বুক রিভিউঃ কাব্য আমপারা - আবদুল কাইয়ুম শেখ
বুক রিভিউঃ কাব্য আমপারা - আবদুল কাইয়ুম শেখ

বই পরিচিতি
বই : কাব্য আমপারা
লেখক : কাজী নজরুল ইসলাম
প্রকাশনী : নজরুল ইন্সটিটিউট
মুদ্রিত মূল্য : ষাট টাকা
পৃষ্ঠা : ৫৬


লেখকের পরিচয়ঃ

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে মে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৬ সালের ২৯ সে আগস্ট ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। কবির আবেদন ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই...’ এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গনে তাকে সমাহিত করা হয়।  


কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালী কবি ও দার্শনিক। তিনি বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসাবে উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে- দুই বাংলাতেই তার কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিপ্লবী মননশীলতার কারণে তিনি বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়। তার কবিতাসমূহে মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার, সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার  প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছে। তার সাহিত্যসাধনার সময়কাল বিশ-বাইশ বছরের চেয়ে বেশি ছিল না। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সাহিত্যের সকল শাখায় কবিতা, গান, গজল, ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনায় অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁষি, সিন্ধু হিন্দোল, দোলন চাঁপা, ফণিমণসা, ছায়ানট, সর্বহারা, মরুভাস্কর ও কাব্যে আমপারা নামক কাব্যগ্রন্থ এবং ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, মৃত্যুক্ষুধা, বাঁধনহারা, শিউলিমালা নামক উপন্যাস ও গদ্যগ্রন্থগুলো তার সাহিত্যসাধনার উল্লেখযোগ্য অমর কীর্তি।


বইয়ের পরিচয়ঃ

মহাগ্রন্থ আল কুর’আনের পারা (পরিচ্ছেদ) সংখ্যা ত্রিশটি। এর মধ্যে ত্রিশতম পারা ‘আম্মা’ শব্দের  মাধ্যমে শুরু হয়েছে। এ জন্য এই পারাকে ‘আম-পারা’ বলে অভিহিত করা হয়। পবিত্র কুরআনের এই পারার অনুবাদ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কাব্যে কাব্যে করে গিয়েছেন। তার অনূদিত সেই অমর কীর্তি ‘কাব্য-আমপারা’ বলে পরিচিত। কবির অনূদিত এই কাব্য-আমপারা  বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের এক অতুলনীয় অধ্যায়!

 নজরুল ইন্সস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মোঃ এরশাদ হোসেন গ্রন্থটির পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন,

“‘কাব্য আম-পারা’ গ্রন্থটি পবিত্র কোরআনের ত্রিশ সংখ্যক পারা-র অনুবাদ। এ অনুবাদ গ্রন্থের কাজ করতে গিয়ে নজরুল আরবী ভাষায় বিস্তর বুৎপত্তি অর্জনের চেষ্টা করেন এবং বিভিন্ন  কুর’আন অনুবাদকের অনুবাদ-কর্মে মনোনিবেশ করতে আগ্রহী হন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় অগ্রহায়ণ ১৩৪০ সালে (২৩ নভেম্বর ১৯৩৩ সালে)। সর্বমোট আটত্রিশটি সূরার অনুবাদ এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। মূলভাবকে অক্ষত রেখে নির্ভুল অবয়বে সুষম অর্থবহ অনুবাদে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। গ্রন্থের শেষে ‘শানে নুযুল’ অংশে সুরা সমূহের পরিচয় প্রদান পূর্বক  যে টীকা উল্লেখ  করেছেন তাতে আরবী ভাষায় বিস্তর জ্ঞান, হাদিস বিষয়ে বুৎপত্তি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতার অসাধারণ পরিচয় পাওয়া যায়।”

 

বক্ষ্যমান গ্রন্থের মুখবন্ধে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন :

‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাধ ছিল পবিত্র কুর’আন শরীফের বাঙলা পদ্যের অনুবাদ করা।’ 

 এই সাধ অন্তরে কেন লালন করতেন তার ব্যাখ্যাও তিনি এভাবে দিয়েছেন যে,

‘আমার বিশ্বাস, পবিত্র কোর’আন যদি সরল বাঙলা পদ্যে অনূদিত হয়, তা হলে তা অধিকাংশ  মুসলমানই সহজে কণ্ঠস্থ করতে পারবেন- অনেক বালক-বালিকাও হয়তো কুর’আন মুখস্থ করে ফেলবে। এই উদ্দেশ্যেই আমি যতদূর সম্ভব সরল পদ্যে (আম-পারা) অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি।’


অভিব্যক্তি :

নজরুলের অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি ও সিন্ধু হিন্দুলসহ বহু রচনাই পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। কিন্তু ‘কাব্য আম-পারা’ পড়ে যতটুকু মুগ্ধ হয়েছি তার অন্য কোনো রচনায় ততটুকু হই নি। মুগ্ধতার কারণ হলো তিনি তার এই অনুবাদ রচনায় ছালেছ-ই কুর’আন, মৌলানা এম ডি আলি’স কুর’আন, তাফসীরে হুসায়নী, তাফসীরে বায়যাভী, তাফসীরে কাবিরী, তাফসীরে মৌলানা আবদুল  হক দেহলভী, তাফসীরে জালালাইন এবং মৌলানা মুহাম্মদ আকরাম খান ও মৌলানা রুহুল আমীন সাহেবের আমপারা হতে সহায়তা নিয়েছেন! ভেবে অবাক হই যে, প্রচলিত মাদরাসায় লেখাপড়া না করেও একজন কবি কীভাবে এমন উচ্চমার্গের তাফসীরগুলোর সুগভীর বুৎপত্তি অর্জন করেন এবং অনুধাবন করার যোগ্যতা রাখেন! তিনি সূরাসমূহের পদ্যানুবাদ শেষ করার পর গ্রন্থের শেষে প্রতিটি  সুরার ‘শানে নুযুল’ উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে তাফসীরে আযিযী, তাফসীরে মাজহারী, তাফসীরে কবীর, তাফসীরে কাশশাফ, তাফসীরে বায়যাভী ও তাফসীরে হক্কানীসহ হাদীস শরীফের অমর গ্রন্থ বোখারীর মত বড় বড় কিতাবের সূত্র উল্লেখ করেছেন। আজকের নামধারী আল্লামাগণ আলোচ্য গ্রন্থটি হতে শিক্ষা নিতে পারেন।
   
     বিসমিল্লাহর বৈচিত্র্যময় অনুবাদ :

পুরো আমপাড়ায় সাইত্রিশটি সূরা রয়েছে। সূরা ফাতেহাসহ মোট আটত্রিশটি সূরার পদ্যানুবাদ এই  গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। কবি প্রতি সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহর একই অনুবাদ পেশ করেননি, বরং প্রতিটি সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহর ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদ পেশ করে কাব্য প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন এবং অনুপম ভাষা নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। আসুন আমরা বিসমিল্লাহর কয়েকটি বৈচিত্র্যময় ও বিস্ময়কর অনুবাদ দেখে নিই!  



শুরু করি লয়ে পাক নাম আল্লার,
করুণা কৃপার যিনি অসীম পাথার।

শুরু করিলাম পুত নামে আল্লার,
শেষ নাই সীমা নাই যার করুণার।

শুরু করি লয়ে শুভ নাম আল্লার
নাহি আদি নাহি অন্ত যাঁর করুণার।

শুরু করি লয়ে পূত নাম বিধাতার,
করুণা ও দয়া যাঁর অনাদি অপার।


পদ্যানুবাদের ঝলক :

 প্রিয় পাঠক! গ্রন্থটি পাঠ করার সময় আপনার কাছে মনে হবে আপনি কোনো মৌলিক কাব্যগ্রন্থ পাঠ করছেন। একে অনুবাদ গ্রন্থ ভাবতে আপনার ভ্রম হতে পারে। উদাহরণ হিসাবে আমরা সূরা ফাতেহা ও সূরা ফীলের অনুবাদ নিম্নে তুলে ধরছি। এর মাধ্যমে আমাদের কথার সত্যতা স্পষ্ট হয়ে  উঠবে!


সূরা ফাতেহা

শুরু করিলাম লয়ে নাম আল্লার,
করুণা ও দয়া যাঁর অশেষ অপার।

সকলি বিশ্বের স্বামী আল্লাহ মহিমা,
করুণা কৃপার যার নাই নাই সীমা।
বিচার দিনের বিভু! কেবল তোমারি,
আরাধনা করি আর শক্তি ভিক্ষা করি।
সহজ-সরল পথে মোদের চালাও
যাদেরে বিলাও দয়া সে পথ দেখাও।
অভিশপ্ত আর পথ-ভ্রষ্ট যারা, প্রভু,
তাহাদের পথে যেন চালায়ো না কভু!


সূরা ফীল

শুরু করিলাম শুভ নামে সে আল্লার
করুণা-নিধান যিনি কৃপা পারাবার।

দেখ নাই, তব প্রভু কেমন (দুর্গতি),
করিলেন সেই গজ-বাহিনীর প্রতি?
(দেখ নাই, তব প্রভু) করেন নি কি রে,
বিফল তাদের সেই দুরভিসন্ধিরে?
পাঠালেন দলে দলে সেথা পক্ষী আর,
করিতে লাগিল তারা প্রস্তর প্রহার
গজপতিদেরে। তিনি তাদেরে তখন
করিলেন ভক্ষিত সে তৃণের মতন।


নেতিবাচক দিক :

গ্রন্থটির কোনো নেতিবাচক দিক আমার চোখে পড়েনি। এরপরও যদি বলতে হয়, তা হলে বলা  যায়, এই গ্রন্থে কুর’আনের আয়াতগুলো উল্লেখ না করে কেবল কাব্যানুবাদ দেওয়া হয়েছে। অনুবাদের সঙ্গে সঙ্গে যদি আয়াতগুলোও দিয়ে দেওয়া হতো, তা হলে আয়াতের নিরিখে অনুবাদের মান নির্ণয় করা সহজ হতো। সঙ্গে সঙ্গে তা উলামায়ে কেরামের জন্য আরো উপকারী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারত।  



পরামর্শ:

কবি তার এই কালজয়ী গ্রন্থটি ’বাঙলার নায়েবে নবী মৌলবী সাহেবানদের দস্ত মোবারকে’ উৎসর্গ করেছেন। কবির উৎসর্গের যথাযথ মূল্যায়ন করা উলামায়ে কেরামের নৈতিক দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। তাই আসুন! আমরা গ্রন্থটি সংগ্রহ করে কবির জ্ঞান-সাগরে অবগাহন করি ও উপকৃত হই!


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান