কবি: মাসুদ খান
কবি, লেখক, অনুবাদক। জন্ম ২৯ মে ১৯৫৯, জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালে। পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জ। প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। তড়িৎ ও ইলেকট্রন প্রকৌশলী। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় বুয়েটের হল ম্যাগাজিনে, ১৯৭৯-তে। জাতীয় পর্যায়ে লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করে মধ্য-আশি থেকে, বাংলাদেশের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্যপত্রিকায়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন সাহিত্য-পত্রিকায় ও কবিতা-সংকলনে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : পাখিতীর্থদিনে (১৯৯৩) নদীকূলে করি বাস (২০০১) সরাইখানা ও হারানো মানুষ (২০০৬) আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি (২০১১) এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায় (২০১৪) দেহ-অতিরিক্ত জ্বর (২০১৫)
প্রলাপবচন
নদ এসে উপগত হবে ফের নদীর ওপর
দুই পারে জমে উঠবে কপট কাদার ঘুটঘুটে কেলেংকারি
মাঝখানে চোরাঘূর্ণি চোরাস্রোত
এলোমেলো এলোমেলো বাউরি ভাবনা এসে
পাক খেয়ে ঢুকে পড়বে বৃষ থেকে মিথুনের অধিক্ষেত্রে...
মাকাল ফলের মৃদু মনস্তাপ
করলা-লতার শ্যামলা আক্ষেপ
কোকিলস্য প্রবঞ্চনা, কাকের বাসায় উপঢৌকন
ভরা বিলের ওপর দিয়ে ভেসে আসা ভেজা-ভেজা সুর
হুদহুদ পাখির অস্থিরতা, অসমাপিকার লঘু তঞ্চকতা
একরোখা অশ্বের অস্মিতা, উগ্রবসনা আগুনের চঞ্চল রসনা...
আলগোছে সবকিছু পাশ কেটে গিয়ে
ওইদিকে বর থাকবে কনের বশে
খলনায়কের দাঁতের নিচে পড়বে কট্টরপন্থী কাঁকর
চার্জ করা হবে পশ্চিমের ব্লাস্ট ফার্নেসে
আর ঝাপটা এসে লাগবে পূর্বেরটা থেকে
খামাখা দিওয়ানা হবে রঙিলা বিড়ালিনী
ঘনঘন গণ-হাইপ উঠবে মামুলি ঘটনা ঘিরে এমনি-এমনি
হিস্টিরিয়ায় কাঁপতে থাকবে দেশকাল
সাত সাধু এক হবে, এক শয়তান সাত
দোষযুক্ত আলু নামবে হিমাগারের শ্রোণিচক্র থেকে...
এবং হয়তো আমি একদিন ঠিকই
পড়ো-পড়ো ঘরকে যোগাতে পারব
গাঁট-অলা তিন-বাঁকা শালকাঠের সমর্থন
নিশ্চিহ্নকে দেখাতে পারব কিছু লুপ্তপ্রায় চিহ্নের ইশারা
বিশেষকে কোনো ভ্রান্তিকর নির্বিশেষের আভাস
বেদিশাকে দিশার বিভ্রম...
আর দুম করে লিখে ফেলব এমন এক কবিতা একদিন,
যা পড়ে ভৌতিক সুর তুলবে একসঙ্গে সাধু ও শয়তান
সাপ-আর-অভিশাপে-গড়া মতানৈক্যে-ভরা গামারিকাঠের গিটারে
আর ‘চলে আয়’ বলে স্বয়ং ঈশ্বর টুইট পাঠাবেন দিব্য টুইটারে।
আবহসংকেত
অস্পষ্ট আশার মতো মাথার ওপর উড়ছে অসংখ্য বেলুন
নিচে মেটে তামাশার মতো একটানা ঘুরে চলেছে কুলালচক্র।
বিশাল মাঠের মধ্যে একা একপায়ে দাঁড়ানো একটি কাকতাড়ুয়া-
উচ্চতা- ন-ফুট। গাত্রবর্ণ- কখনো খড়ের রং, কখনো-বা কালো
(রং- সে তো আর কিছু নয়, আলোর কারসাজি),আহার্য- শূন্যতা ও সন্তাপ।
পুরীষ- হাহাকার, তা আবার বিষাদকর্কশ। পেশা- ভয় দেখানো।
- একটু একটু করে নড়ছে সন্ধ্যার বাতাসে।
সমস্ত জগৎ জুড়ে ঝাপসা আলো-অন্ধকার,
থেকে-থেকে পেঁচার ঘুৎকার,
ভীরু ও নিরীহ প্রাণীদের ত্রাহি আর্ত আওয়াজ,
আর
বেলুন উড়ছে, কুলালচক্র ঘুরছে, ঘুরছে তো ঘুরছেই,
কাকতাড়ুয়া নড়ছে, একটু একটু করে, সন্ধ্যার বাতাসে...
এইসব আবছায়া ভয়ের আবহ, ভয়াবহ,
এগুলির ভেতর দিয়েই কাল-কালান্তর বয়ে যাচ্ছে
তার চেয়েও আবছা কিছু অভয়বাতাস-
খুব হালকা, মৃদুমন্দ, অস্পষ্ট, বোঝাই যায় না প্রায়...
হোমাপাখি
পড়তে থাকা শুরু হলে একবার, জানি না কতটা পতনের পর সূচিত হয় উত্থান আবার--
ভাবছি তা-ই আর মনে পড়ছে সেই হোমাপাখিদের কথা যারা থাকে আকাশের অনেক উঁচুতে। আকাশেই ডিম পাড়ে। পড়তে থাকে সেই ডিম। কিন্তু এত উঁচু যে পড়তে থাকে দিনের পর দিন। পড়তে পড়তেই ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। তখন বাচ্চা পড়তে থাকে। পড়তে পড়তেই বাচ্চার চোখ ফোটে, ডানা হয়, পালক গজায়। একদিন দেখতে পায় সে পড়ে যাচ্ছে। অমনি শাঁই করে উড়ে যায় মায়ের দিকে। উঠে যায় অনেক উঁচুতে। এত উঁচুতে যে পাখিরা আকাশের গায়ে ইতস্তত ভাসমান তিলচিহ্ন হয়ে ফুটে থাকে।
ওই পক্ষিকুলে জন্ম পুনর্জন্ম আমাদের, ওই পক্ষিকুলেই পালন-পোষণ-পতন-উত্থান-উড্ডয়ন...
পাণ্ডবদের দেশে
পাণ্ডববর্জিত, ব্রাত্যজন-অধ্যুষিত জলাজংলা প্রদেশের এক নিরহ নামাজি
অদ্ভুত বিপাকে পড়ে গেছে আজান দিতে এসে এক অচেনা মুলুকে,
নির্ধারিত মুয়াজ্জিনের অনুপস্থিতিতে ৷
পায় না কেবলা খুঁজে পেয়েও হারায় বারবার
আর দ্যাখে- এই দেশে, এইসব বেগানা প্রদেশে
প্রচুর পাণ্ডব, পালোয়ান ৷ এত যে পাণ্ডব, কিন্তু কেমন যে তারা
জামাত-যৌথতা জানে না, আওয়াজ-কালাম মানে না,
নিয়তের ঠিক নেই, খালি-খালি কলহ করে, বাঁধায় তাণ্ডব
তদুপরি পাদ মারে, পিক ফ্যালে, নষ্ট করে ওজু ও ইমান।
আরো আছে হরেক কুতুব, কুতুবের অন্ত নেই,
তারা উল্টাপাল্টা ফতোয়া দেয়, এলোপাথাড়ি মছলা-মাছায়েলা ঝাড়ে,
আর শুধু হেদায়েত দেয়, ওয়াজ-নসিয়ত করে
তাতে বাতেনি কথাই বেশি, জাহেরি কম-কম
তারা সিরাতুল মোস্তাকিম বোঝে না, ঘোরানো পথ বোঝে ।
নিরীহ মুয়াজ্জিনের এমনিতেই জলাবিলা দশা,
তার ওপর ফের পাণ্ডবেরা, কুতুবেরা হল্লা করে কেবলই টালাতে থাকে নিরীহকে।
মন-খারাপ-করা হাওয়া বয়।
মুয়াজ্জিনের মন, একটু একটু করে তুষারের মতো ঝরে।
ঘোরানো সিঁড়ির ঘুর স্বভাব মাড়িয়ে তবু আস্তে আস্তে সে উঠে যায় মিনারের চূড়ায়।
হর্ষতরঙ্গ
সরো সরো, ঈশান থেকে তিরের বেগে ওই নেমে পড়ছে হংসবাহিনী-- উঠানে, অঙ্গনে, ধানখেতে, নয়ানজুলিতে। আর নৈর্ঋত থেকে ছুটে আসছে দস্যি বাচ্চারা। এসেই দুই ডানা পাকড়ে ধরে উঠে পড়ছে রাজহাঁসের পিঠে। তা-ই দেখে ঘাস থেকে মুখ তুলে মুচকি হাসছে খরগোশ, প্রশাখাজালের আড়াল থেকে কাঠবিড়ালি।
এক হোঁদলকুতকুতে, দুষ্টের চূড়ামণি, এমনিতেই লেট লতিফ, তদুপরি পিছিয়ে পড়ছে বারবার, কুকুরছানার কান মলে দিয়ে, পোষা শজারুর শলাকা ধরে টান মেরে, খুচরা নোটাংকি সেরে, দুই কাঁধে দুই অস্থির গুঞ্জনরত বাচ্চা বসন্তবাউরিকে বসিয়ে নিয়ে এগিয়ে আসছে শেষ হংসবাহনের দিকে। হাঁসটি তখনো নয়ানজুলির জলীয় রানওয়েতে। উড়ালে উন্মুখ। বাচ্চাটি আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে জলকাদা মাড়িয়ে কোনোমতে হাঁকুচ-পাঁকুচ করে উঠে পড়ছে সর্বশেষ হংস-ফ্লাইটে। পেছন পেছন আলপথে হেলেদুলে আসছে কান-মলা-খাওয়া নাদুসনুদুস কুকুরছানাটিও।
তুলাপ্রসূ সব শিমুলের গাছ, ফলপ্রসূ সব আম ও আমড়া বাগান। তাদের ওপর দিয়ে
উড়ে চলেছে হংসবাহিনী। এক-একটি হাঁসের পিঠে এক-একটি শিশু। উড়ে যেতে যেতে
উৎফুল্ল বাচ্চারা ভূমণ্ডলের দিকে উড়ন্ত চুমু ছুড়ে দেবার মুদ্রায় ফুঁ দিচ্ছে
হাতের তালুতে। একবার ডান হাত, আরেকবার বাম। দুই দিকে জেগে উঠছে ছোট-ছোট
হাওয়াহিল্লোল।
আর সেই হিল্লোলের হালকা ধাক্কাতেই সঙ্গে-সঙ্গে নিচে আগুন ধরে যাচ্ছে
হুলুস্থুল কৃষ্ণ- ও রাধাচূড়ায়, আর আমের পাতারা খিলখিল আহ্লাদে
ঢলে পড়ছে প্রতিবেশী আমড়ার পাতাপল্লবের ওপর।
আজ আগুনে-বাতাসে গুলতানি, পলাশে-শিমুলে শয়তানি,
আমে-আমড়ায় দুষ্টামি একটানা
আর সাগর দুলছে পাহাড় ঢুলছে আকাশ ঝুলছে মাথার ওপর উড়াল শহর
ভোলাভালারা ভুলছে, লহরি তুলছে, ধীরে উর্ণা খুলছে মেঘের বহর...
নাম
তারপর চুপচাপ চলে যাব কোনো একদিন,
দূরসম্পর্কের সেই মাথানিচু লাজুক আত্মীয়টির মতো,
নিজের নামটিকেই ভুলে ফেলে রেখে তোমাদের কাছে।
গিয়ে বার্তা পাঠাব-- এসেছি তাড়াহুড়া ক’রে,
ভুলে গেছি তাই।
পাঠিয়ে দিয়ো তো নামটিকে।
উত্তর পাব না কোনো।
কিছুদিন অনাথের মতো ঘুরে ফিরে
আমার সে-নামও নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে একদিন তোমাদের ছেড়ে।
আমিও বিলীন, আর নামও লুপ্ত, থাকবে শুধু তিলেক শূন্যতা
আর তা পূরণ করতে এসে যাবে অন্য এক ভাবী বিলুপ্ততা।
জলোচ্ছ্বাস
হাজার হাজার জংলি ঘোড়ার দঙ্গল উঠে আসছে অন্ধকার দরিয়ার মধ্য থেকে আর একটানা বিজলি ও বজ্রচমক। চমকের মুহুর্মুহু ইলিশরঙা ঘ্রাণের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘোড়াদের হ্রেষাধ্বনি, উপর্যুপরি রাত্রিরং চিৎকার। ঢেউয়েরা তো সমুদ্রকেশর। দাউদাউ শিখা শোনা যাচ্ছে কেশরের। কেশরপোড়া গন্ধের ঢেউয়ের আস্বাদ এসে আছড়ে পড়ছে স্তরে স্তরে-- বালুতে লবণে ফসফরাসে। যেন একদল উগ্র পাগল আরেকদল বদ্ধ মাতালের সঙ্গে মারদাঙ্গা মেতেছে সংলাপে। কেউ কারো বাক্য বুঝছে না, জাহেরি-বাতেনি ধর্ম-মর্ম কিচ্ছু বুঝছে না, বাক্যের বিন্যাস-ব্যঞ্জনা বুঝছে না, খালি একনাগাড়ে ঝাপটা মারছে বাগবাহুল্যের। ফলে সংলাপে না হচ্ছে সমঝোতা, না কথাকাটাকাটি। খুব চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই কথাকে কাটছে না কোনো কথা, বাক্যে এসে মিশছে না কোনো বাক্য, পাশ কেটে চলে যাচ্ছে কেবলই অবিরাম হুলুস্থুল ধুন্ধুমার মহাগজব একটানা...
ভাবাধিনায়ক
তোমার উৎফুল্ল হরতনের রাগরক্তিম ব্যঞ্জনা এসে লাগে আমার সাজানো তাসে।
কী ভাব জাগালে ওহে ভাবাধিনায়ক
আকাশে বাতাসে আর আমাদের প্রথাসিদ্ধ তাসের সংসারে
ফুটে ওঠে লজ্জারং, জেগে ওঠে রংধনুরূপ, ব্যাকুল তাসের সেটে।
হে ভাবের কম্যান্ডার, বোঝা ভার এ হরতনি লীলাটি তোমার।
রক্ত-প্রভা-ফুটে-ওঠা স্পন্দমান তাসকেই করেছ হে তুরুপের তাস—অব্যর্থ, মোক্ষম।
পুনরায় টেক্কা মেরে দিয়েছ ঘায়েল করে সব উপশম, একদম।
জাহাজডুবি
তোমাদের বদ্বীপে, বন্দরছোঁয়া শান্ত উপসাগরে, জাহাজডুবি হয় ঘনঘন।
নটখটে উড়োজাহাজ আর বোকা-বোকা শান্ত জলযান অজ্ঞাত কারণে
একসঙ্গে সহমরণে ঝাঁপিয়ে পড়ে তলিয়ে যায় কখনো কখনো।
সেইসব জাহাজডুবির পরপর
ততোধিক দুর্জ্ঞেয় রহস্যে বুড়বুড়ি তুলে ভেসে ওঠে
অভিযানব্যর্থ, তাড়া-খাওয়া কিছু আতঙ্কিত ডুবোজাহাজের ভূতাত্মা।
বিচিত্রাচার: প্রসঙ্গ মানুষ
আর কোনো জীবের নয়,
একমাত্র গাছের কঙ্কালই মানুষেরা ঘরে রাখে একান্ত আপন ক’রে।
যত্ন নেয়, ঝাড়ামোছা করে, দেয় বার্নিশ-প্রলেপ ।
কায়মনে গুনগুন করে ভবঘুরে সোনালি মৌমাছি
সুদর্শন ফুলবাবু পায়রারা ইচ্ছাসুখে বাকবাকুম...
মনোহত মানুষেরা ঘন-ঘন আক্ষেপ, কপালে করাঘাত...
একটু একটু করে ভাঙতে থাকে ভেতরে ভেতরে।
মনোজের তির এসে লাগে
সুখাসনে আসীন ফুরফুরে মনুজের গায়ে।
উঠেই বেরিয়ে পড়ে রাশভারি মধু আর দধি বয়ে নিয়ে চলা
নদীর সন্ধানে।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী আদমেরা উঠতে চায় উচ্চে,
নিম্নাকাঙ্ক্ষীগণ, ক্রমনিম্নপথে।
মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখতে চায় মাঝে মাঝে
উদ্ভাবিত হলো তাই দুঃস্বপ্ন-বটিকা।
বড়ি খাও, ঘুম যাও, আর একে একে দেখতে থাকো
উৎকট, কিম্ভূত সব স্বপ্নের সিরিজ।
ঘুমের মধ্যেই টের পাবে
উদ্ভট ভয়াল এই স্বপ্ন বটে, তবে বাস্তব তো আর নয়!
বিড়বিড় করে বলবে তাই,
হে স্বপ্নাধিরাজ, দেখি-না দুঃস্বপ্ন তবে আরো কিছুটা সময়।