বাগান । জেবুননেসা হেলেন
বাগান । জেবুননেসা হেলেন

 

সৌম্য টিভি দেখছিলো।সেভলনের বিজ্ঞাপন হচ্ছে,করোনা ভাইরাস নিয়ে বলছে, হাত ধোয়ার কথা।

কি এক রোগ এলো! ঘরবন্দী সবাই।মনে পড়ে গেলো,পৃথিবীর ভারসাম্য নিয়ে বিজ্ঞান বইয়ের সেই থিউরি, প্রকৃতি তার প্রয়োজনে অনেক কিছুই ঝেরে ফেলে।যেমন,সুন্দর বনে বাঘ বাড়লে হরিণ কমে।হরিণ বাড়লে গাছপালা কমে।বাঘ কমলে হরিণ বেড়ে যায়।

পৃথিবীতে বড্ড বেশি মানুষ বেড়ে গেছে।তাই কি প্রকৃতি ভারসাম্য রক্ষার কাজে নেমেছে? কি জানি! ওর ছোট মাথায় এতো কিছু ধরে না।শুধু ভয় আতংক বাসা বাঁধে মনে মনে।মাকে বুঝতে দেয় না সে যে ভয় পাচ্ছে।

 

 আজ বেশ অনেকদিন ঘরবন্দী সে।বাবা কুয়েত থেকে ফিরতে পারে নি। প্রায়ই ভিডিও কলে কথা হয়।বাবার কড়া নিষেধ বাড়ি থেকে যেনো বের না হয়।

মা কয়দিন নিজেদের ফার্মের দুধ আর বাড়ির পেছনের সবজি দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছেন।মায়ের খুব সবজি বাগান করার শখ।ওদের গোয়ালে ছোট বড় মিলিয়ে মোট সাতটা গরু আছে।

সব বন্ধ।মা প্রথম দিকে একদিন বাজারেও গেছিলেন,তেল আনতে।তাতেই চলছে।

ঘর থেকে মা বা সে তেমন বের হয় না।কলেজ বন্ধ থাকায় সারাদিন টিভিতেই থাকে।বাড়ির পেছোনের সবজি ক্ষেতে ভোরে পানি দেয়া আর কিছুটা নিড়ানি দেয়া।

 আর কলা বাগানে মরা ডালপালা ছেটে দেয়া এইগুলো ঘণ্টাখানেক সময়ের কাজ।

বাকি সবই মা করেন।

 

- সৌম্য?

- হুম। একটু বাজারে যা।তোর ওই গ্লোবস আর মাস্ক পরে যা।

- বাজারে কেনো মা? বাবা জানলে,বকবে খুব।

- জানাতে হবে না।তুই যাবি আর  পাঁচ কেজি নুন কিনবি, চলে আসবি।

- এতো নুন দিয়ে কি  হবে?

- গরুর চাড়িতে না দিলে ওরা কি কিছু খায়? আর ঘরের নুনও শেষ।যা বাজান, সাইকেলটা নিয়ে যা।

অনিচ্ছা সত্যেও সৌম্য এই সন্ধ্যা রাতে সাইকেলটা নিয়ে,টায়ার টিপে পরীক্ষা করে, রওনা দেয় বাজারে।

বেশ কিছুটা আসার পর টর্চের আলোতে দেখে, বাঁধের পাশের রাস্তার অনেক অংশ ভেঙে গেছে।মনটা কেমন  হু হু করে ওঠে।গতবছরও এমন হয়েছিলো।

অনেক ক্ষতি হয়েছিলো ওদের গ্রামের সবার।কিন্তু রাস্তাটা সেভাবে ঠিক করে নি চেয়ারম্যান। ওর লোকজন টাকা মেরে কোনো রকম তালি দিয়ে রাস্তা ঠিক করেছিলো।ভাবতে ভাবতে সে বাজারে চলে আসে।এখন আকাশটা বেশ পরিস্কার।বড় একটা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে।আজ কি পূর্নিমা?

নুন কিনে আবার রওনা দেয় সে।বাজারে অনেক লোক।চা খাচ্ছে,গল্প করছে।বন্ধু সাঈদের বাবাকেও দেখলো।শুনেছে কয়দিন ধরেই উনার জ্বর,ঠান্ডা,কাশি।তবু তার এই শরিরে বাজারে যাওয়াই লাগবে!

 

মনে মনে বিরক্ত হয় সে।পাশের বাড়িটা বন্ধু সাঈদদের।সাজানো বাগানই বলা চলে।দাদার রেখে যাওয়া অনেক সম্পদ।সাত ভাইবোনের সবাই গোয়াড় টাইপের।কিছুই মানে না ওরা।বাবার স্বভাবই পেয়েছে সবাই।

 

বাঁধের যে জায়গাটা ভাঙছিলো দেখে গেছে,সেখানটায় আসতেই দেখে আরো কিছুটা ভেঙেছে বাঁধটাই পরে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। ওর মনে কাঁটার মত খচখচ করে আশংকা। আজই না ভেঙে যায়!

পূর্নিমার চাঁদের এতো উজ্জ্বল আলোও ওর কাছে ম্লান লাগে।মুখটা তিতকুটে হয়ে ওঠে।

এই করোনাকালীন সময়ে বাঁধ ভেঙে গেলে, মরার উপর খাড়া ঘা হবে।

বাড়িতে ঢুকতেই মা বলেন,কাপড় চোপড় কলতলায় রেখে দেখ বালতিতে গরম পানি দিয়েছি,গোসল করে ঘরে ঢোক।

গোসল করতে করতে সে মাকে বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে জানায়।

মা আৎকে ওঠেন।

কতগুলো ইট জড়ো করতে থাকেন।সৌম্য এগিয়ে আসতেই হৈ হৈ করে ওঠেন,আগে গোসল কর বাবা,আগে গোসল কর।

মায়ের এই সাবধানী স্বভাব ওর ভালো লাগে।

 

তখনও ভোর হয় নি। হু হু করে বাঁধ ভাঙা পানি ঘরে ঢুকতে থাকে।মাথার কাছে রাখা টর্চ জ্বালায় সৌম্য।কখন বিদ্যুৎ চলে গেছে জানে না।মাকে ডাকে।মাও হুড়মুড় করে উঠে বসেন।সন্ধ্যায় জড়ো করা ইটগুলো দিয়ে খাট দু'টো উঁচু করে দু'জন। খাটে বসে জানালা খুলে দেখে তাদের শখের কলা বাগানে পানি ঢুকে মাথা পর্যন্ত ডুবে গেছে গাছগুলো। ১০/১২ টা গাছে থোড় দেখা যাচ্ছে এখনও। সবজি ক্ষেত পানির তলে।

 

 চাঁদ ডুবে গেছে।সূর্যের আলো তখনও ফোটে নি।সবে ফর্সা হচ্ছে প্রকৃতি। মা ছেলে তখনও নিথর বসে খাটে,চেয়ে আছে বাগানের দিকে।পাশের সাঈদদের বাড়ির দিক থেকে এক সঙে অনেকজনের কান্নার শব্দ ভেসে আসতে থাকে...


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান