধারাসনে।
এ তো সেদিনের ফেলে আসা সোনালি দিনগুলো। কিন্তু কোথায়, পাইনা তো ফিরে! মনেপড়ে বৃষ্টিভেজা সতেজ সকালে খেজুরগুড় নিয়ে ঠাকুরদা মুড়ি খেতে বসতেন । আমিও বসতাম। স্বভাবত খেজুরগুড়টুকু খেতাম সবার আগে। ঠাকুরদার মুড়ির বাটিতে চেয়ে চেয়ে দেখতাম আর লোভাতুর গুড় লালা আনতো জিহ্বায়। দাদু বুঝতেন। দাদু লুকোচুরির ছলে আমার বাটিতে গুড় দিতেন। আমিতো অবাক। খুব আগ্রহে জিজ্ঞাসা করতাম গুড় কোত্থেকে এলো দাদু? কালো মেঘ দেখিয়ে দাদু বলতেন ওই আকাশ থেকে। বিস্ময়ে মেঘের দিকে তাকাতাম। আর বলতাম মেঘ কত্তো ভালো। তখন ছড়ার জালে বর্ষাকে আবদ্ধ করে দাদু বলতেনÑ
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান
শিব ঠাকুরের বিয়ে হলো তিন কন্যে দান।
আজকের বর্ষায় নিজেকে খুঁজি। রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর রৌদ্র দাহে শুকায়তনু, মেঘের জলে ভিজে। অথবা, মুহম্মদ নূরুল হুদার রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি। ‘বেড়েছি’ বলেই খুঁজি বৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য। বৃষ্টি ভেজার নৈসর্গিক রূপে আপ্লুত কালিদাস। তিনি গেয়েছেনÑ
কশ্চিৎকান্তা বিরহ গুরুনা স্বাধিকার প্রমত্তঃ
শাপেনাস্তং গমিত মহিমা বর্ষ ভোগ্যেন ভত্তুঃ
স্নিগ্ধছায়া তরুষু বসতিং রাগগির্ষ শ্রমেষু।
বর্ষাকে নিয়ে বিহারী প্রবচনে প্রচলিত‘ অরদরা ধান, পুনরসে পৈয়া/ গেল কিসান, জে রোয়ে চিরৈয়া।’ অর্থ হচ্ছে আষাঢ়ের ১০-২১ তারিখ পর্যন্ত ধান রোপণ করে তবে প্রচুর জন্মে। পরবর্তী শ্রাবণ পর্যন্ত রোপণ করলে ছোট শীষ আসে। তারপর রোপন করলে কিছুই হয়না।
আবার বর্ষার অবসরে
এখন বিকেল শ্রাবণ মাসের আকাশটা আজনীল,
আমরা কজন পেরিয়ে এলাম ঠাকুর গাঁয়ের বিল।
শৈল্পিক গহনে নদী, জল, ঘাট, মানুষ এবং প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র। তাই মনের যত্তোসব বোঝাপড়া প্রকৃতির সাথে। সমাজের সাথে। চালহীন মাটির দেয়াল, জীর্ণ খড়োঘরে টাপুর টুপুর আষাঢ়-শ্রাবণে রিমঝিম বৃষ্টির নিষ্ঠুর রমান্টিকতা। অথচ ভূমিকা নেই, পটভূমি নেই। কবিতা চলে সরস পথে। কাব্য চলে বাস্তবচিত্রে সংস্কৃতির অঙ্গনে। বর্ষার চোখে কবিতা কর্মিষ্ণু গ্রাম্য হালহকিকতে কর্মবিমুখতার ঠাঁই দেয়না। ভেসে তুলে ছিন্ন জনপদের সুস্পষ্ট চিত্রাবলি। যেমন তুলে ধরেছেন রবিঠাকুর। তাঁর দর্শনে
এক একটি কুঁড়েঘর স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার চারপাশের প্রাঙ্গণ জলমগ্ন।...
জল যেখানে সুবিধা পাচ্ছে প্রবেশ করছে স্থলের এমন পরাভব আর কোথাও দেখা যায়না। আর একটু বাড়লেই ঘরের ভেতরে জল প্রবেশ করবে।
...যখন গ্রামের চারিদিকের জঙ্গলগুলো জলেডুবে পাতালতা গুল্ম পচতে থাকে, গোয়াল ঘর ও লোকালয়ের বিবিধ আবর্জনা চারিদিকে ভেসে বেড়ায়, পাট পচানীর গন্ধে বাতাস ভারাক্রান্ত, উলঙ্গ পেট-মোটা পা-সরু রুগ্ন ছেলে-মেয়েরা যেখানে সেখানে জলে কাদায় মাখামাখি ঝাঁপাঝাঁপি করতে থাকে, মশার ঝাঁক স্থির জলের উপর একটি বাষ্পস্তরের মতো ঝাঁক বেঁধে বেড়ায়, গৃহস্থের মেয়েরা ভিজে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বাদলার ঠান্ডা হাওয়ায় বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে জল ঠেলে ঠেলে সহিষ্ণু জন্তুর মতো ঘরকন্যার নিত্য কর্ম করে যায়Ñ তখন সে দৃশ্য কোনো মতেই ভালো লাগেনা। ঘরে ঘরে বাতে ধরেছে, পা ফুলছে, জ্বরে ধরছে, পিলেওয়ালা ছেলেরা অবিশ্রাম কাঁদছে এত অবহেলা অস্বাস্থ্য অসৌন্দর্য দরিদ্র মানুষের বাসস্থানে কি এক মুহূর্ত সহ্য হয়। ...প্রকৃতি উপদ্রব করে তাও সয়ে থাকি, রাজা উপদ্রব করে তাও সই, শাস্ত্র চিরদিন ধরে যে-সকল উপদ্রব করে আসছে তার বিরুদ্ধে কথাটি তুলতে সাহস হয়না।
বর্ষাকে নিয়ে অশেষ ভাবনা। ভাবনায় নাড়া দেয় টিনের চালের উপর পতিত শব্দের দ্যুতি। বারান্দায় পানের বাটায় পোক্ত হচ্ছে আষাঢ়ে গপ্পো। বৃষ্টির ছন্দগীতে ভেসে আসে
দুধে জলে বিশ মন করিল সে পান
আশিমন খানা পুনঃ খায় সোনাভান।
বাপের বাড়ি বেড়াতে এসে বোন বৃদ্ধা মাকে উপহার দিচ্ছে নকশা কাঁথা। কাঁথায় সুচের অজস্র ঢেউ ঢেউ-এ ঢেউ-এ আষাঢ়ে গপ্পো। এক একটি গপ্পো বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণ।
অঢেল অবসরে বর্ষাকে নিয়ে গভীরে প্রবেশ। দুঃচিন্তা মুক্ত অবসর। দূষণ মুক্ত পরিবেশে দুরন্ত বাতাসে সবুজের হাতছানি। কিছুটা সময় হলেও ছিনতাই থেকে মুক্ত। মুক্ত যানজট থেকে । নিতান্তই মন ভরে উঠেছে এজন্য যে, আমার বিরহ কাব্য রচয়িতা নাইয়র আসা নববধুর মতো প্রকৃতি চলেছে স্বকীয়তায় পা টিপে টিপে।