ভুল উপহার - আবুল কালাম আজাদ
ভুল উপহার -  আবুল কালাম আজাদ

জ্যোস্না রাতবস্তিঘরের আশেপাশে লাইটপোস্ট নেইতাই জ্যোস্নাটা স্পষ্টপলিথিনের ছাদের ফুটো দিয়ে আকাশের চাঁদটাকেও দেখা যায়কছিম উদ্দিন আকাশের চাঁদ দেখতে দেখতে বউয়ের মুখে তাকায়ভাবে, কে বেশি সুন্দর? নিজেই উত্তর খুঁজে নেয়, ফুলবানু ঐ চাঁদের চেয়েও সুন্দর

কছিম উদ্দিন ফুলবানুর বুকের একটা কিসমিসে আঙুলের ডগার আলতো স্পর্শ দিতে দিতে বলে-দেখছো, দশ বছর ক্যামনে চইলা গেলো! মনে হয় সেইদিন.......

হইছে, ঘুমানসকালে না আবার রিশকা নিয়া বার হইতে হইবো

আমি একটা বিষয় নিয়া চিন্তা করছি

কী বিষয়?

তুমি তো আবার ছ্যাঁৎ কইরা উঠবা

ছ্যাঁৎ কইরা উঠনের কথা হইলে তো উঠুমই

আমি চিন্তা করছি, বিয়ার দশ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে তুমারে একটা উপহার দিমু

ঢং দেইখা আর বাঁচি না! ফুলবানু ঝটকা দিয়ে নিজের বুক থেকে কছিম উদ্দিনের হাত সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শোয়

কছিম উদ্দিন আবার চাঁদের দিকে তাকায়কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বউয়ের দিকে পাশ ফেরেআলতো করে উরুর উপর হাত রাখেভেবেছিল, বউ ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিবেকিন্তু তা দেয় নাসে মনে সাহস সঞ্চয় করেহাতটা একটু একটু করে উপরে উঠাতে থাকেএকবারে বুকের কাছে নিতে সাহস পায় নাউরু থেকে নিতম্বনিতম্ব থেকে পেটনরম থকথকে পেটে গোলাকারভাবে হাত ঘুরায়নাভির গর্তে অনামিকা প্রবেশ করিয়ে নাড়তে থাকেবউ কিছু বলে নাসে হাতটাকে আস্তে বুকের ওপর রাখেবউ তবু শান্তসে সাহস করে হাতটা চালান করে দেয় ব্লাউজের নিচে

বুকে আস্তে আস্তে চাপ দিতে দিতে তার প্রায়ই শৈশবের একটা স্মৃতি মনে পড়েশৈশবে সে গ্রামের বাজারে যেতমগরব আলীর দোকানে গিয়ে বলতো-একটা বেলুন দেনতোচার আনায় একটা বেলুন কিনতোবেলুনটাকে ফুঁ দিয়ে ফুলাতো

ফুলানো বেলুনে প্রায়ই সে পানি ভরতোপানি ভরলে বেলুনটা তুলতুলে নরম হতোএকদিকে চাপ দিলে পানি অন্যদিকে সরে যেতোবেলুনের মাথার দিকে একটা বোটা ছিলসেই বোটা মুখে নিয়ে চুষতোসমবয়সীদের বলতো-দ্যাখ, গাইর বান থিকা দুধ খাইতেছি

আজ সে বুঝতে পারে, সেটা বেলুন ছিল নামেয়ে হবার পর সে নিজেও অনেকদিন সেটা ব্যবহার করেছেছেলে হবার পর এখন আর কিছু ব্যবহার করতে হয় নাদশ বছরের জন্য ব্যবস্থা নিয়েছেকাপার টি না কী যেন বলেদশ বছর পর আর কোনো সন্তান নিতে না চাইলে আবার নতুন করে ব্যবস্থা নিতে হবে

কছিম উদ্দিনের কাছে ফুলবানুর বুকটা সেই বেলুনেরই মতো মনে হয়পাশাপাশি ঘেষাঘেষি করা পানিভর্তি দুইটা বেলুনতবে সেই বেলুন ছিল কিছুটা লম্বাটে, আর এই বেলুন গোলাকারশৈশবের সেই বেলুনের প্রতি আকর্ষণ থাকতো অল্প সময়আর এই বেলুনের প্রতি আকর্ষণ মুহূর্তের জন্যও এতটুকু কমে নাকেবলই ছুঁতে মন চায়

কছিম উদ্দিন ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে একটা বেলুনের বোঁটা খুব করে নাড়তে থাকেবোঁটা জেগে উঠে-যেন মাটির ভেতর থেকে একটা অঙ্কুর মাথা জাগালোঅঙ্কুর জেগে ওঠা মানে শরীর জেগে ওঠাসে বলল-শোনো, খালি ঝামটা দিও নাআমি তুমারে একটা মোবাইল ফোন দিবার চাই

আজাইরা কথা কইয়েন নাআমি মোবাইল দিয়া কী করুম? আপনের তো একটা আছে

পোলা-মাইয়া বড় হইতেছেমাইয়াডা স্কুলে যায়অনেক সময় দরকারে আমারে খবর-টবর দিতে পারবা

তার চাইতে মাইয়ারে ভালো একটা জামা কিন্যা দেনআর রঙের বাক্স না কী য্যান চাইতেছে, সেইটা দেনস্কুলে লাগবো

আরে সবই দিমুমোবাইল দিলে ঐগুলা আটকা থকবো?

মোবাইলের দাম কত?

একটু ভালোর মধ্যে দিমুচাইর/পাঁচ হাজারের মধ্যে.......ছবি উঠান যাইবো, গান বাজানো যাইবো, আবার ভিডিও-ও দেখা যাইবো

হইছে, এত ট্যাকা আপনে কই পাইবেন?

তুমারে উপহার দিমু বইলাই এক বছর ধইরা ট্যাকা জমাইতেছি

আমি ঐ মোবাইল-টোবাইল ধরতে পারুম নাপোলা-মাইয়াই ধরবো

কছিম উদ্দিন বুঝে নেয়, বউ সম্মতি দিয়েছেসে খুশি হয়বউকে টান দিয়ে বলে-এদিকে ফিরো

চুপ কইরা ঘুমান

এহন এমনি এমনি ঘুম আসবো না

আরে ধুর! মাইয়া জাইগা আছে

কইলা একটা কথা! মাইয়া জাইগা আছেঘুমাইয়া কাদা

আইচ্ছা, এহন না-ভোর রাইতে......

না এহন......!

আপনে যে কী না.....!

 

*******

মোবাইল ফোন দেখে ছেলে-মেয়ে আনন্দে লাফলাফি শুরু করে দিলফুলবানুর আনন্দ-নিরানন্দ কিছু বোঝা যায় নাসে তার মতো কাজে ব্যস্তদাবের করে চুলার পাশে বসে লাকড়ি কাটতে থাকে

মেয়ে মোবাইল ফোনের প্যাকেট খুলতে খুলতে বলে-হায় আল্লা! এই মোবাইলে ক্যামরা আছেছবি উঠান যাইবো

কছিম উদ্দিন বউকে ডাকে, এদিকে আসো, ক্যামনে কী করে শিখায়া দেই

ঐসব তামাশা শিখা আমার কুনু কাম নাই

ফুলবানু কাজ ফেলে আসে নাকছিম উদ্দিন একটু মন খারাপ করেমেয়ে বলে, বাজান, আমারে শিখায়া দ্যাওপরে আমি মারে শিখায়া দিমু

কছিম উদ্দিন মেয়েকে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শিখাতে থাকেবলে-এইটা চাইনিজ মোবাইলনাম সিফনি না কী জানিকথাগুলো বলে বেশ উচ্চস্বরে যাতে ফুলবানুও শুনতে পায় 

মেয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলে-বাজান, সিফনি না, সিম্ফনি

, তুই তো আবার স্কুলে পড়োসস্কুলে পড়া আট বছরের মাইয়া যা জানে, স্কুলে না পড়া পয়ত্রিশ বছরের বাপ তা জানে নাএর নাম লেহাপড়াএইটা চার্জারটানা আট ঘন্টা চার্জ দিয়া রাখবি

এতো ক্যান বাজান?

হেরা কইয়া দিছেপ্রথমে টানা আট ঘন্টা চার্জ দিতে অইবোতারপর রাইতে সব শিখামু

ফুলবানু বুঝতে পারে, তার অনুপস্থিতিতে স্বামীর মোবাইল অপরেটিং শেখাতে ভালো লাগছে নাসে মুখ টিপে হাসেমনে মনে ভাবে, মানুষটা আমারে এত ভালোবাসে ক্যান? বস্তির আর কুনু ব্যাডাই তার বউরে এত ভালো বাসে নাআমার কপাল ভালো

তবে শেষ পর্যন্ত কছিম উদ্দিনের মনে দুঃখই রয়ে যায়তার রূপবতী-গুণবতী বউটা মোবাইল অপরেটিং সম্পর্কে অজ্ঞই থেকে গেলসে কল রিসিভ করা আর কল কেটে দেয়া ছাড়া মোবাইল ফোনের কিছুই শিখল নাফোন করতে হলে সেটা করে দেয় মেয়েআর ছবি তোলা, গান শোনা, ভিডিও দেখা এগুলো তো সে কল্পনাই করতে পারে না

অনেক সময় রিকশা থামিয়ে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে নিতে কছিম উদ্দিনের মনে হয়েছে, বউয়ের সাথে একটু অপ্রয়োজনীয় কথা বলবেএলোমেলো কিছু কথা বলে রূপবতী-গুণবতী বউটাকে হাসাবেকিন্তু তার মনের সে সাধ পূর্ণ হয় নাকল করলে রিসিভ করে ছেলে অথবা মেয়েসে বলে, তোর মা-রে দে

ফুলবানু ফোন কানে নিয়ে বলে, কী কন?

এমনিই, বইসা আছিতাই মনে হইলো, তুমার সাথে একটু কথা কই

ঢং! ফুলবানু কল কেটে দেয়

কতবার কছিম উদ্দিনের মনে হয়েছে, বউটার একটা ছবি তুলবেতা সে পারেনিমোবাইল ফোন-এর ক্যামেরা অন করে বউয়ের দিকে ধরতেই বউ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে, অথবা আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে

সে মনে মনে বলে, ধুর! এই বালের মোবাইল দেওয়াটাই ভুল হইছেতার চাইতে দামি একটা শাড়ি দিলে ভাল হইতোবউ পিনতো, জজ-বারিস্টারের বউয়ের মতো লাগতো

******

একদিন বেলা এগারোটার দিকেমেয়ে স্কুলেছেলে এক বাটি দুধ খেয়ে ঘুমিয়েছেফুলবানু এই ফাঁকে গোসল করতে গেছে

গোসল করে ভেজা চুল ঝারতে ঝারতে ঘরে এসে দেখে খাটের উপর সেলফোনটা বাজছেঅপরিচিত নাম্বারযেহেতু মেয়ে বাসায় নেই, ছেলে ঘুমে, সেহেতু তাকেই ফোন রিসিভ করতে হলোওপার থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ, বুজি, কেমন আছো?

বুজি কেডায়?

তুমি রহিমা বুজি না?

আরে ধুর! রহিমা বুজি কেডায়?

তাহলে রহিমা বুজি কই?

এইসব কী কন আপনে? রহিমা বুজি কই তা আমি কী জানি? আজাইরা......! ফুলবানু কল কেটে দেয়বিড়বিড় করে বলে, আজাইরা ব্যাডা, রহিমা বুজিরে খুঁজতে আসছে আমার মোবাইলে

চুল ঝেরে ফুলবানু গামছাটা কাপড় শুকানোর জন্য বাঁধা তারে ঝুলিয়ে রাখেতারপর সে শাক কাটতে বসেতখন আবার বেজে উঠে ফোনফুলবানুর এমন রাগ হয় যেন ঘরে গিয়ে এক আছাড় দিয়ে ফোনসেটটা ভেঙে ফেলবেস্বামীর তিল তিল করে জমানো কষ্টের টাকায় কেনা ফোনসেট সে ভাঙতে পারবে নারাগে মনে মনে স্বামীকে গালি দিতে থাকে

সেই নাম্বারফুলবানু মনে মনে বলে, শয়তান ব্যাডা আবার কী কইতে চায়?

সে ফোন রিসিভ করেসেই কন্ঠবলে, দুঃখিতরহিমা বুজির নাম্বারের সাথে আপনার নাম্বার হুবহু মিলশুধু রহিমা বুজির নাম্বারে শেষ ডিজিট আট আর আপনার নয়তাই ভুল হয়ে গিয়েছিলদুঃখিত

ডিজিট কী?

মানে সংখ্যাশেষ সংখ্যাটা....

আপনি মনে কিছু করবেন নাদুঃখিত

আইচ্ছা, মনে কিছু করবো না

শাক কাটতে কাটতে ফুলবানু ভাবে, লোকটার কথাবার্তা ভদ্দলোকের মতোমনে হয় ভদ্দলোকসেই জন্যিই আবার দুঃখিত কইতে আইছে

 

রাতে ফুলবানু কথাটা তোলেকছিম উদ্দিন বলে, এই রকম হইতে পারেকয়দিন আগে আমার মোবাইলে এক বুইড়া মানুষ ফোন কইরা কয়, ও রফিক, কয়ডা টাকা পাঠাতিন/চার মাস হইলো কিছুই দেস নাবুইড়া বাপ-মা ক্যামনে চলে? শ্বাস কষ্টের রোগি আমি....আমি কই, আপনে কেডায় চাচা? সে কয়, তোর বাপআমি কই, আমার তো বাপ-মা নাই চাচামইরা গেছে অনেক আগেইআমি এতিমআমার নাম কছিম উদ্দিন

ঘটনাটা শুনে ফুলবানুর মন খারাপ হয়মেয়েটারও মন খারাপ হয়মেয়ে বলে, বাজান, তুমি তার ঠিকানা নিয়া তার জন্যি কয়ডা টাকা পাঠায়া দিতা

তুই ঠিক কইছোসরে মাতাই দেওন দরকার ছিলআমি ভুল করছিদুঃখি মানুষের প্রতি তোর ভালোবাসা আমার বুকটারে এক্কেরে ঠান্ডা কইরা দিছেআয় মা, তুই আমার বুকে আয়

কছিম উদ্দিন এক হাতে মেয়েকে, আরেক হাতে ছেলেকে বুকে টেনে নেয়বলে, বড় হইয়া তোরা বুইড়া বাপ-মারে ঠিকমত দেখবি তো?

ছেলে ফস করে বলে উঠে, বাজান, আমি রিশকা চালায়া যা পামু সব তুমারে দিমু

ধুর! এই পাগল কী কয়? তুমি রিশকা চালাইবা ক্যান? তুমরা লেখাপড়া শিখতাছোতুমরা জজ-বারিস্টার হইবাগাড়ি চালাইবা-মোটর গাড়ি   

     

*****

কয়েকদিন পর আবার অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে ফোনএটা সেই নাম্বার কি না ফুলবানু তা বুঝতে পারে নাফুলবানু বিরক্ত হয়বিড়বিড় করে বলে, এইসব মরার নাম্বার থিকা ফোন আসে যহন ঘরে কেউ থাকে নাআবার কুন বুজিরে চায়?

ফুলবানু ফোন রিসিভ করেওপাড় থেকে বলে, কেমন আছেন?

ফুলবানুর কাছে কন্ঠটা চেনা চেনা লাগেএকটু ভেবে সে বুঝতে পারে, এটা সেই কন্ঠ, যে কন্ঠ একদিন রহিমা বুজির খোঁজ করেছিলফুলবানু বলে, আপনে আবার ফোন দিছেন?

এমনিই দিলামআপনার নাম্বারটা আমি সেভ করে রেখেছিলামএখন হঠাৎ মনে হল, আপনার সাথে একটু কথা বলি

আমার সাথে আপনের কী কথা?

কোনো কথা নেইআপনি কেমন আছেন এই আর কি

ভালো আছিশোনেন, আমি আমার স্বামীর সাথেই ফোনে কথা কই নাআর ফোন দিবেন না, বুঝছেন?

ঠিক আছে দিবো নাআপনি করেন কী? মানে চাকরি-টাকরি....?

আমি কিছু করি নাআমার স্বামী রিশকা চালায়আমার দুই পোলা-মাইয়াবড় মাইয়া স্কুলে পড়েহইছে?

আপনি বিরক্ত হচ্ছেনআচ্ছা, মানুষ কি মানুষের সাথে পরিচিত হতে পারে না? আমি একটা মুদী দোকান চালাইরহমান জেনারেল স্টোরচাল-ডাল-নুন-তেল সবই পাওয়া যায় আমার দোকানেআমার নাম রহমান-আব্দুর রহমান

ও.....

আমি আই.এ পাসইচ্ছা ছিল, উচ্চ শিক্ষিত হয়ে চাকরি করবোআই.এ পাস করার পরই বাবা মারা যায়বড় বোন রহিমা বুজির তখনও বিয়ে হয় নাইছোট ভাই-বোন আছে আরওসংসারের চাপ পড়ে আমার ঘাড়েআর লেখাপড়া হয় না

আহারে!

তবে এখন সুখেই আছিএ এলাকায় আমার দোকানের চাইতে বড় দোকান আর একটাও নাইদিনে কম হলেও দশ হাজার টাকার মালামাল বিক্রি হয়দুজন কর্মচারী রেখেছি

ভালোই তোআমরা গরিব মানুষদিন আনি দিন খাইবস্তিতে থাকিআপনে আর আমারে ফোন দিয়েন না

ধনী-গরিব বলে কিছু নাইসবাই আমরা মানুষমানুষের মধ্যে ধনী-গরিব, উচু-নিচু, ধর্ম, জাত-পাত এই সব মানুষই তৈরী  করেছেমানুষই মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে

এইসব অনেক বড় কথাএগুলা আমার মাথায় ঢুকবো নাআইচ্ছা রাখি

আচ্ছাআমি যদি মাঝে মাঝে আপনাকে ফোন করি, আপনি কি মনে কিছু করবেন?

শোনেন, আমার স্বামী আছে, সন্তান আছেশেষে একটা ঝামেলা হইয়া যাইবো

না না, ঝামেলা হওয়ার মতো কিছু আমি করবো নাআপনি যখন ফ্রি থাকবেন......

তায়লে এই টাইমে ফোন দিতে পারেনএই টাইমে স্বামী রিশকা নিয়া বাইরে থাকেমাইয়া স্কুলে যায়

ছেলে....?

পোলা তো ছোট

ঠিক আছে, যদি ফোন করি তো এরকম সময়েই করবো

মানুষের মন বড়ই বিচিত্রফুলবানু লোকটাকে, মানে আব্দুর রহমানকে মনে করতে চায় নাতারপরও তার কথা ভাবনায় এসে যায়

লোকটা শিক্ষিতবড় ব্যবসায় আছেধনী-গরিব ভেদাভেদ করে নাসুন্দর করে কথা বলেআসলে লোকটা ভালোভুল করে একবার ফোন করেছিল, এখন কেমন খোঁজ-খবর নেয়কেমন আপন আপন ব্যবহার

তারপর থেকে মাঝে মাঝে আব্দুর রহমানের ফোন আসেনাম্বারটা ফুলবানুর মুখস্থ হয়ে গেছেএখন সে বিরক্ত হয় নাবরং কখনো টানা ৩/৪ দিন ফোন না এলে তার ভালো লাগে নামনে মনে ভাবে, কোনো অসুখ-বিসুখ হইলো না তো?

একদিন আব্দুর রহমান বলল, আচ্ছা, আপনাদের বস্তিটা কোথায়?

বস্তির ঠিকানা চান ক্যান?

বললে তো কোনো ক্ষতি নাইভয় পান? আমি কি চোর-বদমাশ?

আরে তা না

ফুলবানু লজ্জা পায়লজ্জা পেয়ে বস্তির ঠিকানা বলে দেয়আব্দুর রহমান উৎফুল্ল হয়ে বলে, আপনে তো আমার অনেক কাছেই থাকেন দেখছি

কাছে ক্যামনে?

আপনাদের বস্তির সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা গেল, ঐ রাস্তা দিয়া সোজা দশ/পনেরো মিনিট হাঁটলে ডানে একটা মোড়সেই মোড় থেকে দশ মিনিটের মতো হাঁটলে মডার্ন মার্কেটসেই মডার্ন মার্কেটে আমার দোকান

মরডান মার্কেট! ঐখানে তো আমরা যাইপোলা-মাইয়ার ঈদের কাপড় কিনতে যাই

একদিন আপনার বাসায় যাব

আরে ধুর! বাসা কই? বস্তিঘর কি বাসা? দয়া কইরা এই কাজ কইরেন নাআপনের সাথে কথা-বার্তা কই ততেই আমার খুব কষ্ট লাগেস্বামীরে না জানায়া......আপনে যদি আসেন, আর আমার স্বামী যদি জানবার পারে......!

আপনি দেখি ভয় পাচ্ছেনআপনার সমস্যা হতে পারে এরকম কিছু আমি করবো না

চিন্তায় ফুলবানুর শরীর-মন অবশ হয়ে যেতে চায় যেনতার সাজানো সুখের সংসারে কোনো ঝড় উঠে আসছে না তো? স্বামী আর সন্তান দুটোকে সে জীবন দিয়ে ভালোবাসে

********

ফুলবানু পানি আনতে গিয়েছিলসে কাখের কলসি ঘরের সামনে নামাতে যাবে তখন এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করে-আচ্ছা, এখানে ফুলবানুর ঘর কোনটা?

ফুলবানু চমকে উঠেধপ করে কাখের কলসি নামায়এলুমোনিয়ামের না হয়ে মাটির হলে কলসি নিশ্চিত ভেঙে যেতসে ঘোমটা টানেতারপর তাকায় লোকটার দিকে

লোকটার গায়ে চেক শার্টপরনে ফুলপ্যান্টপায়ে চামড়ার স্যান্ডেলবাম হাতে কজ্বিতে সোনালী রঙের একটা ঘড়িডান হাতে ছোট একটা প্যাকেটপ্যাকেটের ভেতর বিস্কুট, চকলেট, চিপস ইত্যাদি বাচ্চাদের খাবার প্রকাশিত

ফুলবানু বলে, আপনে কার কাছে আসছেন?

ফুলবানুর কাছে?

যারে চিনেন না, যার ঘর চিনেন না, তার কাছে আসছেন ক্যান?

আব্দুর রহমান মুহূর্তে বুঝে নেয়, সে ফুলবানুর সামনে দাঁড়িয়েবলে, চিনবো না কেন? আমি যার কাছে এসেছি সে আমার সামনে দাঁড়িয়েআমি আব্দুর রহমান

আমি মনে করছিলাম, কওনের কথা-কইছেন, আসবেন নাসত্যিই আইসা পড়লেন?

আমি মুখে যা বলি তা করি

আপনেরে বসতে দিমু কই?

আমি মাটিতেও বসতে পারি

ফুলবানু ঘর থেকে একটা টুল এনে এগিয়ে দিয়ে বলে-আপনের মতো মানুষ এই দুনিয়ায় আর একটাও নাইভুল কইরা একদিন ফোন দিছিলেন, তারপর এক্কেরে তার ঘরে

মানুষ প্রত্যেকেই যার যার মতোএকজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের কোনো দিক দিয়েই মিল হয় না

ফুলবানুর ছেলেটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বড় চোখে তাকিয়ে আছে আব্দুর রহমানের দিকেশিশু-দৃষ্টিতে মেখে আছে বিস্ময়এরকম পোশাকের কোনো মানুষকে এর আগে সে কোনোদিন তাদের ঘরের সামনে দাঁড়াতে বা বসতে দেখেনিতার চোখে ভেতরে প্রশ্নও জেগে আছে

আব্দুর রহমান ছেলেটার দিকে তার হাতের প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে বলে, নাও-এগুলো তোমার জন্য

ছেলেটা সেসব নিল নাএকটু নড়াচড়াও করল নাএতটুকু শব্দও না

ফুলবানু বলল, আপনে আবার এইসব আনতে গেছেন ক্যান?

কিনে তো আনি নাইনিজের দোকান থেকে নিয়ে এসেছি

ফুলবানু ছেলেকে বলল, ন্যাও বাজান-ন্যাওচাচা লাগেচাচারে সালাম দ্যাও

কিন্তু ছেলে সেভাবেই দাঁড়িয়েঅনড়নির্বাকচোখের ভেতর বিস্ময় ও প্রশ্ন 

আব্দুর রহমান উঠে গিয়ে একরকম জোর করে ছেলেটার হাতে প্যাকেটটা গুজে দিয়ে এসে নিজ টুলে বসলোফুলবানু বলল, কী খাইবেন?

কিছু খাবো নাআমি এখনই চলে যাবোহাতে কাজ আছে

চা দেই এক কাপ?

চায়ের কথা শুনে আব্দুর রহমান যেন একটু চমকে উঠলদুধ চা না-ই হলোলাল চায়ের জন্যও তো চায়ের পাতা, চিনি ইত্যাদি লাগবেআর লাগবে অন্তত একটা কাপ, একটা পিরিচনাকি দোকান থেকে চা কিনে এনে দিবে?

আব্দুর রহমানের মনের কথা ফুলবানু ধরতে পারলো হয়তোবলল, ঘরে চাপাতি, চিনি আছেচারটা কাপ আর চারটা পিরিচও আমার জমানো ট্যাকা দিয়ে কিনছিমাঝে মাঝে আমরা চা খাই

আব্দুর রহমান লজ্জা পেলমানুষের সম্পর্কে এতটা নিম্ন ধারণা রাখা ঠিক নাফুলবানু বলল, বসেন, চা বানায়া আনতেছিদেরি হইব না

ফুলবানু যখন মাটির চুলায় চা বানানোর কাজে ব্যস্ত, তখন আব্দুর রহমান ভেতর-বাহিরের সবগুলো চোখ দিয়ে ফুলবানুকে দেখতে লাগলোতার মনে হলো, এরকম বস্তিতে ফুলবানুর মত একজন নারী ঠিক মানানসই নয়মনে হচ্ছে, নোংড়া-আবর্জনার মধ্যে একটা সুন্দর-সুগন্ধী ফুলএকে টবে সাজিয়ে রাখলে সবার দৃষ্টিতে ধাঁধাাঁ লাগবে

আব্দুর রহমান চলে যাবার পর অনেক রকম ভাবনা আসে ফুলবানুর মাথায়আব্দুর রহমানের সাথে এতটা কথা বলা, তাকে চা বানিয়ে খাওয়ানো, এসব কী ঠিক হলো? বস্তির অন্যান্য ঘরের মেয়েরা গলা বাড়িয়ে দেখেছে সবতারা পরস্পরের সাথে চোখে চোখে কথা বলেছে, ফিসফিস করেছেকথাটা তার স্বামীর কানে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়স্বামী যদি তাকে ভুল বোঝে? তার সুখের সংসারে আগুন লেগে যাবে না তো? সে স্বামী-সন্তানদের অনেক ভালোবাসেআব্দুর রহমানকে একজন শিক্ষিত-ভদ্রলোক ছাড়া সে আর কিছুই মনে করে নাআর সে তো তাকে ডেকে আনেনিনিজে থেকে তাকে কখনো ফোনও করেনিএকজন মানুষ বাড়িতে এসে গেলে তার সাথে কি খারাপ ব্যবহার কর যায়?

ফুলবানু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, সে নিজেই স্বামীকে সব খুলে বলবেসত্য কথা বলবেতার স্বামী নিশ্চয় তার কোনো দোষ খুঁজে পাবে নাঅন্যের মাধ্যমে কথাটা স্বামীর কানে গেলে বিকৃত হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে

রাতে স্বামীর উষ্ণ আলিঙ্গনের মধ্যে আবদ্ধ থেকে ফুলবানু বলল, একটা কথা কইতে চাইআবার রাগ করবেন না তো?

তুমার কথায় আমি কোনোদিন রাগ করছি?

যদি আবার অন্যভাবে নেন?

কী এমন কথা যে অন্যভাবে নিমু?

নিলেও নিতে পারেন, তাই ডর লাগে

তোমার কথা নির্ভয়ে কইয়া ফালাও

কথা বলার আগে ফুলবানু নিজেকে আরও বেশি করে উন্মুক্ত করেস্বামীকে আরও বেশি মাতাল করে দেয়শরীর জেগে উঠলে পুরুষ মানুষের পক্ষে নারীর আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করা অসম্ভবপুরুষ সবচেয়ে অসহায় নারীর শরীরের কাছে

ফুলবানু সময় নিতে থাকেকছিম উদ্দিন দুটি বেলুনের মাঝে তীব্রভাবে মুখ গুঁজে দিয়ে গোঙানির মতো করে বলে, কও না ক্যা, কী কইতে চাইলা?

সেই লোক আইজ আমাগো বস্তিতে আসছিল

কোন লোক?

ঐ যে একদিন ভুল কইরা ফোন দিছিলশিক্ষিত মানুষবড়লোকমরডান মার্কেটে বড় দোকান আছে

কছিম উদ্দিন বেলুনের ভেতর থেকে মুখ বের করতে চেয়েছিলফলবানু সেটা করতে দিল নাআরও বেশি করে চেপে ধরলো সেকছিম উদ্দিন গোঙানির সুরে বলল, কী কও কিছু বুঝি না

অহন বুঝবেন নাবুঝতে চাইলে কেমুন কেমুন মনে হইবোতার চাইতে কাইল-পরশু আমরা সবাই তার দোকানে যামুগেলেই বুঝবেনসে পোলা-মাইয়া আর আপনেরে নিয়া যাইতে কইছে

ফুলবানু বুঝতে পেরেছে, এভাবে বলতে গেলে স্বামীর মাথায় অনেক প্রশ্ন আসতে পারেসে সব প্রশ্নের জবাব ঠিকমতো দেয়া সম্ভব না-ও হতে পারেতাই সে বাস্তবে প্রমাণ করে দিতে চায় যে, দোষের কিছু সে করেনি

তারপরই সে স্বামীকে চূড়ান্ত আহ্ববান জানায়কছিম উদ্দিনের মাথার মধ্যে তখন অবিরাম বিদ্যুৎ চমকাচ্ছেকে এসেছিল, না এসেছিল সে কিছুই ভাবতে পারে নাসে ভুলে যায় আব্দুর রহমান-মডার্ন মার্কেট-রহমান স্টোরপৃথিবীর সবকিছু মুছে দিয়ে পতঙ্গ হয়ে সে বাটারফ্লাই সাঁতার কাটতে থাকে আগুন সাগরেতারপর চরম ক্লান্তিঘর্মাক্ত শরীরে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়েএবং ঘুমিয়ে যায়সকালে তার কিছু মনে থাকে কি না তা বোঝা যায় নাস্বাভাবিকভাবে খেয়ে-দেয়ে রিকশা নিয়ে বের হয়ে যায়   

       

******

মডার্ন মার্কেটে রহমান স্টোরে গিয়ে কছিম উদ্দিন বুঝলো, দোকানটা তার ভালোই চেনাএই দোকানের সামনে রিকশা ভিড়িয়ে, দোকানের বেঞ্চিতে বসে অনেকবার সে বাটারবন, পাউরুটি, কলা ইত্যাদি খেয়েছেঅবশ্য আব্দুর রহমানকে দেখেছে খুব কমদুজন কর্মচারী থাকে সব সময়

আব্দুর রহমানও তাকে দেখেছে নিশ্চয়এখন সে দোকানে রিকশাওয়ালা হিসেবে আসেনি, এসেছে দোকান মালিকের মেহমান হয়েআব্দুর রহমান যদি তাকে রিকশাওয়ালা হিসেবে মনে রেখে থাকে-এরকম ভেবে তার কেমন শরম বোধ করতে লাগলো

তবে আব্দুর রহমান তাকে এবং তাদেরকে মেহমান হিসেবেই পূর্ণ সম্মান দিলদোকানের সামনে ও দুই পাশে মোট তিনটা বেঞ্চি পাতাআব্দুর রহমান কিন্তু তাদেরকে বেঞ্চিতে বসতে দিলো নাব্যতিব্যস্ত হয়ে নিজ হাতে দোকান থেকে চেয়ার টেনে বের করলএকজন কর্মচারীকে দিয়ে পাশের হোটেল থেকে মোগলাই পরাটা, হালিম আর চা আনালোনিজে পাশে বসে হাসি মুখে কথা বলতে লাগল, আপনারা এসেছেন, খুব খুশি হয়েছিআত্মীয় বলতে শুধু রক্তের সম্পর্ক থাকতে হবে, এটা ভাবা ঠিক নাআত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠলে সেটা হয় আরও বড় আত্মীয়আল্লার সৃষ্টি মানুষ সবাই সবার আত্মীয়

আব্দুর রহমানের কথা কছিম উদ্দিনের ভালো লাগলোকছিম উদ্দিন মুখে কোনো ভাষাই খুঁজে পাচ্ছিলো নাআসলে সে যে ভাষায় কথা বলে সেটা তো ভদ্রলোকের ভাষা নাআব্দুর রহমান বলল, ভাই সাহেব, আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন নাআপনি কি আমাকে ভাইয়ের মতো ভাবতে পারছেন না?

কছিম উদ্দিন হতভম্ব বলতে লাগলো, খাইতেছি তো.... আরে কী যে কন!

বিদায়ের সময় আব্দুর রহমান কছিম উদ্দিন আর ফুলবানুর ছেলেমেয়ের হাতে বড় বড় দুটি প্যাকেট ধরিয়ে দিলপ্যাকেটগুলো ভর্তি চানাচুর, চকলেট, বিস্কুট, চুইংগাম, কেক ইত্যাদি

কছিম উদ্দিন আর ফুলবানু দুজনেই বলতে লাগলো, আহা! করেন কী? করেন কী? আপনে কি পাগল হইছেন?

আব্দুর রহমান মিটিমিটি হাসে আর ছেলেমেয়ে দুটির মাথায় হাত বুলায়

কছিম উদ্দিনের সাথে বিদায়ী করমর্দন করতে গিয়ে আব্দুর রহমান বলল, ভাই সাহেব, আপনিও যখন আছেন, তো কথাটা আজকেই সেরে ফেলি

কছিম উদ্দিন আর ফুলবানু একযোগে চমকে উঠেকী কথা বলতে চায় সে? বেশি ঘাবড়ে যায় ফুলবানুশত হলেও সে নারীআর তারা এখানে এসেছে তার পরিচয়েইসে বলে, কী কথা.....! কী কথা.....!

আব্দুর রহমানের মুখের হাসি মুহূর্তের জন্য বিলীন হয় নাআব্দুর রহমান বলে, শান্ত হয়ে বসেন, তারপর বলি

ফুলবানু ধপ করে বসে পড়েতার হাঁটুর শক্তি যেন কমে গেছেসত্যি কি কিছু হতে যাচ্ছে? কী বলতে চায় আব্দুর রহমান?

আব্দুর রহমান বলে, আমার দোকান তো দেখছেনআল্লার রহমতে মার্কেটের সেরা

কছিম উদ্দিন বলে, জি জি

এছাড়া, দুইটা সিএনজি আর দশটা রিকশা কিনে ভাড়া দিয়েছি

জি জি

পাশের মার্কেটে একটা কফিসোপ চালু করতে যাচ্ছিকফি, পাশাপাশি সব ধরনের ফাস্টফুড থাকবে

জি জি

ফাস্টফুডের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে একজন নারী রাখার ইচ্ছা

জি জি

আমি বলছিলাম কি, বোন ফুলবানু যদি......

আব্দুর রহমান এবং ফুলবানু দুজনেই ধরে প্রাণ ফিরে পায়বিশেষ করে ফুলবানুর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়েআব্দুর রহমান বলে, আসলে বিশ্বস্ত মানুষ পাওয়া কঠিন কি না

কছিম উদ্দিন বলে, কিন্তু সে তো তেমন লেখাপড়া জানে না

হিসাব-নিকাশ তো লিখতে পারবে?

তা পারবোফোর কি ফাইভ পর্যন্ত পড়ছিল মনে হয়

তাতেই যথেষ্টতার নিজের লিখতে হবে নাঅন্য লোকও তো থাকবেতার কাজ সবাইকে তত্ত্বাবধান করা

আমার তো দুইটা ছেলে-মেয়ে আছে

সেটা আমি বুঝিগার্মেন্টেসের মতো ভোর বেলা আসতে হবে নাখাবার সার্ভের জন্য যে ছেলেরা থাকবে ওরাই দোকান খুলবেঘরের নাস্তা তৈরী করে, ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে দশটার দিকে এলেই চলবেআবার বারোটার মধ্যে গিয়ে ছেলে-মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে, দুপুরের খাবার তৈরী করে দুইটার মধ্যে আসবেআর এ দিকে পাঁচটা/সারে পাঁচটা পর্যন্ত থাকতে হবে

এত সুবিধা!

দোকান তো মাত্র শুরু হচ্ছে, তাই বেতন বেশি দিতে পারবো নাশুরুতে আড়াই হাজার দিব

অনেক!

দোকান থেকে যখন লাভ আসা শুরু হবে তখন বেতন বাড়াবোআর বছরে বেতনের অর্ধেক দুইটা উৎসব বোনাস থাকবে

আইচ্ছা, ভাইবা দেখি

আমার মনে হয়, এত ভাবাভাবির কিছু নেইসেলসগার্ল-এর চাকরি সম্মানিত চাকরিকলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরাও এ চাকরি করছে

খারাপ তা বলি নাই

আর আমার দোকান থেকে আপনাদের বাসাও তো কাছেহেঁটেই যাওয়া-আসা করতে পারবেন

তা ঠিক

আব্দুর রহমানের দোকান থেকে তারা হেঁটেই আসতোকিন্তু এখন তারা মেহমানআব্দুর রহমানের সামনে হেঁটে আসতে লজ্জা বোধ করলোতাই কছিম উদ্দিন বলল-দাঁড়াও, আমি একটা রিকশা নিয়া আসি

বরাবর কছিম উদ্দিন উচ্চারণ করে রিশকাএই প্রথম তার রিকশাউচ্চারণতবে তার রিকশা ডাকতে হলো নাআব্দুর রহমান দোকানের ছেলে দিয়ে রিকশা ডেকে দিলশুধুই তা নয়, নিজের পকেট থেকে ভাড়া বাবদ বিশ টাকা রিকশাওয়ালার হাতে গুজে দিলকছিম উদ্দিন ও ফুলবানু দুজনেই বলতে লাগলো, আপনে ভাড়া দিতেছেন ক্যান? আরে......!

কছিম উদ্দিন সারা জীবন ভদ্রলোকদের রিকশায় বসিয়ে নিজে রিকশা চালিয়ে আসছেএই প্রথম সে নিজে রিকশার যাত্রীস্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে ভদ্রলোকদের মতো বেড়াচ্ছেতার রিকশায় বসে স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু-বান্ধব কত রকমের আলাপ, কত খুনসুটি করে! সে আজ স্ত্রীর সঙ্গে কী গল্প করবে? গল্প কিছু নেইজরুরি আলাপটাই সেরে নেয়া যায়

সে বলল, বেতন আড়াই হাজারদুই ঈদের বেতনের অর্ধেক বোনাসপরে বেতন আরও বাড়বোএ তো সরকারি চাকরি দেখতেছি!

ফুলবানু বলল, আপনে কী কন? সেই কামে যাওন ঠিক হইবো?

মানুষটা তো ভালাই মনে হইতেছে

মানুষ ভালাশিক্ষিত মানুষ না?

আমাগো কপালডাও ভালাআসলে কার কপাল কহন খুলে তা বোঝা যায় না

সেইহানে কামে যোগ দিলে তো সামনের মাস থিকাই দিতে হইবো

একটু সবুর করোআমি এর মধ্যে মরডান মার্কেটে গিয়া তার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা কইরা দেখি

হেয় যদি টের পায়? মনে কষ্ট পাইবো যে, আমারে বিশ্বাস করতে পারতেছে না

আরে না, হেয় কিচ্ছু টের পাইবো নাহেয় যহন থাকবো না তহন যামু

আইচ্ছা, আপনে যেইটা ভালা বুঝেন

সত্যিই কছিম উদ্দিন মডার্ন মার্কেটে গিয়ে অন্যান্য লোকজনের সাথে আব্দুর রহমানের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করেকেউ খারাপ বলে নাবরং সবাই তার প্রশংসাই করে

********

ফুলবানুর প্রথম মাসের বেতন পাবার পর থেকেই সংসারে উজ্জ্বলতা বাড়তে থকেমাটির হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসনকে বদলে আসে এলুমোনিয়ামমাটির চুলার বদলে কেরোসিন তেলের স্টভছেলে-মেয়ের জন্য অসময়ে নতুন জামাকাপড় কেনেস্বামীর জন্য জামা, লুঙ্গিনিজের জন্য নতুন সালোয়ার-কামিজ, শাড়িখাবার-দাবারেও উন্নতি হয়

আশেপাশের বস্তিঘরের মেয়েরা শুধু উঁকি-ঝুঁকি দেয়কানে কানে ফিসফিস করেনানা রকম কথাকল্পনা-জল্পনা

মাগি এমুন পাল্টায়া গেল ক্যামনে?

হাতে ট্যাকা আসলে সবাই পাল্টায়

ট্যাকা ক্যামনে আসলো? শুনলাম, মগি নাকি চাকরি নিছে? ক্যামনে চাকরি পাইলো? মাগি কি লেহা-পড়া জানে?

লেহা-পড়া জানা লাগে নারে, লেহা-পড়া জানা লাগে নাঅমন রূপ থাকলে মাইয়া মানুষের আর কিচ্ছু লাগে নাচাকরি ঘরের মধ্যি হাঁইটা আসে

একদিন দেখলাম, এক ব্যাডায় আইসা বইসা আছেমাগি ব্যাডারে চা বানায়া খাওয়াইল

মাগি পারেওভদ্দলোকের মতো চা বানায়া খাওয়ায়

এমুন ছলা-কলা জানে বইলাইতো আইজ......

মাগির ভাতারও একটা.......! বউরে দিয়া ট্যাকা আনে

দ্বিতীয় মাসের বেতন পেয়ে আগের কিছু জমানো টাকা মিলিয়ে ফুলবানু কছিম উদ্দিনকে একটা রিকশা কিনে দিলআর সেই সাথে সংসারের আয়-রোজগার বেড়ে গেল আরওআগে রিকশার মালিককে দিতে হতো দিনে দেড়শটাকাসারা দিনে দুই/আড়াইশটাকার বেশি কছিম উদ্দিন নিজের পকেটে রাখতে পারতো নাপরিশ্রমও করতে হতো বেশিনিজের রিকশা হবার পর অল্প পরিশ্রমেই বেশি টাকা রোজগার করতে পারেমাঝে মাঝে মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দেয়ফুলবানুকে নামিয়ে দেয় তার কর্মস্থলেঅনেক আনন্দ!

দোকান থেকে লাভ আসা শুরু হলে ফুলবানুর বেতন বাড়ানোর কথা ছিলদোকান ভালো চলেকাছেই একটা স্কুলটিফিন পিরিয়ডে ছেলে-মেয়েরা এসে হামলে পড়েহল্লা করে ফাস্টফুড খায়এটা যে একটা লাভজনক ব্যবসায় হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে তা আব্দুর রহমানের বুঝতে বাকি থাকে না

তিন মাস পরেই ফুলবানুর বেতন পাঁচশটাকা বেড়ে গেলবাস্তবিক সে বসার কারণে দোকানে বিক্রি বেড়ে গেছে কয়েক গুণআশেপাশে যে সব ফাস্টফুডের দোকান আছে, সেগুলোর কোনোটায়ই সেলস গার্ল নেইআর ফুলবানুও পোশাক-আশাক, ব্যবহারে তার রূপ-যৌবন প্রকাশ করতে পেরেছে, হয়তো নিজের অজান্তেইমুখের ভাষাটাও বদলে ফেলেছে আশ্চার্যজনকভাবেপ্রমিত বাংলায় কথা বলে

এ নিয়েও বস্তিতে কথা হয়

মাগি কি সুন্দর কইরা কথা কয়-আচ্ছা, আপনি কী চাচ্ছেন? আমি তো হাসতে হাসতে শ্যাষ

পারলো কেমনে এমুন?

এই মাগি সবই পারেস্বামীরে তো রাজা-বাদশা বানায়া দিল

আমি তো মনে করছিলাম, মাগি বুঝি সিনালপনা করে

করে না যে তা ক্যামনে বুঝোস? দেখস না, কেমুন টাইট জামা-পায়জামা বানাইছেসব ফাইটা বার হইতে চায়

আলোহীন জগতেও ভালো থাকেসেরকম একজন বলে, আইচ্ছা, তুমরা দিন-রাইত তারে নিয়া প্যাঁচাল পারো ক্যান? হেয় কি তুমাগো কিছু করছে? হেয় তার মতো চলতেছেতুমাগো জ্বলে ক্যান? তুমরা কি তারে বিপদ-আপদে দুইটা ট্যাকা দিবা, না দিতে পারবা?

ছয় মাস অতিবাহিত হবার আগেই ফুলবানু আর কছিম উদ্দিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, তারা আর এই বস্তিতে থাকবে নাঅন্তত উপরে টিনের ছাদ, চারিদিকে ইটের দেয়াল, আলাদা একটা বাথরুম, একটা রান্নাঘর এরকম এক রুমের একটা ঘর ভাড়া নিবেমাথার ওপর ঘুরবে বৈদ্যুতিক পাখাসাদা আলোর লাইট লাগাবেহ্যাঁ, সেটাকে আর ঘর বলতে হবে নাবলতে হবে বাসাছেলে-মেয়ের লেখা-পড়ার জন্য চেয়ার-টেবিল কিনবে

কছিম উদ্দিন প্রতিদিনই বাসা খোঁজেকিন্তু পায় নানা পাবার কারণ-মেয়ের স্কুল আর ফুলবানুর চাকরির দোকানবাসাটা এর কাছাকাছি হতে হবেদূরে গেলে দুজনেরই সমস্যাকিন্তু কাছাকাছি কোনো টিনসেড বাসা পাওয়া যাচ্ছে না

******

ফুলবানুর চাকরির বয়স নয় মাস হয়ে গেছে

একদিন বিকাল পাঁচটা অতিক্রান্তকিন্তু ফুলবানু দোকান থেকে ফেরে নাসাধারণত পাঁচটার কিছু আগেই সে ফিরে আসেসে ফেরে তারপর কছিম উদ্দিন রিকশা নিয়ে বের হয়ছেলে-মেয়েকে সন্ধ্যাবেলা বস্তিঘরে একাকি রেখে যাওয়া যায় না

কছিম উদ্দিন মেয়েকে বলল, মা জননী, তোর মায়রে ফোন দেদেহিএত দেরি তো কুনু দিন করে না

মেয়ে কয়েক মিনিট পর ঘর থেকে বের হয়ে এসে বলে, বাজান, মা তো মোবাইল রাইখ্যা গেছে

কস কী! আইচ্ছা, তায়লে আমি রহমান বাইয়ের মোবাইলে ফোন দিয়া দেহি

আব্দুর রহমানের দুটি নাম্বারই কছিম উদ্দিনের মোবাইল ফোনে সেভ করা আছেকছিম উদ্দিন ফোন করলোদুটি নাম্বারই বন্ধ

কছিম উদ্দিন চিন্তিত হয়ে বলল, কী করি এহন? তোর মায় না ফিরলে কেমনে আমি রিশকা নিয়া বার হই?

সন্ধ্যা অতিক্রান্তভেবে ভেবে কছিম উদ্দিন বলল, তোরা রিশকায় ওঠতোগো দোকানে নিয়া যাইমায়ের কাছে তোগো পৌছায়া দিয়া আমি যামুগাতোরা মায়ের সাথে ঘরে ফিরা আসিস

রহমান ফাস্টফুড সোপ-এর সামনে গিয়ে কছিম উদ্দিন বজ্রাহতদোকান বন্ধসেখান থেকে গেল রহমান জেনারেল স্টোরেসেটাও বন্ধদোকানের সামনে অন্ধকারদুটি কুকুর জড়াজড়ি করছে

পাশের দোকানে গিয়ে কছিম উদ্দিন জিজ্ঞেস করে, ও বাই, ঐ দোকান কহন বন্ধ করছে?

বন্ধ করবো কী, দোকান তো আজ খোলেই নাই

খোলে নাই! আর ফাস্টফুডেরটা?

ঐটাও খোলে নাইশুনছি, রহমান ভাই নাকি বিয়া করছে

বিয়া করছে! কই বিয়া করছে? কিছুই তো জানলাম না

আমি অতো কিছু বলতে পারবো নাআমারে কি দাওয়াত দিছে?

কছিম উদ্দিন বিড়বিড় করে বলে, বিয়া করছে! একবারও তো কিছু কইলো না

কি এক শঙ্কায় কছিম উদ্দিনের বুক কেঁপে ওঠেতার হাত-পা যেন অবশতবু শক্তিহীন পায়ে ভর করে ছেলে-মেয়ের হাত ধরে এ দোকান থেকে ও দোকানে যায়

ছেলেটা ছোটবিশেষ কিছু ভাবতে পারে নামেয়েটার মুখ মলিনমায়ের কোনো অমঙ্গল হতে পারে সে এরকমই ভাবে

একটু ফাঁকা জায়গায় এসে কছিম উদ্দিন ছেলে-মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, তোগো মায় কি রহমান বাইয়ের বিয়ার ব্যাপারে কিছু কইছিল?

মেয়ে বলে, না বাজান, কিছু কয় নাই

আরেক দোকান থেকে একজন বলে, শুনছি, ফাস্টফুডের দোকানের ঐ মেয়েটার সাথে বিয়া

কছিম উদ্দিনের পায়ের নিচে যেন কোনো মাটি নেইসে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নেয়দুটি শিশু সন্তানের হাত তার দুই হাতের মুঠোয়তাকে পড়ে গেলে চলবে নাশত ঝড়েও তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে

ফিরে আসার সময় রিকশায় বসে মেয়েটা বলল, বাজান, ঐ ব্যাডা একটা শয়তানমিছা কথা কইছেমায় হেরে বিয়া করতে যাইবো ক্যান?

ব্যাডা আমগো সাথে ইয়ার্কি করছে

ঘরে ফিরে কছিম উদ্দিন আব্দুর রহমানের নাম্বারে অনেক বার চেষ্টা করলোফল একইবন্ধ

রাত বেড়ে যাচ্ছেছেলেটার চোখে ঘুম নেমে এসেছেমায়ের বুকের ওম ছাড়া সে ঘুমাতে পারে নাকছিম উদ্দিন বলল, বাজান, তুমি ভাত খাইয়া ঘুম যাওমায় আসলে তুমারে ডাইকা উঠামু

আমি ভাত খামু না বাজান

দুঃশ্চিন্তায় মানুষের ক্ষুধা মরে যায়শিশু মনেও দুঃশ্চিন্তা ভর করেছেমা ছাড়া সে নিজের অস্তিত্ব ভাবতে পারে নাছেলেটা বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলো

আকাশের চাঁদ মাথার ওপরে চলে এসেছেছেলেটা ঘুমিয়ে আছে বাবার কোলেমেয়েটা বসে আছে বাবার গা ঘেষেএই ক্ষুদ্র জীবনে এত রাত পর্যন্ত সে কোনো দিন জাগেনিকছিম উদ্দিন বসে বসে ভাবছে-কিচ্ছু হয়নিতার প্রিয়তমা স্ত্রী ফিরে আসবেআজ রাতে না হলেও, কাল সকালে

আচানক কছিম উদ্দিনের ফোন বেজে উঠেসে ধরপড়িয়ে উঠেমেয়েটাও সোজা হয়ে বসেঅপরিচিত নাম্বারকছিম উদ্দিন কল রিসিভ করেফুলবানুর কন্ঠআনন্দিত হয়ে সে মেয়েকে বলে, তোর মা ফোন দিছে

মেয়ে ম্লান হাসেকছিম উদ্দিন ফোনে কান পেতে শোনে, শোনো, মানুষের মন বড়ই বিচিত্র জিনিসমানুষ অনেক সময় নিজের মনকে নিজে বুঝতে পারে নাতুমি বড়ই ভালো মানুষআমি তুমারে অনেক ভালোবাসিদুনিয়ার যে কোনো পুরুষের চাইতে আমি তুমারে বেশি ভালোবাসি

এই সব কী কইতাছো? আসল কথা কওপোলাডা না খাইয়া ঘুমায়া গেছেমাইয়াডা.....

তারপরেও আমি কেন যে আব্দুর রহমানকে বিয়া করলাম, আমি তা নিজেই জানি নাশুধু জানি, আব্দুর রহমানের চাইতে আমি তুমারেই বেশি ভালোবাসিকিছু চিন্তা কইরো নাপোলা-মাইয়ার সব খরচ আমি চালামুযেমুন ঘর ভাড়া করতে চাইছিলা তা করোমাসে মাসে ভাড়ার ট্যাকা আমি দিমুচিন্তা কইরো না কিছুমাইয়া কি জাইগা আছে? জাইগা থাকলে ওরে দ্যাও

কছিম উদ্দিন প্রাণহীন দৃষ্টি মেলে তাকায় মেয়ের দিকেফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, তোর মায় সত্যিই রহমান মিয়ারে বিয়া করছেনেকথা ক

মেয়েটা চোখের পানি মুছতে মুছতে মায়ের কথা শুনতে লাগলোমা তাকে কী বললো তা সে-ই শুধু জানেবেশ কিছুক্ষণ পর কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, আমাগো কিছু দেওন লাগবো না মাতুমিই যহন নাই, তহন আমাগো আর কিছু দেওন লাগবো নাতুমি সুখে থাকো মা

********

কছিম উদ্দিন শুয়ে আছে চিৎ হয়েতার ঘুম আসছে নাতার দুই পাশে ছেলে আর মেয়েদুজনই ঘুমাচ্ছেআবার মেয়েটা জেগেও থাকতে পারেসে ঘুমের ভান করে জেগে থাকতে শিখেছে

ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছাদের একটা ফুটো দিয়ে কছিম উদ্দিনের চোখ চলে গেল আকাশেসেখানে বড় একটা চাঁদআজ পূর্ণিমার রাত

এক বছর আগে ঠিক এই ফুটোটা দিয়েই সে পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছিলদেখতে দেখতে স্ত্রীকে একটা মোবাইল ফোন উপহার দেবার কথা তুলেছিলনা, ফুলবানুকে এখন স্ত্রী ভাবাটা ঠিক হবে নাসে এখন আব্দুর রহমানের আইনসম্মত স্ত্রীফুলবানু তাকে আইনসম্মতভাবে তালাক দিয়েছেতালাক দেবার পর কাউকে স্ত্রী ভাবা ঠিক না

চাঁদটা তেমনই আছেএক বছর আগে যেমন ছিল, ঠিক তেমনহাজার বছর আগে যেমন ছিল, ঠিক তেমনকোনো কিছুরই কোনো পরিবর্তন হয়নিশুধু তার জীবনটাই বদলে গেছেমানুষের জীবন মুহূর্তে অনেক বদলে যেতে পারে

 ফুলবানু কথামত মাসে মাসে কছিম উদ্দিনকে টাকা দিচ্ছিলকিন্তু সে তা নেয়নিতার টিনের ছাদ দেয়া কোনো বাসায়ও ওঠা হয়নিফুলবানু ছেলে-মেয়েকে জামা-কাপড়, খাবার ইত্যাদি দেয়সেসব ছেলে-মেয়ে নিতে চায় না, নেবার ইচ্ছা হয় না তাদেরতারপরও ফুলবানু জোর করে রেখে যায়খাবারগুলো ছেলে-মেয়ে অল্পই খায়কছিম উদ্দিন সে সব স্পর্শ করে নাবেশিরভাগ খাবারই নষ্ট হয়আর ছেলে-মেয়ে বাবার কিনে দেয়া কাপড়গুলোই আনন্দের সাথে পরেমায়ের দেয়া দামি কাপড়গুলো পরলে ওরা আরও ম্লান হয়ে যায়ফুলবানু প্রতি মাসে স্কুলে গিয়ে মেয়ের বেতন, এবং অন্যান্য যা লাগে দেয়ছেলেকেও সে স্কুলে ভর্তি করেছেকছিম উদ্দিন প্রায়ই মেয়েকে বলে, তোর মায়রে কইবি, ইসকুলের কুনু খরচ য্যান না দেয়সব আমি দিমুআমার হাত-পাও কি নুলা হইছে?

মেয়ে বলে, আমি তো দিতে না করি, তাও দিয়া যায়

মেয়ে ঠিকই বলেছেসে অনেক বার মাকে নিষেধ করেছে কিছু না দিতেবেশ যুক্তি সহকারেই কথা বলেছে সে

তুমি আর আমাগো ইসকুলের বেতন দিও নাআমার বাপই দিতে পারবো

আমি দিলে দোষ কী?

তুমার কাছ থিকা কিছু নিতে ভাল্লাগে নাতুমার দেওয়া জামা-কাপড় আমাগো পরতে ইচ্ছা হয় না

এইসব কী কস তুই?

ঠিকই কইতুমিই যহন নাই, তহন তুমার দেওয়া জিনিস-পত্তর আমাগো দরকার নাইআমরা রিশকাওয়ালার পোলা-মাইয়া, রিশকাওয়াল পোলা-মাইয়ার মতো জামা-কাপড় পরুম

আমি নাই! আমি কী তোগো মা না? তুমি তুমি কইরা কথা কস ক্যান? আমারে মা ডাক

তুমারে মা ডাকতে ইচ্ছা হয় নাদুনিয়ায় আমাগো মা আছে এই কথা ভাবতে ভাল্লাগে না

ফুলবানু হাহাকার করে কেঁদে উঠে, অপরাধ করছিঅপরাধের শাস্তি তো পাইতেই হইবোপেটের পোলা-মাইয়া আর কোনো দিন আমারে মা ডাকবো না

অবশ্য কছিম উদ্দিন চায়, ছেলে-মেয়ে ফুলবানুকে মা ডাকুকসে বলে, তার কাছ থিকা কিছু না নেস, তয় তারে মা ডাকিসদশ মাস দশ দিন তোগো পেটে ধরছে তোবুকের দুধও তো খাওয়াইছেগান আছে-মায়ের এক ধার দুধের দাম/ বিকিয়া গায়ের চাম/ পাপশ বানাইলে ঋণের শোধ হবে না......

ফুলবানুর কিনে দেয়া রিকশাটা কছিম উদ্দিন ফেরত দিতে চেয়েছিলএকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আব্দুর রহমানের দোকানের সামনে গিয়ে রিকশাটা ফেলে রেখে আসবেকিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা করতে পারেনি

ভাড়ার রিকশা নির্দিষ্ট সময়ে চালাতে হয়, আর নির্দিষ্ট সময়ে জমা দিতে হয়এখন সে সেরকমভাবে সময় মানতে পারে নাঘরে ছোট দুটি ছেলে-মেয়েতাদের দেখাশোনা করতে হয়সময়-অসময়ে তাদের কাছে আসতে হয়অসময়ে তাদের ঘরে রেখে যাওয়া যায় নানিজের রিকশা থাকলে সুবিধামত সময়ে বের হওয়া যায়

কছিম উদ্দিন শোয়া থেকে উঠে বসেছেলে-মেয়ের শরীরে হাত বুলায়কপালে চুমু খায়তারপর উঠে বাইরে আসেঘরের সামনে একটা ইটের উপর বসে

বাইরে খাঁ খাঁ জ্যো¯œচাঁদটা যেন খিল খিল করে হাসছেকছিম উদ্দিন চাঁদকে উদ্দেশ্য করে বলে, তুই যদি মানুষের দুঃখ বুঝতে পারতি, তো অমন হাসতে পারতি না

তারপর সে নিজের অজান্তেই চলে যায় স্মৃতির আঙিনায়উল্টাতে থাকে দশ বছরের স্মৃতিকত স্মৃতি ফুলবানুকে ঘিরেসংসারে অভাব ছিলকিন্তু দুঃখ ছিল না কোনোকত সুখ! কত হাসি! কত আনন্দস্মৃতিগুলো আজ বুকের পাঁজরে কেমন নির্মমভাবে আঘাত করেফুলবানুরও কি মনে আছে সেই সব স্মৃতি? তাকেও কি সেসব আঘাত করে? সে নিজের ভুল শুধরে নেয়, আরে ধুর! সেই সব বিষয় তার মনে থাকবো কেমনে? হেয় তো এখন রাজরাণী

আচানক কাঁধে একটা স্পর্শছোট্ট-কঁচি-নরম হাতের ছোঁয়াকছিম উদ্দিন চমকে তাকিয়ে দেখে, মেয়ে দাঁড়িয়েসে দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চায়বলে, কিরে মা, তুই জাগনা?

মেয়ের হাতে সেই মোবাইল ফোনটা, যেটা সে ফুলবানুকে দিয়েছিলভালোবাসার উপহারযাবার বেলায় ফুলবানু সেটা ফেলে রেখে গেছেকোনো পিছুটান সে সাথে নিতে চায়নিমেয়ে বলে, বাজান, মায়রে এই মোবাইলটা দেওয়াই ভুল হইছিলএই মোবাইলটার জন্যিই মায়রে হারাইলাম

তারপর সে মোবাইল ফোনটা ছুড়ে মারে সামনের রেইল লাইনের ওপরটং করে একটা শব্দ হয়আবছা অন্ধকারে মোবাইলটার ভাঙা টুকরোগুলো কোথায় ছড়িয়ে পড়ে তা দেখা যায় না

আচানক মেয়েটা বাবার গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠেসে কান্নার শব্দে জেগে উঠে ছেলেটাওসেও উঠে এসে বাবার কোলে লুটিয়ে কাঁদতে থাকেএই প্রথম যেন ওরা সমস্ত অস্তিত্ত দিয়ে বুঝতে পারলো, একদিন মা ছিলএখন নেইদুটি অবুঝ শিশুর কান্নার শব্দে মাঝ রাতে জেগে ওঠে পুরো বস্তিওদের কান্নার শব্দে আকাশের চাঁদটা যেন ভেঙে খান খান হয়ে ছড়িয়ে পড়বে মাটিতে

কছিম উদ্দিন নিজেকে শক্ত রাখতে চেষ্টা করেবলে, আমি তো আছিআরে ......! আরে এইভাবে.....! এই রাইতে.....!

কোনো বাক্য শেষ করতে পারে না সেমেয়েটা বলে-ভাল্লাগে না বাজানকতদিন মায়ের গলা ধইরা শুই না! কতদিন মায়ের শরীল ছুঁইয়া ঘুমাই না!

কছিম উদ্দিন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে নাতিনটি কন্ঠের মিলিত কান্নার ঢেউয়ে দরিদ্র বস্তিবাসীরা ঘরে থাকতে পারে নাসবাই এসে গোল হয়ে ওদের ঘিরে দাঁড়ায়অনেকেরই চোখ ভিজে উঠে

আচানক ভিড়ের ভেতর থেকে নিঃসন্তান-বিধবা জয়গুন ছুটে গিয়ে ছেলেমেয়ে দুটিতে বুকে তুলে নেয়বলে, আয় মা, আয় বাপ, আয়, আমি তোগো ঘুম পাড়ায়া দেই

জয়গুনের সাথে ছেলেমেয়ে দুটি ঘরের ভেতর যায়অনেক দিন পর তারা ¯œহের ছোঁয়ায়, নরম বুকে ঘুমায়

কছিম উদ্দিন বসে থাকে বাইরেমানুষ একে একে চলে গেছে সবাইচাঁদটা ফ্যাকাসে হয়ে এসেছেকছিম উদ্দিন ঘরে যেতে পারে নাঘরে ছেলেমেয়ের সাথে ঘুমাচ্ছে জয়গুনসে ঘরে গেলে কোনো কথা উঠতে পারেবদনাম হতে পারে     


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান