কবি পরিচিতিঃ
আহমদ ফারাজ ১৪ জানুয়ারী ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে ( বর্তমান পাকিস্তানের কোহটে ) জন্মগ্রহণ করেন ৷জাতিগতভাবে তিনি পশতুন ছিলেন ৷ তার প্রকৃত নাম সৈয়দ আহমদ শাহ ৷ আহমদ ফারাজ তার ছদ্মনাম (উর্দুতে তাখালুস)৷ তিনি ইসলামাবাদে ২৫ আগষ্ট ২০০৮ সালে কিডনি রোগে মৃত্যুবরণ করেন ৷আহমদ ফারাজ ছিলেন প্রেমের কবি ৷ তিনি তরুন ও সাধারণ জনগনের কাছে ব্যাপক নন্দিত ছিলেন ৷
বিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান কবি তিনি ৷ এডওয়ার্ডস কলেজে তিনি স্নাতক ও উর্দু ও ফারসীতে পেশবার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন ৷ পরবর্তীতে পেশবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন ৷ কলেজ জীবনে তিনি রেডিও পাকিস্তানে ফিচার লিখতেন ৷ সে সময় ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ও আলী সর্দার জাফরী খ্যাতিমান কবিদের দ্বারা তিনি অনুপ্রানিত হন ৷ তিনি অসাম্প্রদায়িক মননের আধুনিক কবি ছিলেন ৷ তার কবিতার বিচারে তাকে মুহম্মদ ইকবাল ও ফয়েজ আহমদ ফয়েজের সাথে তুলনা করা হয় ৷পাকিস্তানী সেনাশাসক জিয়াউল হকের সময় তিনি একটি সাহিত্যসভায় সমালোচনা মূলক কবিতার জন্য অভিযুক্ত এবং গ্রেফতার হন ৷পরে ছয় বছর নির্বাসনে ব্রিটেন,কানাডা ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেন ৷ এ সময় তিনি পাকিস্থানের গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন ৷
তিনি দেশে ফেরার পরবর্তীতে পাকিস্তানের হেলাল-ই-ইমতিয়াজ পদকে ভূষিত হন ২০০৪ সালে এবং পরে তা প্রতাখ্যান করেন ৷ ২০০৬ সালে তিনি দেশী বিদেশী নানা সম্মানে ভূষিত হন ৷ এছাড়াও সেতারা-ই- ইমতিয়াজ,নিগারা পদকসহ নানা সম্মানে ভূষিত হন ৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাঙ্গালীর পক্ষে পরোক্ষ যুদ্ধ করেছেন ৷তার "মহাসরাহ" কবিতাকে সে সময়ের শ্রেষ্ঠ লেখা হিসেবে বিবেচনা করা হয় ৷ তার মৃত্যুর পর তাকে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে মরনোত্তর হেলাল-ই-পাকিস্তান পদক প্রদান করা হয় ৷ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ তানহা তানহা ৷এছাড়াও উলেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে দর্দে আসব,শবে খুন,নেয়াফ্ত,মেরে খোয়াব রেজা রেজা ইত্যাদি ৷তার শায়েরী অর্থাৎ ছোট কবিতা গুলো ইংরেজী,ফ্রান্স,হিন্দী,রাশিয়ান,জার্মান,পাঞ্জাবী ভাষায় অনূদিত হয়েছে ৷নিম্নোক্ত কবিতাটি মূল নাস্তালিক হরফে লেখা কবিতা থেকে অনূদিত ৷ এটি তার "বে আওয়াজ গালি কুঁছ মেঁ"কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত
প্রতিরোধ(محاصرہ)
মূলঃ আহমদ ফারাজ
অনুবাদঃ রায়ান নূর
আমার শত্রু―
আমাকে চিঠি দিয়ে আজ জানিয়ে দিয়েছে;
তার অনুগত সৈন্যদের হাতে জিম্মি
আমার এই তুচ্ছ জীবন ৷
এই শহরের সীমানা-প্রাচীরে;
প্রত্যেক তোরণ;আর প্রত্যেক মিনারের উপর
তার যুদ্ধবাজ সৈন্যরা সজ্জিত হয়ে
বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে ৷
হঠাৎ―
বিজলীছটার মত গুলি চারদিকে জাগালো কম্পন
মাটিতে যেন ঝড় আঁছড়ে পড়ল তার অগ্ন্যুৎসবে ৷
কামানের বারুদের সাদা ধোঁয়া
পানির মত ভাসতে লাগল চারদিকে;
আর―
বৃষ্টিরফোটার মত গুলি
আমার বাড়ির গলিতেও আছড়ে পড়া শুরু করল ৷
সেই বৃষ্টির ক্ষত-যন্ত্রণায়
সকলে ব্যথায় কাতরাতে লাগল
আর―
শাসকের অত্যাচার থেকে বাঁচতে সকলে
শহর ছেড়ে দিকবিদিক ছুটতে লাগল ৷
সকল সুফী ও সালেক,প্রত্যেক শায়েখ ও ইমাম
সামান্য দয়া ভিক্ষায়
অত্যাচারীর আদালতের শরণাপন্ন হল ৷
মর্যাদার খাতিরে,নীতির প্রশ্নে―
আদালতে মুহুরীর সেই হলফনামা তোলা পর্যন্ত
রাস্তার ধারে তারা একত্রে
ভিখারীর মত অপেক্ষা করতে লাগল ৷
তুমিই―
সেইসব খ্যাতিমান লেখকদের
জ্ঞানের প্রশংসা কর উচ্চবাচ্যে!
যাদের সামনে অগনিত পত্র-পত্রিকা আর মাধ্যম
তাদের চিন্তা-বক্তব্য-লেখা প্রকাশে অপেক্ষারত ৷
মর্যাদায় খাতিরে,নীতির প্রশ্নে―
তাদেরও কি আজ দরবারে গিয়ে বলতে হবে?
যখন ভিখারীর মত জনতার কোলাহল সামনে ৷
তুমিই―
সেইসব খ্যাতিমান বিজ্ঞ লেখকদের
প্রতিষ্ঠার ভিত্তিটি ভালো করে একবার দেখ,
তোমাদের সঙ্গে আগে কেউ কি ছিল?
আজও আশেপাশে তাদের একটু খুঁজে দেখ৷
নিজেকে;
এবং এই জীবনগুলোকে যদি রক্ষা করতে চাও?
সেই খাতা-কলমকে মৃত্যুর ময়দানে নিয়ে যাও ৷
তুমিও রেহাই পাবেনা!
তাই তুমি
অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এইসময়ে রুখে দাঁড়াও ৷
সফল হও কিংবা বিফল হও তুমিই তো পারবে
নিজ বিবেকের কাছে আতœসমর্পন করতে!
একমাত্র আমিই;
নিজ চোখে সেইসব প্রত্যক্ষ দেখেছি,
সেগুলোই তাকে পুনর্বার স্মরণ করে দিয়েছি,
সে জানেনা অতীতের ইতিহাস কি শিক্ষা দেয়?
রাত যখন কোন সূর্যকে শহীদ করে
প্রভাত নবসূর্যে তাকে বিনাশ করে;
আমার একমাত্র উত্তর এটিই;
আমার অত্যাচারী শত্রুর প্রতি―
আমি কারো অনুগ্রহের ভিক্ষুক নই;
আমি আজ কোন যন্ত্রনায় কাতর নই;
সে শুধু শক্তি আর জানে তার ক্ষমতার দম্ভ
কিন্তু এখনো সে জানেনা,বোঝেনা,
কলমের কত দুর্নিবার প্রতিরোধ ক্ষমতা―
আমার কলম রক্ষকদের নিছক প্রেমসঙ্গীত নয়
যারা নিজ শহরকে কয়েদ করতে ছলনা করে ৷
আমার কলম কিছু জাঁকালো খাবারের বাটি নয়
যেগুলো নারকীদের স্তবগীতি রচিয়ে তুষ্ট করবে ৷
আমার কলম সিঁধেল চোরের হাতিয়ার নয়
যারা নিজ বাড়ির ছাদেও গর্ত কেটে রাখে ৷
আমার কলম সেই সিঁধেল চোরের বন্ধু নয়
যারা প্রদীপহীন বাড়িতে সিঁধ কাটতে যায় ৷
আমার কলম ধার্মিকের প্রার্থনার স্তবগীতি নয়
সারাজীবন যে সবকাজে হিসাব করে চলবে
আমার কলম এমন আইনের দাঁড়িপাল্লা নয়
নিজ চেহারায় সর্বদা দুটো বেশ ধারণ করবে ৷
আমার কলম আমার জনগনের পবিত্রধন,
আমার কলম আমার বিবেকের আদালত:
সেই কারণে অবিরত প্রাণপণ লিখে চলেছি―
এর সুর বেহালার মত হৃদয়গ্রাহী,
তীরের মতই শক্তিশালী ৷
বন্দীদশায়ও
আমি এ'ই আশা রাখি,
আমার আজও বিশ্বাস হয়,
এই অত্যাচারীর কবর একদিন রচনা হবেই ৷
যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষগুলোর ভাগ্যের শপথ
আমার কলম কখনো ক্ষান্ত হবে না,চলবে―