মিথিলা ও টিয়া পাখি- সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
মিথিলা ও টিয়া পাখি- সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

মিথিলা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ওরা তিন ভাই-দুই বোন। মিথিলা সবার ছোট। সবাই মিথিলাকে আদর করে। ওর সাধ-আহ্লাদ সবাই পূরণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। সবার আদুরে মিথিলা ভাবে, ‘ইস, আমি যদি পাখি হতে পারতাম। তাহলে উড়ে উড়ে সারা পৃথিবীটা দেখতে পারতাম। গাছের ফল খেতাম। কতোই না মজা হতো।’ তবে পাখি হতে না পারলেও পাখি পোষার শখ হলো তার।

গ্রীষ্মের ছুটিতে নানা বাড়ি ভোলায় বেড়াতে গেল মিথিলা। নানা বাড়ির রয়না গাছে টিয়া পাখি বাসা বেঁধেছে। পাখির বাসায় চারটি টিয়ার ছানা আছে। মিথিলা নানুর কাছে বায়না ধরে। পাখি তাকে এনে দিতে হবে। পরদিন এক দূরসম্পর্কের মামা গাছ থেকে চারটি ছানাই নামিয়ে নিয়ে আসে।

মিথিলা তখন গাছের নিচে দাঁড়ানো। মামাকে বলে, ‘আমাকে একটা টিয়া পাখির বাচ্চা দাও।’ মামাও তাকে একটি বাচ্চা দিয়ে দিলো। মিথিলা তো মহা খুশি। বাচ্চাটি পেয়ে মামাকে দিয়ে একটি খাঁচা কিনিয়ে আনালো। মিথিলা পাখির ছানা পেয়ে খুব আদর-যতœ করে। গোসল করায়, খাবার দেয়। আরও কত কী?

তিন দিন পর মিথিলারা বাড়ি চলে আসে। পাখির খাঁচা তার হাতেই। বাড়ি ফিরে সবাইকে দেখায় আর বলে, ‘আমার টিয়া পাখি।’ মিথিলার পাখিটিকে সবাই খুব ভালোবাসে। পাখিটির নাম দেয় ‘মিঠু’। পাখিটিকে গম খাওয়ায়। বন-বাদাড়ে ঘুরে খুঁজে খুঁজে লাল টকটকে পাঁকা ফল নিয়ে আসে। গ্রামে এ ফল গাছের নাম ‘কলাকচুর পাতা’। এ ফল টিয়া পাখির খুব পছন্দ। ফলটি দেখতে খুবই সুন্দর।

মিথিলা প্রতিদিন সময়মত খাবার দেয়, গোসল করায়। মিথিলার মা ফজরের নামাজ শেষ করে পাখির খাঁচাটি বাইরে চালের নিচে খুঁটির সাথে বেঁধে দেয়। মিথিলার মা পাখিটিকে বলে, ‘মিঠু, আমার সাথে সাথে বল আল্লাহু, আল্লাহু।’ মিঠু বলার চেষ্টা করে।

দেখতে দেখতে মিঠু একদিন ‘আল্লাহু আল্লাহু’ বলতে শিখে ফেলে। তা শুনে সবাই খুব আনন্দিত। এরপর থেকে মিঠু প্রতিদিন আজানের পরই শুরু করে জিকির। সবার ঘুম ভাঙে মিঠুর জিকির শুনে। একে একে ওর নিজের নাম বলতে শেখায়। কেউ যদি বলে ‘মিঠু’। মিঠুও সাথে সাথে সুর দিয়ে বলে মি...ঠু, মি...ঠু। টিয়া পাখি নিয়ে মিথিলা খুব মজা করে। স্কুলে গিয়ে সবার কাছে গল্প করে। কেউ কেউ দেখতে আসে। মিঠুর নাম ধরে ডাকে। মজা করে।

এরপর মিঠুকে শেখানো হয় ক্ষুধা লাগলে নাম ধরে ডেকে খাবার চাইতে। শেখানো হয়, ‘রকিব ভাত দে।’ রকিব মিথিলার ছোট ভাই। মিঠুও সুর দিয়ে বলে, ‘ইকি...ব ভাত দে...।’ যখনই ক্ষুধা লাগে; তখনই ডেকে ডেকে ভাত চায়। মিঠুর কথা শুনে সবাই হাসে। মিঠু কথা বলতে পারে বলে মিথিলার কাছে খুবই খুশি খুশি লাগে।

একদিন খাবার দিতে গিয়ে ভুল করে খাঁচার দরজা খোলা রেখেই চলে আসে মিথিলার বড় বোন রিপা। মিথিলা তখন স্কুলে ছিল। দরজা খোলা পেয়ে টিয়া পাখিটা বের হয়ে যায়। কিন্তু উড়তে পারে না। কারণ কথা বলা শিখলেও উড়তে শেখেনি মিঠু।

পাখিটি বেশি দূর যেতে পারেনি। সামনেই মিথিলাদের একটি পেয়ারা গাছ। একটু উড়ে গিয়ে পেয়ারা গাছের ডালে বসে নিজের নামেই ডাকা শুরু করে, ‘মি...ঠু, মি...ঠু’। মিথিলার মা ডাক শুনে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখেন খাঁচায় টিয়া নেই। তিনি সবাইকে ডাকতে লাগলেন। সবাই দেখে মিঠু গাছে বসে ডাকছে। পরে রিপা একটু কাছে গিয়ে যখন বলল ‘মিঠু’; তখন উড়ে এসে রিপার হাতের ওপর বসে। তা দেখে সবাই খুব খুশি হয়।

স্কুল থেকে আসার পর মিথিলাকে ঘটনাটি জানান মা। মিথিলা তার আপুর সঙ্গে অনেক রাগারাগি করে। বলে, ‘তুই আর কখনো আমার টিয়াকে খাবার দিবি না।’ সবাই মিথিলাকে বলে, ‘মিঠু তো তোকে ছেড়ে যায়নি।’ মিথিলা বলে, ‘যদি চলে যেত, তাহলে কী হতো?’ এরপর থেকে সবাই মিঠুকে বিশ্বাস করতে থাকে। ভাবে, মিঠু তো চলে যায় না। ছেড়ে দিলেও হয়তো আবার ফিরে আসবে। তারপরও কেউ ছেড়ে দেয় না। ভয় পায়Ñ যদি মিথিলা সবাইকে বকা দেয়।

একদিন মেজ ভাইয়া এসে দুষ্টুমি করে মিঠুকে ছেড়ে দেয়। তিনি আসলে দেখতে চান যে, মিঠু ফিরে আসে কিনা। সেদিনও মিথিলা স্কুলে ছিল। তবে ঠিকই মিঠু আস্তে আস্তে সব জায়গা ঘুরে ঘুরে মনের সাধ মিটিয়ে উড়তে শিখে নেয়। যখনই ক্ষুধা লাগে বাড়ির পেয়ারা গাছের ডালে বসে ডাকে, ‘ইকি...ব ভাত দে’। তখন মেজ ভাইয়া এসে হাত বাড়ায়। মিঠু উড়ে এসে হাতের ওপর বসে।

স্কুল থেকে বাসায় এসে মিঠুর সঙ্গে দুষ্টুমি করে মিথিলা। তবুও মিথিলার দুশ্চিন্তা বাড়ে। সে ভাবে, আজ হয়তো উড়তে শিখেছে, কাল হয়তো খাবার খেতে শিখবে। মিঠুকে বিরক্ত করলে কামড় দিতে চায়। দাঁত দিয়ে খাঁচা কামড়ায়।

কয়েকদিন পর মিঠুকে ছেড়ে দিলে আর ফিরে আসছে না। সবাই খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। মিথিলা পাখির জন্য কাঁদতে থাকে। মেজ ভাইয়াকে খুব বকে। সেদিন সবাই খুব কষ্ট পায়। মিথিলার মা-ও কাঁদে। হঠাৎ সন্ধ্যায় সেই পেয়ারা গাছে ডালে মিঠুর ডাক শুনতে পায়। মিঠুর ডাক শুনে মিথিলা যেন প্রাণ ফিরে পায়। দৌড়ে গিয়ে উঠানে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে ‘মিঠু’ বলতেই হাতের ওপর বসে। মিঠুকে হাতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে মিথিলা। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘তোকে আর উড়ে যেতে দেব না।’

পরদিন সকালে মিথিলা পরীক্ষা দিতে যায়। সবাইকে বলে যায়, ‘ওকে যেন কেউ না ছাড়ে। আমি বেশি করে খাবার দিয়ে গেলাম। কারো খাবার দেওয়ার প্রয়োজন নেই।’ যেতে যেতে ভাবে, মিঠুর তো এতদিনে অনেক বন্ধু হয়েছে। এখন সে উড়তে চায়, তাদের সাথে খেলতে চায়। কিন্তু ঘরের কেউ তাকে সেই সুযোগ করে দিচ্ছে না।

এদিকে মিঠু খাঁচার মধ্যে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু কেউ খাঁচা খুলে দিচ্ছে না। সবাই শুধু দেখে দেখে চলে যায়। এরপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল চলে আসে। সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘুমাতে যায়। মিঠু জেদ করে খাঁচা কাটতে শুরু করে। খাঁচা কাটা শেষ হলে সুযোগ বুঝে উড়ে যায়।

মিথিলা বাড়ি এসে মিঠুর চলে যাওয়ার খবর পেয়ে কষ্ট পায়। মিথিলা ভাবে, মিঠু বুঝে গেছে আকাশে ওড়ার মজা। বনের অন্য পাখির সাথে খাবার খুঁজে বের করা ও বাসা বেঁধে ঘর করার মজা শিখে গেছে। শুধু ভুলে গেছে মিথিলাদের শেখানো কথা। অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোথাও পেল না। মিথিলার মনে পড়েÑ আমিও তো পাখি হতে চেয়েছিলাম। আকাশে উড়ে পৃথিবীটা দেখতে চেয়েছিলাম। আর মিঠু তো সত্যিকারের পাখি; ও তো আকাশে উড়বেই।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান