কবি : মুহম্মদ নুরুল হুদা
মুহম্মদ নুরুল হুদা (১৯৪৯) সত্তর দশকের একজন বাংলাদেশী প্রথিতযশা কবি। একই সঙ্গে তিনি একজন ঔপন্যাসিক ও সাহিত্য-সমালোচক। তাঁর জন্ম ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কক্সবাজার জেলায়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা অর্ধ শতাধিক। ১৯৮৮ সালে বাংলা কবিতায় উল্লেখযোগ্য অবাদনের জন্য তাঁকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
সুনীল সন্ন্যাসী
এবার নয়া দিল্লিতে দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য সম্মেলনের বিষয় ছিল সুফিজম ও
বুদ্ধিজম। সাধারণত কোনো গভীর আলোচনা শুনতে শুনতে আমি চোখ বন্ধ করে মন খুলে
রাখি। লোকে ভাবে আমি ঘুমাচ্ছি। তেমনি এক মনোদৃষ্টির মুহূর্তে আমার সামনে
এসে দাঁড়ালেন এক কৃশকায় ঋষি। বললেন, আমি আসিনি কপিলাবস্তু বা বলখ থেকে।
আমার গন্তব্য না-নির্বাণ না-ফানা। যেখানে যার মন খোলা পাই সেখানেই আমি
পদ্মাসনে বসি। আমার একটুক্ষণ বন্ধু হবে তুমি? আমি কোথাও যাই না, কেবল আসি।
আমাকে নাম দিতে পারো সুনীল সন্ন্যাসী। আমি নীল থেকে নীলে ডানা মেলি আর
বাঁশি বাজাই, বাঁশি।
আমি কিছু বলার আগে দূরতমা এক সুহাসিনী আমাকে কী যেন বলেলন কানে কানে। আমি বাধ্য হয়ে মন ছেড়ে কানে এলাম। তারপর চোখ খুললাম।
কেউ নেই কোথাও। না মঞ্চ, না বক্তা, না শ্রোতা। না বুদ্ধ, না রুমি। না
সুহাসিনী না সন্ন্যাসী। শুধু শিরায় শিরায় বেজে চলেছে এক অনিকেত বাঁশি।
সুনীল সন্ন্যাসী - দুই
ভালবেসে হয়েছি বিব্রত। ভালবাসা যার ব্রত সে কেন অগ্রাহ্য করবে সত্যব্রত? না সক্রেটিস না প্লেটো না সফিস্ট, ওরা কেউ খোঁজে না ভালবাসার ধ্যানতত্ত্ব ; কিংবা বোঝেও বোঝে না। আপাতত যাকে মনে হয় প্রশান্ত মন, একসময় তাই হয়ে যায় ভ্রান্তদর্শন। এমন হৃৎজমিনে হলকর্ষণ নাই তো ফসলও নাই। সোনালি শস্যের মাঠে হাঁটে সুনীল সন্ন্যাসী ; মুখে বাঁশপাতার বাঁশি; বলে সামান্য কথা; অধিক বলে না। শর্তহীন ভালবাসা শিকড় থেকে শিকড়ে চলে; না, টলেও টলে না।
সুনীল সন্ন্যাসী - তিন
যে কর্ষক সে-ই দর্শক। ভালবাসা ঊর্বরতার প্রথম সবক। ত্রিভুবনে নেই কোনো খরা। ঋষি জানে ধ্যানের ধান ও কৃষির পরম্পরা। মনখামারের দশপাশে সেবাদাস আর সেবাদাসী। নহলি মনের পাশাপাশি প্রাজ্ঞমন অবিনাশী। লোক থেকে লোকান্তরে এই মন ভালবাসার অনুঘটক। যে দর্শক সে-ই কর্ষক। ভালোবাসা মনোভাষা। অলিখিত পত্র সর্বনাশা। নাই মৃত্যু নাই জরা। সুনীল সন্ন্যাসী ভালবাসার ডাক হরকরা।
সুনীল সন্ন্যাসী - চার
সুহাসিনী হে প্রিয়দর্শিনী। তোমাকে কি চিনি? তুমিও কি চর্যার হিরণ্য হরিণী?
আছে সুখ, আছে দুঃখ, আছে মিলন-বিরহ; আছে বিকিকিনি। পথে পথে পসরা সাজায়
স্রোতস্বিনী; পাহারা বসায় ধরিত্রী ধমনী। সতীর সতীত্ব সত্য; তটস্থ তটিনী।
সুনীল সন্ন্যাসী চেনে মোহনা মোহিনী।
যাই, তবে যাই; মোহনায় যাই।
বিরহে মিলন পাই, মিলনে বিরহ। এই দাহ সত্যদাহ, দাহ অহরহ। সতীদাহ পতিদাহ
প্রকৃতি প্রদাহ। দহনে দহনে শুদ্ধ প্রাণের প্রবাহ। প্রাণ থেকে প্রাণে যাই,
প্রাণে-প্রাণে যাই। প্রাণেই প্রাণের ঘ্রাণ, অন্য ঘ্রাণ নাই।
সুনীল সন্ন্যাসী - পাঁচ
দেখা যায় শুধু একবার। তরপর অনেক মুখের ভিড়ে হারিয়ে যায় মুখটি। শুধু তরঙ্গিত হতে থাকে তার গমনভঙ্গি।
শরীর যেদিকে যায় মন যায় ঠিক উল্টো দিকে। নাগালে আসে কিন্তু দখলে থাকে না।
ধ্বনি হয় তো অর্থ হয় না। অর্থময় শব্দ হয় তো বাক্য হয় না। বাক্য হয় তো বাণী
হয় না। কেবল কানাকানি করে দুই শত্রু দুই মিত্র। অগত্যা মধ্যস্থতা করেন
মহামতি হেগেল। উদয়াচলের কিরণের স্পর্শে সত্তান্তরিত হয় অস্তাচলের আলো। জন্ম
হয় উদয়াস্তের মিলিত প্রতিমা। তাকে বুকে তুলে নেয় সুনীল সন্ন্যাসী। এই তো
তার ধ্যানের অসীমা। পরিমেয় ও অপরিমেয় তার রূপ।
তাকে দেখে দশদিগন্ত
চুপ। শুধু চুপ থাকে না অঙ্গে ও অনঙ্গে উড্ডীন এক নীলরঙা চিল। মধ্যদুপুরে
তার বুকের ছায়ায় গুটিশুটি ঘুমিয়ে পড়েছে অনন্ত নিখিল।
সুনীল সন্ন্যাসী - ছয়
রোদে জঙ্গলে গৈরিক পথে সহজে চলে না তার পা।
মাটিতে কয়েদি আলোছায়ার আলপনা। পাখি ডানা গুটিয়ে লুকিয়ে আছে পাতার আড়ালে।
তার অথই চোখ জরিপ করছে ব্রহ্মাণ্ডের সীমা । ঝড় আসছে ঝড়। বুকে বুকে উছলে
পড়ছে মহাজাগতিক মনোঝড়।
ধ্যানগিরি ছেড়ে আরেকটু এগোলেই জ্ঞানগিরি। ধাপে ধাপে উঠে গেছে গৈরিক সিঁড়ি। মধ্যপথে থেমে আছে সন্ন্যাসীর মনোডানা।
মাটি ছাড়িয়ে আকাশ ছাড়িয়ে দিগন্ত ছাড়িয়ে যেখানে সে যাবে, সেই ঠিকানা এখনো অজানা।
সুনীল সন্ন্যাসী - সাত
সামনে অনন্ত; চলন্ত সে তন্দ্রাচ্ছন্ন; দশপাশে দূরবেদূরের হাতছানি। মানুষ
পশুপাখি রূপ-অরূপের কানাকানি। খুব কাছে যুবতীর বুক উত্তাল। অদূরে হাসছে
লুসিফার। 'তুমি কার, তুমি কার?'
নিজের বুকে খুন্তি চালায় সন্ন্যাসী।
স্নায়ুতে স্নায়ুতে বাজে শোণিতের বাঁশি। আত্মা আর অনাত্মার বিবাদে সন্ন্যাসী
রায়হীন। তার গগণবিদরী চিৎকার : 'না, তুমি নও কেবল তোমার'।
সুনীল সন্ন্যাসী - আট
কবিতার ডাকে নিশি-পাওয়া পথিকের পায়ে চড়ে বসেছি উপবন ট্রেন। গন্তব্য শ্রীমঙ্গলের চা-বাগান। পৌছেই দীর্ঘ ঘুম। তারপর দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে রাজপথ ছেড়ে ধরেছি পায়ে হাঁটা পথ। সমতল থেকে টিলায় উঠে এই পথ চলে গেছে অনেক দূর। এই পথে হেঁটে গেছে কত শ্রমিক কত বণিক কত প্রেমিক। ছড়িয়ে রেখেছে শ্রম আর প্রেম আর ঘূর্ণিধূলি। হাঁটতে হাঁটতে আমিও টিলার উপরে পেয়ে গলাম পত্রপুষ্পহীন এক বৃক্ষ। তার গায়ে গা মিলিয়ে বললাম, জয় গুরু। তারপর চোখ বন্ধ করলাম। পরক্ষণেই সামনে এসে দাঁড়ালেন নাছোড়সঙ্গী সুনীল সন্ন্যাসী। হেসে বললেন, জয় গুরু। আমি দ্রুত চোখ খুললাম। আমার দৃষ্টিকে আড়াল করে উড়ে যাচ্ছে হলুদ ডানার রাশি রাশি প্রজাপতি।
সুনীল সন্ন্যাসী - নয়
সবুজ পাতার পাশে ঝরা পাতা, তার মাঝে ফুটে আছে রকমারি ফুল। লাকড়ি মাথায় ঢেউ
তুলে সারি বেঁধে হেঁটে যাচ্ছে পাহাড়ি রমণী। এক পাহাড়ের সঙ্গে আরেক পাহাড়ের
গলাগলি । দুই পাহাড়ের মাঝখানে নেচে যায় চ্ছলোচ্ছল ঝিরি। স্বচ্ছ খরতোয়া
জলের প্রবাহ, বুকে তার দাহ। তার আড়ালে গড়াগড়ি খায় বালির পর বালি। হঠাৎ কখনো
ঝিলিক মারে পুঁটি ডানকানা টাকি বা ডানকানার চোখ।
একবার আকাশের দিকে,
একবার মাটির বুকে তাকায় সুনীল সন্ন্যাসী; তারপর গাছের শেকড়ে কান পাতে।
তারপর চোখ বন্ধ করে প্রাণায়াম সারে। চলে যায় পারাপার থেকে পারাপারে। ওড়ে
প্রজাপতির ডানায় ডানায়। শীর্ষানন্দে ভেঙে যায় ঈশ্বরকণা। ভাঙে অণু পরমাণু।
মুহূর্তে মুহূর্তে জন্ম নেয় কুসুম-শূক্রাণু।
সুনীল সন্ন্যাসী - দশ
পাতা আছে পাতা নেই, শাখা আছে শাখা নেই, কাণ্ড আছে কাণ্ড নেই, মূল আছে মূল নেই। মৃত্তিকার গহীনে গহীন, এই বৃক্ষ আকাশে উড্ডীন। হে উড়াল মনীষী, তুমিও শিখে নাও ব্রহ্মাণ্ডের কৃষি। নীলে নীলে শূণ্যে শূণ্যে চাষ করো জলস্থল। সন্ন্যাসী হে, এই ব্রহ্মতল তোমারই সুনীল করতল। তাতেই ফলে চলেছে জগতের সকল ফসল। বৃষ্টি আসছে বৃষ্টি। তোমার দুইচোখে অশ্রু টলোমল।
সুনীল সন্ন্যাসী - এগারো
ধীরপ্রবাহিনী এক পাহাড়িয়া ঝিরি। জলের
নিচে গড়িয়ে চলছে নুড়ি। নুড়ি ভেঙে ভেঙে বালি। বালি জমে জমে চর। চর ঘেঁষে
দোঁয়াশ মাটির ভাঙা পাড়। সেই পাড়ে লতিয়ে উঠছে নাম-নাজানা লতা। লতায় ফুটছে
কলি, কলি থেকে ফুল। নাম দেয়া যাক বুনো ফুল।
রাত যখন আঁধার হয়ে নামে,
সেই বুনোফুল তাকায় নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে। তখন বুনোফুল আর সপ্তর্ষির মধ্যে
বিনিময় হয় রশ্মি। সেই রশ্মিপথে মুহূর্তেই ত্রিভুবন ঘুরে আসে সুনীল
সন্ন্যাসী।
ততক্ষণে আদি হয় অন্ত, অন্ত হয় আদি। তুমি আমি তখন অনাদি।
সুনীল সন্ন্যাসী - বারো
বয়ে চলেছে ঝিরির জল। সেই জলে পড়েছে রাঙা
বাছুরের ছায়া। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। থাকলেও সে ছুটে আসছে তার
মা-বাবা আর সঙ্গীসাথীদের দিকে। ওরা সন্ধান পেয়েছে সবুজ ঘাসের।
কে আগে কে পরে এখন সেটিই বড় কথা। এ নিয়ে কোনো গুঁতোগুতি নেই, হুড়োহুড়ি নেই। আছে শুধু জঠর জ্বালার তাড়া।
গবাদি প্রাণী কি অবোধ প্রাণী? সবুজ ঘাস কি আত্মরক্ষাহীন? একজন খাদক,
অন্যজন খাদ্য। না, ওরা বাজায়নি কোনো যুদ্ধ বাদ্য। কিন্তু চলছে নিরব
দানপ্রতিদান। পরস্পরের বিনিময় নির্বাণ। এইতো প্রকৃতির অকাতর সম্প্রদান।
ঝিরির বহতা জল আঁজলা ভরে পান করে সটান দাড়ায় জাগতিক ঋষি। এই তো চরাচরে তার জগৎ সংসার। এই তো জলমাটি আলোহাওয়ার কৃষি।
এই বিশ্বভবনে কে বলো কার পরদেশী?
সুনীল সন্ন্যাসী - তের
পাতা আর আকাশ, বৃক্ষ আর ঘাট, পুকুর আর জল,
ছায়া আর আবছায়া ... সব মিলিয়ে কেমন যেন মায়া মায়া। মনে পড়ে যায় কবেকার
মায়া সভ্যতার কথা। কোথাও জনমনিষ্যি নেই, নেই ছলনাসঙ্গী, আছে শুধু প্রকৃতির
অনঙ্গ অঙ্গভঙ্গি।
যখন ওরা ডাকে, তখন কেমন যেন লাজুক তাকায়। এড়াতে
গিয়েও এড়াতে পারি না। একসময়ে শিকারি পানকৌড়ি হয়ে যায় এই মন। ডুবে ডুবে
সাঁতরায় জলে ও কাঁদায়। অনন্তর ভেসে ওঠার আগে এলো কুন্তলে জড়িয়ে ফেলে
মৎস্যগন্ধা নারী। নেশা জাগায় তার নধর অধর আর ভারি পয়োধর। তখন জগৎসংসারে
কারা যেন অরক্ষিত থাকে পরস্পর। তারপর কিছুই জানি না, কিছুই মানি না। অকস্মাৎ অদূর শোনা যায় জলাঙ্গীর বাঁশি।
ততক্ষণে নীলাকাশ কাঁপিয়ে ঠা-ঠা হেসে ওঠে সুনীল সন্ন্যাসী। সেই হাসিতে ভেসে
ওঠে নবীনূহের নৌকা। প্লাবনে প্লাবনে ভাসে একুল-ওকুল। হাশর ঘনায়।
আয় ওরে আয়, কে কে তোরা যাবি বল্ জোড়ায় জোড়ায়! সন্ন্যাসীর পাল ওড়ে ভুবন আখড়ায়।