ছবি : বইমেলা
পরণে জমকালো শাড়ি, মাথায় বাহারি ফুলের খোঁপা, হাতে টকটকে লাল গোলাপ ফুল, চোখে কাজল, মুহুর্মুহু বাতাসে উড়ছে শাড়ির আঁচল, হাতে রিনিঝিনি করে বাজছে রঙিন কাচের চুড়ি, সেই হাত ধরে আছেন প্রিয়জন। এমন নান্দনিক সাজে সজ্জিত হয়ে তরুণীরা ঘুরেছেন মেলার এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তের নানা স্টলে। কিনেছেন প্রিয় লেখকদের বই। স্মৃতি ধরে রাখতে তুলেছেন সেলফি আর নানা ভঙ্গিমায় ছবি। পিছিয়ে ছিলেন না তরুণেরাও। মেয়েদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের সাজ-সজ্জাও ছিল চমত্করা। গতকাল ১৪ ফেব্রুয়ারির মেলার চিত্র ছিল এমননি।
ভালোবাসার মধুর সমর্পণে আবিষ্ট হয়ে গ্রন্থমেলার দ্বার খোলা হয় বিকেল ৩টায়। ফাগুনের আগুনরাঙা দ্বিতীয় দিনে তীব্র রোদ উপেক্ষা করেও বইমেলা প্রাঙ্গণে ভালোবাসা দিবসে তারুণ্যের উন্মাদনা ছিল লক্ষ করার মতো। যুগলদের পদচারণায় মুখর ছিল অমর একুশে বইমেলা। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন তরুণ-তরুণীরা। কবিতা, গল্প আর উপন্যাস কিনে দিয়েছেন প্রিয় মানুষটির হাতে। বইয়ের মলাটের ফাঁকে গুঁজে দিয়েছেন ভালোবাসায় সিক্ত গোলাপকলি। হাতে হাত রেখে অনুভব করেছেন পরস্পরের উষ্ণতা। বইমেলায় ছিল ভালোবাসার প্রভাব। তাইতো প্রেম বিষয়ক বইগুলোর বিক্রিতে লেগেছিল ভালোবাসার হাওয়া।
প্রকাশকরা বলেন, প্রিয় মানুষকে বই উপহার দিন। লাইনটি তাত্ত্বিক হলেও গতকাল বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে এর প্রয়োগটি ছিল চোখে পড়ার মতো। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আগত যুগলরা এদিন একে অন্যকে উপহার দিয়েছেন ভালোবাসার বই। তাই বই মেলা জুড়ে অন্য বইয়ের কদর কম থাকলেও ভালোবাসার বইয়ের কদর ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রেমের কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্পসহ অন্যান্য বইয়ের বিক্রি হয়েছে দেদারসে। আর এতে করে ভালোবাসা নিয়ে যেসব প্রকাশনা বেশি করে বই এনেছে তাদের স্টলে সমাগমও ছিল চোখে পড়ার মতো।
কথা প্রকাশের স্বত্বাধিকারী মো. ইউনুস মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘এদিনটি মূলত ভালোবাসার। তাই আজ ভালোবাসার বই বিক্রি দিয়েই শুরু হয়েছে দিন। বিক্রির ৮০ শতাংশই ভালোবাসার বই চলছে। আজকের পর ভালোবাসার বইয়ের চাহিদা কমই থাকবে। অন্য বইয়ের চাহিদা সেসব দিনে বেশি থাকলেও ভালোবাসার বইয়ের দিন আজই। আমরাও এ জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। প্রত্যাশিত মতোই বিক্রিও হচ্ছে।’ বৃহস্পতিবার মেলায় প্রবেশ করে দেখা যায় বই স্টলগুলোতে ভিড় তুলনামূলক কম। তবে কিছু স্টলের সামনে তরুণ-তরুণীদের একটু বাড়তি ভীড় ছিল। একটু কাছে গিয়ে দেখা যায় আগত পাঠকরা সব বই কিনছেন না। বরং বিশেষ শ্রেণির বই কিনতেই তারা বেশি আগ্রহী। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা একে অন্যকে উপহার হিসেবে দেয়ার জন্যই বই কিনছেন। তবে সে সব বই অন্য বইয়ের মতো নয়। বরং ভালোবাসা কেন্দ্রিক লেখা বই কিনছেন তারা। উপহারও দিচ্ছেন ভালোবাসার মানুষকে।
কথা হয় প্রেমিক যুগল রবিন-আফসানার সঙ্গে। রবিন জানান, প্রতি বছরই তিনি তার ভালোবাসার মানুষকে বই উপহার দেন। এবারো তাই প্রিয় জনকে নিয়ে মেলায় এসেছেন বই কিনতে।
আফসানাও জানান, তিনিও তার ভালোবাসার মানুষকে বই উপহার দেবেন। এজন্য তারা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। তবে মনের মতো ভালোবাসার বই খুজে পাচ্ছেন না বলে জানান এ যুগল। তবে ঘুরতে ঘুরতে কোনো একটি ভালো লেগে যাবে বলেও জানান তারা।
অন্বেষা প্রকাশনার প্রকাশক শাহাদাত হোসেন মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘আজকের দিনটি অন্যদিন থেকে একটু ব্যতিক্রম। এদিন সব বইয়ের বিক্রি সমান হয়না। ভালোবাসা কেন্দ্রিক বইয়ের বিক্রিই এদিন বেশি হয়। এ জন্য আমাদের প্রস্তুতিও থাকে আলাদা। প্রেম ও ভালোবাসা কেন্দ্রিক বইগুলো এদিন চলবে সেটিকে মাথায় রেখে আমরা এ সংশ্লিষ্ট বই এনেছি। এবার আমাদের স্টলে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া ভালোবাসার বইয়ের মধ্যে রয়েছে, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, ভালোবাসি তাই, যে প্রেমে বিরহ নেই। এসব বইয়ের সবগুলোই পাঠককে ভীষণ আকৃষ্ট করছে।’
লেখক আহমেদ কাজলও জানান, ‘আজকের দিনটি মূলত ভালোবাসার বই বিক্রির জন্যই। এ দিন তরুণ-তরুণীরা একে অন্যকে বই উপহার দেন। এ জন্য এ বিষয়ক বইয়ের বিক্রিটাও একটু বেশি থাকে। অন্যদিনগুলোতে এ সংশ্লিষ্ট বইয়ের বিক্রি তুলনামূলক কমই থাকবে।’
মূল মঞ্চের আয়োজন: অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৪তম দিনে মেলার দ্বার উন্মোচিত হয় বেলা ৩টায় এবং শেষ হয় রাত ৯টায়। বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ডিজিটাল বাংলাদেশে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানভাবনা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন রেজাউর রহমান, আবদুল কাইয়ুম এবং অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। এ ছাড়াও সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন আকিমুন রহমান, আনিসুল হক, রাহাত মিনহাজ, মাহবুব ময়ুখ রিশাদ এবং চাণক্য বাড়ৈ।
কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি আমিনুর রহমান সুলতান এবং সাকিরা পারভীন। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ এবং মাহিদুল ইসলাম। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী খুরশিদ আলম, সুজিত মোস্তফা, তানভীর সজীব আলম, মুর্শিদুদ্দিন আহম্মদ, আঞ্জুমান আরা শিমুল, মো. রেজওয়ান আহমেদ।
নতুন বই: অমর একুশে গ্রন্থমেলার গতকাল ছিল ১৪তম দিন। মেলায় গতকাল নতুন বই এসেছে ১৪৭টি। এর মধ্যে গল্প ২৪টি, উপন্যাস ২৯টি, প্রবন্ধ ৬টি, কবিতা ৫০টি, গবেষণা ১টি, ছড়া ২টি, শিশুসাহিত্য ১টি, জীবনী ৬টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ২টি, নাটক ১টি, বিজ্ঞান বিষয়ক ১টি, ভ্রমণ ১টি, ইতিহাস বিষয়ক ৩টি, রাজনীতি ২টি, স্বাস্থ্য ১টি, ধর্মীয় ১টি, অনুবাদ ২টি, অভিধান ১টি, সায়েন্স ফিকশন ২টি এবং অন্যান্য ১০টি। উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে হাওলাদার প্রকাশনী এনেছে বিশিষ্ট লেখক, মুক্তিযোদ্ধা মো. আলাউদ্দিন মোল্লা রচিত ‘সঙ্গীত সমগ্র ও স্বরচিত কবিতা’ পার্ল পাবলিকেশন্স এনেছে মাহবুব জামিল পুলকের কাব্যগ্রন্থ ‘জলপরীর নিঃশ্বাস, আগামী প্রকাশনী এনেছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন’, সৈয়দ মিজানুর রহমানের ইতিহাস গ্রন্থ ‘নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ইতিহাসের অকাট্য দলিল’, উৎস প্রকাশন থেকে আহবাব চৌধুরী খোকনের নিবন্ধ ‘কালের ভাবনা’, অ্যার্ডন পাবলিকেশন্স থেকে মোস্তাক শরীফের উপন্যাস ‘আমি তিশোওমা’, কথা প্রকাশ থেকে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘সময়ের ফুলে বিষপিঁপড়া’, অনন্যা থেকে উত্পল শুভ্রের ক্রিকেট বিষয়ক গ্রন্থ ‘শুধুই ক্রিকেট’।
আজকের আয়োজন: অমর একুশে গন্থমেলার আজ ১৫তম দিন। এ দিন শুক্রবার থাকায় মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায় এবং শেষ হবে রাত ৯টায়। আজ মেলায় থাকবে শিশুপ্রহর। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হয়েছে।
সংগীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত নির্বাচন: সকাল ১০টায় অমর একুশে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে শিশুকিশোর সংগীত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী: শ্রদ্ধাঞ্জলি শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মোহাম্মদ সাদিক, জাহিদ হায়দার এবং সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, কবিতা-আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সূত্র: মানবকণ্ঠ