আজ ১২ নভেম্বর, বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি বেলাল চৌধুরীর জন্মদিন। তিনি ১৯৩৮ সালের এই দিনে ফেনী জেলার ফেনী সদর উপজেলার শর্শদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম রফিকউদ্দিন আহমাদ চৌধুরী ও মা মুনীর আখতার খাতুন চৌধুরানী। কেবল কবি নয়- সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং সম্পাদক হিসাবেও তিনি খ্যাতিমান।
পরিবারে নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তিনি কুমিল্লা ইউসুফ থেকে ম্যাট্রিক (বর্তমানে এসএসসি) পাস করেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভূত আধুনিক বাঙালি কবি বেলাল চৌধুরী নিজেকে ‘স্বশিক্ষিত’ বলতেই বেশি পছন্দ করতেন। যুক্ত ছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলনকে তুলে ধরেছেন নিজের কবিতাতেও। এ নিয়ে কবির স্পষ্ট উচ্চারণ- ‘ভাষারিক্ত মৌন মিছিলে একাকার বুড়িগঙ্গা/ দিন যায় দিন আসে ফের- আমরা ভাগাভাগি করি সুন্দরকে/ অন্ধকার বীজতলায় বোনা দুঃখকেও।’
সাজানো গোছানো সাংসারিক জীবনের জন্য লালায়িত ছিলেন না কোনও কালেই, বাউন্ডুলে জীবনের প্রতি ছিল কবির অমোঘ আকর্ষণ। তাই বুঝি ১৯৬৩ সালে কলকাতায় পাড়ি জমান এবং কবি হিসাবে সেখানকার সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠা পান। পরে অবশ্য মায়ের ডাকে দেশে ফিরে আসেন ১৯৭৪-য়ে। এরপর সাংবাদিকতা এবং সার্বক্ষণিক লেখালেখিই ছিল তার পেশা ও নেশা। তিনি দীর্ঘদিন ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃক প্রকাশিত ভারত বিচিত্রা পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। কলকাতার প্রবাসজীবনে কৃত্তিবাস-এর কয়েকটি সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন।
বাংলা কবিতায় ভুবনে কবি বেলাল চৌধুরীর আবির্ভাব ষাটের দশকে। সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে তার ছিল দারুণ সখ্যতা। বন্ধুসঙ্গপ্রিয় কবি ছিলেন দারুণ আড্ডাবাজ। আড্ডা থেকেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন কবিতার নানা উপকরণ। বিখ্যাত দৈনিকগুলোর সাহিত্য সাময়িকী পাতা সম্পাদনায় তার নেপথ্য ভূমিকা ছিল। তরুণ কবিদের কবিতা তিনি আগ্রহের সঙ্গে পড়তেন। সব বয়সী কবি ও লেখকরা তার কাছে ছুটে গিয়েছেন। বিষয় বৈভবে ঋদ্ধ কবিতা তাকে মুগ্ধ করত। শুদ্ধ কবিতা রচনায় বেলাল চৌধুরী ছিলেন নিবেদিত। লেখালেখির মতো ভ্রমণ ছিল তার আরেক নেশা। অকাতরে ঘুরে বেরিয়েছেন কত না গ্রাম-গঞ্জ, শহর, নগর, দেশ-বিদেশ। যদিও অসুস্থতার জন্য শেষ কয়েক বছরে ঘরবন্দি হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন কবি।
কবি বেলাল চৌধুরী প্রচুর লিখেছেন। সাহিত্যের সব শাখাতেই তার দীপ্ত পদচারণা
লক্ষ্যণীয়। দু হাতে লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য।
পাশাপাশি অনুবাদ ও সম্পাদনাও চলেছে সমান তালে। তারপরও বেলাল চৌধুরী বেশি
খ্যাতি পেয়েছেন কবি হিসেবেই। তার কবিতায় জগৎ সংসারের পরিচিত দৃশ্যপট,
ব্যক্তিক অনুভূতি, স্বদেশ, মানুষ আর প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য লীলায়িত। তার
কবিতার বিষয়বৈচিত্র্য পাঠককে বিমুগ্ধ করে। কবি প্রিয়জনকে কখনও বৃক্ষের
সঙ্গে কখনও বা বৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করেন। কবি বলেন-
‘জটিল অরণ্যে তুমিই একমাত্র বিটপী
শালের মত অটল, সেগুনের মত নমনীয় ও কোমল
ঝাউয়ের মত তোমার মর্মরিত মাধুর্যের দিকে, কাঠুরেও
তার কুড়ালের হাতলে আলতো হাত রেখে দাঁড়ায় ফিরে।’
ঐতিহ্য, স্বদেশ ও মেহনতি মানুষের যাপিত জীবন তার কবিতার মূল উপজীব্য ছিল। স্বদেশে তিনি ব্যাপ্ত ছিলেন রৌদ্র ছায়ায়। ভাটিয়ালি গান উদাসী বাউলের কণ্ঠে যেভাবে গীত হয় সেভাবে ধানের দুধে, আঁচল ছোঁয়া নীলাম্বরী মেঘে কবি ছিলেন। তার কবিতার উপমা ও উৎপ্রেক্ষা মুগ্ধ করে পাঠককে। ‘উড়ন্ত উজ্জ্বল সবুজ চুল’, ‘অরণ্যের বিষন্নতা’, ‘রাজফুলের মত তোমার রক্তিম অধর’বলে দেয় উপমা নির্মাণে কতোটা সাবলীল ছিলেন এই কবি।
তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে নিষাদ প্রদেশে, বেলাল চৌধুরীর কবিতা, আত্মপ্রতিকৃতি, স্থিরজীবন ও নিসর্গ, স্বপ্নবন্দী, সেলাই করা ছায়া, কবিতার কমলবনে, যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাসে, বত্রিশ নম্বর, ভালোবাসার কবিতা, যে ধ্বনি চৈত্র শিমুলে, বিদায়ী চুমু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
প্রবন্ধ-গবেষণা:কাগজে-কলমে; একমাত্র উপন্যাস স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল। স্মৃতিমূলক গ্রন্থ-নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়; ভ্রমণ কাহিনী: সূর্যকরোজ্জ্বল বনভূমি ও আমার কলকাতা; শিশুসাহিত্য: সবুজ ভাষার ছড়া, বত্রিশ দাত,সাড়ে বত্রিশ ভাজা। সম্পাদনা: বিশ্বনাগরিক গ্যেটে; জলের ভেতরে চাঁদ ও অন্যান্য গল্প; লঙ্গরখানা; পদাবলী কবিতা সংকলন। অনুবাদ: মৃত্যুর কড়ানাড়া ও ত্রান্তোরা (নাটক)।
কবিতার জন্য পেয়েছেন নানা পুরস্কার যার মধ্যে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭) নীহাররঞ্জন পুরস্কার (১৯৯২) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাজের স্বীকৃতি হিসাবে ২০১৪ সালে পেয়েছেন একুশে পদক।
ব্যক্তি জীবনে কবি বিবাহিত। তবে তার স্ত্রী কামরুন্নেসা চৌধুরী বেঁচে নেই। তার দুই ছেলের নাম আব্দুল্লাহ প্রতীক ইউসুফ চৌধুরী ও আব্দুল্লাহ নাসিফ চৌধুরী।
২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল প্রিয় পৃথিবীর রৌদ্রছায়া থেকে অদৃশ্য জগতে পাড়ি জমিয়েছেন কবি বেলাল চৌধুরী।
আজ কবির ৮৩তম জন্মদিবসে ওমেন্স নিউজের পক্ষ থেকে তার প্রতি রইলো অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি বেলাল চৌধুরী।
সূত্র: উইকিপিডিয়া