আমি তখন খুবই ছোট, ন’বছরে পা দিয়েছি মাত্র। রাজনীতি, অর্থনীতি, মুক্তিযুদ্ধ এই সব বুঝবার বয়স আমার ছিল না। আমি তা বুঝিও নি। বাড়ির পাশে মক্তব ঘর। সামনে একটা খোলা মাঠ। মাঠের পাশ ছুঁয়ে চলে গেছে থানা সদর বিয়ানীবাজারের সাথে সংযোগ রক্ষাকারী সড়ক। সেই মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতাম আমরা পাড়ার অনেক ছেলেমেয়ে। মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন চলার সময়কার ঘঠনা এটা। আমি তখন নিতান্তই বালক, যথারীতি মক্তবে পাঠ গ্রহণ করছি। সেই সময়ের এক সোনালী সকালে নির্ধারিত সময়ে মক্তব ছুটি হয়ে গেলে, ঘরে গিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে, পাড়ার সকল ছেলেমেয়েরা মিলে পাঠশালা যাচ্ছি। যাত্রাপথে মক্তবের মাঠে গিয়ে দেখি, ওখানে গ্রামবাসীরা এসে জড়ো হচ্ছেন। উপস্থিত জনসমষ্টির মধ্যে সেখানে তখন তরুণরাই সংখ্যায় বেশী ছিলো। দেখতে দেখতে ভরে গেলো মাঠ। মাঝে মাঝে শ্লোগান উঠছে ‘ জয় বাংলা’ ‘ জয় বঙ্গবন্ধু’ ‘ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সমবেত প্রায় সবার হাতেই ছিলো দা, কুড়াল, শাবল, খন্তা, সটা, ঝাটা, লাঠি, বল্লম আর ছিলো পাঁচ সাতটা পাখি শিকারের বন্দুক। কন্ঠে ছিলো গগণ বিদারী সুর ‘ দা কুড়াল খন্তা মুক্তির পন্থা’। মিছিলে মিছিলে সে দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলো মক্তবের মাঠ এবং চারিধার । আমি সে দিন কিসের প্রবল টানে বই খাতা ফেলে, বাঁশের বেড়া থেকে একখানা বাঁশ ( গড়ছি) হাতে নিয়ে যোগ দিয়েছিলাম মানুষের ভীড়ে। শ্লোগান দিতে দিতে সামনের দিকে মিছিল এগোচ্ছে আমিও ধাবিত প্রবাহিত প্রকম্পিত মিছিলের সুরে ও শব্দে। সময় সময় মিছিল বড় হতে থাকলো। এক সময় বিশাল মিছিলটি গিয়ে পৌছিল বিয়ানীবাজার সদরে। সে দিন নেতৃত্বাধীন তরুণদের মধ্যে যাদের মুখখানা সমুজ্জ্ব হয়ে আজও চোখ ভরে ভেসে ভেসে উঠছে তারা ছিলেন, আতিকুল হোসেন ফণি, খলিল ডাক্তার, আবদুল হামিদ, আবদুল জলিল, আবদুস শুক্কুর, মতিউর রহমান, আতিকুর রহমান, মাহতাব উদ্দিন, নিজাম উদ্দিন প্রমুখ। ওরা সবাই, মা-মাটি আর মানুষকে রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এবং স্বাধীনতা আনবার অগ্নিশপথ নিয়ে সে দিন আরো লক্ষ লক্ষ বাঙালীর মতো হাতে অস্ত্র নিয়েছিলো। ওরা ছিলো মুক্তিযোদ্ধা। নয়টি মাস যুদ্ধ শেষে যেদিন কাক্সিক্ষত বিজয় আসলো, ওদের কেউ কেউ বিজয়ের সাথে সে দিন ঘরে ফিরেও আসলো, আবার কেউ কেউ আর ফিরে আসলো না এই বাংলার এই পথে, প্রান্তরে, অথবা নিজ ঘরে প্রতিক্ষিত মায়ের বা প্রিয় পরিজনের বুকে।
বিয়ানীবাজারের বুক চিরে মিছিল যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে। দক্ষিণ বাজার প্রদক্ষিণ করে মিছিল আবার ফিরে আসছে থানা টিলার দিকে। সহস্র কন্ঠের সাথে কন্ঠ মিলাচ্ছি আমি। কিন্তু কেন মিছিল, কী দাবি নিয়ে যাচ্ছেন মিছিলকারীরা, তার কিছুই সে দিন আমি বুঝতে পারি নি। কী এক অজানা অব্যক্ত আবেগ উদ্দীপনা আর অসম্ভব সাহস বুকে নিয়ে কেবল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বলতে বলতে এগোচ্ছিলাম সামনের দিকে। সাথে সাথে এও মনে পড়লো, ক’মাস আগে ঠিক এমনি ভাবে আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনী মিছিলে যোগ দেবার ফলে পথ হারিয়ে ভয়ে-আতঙ্কে কী কান্না যে করে ছিলাম! সেই স্মৃতির কথা। সেদিন মুরাগঞ্জ পর্যন্ত যাওয়ার পর মিছিল থেকে আমি হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি । তারপর একা বাড়ি আসতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলি। এক পর্যায়ে আমি আসলেই অসহায় হয়ে পড়ি। অবশেষে একজন সুহৃদ লোক আমাকে বিয়ানীবাজার এনে আমার বড় ভাইয়ের দোকানে নিয়ে এসে তাঁর হাতে তুলে দেন। আর আজ আমি বিয়ানীবাজার পর্যন্ত যেতেই আমার পথ আটকে দেন আমার মেজো ভাই। এবং বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
আমার বাবা একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলো তাঁর দৃঢ় অবস্থান। তাঁকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতাম, কেন পাকিস্তানি মিলিটারিরা আমাদের লোকজনকে হত্যা করছে, আর কেনই-বা আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, এই সবের উত্তরে বাবা খুব সহজবোধ্য ভাষায় বলতেন, ওরা আমাদের সম্পদ লুট করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। আমাদেরকে চাকরি দেয় না। আমাদের পাওনা অধিকারও দেয় না। ওরা আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলতে দিতে চায় না। কিন্তু এ সবের কিছুই আমি তখন ভাল করে বুঝে উঠতাম না। তবে, এইটুকু বুঝতাম যে, তারা চরম অন্যায় করছে। তাদেরকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। তার জন্যে যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আমাদেরকে জয়ী হতেই হবে।
যুদ্ধদিনের কথা স্মরণ হলেই মনে পড়ে যায় অনেক গুলো ভয়ানক দিন-রাত্রির কথা। আর আজকে যে দিনটির কথা স্মরণ হচ্ছে , তারিখ ঠিক মনে নেই, তবে খোজ খবর নিয়ে যে টুকু পেয়েছি তা হচ্ছে, ১৯৭১ এর ৮ই জুন, রোজ মঙ্গলবার। খুব করে মনে আছে, উজ্জ্বল দুপুর তখন মধ্যাহ্নের মিলন মোহনায় কেবল ছুঁই ছুঁই করছে, এমন সময় আমি এবং আমার ভাই কুতুব উদ্দিন, আমরা দু’জন মিলে পেলুন জাল নিয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা লোলা নদীতে মাছ ধরছিলাম চুড়–ইভাতি জন্যে। মনে আছে পুঁটি-টেংরা-কই-শিং পাঁচমিশালী অনেক মাছ সেদিন আমরা ধরেছিলাম। হঠাৎ শুনি মানুষের কোলাহল। তীরে তাকাতেই দেখি মানুষের স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে পশ্চিম দিকে। নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে পালাচ্ছে সবাই! পালাচ্ছে পুরো গ্রামবাসী! আমাদের বাড়ির লোকজন, পাড়ার সবাই, সবাই পালাচ্ছে, প্রাণের ভয়ে প্রায় উদোম দেহে! পাগল প্রায় ছুটছেন বাড়ির কর্তা, তার পিছু ছুটছেন পুত্র-কন্যা-জায়া-ভাই-ভগ্নি সবাই, সবাই ছুটছেন, কোথায় ছুটছেন? যাবেন বা কোথায়? এ সবের প্রশ্ন করবার সময় যেমন কারো হাতে নেই, তেমনি সময় নেই নিজেকেও জিজ্ঞেস করবার। ভেতর থেকে কেবল তাগিদ পাচ্ছে, পূর্ব দিক থেকে দাওয়া খাচ্ছে প্রান বাঁচাতে পশ্চিম দিকে পালাতে হচ্ছে, তাই মানুষজন পালাচ্ছে। এই ছিলো সে দিনের তখনকার দৃশ্য! সে এক মর্মবিদারী দৃশ্য!
আমরা দু’টি ভাই তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়! হঠাৎ কানে ভেসে এলো পালাও পালাও চিৎকার। সমস্বরে অনেকেই বলছেন ‘ পাঞ্জাবি আসছে-পাঞ্জাবি আসছে’, ‘পালিয়ে যাও-পালিয়ে যাও’, ‘মহিলাদেরকে বাড়ি থেকে সরাও’। এবারে আর বুঝতে বাকি থাকলো না কিছুই। কেননা, পঁচিশে মার্চের রাতে যুদ্ধ বাঁধার পর থেকেই শুনে আসছি, পাঞ্জাবিরা ( পশ্চিম পাকিস্তানি হায়না সেনারা) মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে, নারীদেরকে ধরে ধরে ধর্ষণ করছে, এসব শুনতে শুনতে শিশু মনেও ওদের তান্ডবের একটি রূপরেখা মোটামুটি এঁকে ফেলেছিলাম। তাই ‘পালাও-পালাও’ শুনামাত্র, হায় হায় চিৎকার করতে করতে নদীর পাড়েই পেলোন জাল আর মাছগুলি ছুঁড়ে ফেলে বাড়ি অভিমুখে ছুটে আসছিলাম। এ দৌড় ছিলো আজরাইলের হাত থেকে রক্ষার দৌড়! বাড়ি পৌঁছা মাত্রই শুনলাম আগ্নেয়াস্ত্রের বিকট শব্দ। মেশিনগান আর স্টেইনগানের বিকট গুলিবর্ষণ এতো কাছে থেকে জীবনে এই প্রথম শুনলাম। ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখলাম আমার বাবাও অস্থির প্রায়! কী করবেন যেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি তখন একটি বড় হাড়িতে গরুর মাংশ রান্না করছিলেন ( উল্লেখ্য সত্তরের শেষের দিকে আমাদের মা মারা যান, সৎ মা ছিলেন আমাদের সংসারের জন্যে একেবারে নতুন তাই বাবাই আমাদেরকে রান্ন-বান্নার কাজে প্রায় সময় সাহায্য করতেন।) হঠাৎ করে তিনি উনুনে ভিতর পানি ঢেলে দিয়ে হাতের কাছে কাপড়-চোপড় টাকা-কড়ি যা পেলেন তা হাতে নিয়ে ‘ চলো চলো পালাই পালাই’ বলে পশ্চিম দিকে ছুটতে থাকলেন এবং আমরাও তিনির পিছু পিছু অনুসরণ করতে থাকলাম।
পশ্চিম দিকে পালানোর কারণ, বিয়ানীবাজার সদর থানার অবস্থান হচ্ছে আমাদের বাড়ির পূর্বদিকে। সুতরাং আমাদেরকে পালাতে হচ্ছে পশ্চিম দিকে। কারণ পাঞ্জাবিরা বিয়ানীবাজার ঢুকে পড়েছে এবং সাথে সাথে থানাটিলা ও ডাকবাংলোয় উঠে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে। মেশিন গানের অভিশ্রান্ত গুলি মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে, এক এক সময় মনে হয়েছে এই বুঝি পিঠে বিধে বুক বিদীর্ণ হয়ে গেলো। তবুও কেবল ছুটছি সম্মুখ পানে। লোলা নদী পার হয়ে সামনের বিশাল মাঠ আমাদের পার হতে হবে। ঠোঁটে-মুখে পানি নেই, বিশুষ্ক কন্ঠনালী, ভয়ে ত্রাসে তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে ছাতি। এমতাবস্থায় হঠাৎ বাবার হাত ছেড়ে আমি হারিয়ে গেলাম! হারিয়ে গেলাম পলায়নপর বিশাল জনসমুদ্রে মাঝে। বাবা ভাই আমার জন্যে হতাশ হয়ে কেঁদে কেঁদে ব্যাকুল হয়ে খূঁজছেন। আমিও পাগলের মতো কাঁদছি আর হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে তাদেরকে খুঁজছি। সে এক নির্মম হৃদয়বিদারক দৃশ্য! ছোখ দিয়ে এমন দৃশ্য না দেখলে কেউই শতাংশও বুঝবেন না, বুঝানোও যাবে না। আমার হাতে ছিলো একটি ‘ সনি ব্রান্ডের ফাইভ বেন্ড রেডিও’ ওটা ছিলো আমার বড় ভাইয়ের একান্ত প্রিয় বস্তু। আমারও প্রিয় ছিলো, কেননা, গান যে শুনি। পালানোর সময় বড় ভাই বাড়ি ছিলেন না বলেই হয়তো আমি ওটা হাতে নিয়ে ছুটে গিয়ে ছিলাম। কিন্তু এই রেডিও এমন দুঃসময়ে আমার জন্যে বাড়তি ঝামেলা হয়ে যাবে তাতো আমার মাথায় আগে আসেনি। ডান হাতে শক্ত করে রেডিওটি ধরেছি পরনে হাফপেন্ট ছিলো আর লন্ডন থেকে আমার ছোট মামার দেওয়া কেরোলিন এর হাফ সার্টটি কোমরে প্যাঁচ দিয়ে প্রাণপণে জনসমুদ্রের প্রবাহিত স্রোতে আমিও ছুটছি। এমন পরিস্থিতির সময় কিছু লোক আমাকে তিরষ্কারের সুরে বলতে লাগলো, ‘এই ব্যাটা শুন, রেডিও ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ এর খবর পড়ে। এই জন্য পাঞ্জাবি তোর হাতে রেডিও দেখামাত্র তোকে আগে গুলি করবে! বুঝলে? ওটা ফেলে দে হাত থেকে, তাড়াতাড়ি ফেলে দে। কী ভাবে ফেলি এই সেই রেডিওটি! যাকে বুকে জড়িয়ে আমি সকাল সন্ধ্যা গান শুনি। কারও কথা শুনছি না, শক্তহাতে রেডিওটি ধরে দৌড়াচ্ছি কেবল সামনের দিকে। গরবিলের পাড়ে প্রায় চলে গেছি। মনে মনে ভাবছি ঐ তো গবিন্দ্রশ্রী গ্রাম দেখা যাচ্ছে, ওখানে তো মেজ বুবুর বাড়ি আছে। লোকের কাছে জিজ্ঞেস করে করে খুঁজে বের করে ফেলবো। মাথায় যখন এমন পরিকল্পনা করছি ঠিক তখনই শত সহস্র কান্নার সুর আর ডাকা-ডাকির ভিতর আমার কানে ভেসে আসলো মেজ ভাইয়ে কন্ঠস্বর! হাসিব ----হাসিব ----হাসিব-রে, ও-- হাসিব ---ডাকতে ডাকতে মুখ দিয়ে তাঁর ফেনা বেরুচ্ছে, কন্ঠ যেন তাঁর রুদ্ধ হয়ে আসছে। সাথে সাথে থেমে গেলাম এবং তিনির কন্ঠস্বর অনুসরণ করে করে এগোতে এগোতে এক সময় বিধাতার অপার কৃপায় অত্যাশ্চর্যভাবে ভাইয়ের বুকেই জড়িয়ে গেলাম। বলাই বাহুল্য, রেডিওটি আমি হাত থেকে কখনও ছাড়িনি। উল্লেখ্য, যদিও আমি তাকে হাত থেকে সেদিন ছাড়ি নি, তবুও স্বাধীনতার পর স্মৃতিবিজড়িত প্রিয় সেই রেডিওটি চুরি হয়ে গিয়েছিলো। তারপর গরবিলের পার থেকে আমার মেজ ভাই আমাকে নিয়ে পুরুষপাল গ্রামে আমাদের মামার বাড়িতে গেলেন। এবং সেখানে আমরা পরিবারের সবাই মিলিত হলাম এবং অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে আশ্রয় নিলাম।
সেদিনের আরো একটি বাস্তব ঘঠনা মনে হলে এখনও আমার গায়ে লোম কাঁটা দিয়ে উঠে। আমার চাচাৎ ভাইয়ের বউ নববধুই ছিলেন বলা যায়, বিয়ের এক বছর পূর্ণ হতে না হতেই তাদের কোলে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তান আসে। বয়স তখন তার দেড় মাসের মতো হবে। বাড়ির সবাই যখন পালাচ্ছিলাম, তিনি তখন সবার সাথে পালাবার সময় সজ্ঞানে পলায়ন করেননি বিধায় তিনি তার কোলের কঁচি শিশুপুত্র জিয়া উদ্দিনকে বিছানায় ফেলে রেখে কুলবালিশটি বুকে জড়িয়ে নিয়ে লোলা নদী পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হতেই চিৎকার করে মাটিতে ধপাস। পরে আমার চাচি অর্থাৎ তিনির শাশুড়ি গুলির ভয় না করে ফিরে গিয়ে শিশুটিকে তুলে নিয়ে আসেন এবং সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করেন।
অবরুদ্ধ বাংলায় আমাদের পাড়ার সকল কিশোর মিলে যুদ্ধ চলাকালীন সময় নতুন একটা খেলা চালু করেছিলাম। এর নাম আমরা দিয়েছিলাম মুক্তি-পাঞ্জাবি যুদ্ধ খেলা। আমি শৈশব থেকেই দেখবার আর জানবার বিষয়ে খুবই কৌতুহলি, তাই প্রায় দিন ভাইয়ের সাথে বিয়ানীবাজার যাওয়ার জন্যে আবদার করতাম। অন্তরে উদ্দেশ্য থাকতো, সেখানে গিয়ে পাঞ্জাবিদের চাল-চলন কর্ম-কান্ড এবং প্রশিক্ষণ দেখবো। এবং সেখানে আমি গিয়ে দেখতাম, পাকসেনারা স্কুলের ফুটবল মাঠে রাজাকারদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, যুদ্ধের নানা কলাকৌশল শিখাচ্ছে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমি সে সব আঁচ করতাম। কোন কোন দিন গিয়ে দেখতাম থানা পরিষদ এর টিলা থেকে বৈধ্যভূমির টিলায় হাতের নিশানা ঠিক করবার জন্যে রাজাকাররা গুলি ছুড়ছে। ভাবতে আজও অবাক লাগে, এমন দুঃসাহস কোথা থেকে সে সময় আমি সঞ্চয় করতাম আর এভাবে তাদের পিছনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমি গুলি ছুড়া কৌতুহলের সঙ্গে দেখতাম। এবং বাড়িতে এসে খেলার সাথীদের নিয়ে বিকালে মক্তবের মাঠে প্রশিক্ষণ দিতাম। প্রশিক্ষণ দিতাম কি ভাবে পাক বাহিনীকে আক্রমণ করা, বিমান আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার কৌশল সংক্রান্ত অনুকরণপ্রিয়তাই ছিলো আমাদের যুদ্ধখেলা। প্রতিদিন বিকালে এই খেলায় আমরা মেতে উঠতাম। সমেবেত সকল কিশোররা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যেতাম। এক দল মুক্তিযোদ্ধা তৈরী হতাম, আর অন্য দল থাকতো পাঞ্জাবি। গোরস্থানের চারিধারের ঝুঁপে ঝাড়ে ঢুকে লুকিয়ে লুকিয়ে বাঁশের তৈরী বন্দুক ( পিছইন’র গোটা আর মুলি বাঁশের ফটাং) দিয়ে গেরিলা যুদ্ধ করতাম। সন্ধ্যা হলেই পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী পাঞ্জাবিরা অস্ত্র মাটিতে রেখে মুক্তিযোদ্ধার কাছে আত্নসমর্পণ করতো। অতঃপর পাকবাহিনীর পরাজয়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করে আমরা শিশুরা বিজয় শ্লোগান দিতে দিতে প্রতিদিন ঘরে ফিরতাম।
আমি আমার পাড়ায় কিশোরদের দলনেতা ছিলাম বলেই প্রতিদিন আমি মুক্তিযুদ্ধা কামান্ডার থাকতাম। তবে মাঝে মাঝে বিপত্তি বেঁধে যেতো পাশের বাড়ীর ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা আবুল কালাম আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে। কারণ, তিনি কিশোরদের খেলার মধ্যেও পাকসেনাদের পরাজয়ের এই দৃশ্যকে কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। তিনি প্রায় দিনই আমার সাথে কথা কাটাকাটি করতেন এবং ঝগড়া করতেন। আমাকে অনেক ভয় দেখাতেন, এমন কি এও বলতেন ‘বাপ ব্যাটাকে পাঞ্জাবি দিয়ে ধরিয়ে নিয়ে ডাক বাংলার বারান্দায় ঝুলায়ে এমন শাস্তি দেবো! তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল’। তবুও কী জানি, কী মোহে, কী বোধে, কী শক্তিতে তিনির সাথে চ্যালেঞ্জ করে আমি বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু সারারাত্রি ধরে দুঃশ্চিন্তায় চোখ ভরে ঘুম আসতো না। কেবল ভাবতাম সত্যি সত্যি যদি ওরা আমাকে ও আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যায় এবং সত্যি সত্যি যদি একাত্তরে নয়টি মাস হতাশায়-আতঙ্কে ভয়ে-ত্রাসে এভাবে কেটেছে আমার মতো সহস্র শিশুর সময়।
আমি তখন চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র। বিয়ানীবাজার সরকারী প্রাথমিক এবং হরগোবিন্দ হাই স্কুল ছিলো একটি টিলার উপরে। বিদ্যালয়ের উত্তর দিকে ফুটবল খেলার মাঠ, মাঠের পরে অন্য একটি টিলার উপর ছিল ডাকবাংলো। সেখানে থাকতো পাকবাহিনীর ক্যাপটেন ইফতেখার হোসেন গন্দল। অসম্ভব অত্যাচারি নরপশু ছিলো সে। ডাকবাংলোর রন্দনশালার বারান্দার ভীমের সাথে ঝুলিয়ে সে বন্দিদেরকে অমানবিক নির্যাতন করতো। ডাকবাংলোর পশ্চিম দিকে ছিলো বধ্যভূমি, সেখানেই পাষাণ নরপশুরা বিয়ানীবাজারের ক্রীড়াবিদ মন্নান মিঞা, মরমী কবি কমর উদ্দিন সহ অসংখ্য নিরীহ নারী-পুরুষকে হত্যা করেছে।
আজ এসব কাহিনী গল্পের মতো মনে হলেও, তখন যে ওগুলো ছিলো কঠিন এবং নির্মম সত্য। এরকম অগণিত অপ্রত্যাশিত বাস্তব ঘঠনা স্বচক্ষে দেখেছি আমি, দেখেছেন বাংলার অগণিত নর-নারী অগণিত জনগণ একাত্তরের নয়টি মাস, এই শ্যামল সুন্দর শান্ত সবুজ সোনালী ধানের দেশে, এই বাংলায়।
স্বদেশীয় দালাল, আলবদর, রাজাকার, আলসাম্স এবং পাকিস্তানি নরপশুদের কোনদিনই আমরা ক্ষমা করবো না; ক্ষমা করতে পানি না। বর্তমান সরকারের কাছে আমরা বাঙালিদের একমাত্র প্রত্যাশা এবং প্রাণের দাবি গ্রেফতারকৃত সকল দেশদ্রোহী আলবদল রাজাকারদের ফাঁসি অনতিবিলম্বে যেন কার্যকর করা হয়। এবং ধর্মের নামে অরাজকতা সৃষ্টিকারী এবং ওদের উত্তরসুরীদেরকে যেন সমূলে নির্মূল করা হয়। আমরা চাইনা, ধর্মের নামে আর ভন্ডামি অব্যাহত থাকুক, আর মায়ের বুক খালি হউক। আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর কোন ধর্মই ধর্ষণ, ঢাকাতি, লোটপাট, জ্বলাও, পুড়াও করবার কথা বলেনি, অরাজকতা সৃষ্টির কথা বলেনি। অতঃপর; ইসলাম এর অর্থই হচ্ছে শান্তি! শান্তি! এবং শান্তি। সুতরাং ধর্মের নামে নিরীহ নিরক্ষর মানুষদেরকে আর ঠক্তে দেয়া যায় না; সবুজাভ এই বাংলার মাটিতে আর রক্তের প্লাবণ বইতে দেয়া যায় না।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা’র কসবা গ্রামে তার জন্ম। লেখক এর প্রকাশিত গ্রন্থ: চোখে আসে জল (ছড়াগ্রন্থ), প্রজাপতির রঙিন পাখা (ছড়াগ্রন্থ), অষ্টপ্রহর স্পর্শ চাই ( কাব্যগ্রন্থ), নিস্ফলা জমির কান্না (কাব্যগ্রন্থ), প্রসূনে প্রনষ্ট ( কাব্যগ্রন্থ), গোধূলীর দুটো রঙ (গল্পগ্রন্থ), পারুলের প্রথম পরশ (গল্পগ্রন্থ), বালকের চোখে দেখা’৭১ ( স্মৃতিগ্রন্থ), জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে ( জীবনীগ্রন্থ), নজরুল, নারী ও অন্যন্য প্রসঙ্গ (প্রবন্ধগ্রন্থ), এক টুক্রি সিলেটি ছড়া ( ছড়াগ্রন্থ), ছড়ায় ছন্দে স্বদেশ দেখো ( ছড়াগ্রন্থ), পোশাকের অন্তরালে (উপন্যাস), মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (প্রবন্ধগ্রন্থ), খুঁজে বেড়াই তোমাকে (কবিতাগ্রন্থ)। ২০১৫ সালে যুক্ত রাজ্যের ‘সংহতি সাহিত্য পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে কবি-কে ‘সম্মাননা পদক’ প্রদান করা হয়। এবং ‘জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট’ কানাডা শাখার পক্ষ থেকে ‘জয়বাংলা সাংস্কৃতিক সম্মান ২০১৫-১৬’ পদক প্রদান করা হয়। কবি আবদুল হাসিব বর্তমানে উনার স্ত্রী Ñরুনা বেগম এবং কণিষ্ট পুত্র প্রদীপ-কে নিয়ে কানাডা’র মন্ট্রিয়ল শহরেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।