প্রবন্ধকার : সারওয়ার-ই আলম
মানুষ জীবনের প্রয়োজনে ভাষা ব্যবহার করে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে। ব্যক্তি কী বলছে, কিভাবে বলছে, প্রমিত বাংলায় বলছে না বিদেশী শব্দ মিশিয়ে বলছে- এ নিয়ে তার খুব একটা মাথাব্যথা থাকেনা যদি না স্বীয় মেধা ও প্রজ্ঞার গুণে মাতৃভাষা সংরক্ষণে তার সচেতনতা ও আগ্রহ থাকে। রাষ্ট্র আইন করে নাগরিকদেরকে ভাষার প্রতি যত্নশীল হতে বাধ্য করতে পারে না; এটি শোভনীয়ও নয়। কিন্তু সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। মাতৃভাষার সঠিক চর্চা ও পরিচর্যায় তাদের ভূমিকা যেহেতু ব্যাপক, সেহেতু প্রতিবেদন তৈরিতে তারা কিভাবে বাংলা লিখছে এবং অপ্রয়োজনে ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করছে কিনা সে বিষয়ে সতর্ক থাকাটা অপরিহার্য। বাংলা সংবাদপত্রে কর্মরত সাংবাদিকদের এ সত্যটি অনুধাবন করতে হবে যে, মানুষ তাদের কাছ থেকে শুধু সংবাদই জানে না, ভাষাও শিখে থাকে।খবরের কাগজের পাঠকের ক্ষেত্রে যা হয় তা হলো- একটি শব্দ বার বার পড়তে পড়তে তার মস্তিষ্কে এ শব্দটি স্থিত হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে দৈনন্দিন জীবনের কোথাও না কোথাও অবচেতনভাবেই সে ব্যবহার করে সে শব্দটি। এভাবেই প্রথাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাহিরে সংবাদপত্র হয়ে উঠে একটি জনগৌষ্ঠির সঠিকভাবে ভাষা শেখার এক প্রকৃষ্ট মাধ্যম।
দু:খজনক হলেও সত্য যে আমাদের সংবাদপত্রগুলো মাতৃভাষা চর্চা ও পরিচর্যায় কাঙ্খিত মাত্রায় দায়িত্ব পালন করছে বলে প্রতীয়মান হয় না। দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ইত্তেফাক হাতে নিলে আমরা দেখি এ পত্রিকাটি যে সকল প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের নাম প্রকাশ করে না সেগুলোতে লিখে ‘ ইত্তেফাক রিপোর্ট’। জ্ঞাতসারে এ কাজটি তারা করছে বছরের পর বছর। প্রশ্ন হলো- যেখানে ‘প্রতিবেদন’র মতো একটি সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী শব্দ উপস্থিত সেখানে কেন আমরা ‘রিপোর্ট’ শব্দটি ব্যবহার করবো? এর মধ্যে দিয়ে কি বিশেষ অাভিজাত্য প্রকাশ পায়! না এটি পরম্পরার দুর্বল অযুহাত! একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমার কাছে মনে হয়, এটি নিতান্তই মাতৃভাষার প্রতি তাদের ভালবাসার অপ্রতুলতা। শুধু ইত্তেফাকই বা কেন, এ ব্রিটেনেও সাপ্তাহিক জনমতকে ‘জনমত রিপোর্ট’ সুরমাকে ‘ সুরমা রিপোর্ট’ এবং পত্রিকাকে ‘ পত্রিকা রিপোর্ট’ লিখতে দেখি। এটি দু:খজনক। ‘রিপোর্ট’ শব্দের স্থলে ‘প্রতিবেদন’ লিখলে পাঠকদের বুঝতে বিন্দুমাত্রও অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, অনেক খেটেখুটে তৈরি করা এটি তাদেরই প্রতিবেদন। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য কিংবা পরম্পরার অযুহাতে এ অপ্রয়োজন-ইংরেজীপ্রীতি যতো বেশী চর্চিত হবে, পাঠকের কাছে তাদের ভাষাপ্রেম ও ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা ততই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
ব্রিটেন’র বাংলা সংবাদপত্রগুলোর দাবী পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে তাদেরকে অনেক সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করতে হয়। অনেকক্ষেত্রে হয়তো তাদের এ দাবী সঠিক; কিন্তু আমরা যখন দেখি সাপ্তাহিক দেশ ছ’কলাম জুড়ে শীর্ষ শিরোনামে লিখছে- ‘এমাদ-জুবায়ের-মুরাদ অ্যালায়েন্সের নিরংকুশ জয়’, তখন পাঠকের মনে প্রশ্ন তৈরী হওয়া স্বাভাবিক এই ‘অ্যালায়েন্স’ শব্দটি কতটা পাঠকের প্রয়োজনে আর কতটা ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব প্রসূত। এ প্রতিবেদনে পত্রিকাটি প্রেসক্লাব’র শীর্ষ পদটিকে আখ্যায়িত করছেন বাংলায়, সভাপতি হিসেবে কিন্তু সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ পদদুটিকে উল্লেখ করছেন ইংরেজীতে যথাক্রমে জেনারেল সেক্রটারী ও ট্রেজারার। এটি কেন? ২৫ অক্টোবরের সাপ্তাহিক বাংলা পোস্ট’র একটি শিরোনাম ছিল এরকম: ‘সলিসিটরদের কোয়ালিফিকেশন ও ফিস প্রকাশ করতে হবে’। এ শিরোনামে যোগ্যতা লিখলে কী ক্ষতি হতো এ নিয়ে পত্রিকাটির অবশ্যই নিজস্ব ব্যাখা থাকবে কিন্তু পাঠক হিসেবে কখনোই মনে হয়নি এটি প্রাসঙ্গিক ছিল। নৈশভোজ শব্দটি এখন আর ব্রিটেন’র বাংলা কাগজে চোখে পড়ে না, লেখা হয় ‘ডিনার’, নিবন্ধন হয়ে যায় ‘রেজিস্টার’, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে যায় ‘স্যোসাল মিডিয়া’ ইত্যাদি।এ তালিকা আরো দীর্ঘ করা সম্ভব।
দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো মোবাইল ফোন’র বাংলা প্রবর্তন করেছে ‘ মুঠোফোন’।কী দুর্দান্ত কাজ রে বাবা! ব্যাপারটা অনেকটা ‘আসল ঘরে মশাল নেই, ঢেঁকি ঘরে চাঁদোয়া’র মতো! অসংখ্য প্রচলিত বাংলা শব্দের ব্যবহারে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে বহুল প্রচলিত মোবাইল ফোন নিয়ে তাদের মাথাব্যথার শেষ নেই। তাও যদি হতো একটি যৌক্তিক প্রতিশব্দ! ‘মোবাইল’- এর বাংলা কিভাবে ‘মুঠো’ হলো, এ নিয়ে প্রথমআলোর কোন জবাবদিহিতা নেই। প্রশ্ন হলো- একটি সংবাদপত্রের কি সে এখতিয়ার আছে যে তারা একটি বিদেশী শব্দ নিজ্স্ব ভাষায় আত্মীকরণ করতে পারবে নিজেদের ইচ্ছেমতো! সৃজনশীলতার দোহাই দিয়ে নিশ্চয় পার পাওয়া যাবে না, কারণ মুঠোফোন মোটেই একটি সৃজনশীল শব্দ নয়, বরং এটি একটি ভুল শব্দ যা কিনা অর্থ বিভ্রাট দোষে দুষ্ট।
অবাক হতে হয়, যখন দেখি হাকিম’র মতো সুন্দর একটি প্রমিত শব্দ থাকার পরও প্রথমআলো ব্যবহার করে ইংরেজী ‘ ম্যাজিস্ট্রেট’ শব্দটি। মুদ্রণ-এর মতো সুন্দর বাংলা শব্দ যেখানে হাতের কাছেই, সেখানে তাদের পছন্দ ইংরেজী ‘ প্রিন্ট’ শব্দটি, তারা বলে ‘প্রিন্ট সংস্করণ’। প্রথম আলো অপ্রয়োজনে মোবাইল ফোন’র বাংলার প্রচলন করে অথচ নির্বাচনী কর্মকর্তাকে ‘ রিটার্ণিং কর্মকর্তা’ বলতে তাদের কোন আপত্তি নেই। চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়গুলোকে ইচ্ছে করলেই যেখানে বাংলায় লিখা যায় সেখানে তাদের পছন্দ ‘মেডিকেল কলেজ’। প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে তারা কোলন দিয়ে সেঁটে দেয় ‘সিইসি’।অথচ ‘প্রনিক’ কিন্তু প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা’র সুন্দর ও যৌক্তিক সংক্ষিপ্তরুপ হতে পারতো।
ইংরেজী পত্রিকা ‘ডেইলি স্টার’ সম্প্রতি অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করছে। ১৫ ফেব্রুয়ারীর সংস্করণে জামায়াতে ইসলামকে নিয়ে প্রতিবেদনে লিখেছে ‘ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল’র পদত্যাগ’। কী অদ্ভূত শব্দবন্ধ! সেক্রেটারী জেনারেলই যদি বলবো তাহলে কেন বাংলা সহকারী শব্দটিকে ডেকে এনে এই মানহানি! আরেকটি জাতীয় দৈনিক সমকাল এখন আর সেতু লেখে না, তারা লিখে ব্রীজ। ডাকঘর লেখে না, লিখে পোস্ট অফিস।
ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক’র ১৬ ফেব্রুয়ারীর সংখ্যাটি পড়ছিলাম। অপ্রয়োজনে অসংখ্য ইংরেজী শব্দের ছড়াছড়ি। নির্বাহী হাকিমকে তারা লিখছে ‘নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রট’। নিন্দুকেরা মজা করে একটি শব্দ বলে- বাংলিশ। এ যেন ঠিক তাই! ইংরেজী ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটির সাথে বাংলা নির্বাহী শব্দটি গেঁথে কী সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে চেয়েছে কাগজটি তা বোধগম্য নয়। এরকম একটি জঘণ্য ভুল কি কারোই চোখে পড়লো না? একই তারিখে আরেকটি হাস্যকর বাক্য তারা লিখেছে। তা হলো- উপজেলা নির্বাহী অফিসার’। অফিসার’র বাংলা যে কর্মকর্তা তা কি ইত্তেফাক ভুলতে বসেছে নাকি এটি স্রেফ একটি রসিকতা পাঠকদের সাথে! অফিসার এবং অফিস- এ শব্দগুলোর প্রতি ইত্তেফাকের দুর্বলতা প্রবল। যে কারণে স্থানীয় কোন প্রতিনিধির কার্যালয়কে তারা ‘কার্যালয়’ বলতে নারাজ; তারা বলে ‘অফিস’, যেমন: বরিশাল অফিস। তাদের প্রতিবেদকেরা এখন আর প্রতিবেদন লিখে না, তারা লিখে-‘এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত.......’।
ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে এখন আর নলকূপের নল দিয়ে গ্যাস নির্গত হয় না, তা নির্গত হয় ‘পাইপ’ দিয়ে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তারা এখন ‘অফিসার ইন চার্জ’ লিখতেই বেশী স্বচ্ছন্দ বোধ করে। একই কারণে হয়তো বছরের পর বছর লিখে আসছে ‘ ইত্তেফাক গ্রুপ অব পাবলিকেশন্স’, অথচ একটু আন্তরিক হলেই এর সুন্দর বাংলাটি এখানে এভাবে শোভা পেতে পারতো যে- ইত্তেফাক প্রকাশনা সংস্থা। না, শুনতেতো মোটেই শ্রুতিকটু লাগছে না, বরং এর মধ্যদিয়ে নিজস্ব ভাষার প্রতি একটা মায়ার স্ফূরণ প্রকাশ পাচ্ছে, প্রকাশ পাচ্ছে ভাষার প্রতি ভালবাসা। ছোট ছোট এ ভালবাসাগুলো আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার জন্য আজই বড়ই জরুরী। কারণ সংবাদপত্রের হাত ধরে ভাষা এগিয়ে যায় বহুদূর। শিক্ষিত প্রজন্ম সংবাদপত্র থেকে শব্দ ও শব্দের বহুবিধ ব্যবহার শিখে ঋদ্ধ হয়। একটি জাতিগৌষ্ঠির ভাষাগত ঐশ্বর্য নির্মাণে এ ঋদ্ধতা শুধু প্রয়োজনই নয় অপরিহার্যও বটে।সংবাদপত্রে ভাব প্রকাশের প্রয়োজনে ইংরেজী কতটা গ্রহণ করবো আর কতটা বর্জন করবো- সম্পাদকদের এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আজ সময়ের দাবী।