গল্পকার: শৌনক দত্ত
সে দেখতে বলিউড নায়িকা রানী মুখার্জীর মত,এটা তার নিজের ঘোষনা নাকি কেউ তাকে বলেছিল তা আমরা জানি না।তবে আমরা কেউ রাধুর চেহারায় রানীকে খুঁজে পাইনি কখনো।তবে রাধুকে রানী মুখার্জী ডাকলে সে বেশ খুশি হয় বোঝার পর থেকে আমরা বন্ধুরা তাকে রানীই ডাকি।
আমাদের রানী মুখার্জীর বেজায় প্রেমে পড়ার রোগ।যেখানে সেখানে যার তার প্রেমে সে পড়ে এবং হৃদয় ভাঙে,প্রেমিক তো বটেই এমনকি তার পরিবারের লোকদের সাথেও তার আদান প্রদানের সম্পর্কগড়ে ওঠে পলকে । দুঃখের বিষয়, তাঁর প্রদান অতি সামান্য—আদানই বেশি। কতগুলি বাঁধা গল্প,সেগুলোই সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব প্রেমিককে চালিয়ে দেয়। কিন্তু সেসব গল্পে বারবার কেউ না কেউ ঠিক রানীর প্রেমে পড়ে!আমাদের কানে সব কথা আসে,কিছু বলি না।প্রাক্তন কেউ কেউ আমাদের অভিযোগ করে।তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে অন্য মেয়েরা,আমাদের ভাল লাগবে কেন?রাগ হয়,রাধু সেসব গল্প শুনে কেবল হাসে।
কিন্তু তবু নতুন নতুন প্রেমে পড়ার উৎসাহও তাতে তার কিছুমাত্র কমে না।
সেদিন হঠাৎ সে কোথা থেকে একটা নূতন প্রেমিক জুটিয়ে কলেজ ফেরার পথে পরিচয় করালো। ছেলেটা অতি সাধারন,সুকুমার রায়ের সৎপাত্রের মতন চেহারা কিন্তু তবু রানীকে খুশি করতে সকলেই প্রসংশা করল। রানী সেটা বুঝলো না, সে ভাবলো এবারের প্রেমিকটা তার খুব সুন্দর হয়েছে। সুতরাং, তার সপ্তাহখানেক বাদে সঞ্জনার বাড়িতে নিমন্ত্রণে বসে, সে খুব আড়ম্বর করে আবার সেই প্রেমিক ও সেই প্রেমিকের কাছ থেকে নেয়া উপহারের অনেক কিছুর সাথে বিস্কুট,চিনি,চাপাতার গল্প শোনালো। দু-একজন যারা আগে শোনেনি এবং যারা গঙ্গারাম মার্কা প্রেমিকটিকে সেদিন দেখেনি, তারা শুনে ভাবলো রাধু বুঝি এবার শাহরুখ খানের সাথে প্রেম করছে,তারা বেশ বেশ করল। রাধু ভাবলো এবারের প্রেমিকটা তার আসলেই সেরা।
তারপর কলেজ ফেস্টের দিন রানী আবার নতুন গল্প,নতুন প্রেমিক নিয়ে হাজির।এবারে রিনি ছাড়া আর কেউ উৎসাহ দেখালো না। তারপরেও যখন সে আরও দু তিন বার সেই প্রেমিক সেই চিনি,চাপাতার একই গল্প জোর করে শোনাতে লাগলো, তখন আমাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব চটে গেল।তরু বলল, "না রে, আর ত সহ্য হয় না। বন্ধু ব'লে আমরা এতদিন সয়ে আছি— কিন্তু ওঁর প্রেমের ও উপহারের গল্পের উৎসাহটা একটু না কমালে চলছে না।"
কয়েকদিন বাদে, আমরা দশবারোজন বসে গল্প করছি, এমন সময় আমাদের রানী মুখার্জীর মূর্তিটা দেখা দিল। আমরা বললাম, "আজ খবরদার! ওঁর প্রেমিক বা গল্প শুনে কেউ কিচ্ছু বলবি না! দেখি ও কি করে।"রাধু বসতেই তরু বললো, "নাঃ, রে রাধু তুই আজকাল যেন কেমন হ'য়ে গেছিস।আগে কেমন সুন্দর সুন্দর প্রেম করতি সেই প্রেমিকের দেয়া গিফট বিস্কুট,চিনি,চাপাতার সব গল্প বলতি।আজকাল, কৈ? কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছিস।রানী মুখার্জীর লাস্ট হেয়ার কাটও করালি না।তোকে এখন আর রানী,রানী লাগছে না সেইজন্য জানিস।
" রাধু এ কথায় ভারি ক্ষুন্ন হলো। তাকে এখন আর আগের মত রানী মুখার্জী লাগে না, এ কথাটি তার একটুও ভাল লাগলো না। সে বললো, "তাই? আচ্ছা অপেক্ষা কর। আজ তোদের এমন এক প্রেমিক দেখাবো, দেখে তোদের হুঁশ উড়ে যাবে।তখন বুঝবি রাধু আর রানী মুখার্জীতে কোন তফাত নেই।" এই বলে সে হনহন করে ক্যান্টিনের দিকে চলে গেল।মাসখানেক পরে একদিন রণ কে বগলদাবা করে রঞ্জিতা এলো।রণের হাতটা ছেড়ে দাঁড়াতেই রণ লজ্জায় লাল হয়ে এক দৌঁড়ে কমনরুমে। রাধু তার সেই স্বভাবসিদ্ধ ভাবে রণকে তার প্রেমিক পরিচয় দিয়ে,বিস্কুট,চিনি,চাপাতার গল্প আরম্ভ করলো।কিন্তু গল্প বললে কি হবে? আমরা কেউ কিচ্ছু বলতে রাজি না— সকলেই চুপ করে বসে থাকলাম।তরু বলল, "নাঃ,রণ কে তোর সাথে ঠিক মানাচ্ছে না।" তখন রাধু নতুন এক গল্প শুরু করলো,আগামী মাসেই রণ এর সাথে তার বিয়ে।রণ এর মাকে সে মামনি ডাকে,তিনি নিজে রঞ্জিতা কে পুত্রবধু হিসেবে সিলেক্ট করেছেন,ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তাতেও কারো মুখে কোন বাহবা নেই,জিজ্ঞাসা নেই,কেবল সবার মুখ পেঁচার মত আরও গম্ভীর হয়ে উঠল! তখন রাধু ক্ষেপে গেলো। সে বলল, "যা যা! জানি তোদের হিংসা হচ্ছে আমার কথায়— রণ কে বিয়ে করছি শুনে তোদের জবান বন্ধ হয়ে গেছে — তোরা আমার বন্ধু ভাবতেও লজ্জা।যতসব মিডিল ক্লাস,তোরা কি বুঝবি প্রেমিক কি?তার কাছ থেকে গিফট নেবার কি আনন্দ।" তখন আমাদের মধ্যে একজন বলল, "সে কি রাধু? আমরা প্রেম,প্রেমিক,তার দেয়া বিস্কুট,চিনি,চাপাতার আনন্দ বুঝিনা?তোকে হিংসা করছি? বলিস কি! তোর গল্প শুনে কতবার তোকে বলেছি এবার বিয়েটা করে ফেল , ভেবে দেখ ত'। আজকাল তোর প্রেমিকগুলো তেমন ভাল হচ্ছে না,তাই কিছু বলবো কোত্থেকে?এই ত,তরু যখন ওর প্রেমিকের গল্প বলে তখন আমরা বেহুশ হয়ে শুনি? কি বলিস?"
রাধু হেসে বলল, "তরু? ও আবার প্রেম করে নাকি? আরে,দুটো রোমান্টিক কথা বলতে ওর মুখে আট্কায়, ও আবার করবে প্রেম বলিস কি?" তরু বলল, "সে কি! আমার প্রেমিকের গল্প শুনিস নি বুঝি?" আমরা সকলে উৎসাহ দিয়ে বললাম "হাঁ, হাঁ,এখন একটু শুনিয়ে দে ত।" তরু তখন গম্ভীর হয়ে বলল, "অমবস্যার রাতে কোথাও কোন আলো নেই তাকে দেখলাম টানা টানা চোখে আমায় দেখছে" শুনেই আমাদের চার পাঁচজন বেশ,বেশ তারপর, তারপর করে উঠল, " আরে বেচারা প্রেমিক রে, অমবস্যার রাতে দেখা! কি প্রেম কি প্রেম।"
তরু বলল,"ছেলেটি একপ্যাকেট মোম বাতি দিয়ে বললো যখন আমি থাকবো না তখন এই অন্ধকারে মোম জ্বেলে আমাকে ভেবো "
শোনা মাত্র আমরা একসঙ্গে এমন করে কান্নার মত করে শব্দ করে উঠলাম যে,তরু নিজেই চমকে উঠল। সকলে কান্নার ভঙ্গিতে, এ তাকে জড়িয়ে ধরতে লাগলাম। কেউ বলল, "দোহাই তরু, আর কাঁদাস না" কেউ বলল, "তরু এমন ছেলে কোটিতে একটা মেলে,ওকেই তুই বিয়ে কর।" কেউ কেউ এমন ভাব দেখালো, যেন প্রেমের ও প্রেমিকের গল্প শুনতে শুনতে তাদের ভাবান্তর হয়েছে।
রাধু খুব রেগে গেল।সে বলল, "এসব ঐ তরুর কারসাজি। ওই আগে থেকে সব শিখিয়ে এনেছে তোদের। নইলে, ও যা বলল তাতে প্রেমের কি হল।তাছাড়া অমবস্যায় যেখানে কোন আলো নেই সেখানে ও কি করে দেখলো ছেলেটি তাকে দেখছে,যত্ত সব ন্যাকামি তোদের,তোরা আমার রূপে জ্বলিস সেটাই বল না" একটা ভেঙচি দিয়ে রাধু রাগে গজ্গজ্ করতে করতে হেঁটে গেলো।