মৃন্ময়ীর নীল চুড়ি - সানজীদ আহমেদ তিয়াস
গা চিড়বিড় করে এমন রোদ অনেকক্ষন ধরেই গায়ে লাগছে, কিন্তু জানালা লাগাতে
ইচ্ছা করছে না। আসলে ইচ্ছা করছে না বললে ভুল হবে। দুই বার জানালা লাগানোর
চেষ্টা করেছি কিন্তু লাগানো যায় না। কোথাও একটা সমস্যা আছে। গায়ে রোদ
লাগলেও বাতাসে আমার চুল উড়ছে। আমি বসেছি ট্রেনের ৪ নাম্বার বগির টয়লেটের
কাছাকাছি সীট টার জানালার পাশে। তীব্র গন্ধ কিছুক্ষন পর পর আমাকে তার
উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। নাড়ি উল্টে সব বের হয়ে যাওয়া অবস্থা৷ কিন্তু
জানালার পাশে বসতে গেলে এখানে বসা ছাড়া উপায় নেই। জানালার পাশে বসে সুন্দর
দৃশ্য দেখার জন্য এতোটুকু কষ্ট করা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমার সামনে
বসে থাকা ছেলেটিকে নিয়ে৷ দুঃখিত একটু ভুল বললাম৷ ছেলেটি না বলে লোকটি বললেই
বেশি ভালো দেখায়৷ লোকটির গায়ে আকাশী রঙের ফুল হাতা শার্ট৷ এক হাত কনুই
পর্যন্ত মুড়ানো। আর এক হাতে বাজারের ব্যাগ। ঘুমের মধ্যেও ব্যাগটা এমন ভাবে
ধরে আছে যে মনে হচ্ছে সম্রাট হুমায়ুন তাকে কহিনুর হীরা উপহার দিয়েছেন আর
সেটা তিনি এই ব্যাগের ভেতর করে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি যে লোকটির কথা এভাবে
বলছি, তার পেছনে ভালো কারন আছে৷ অযাথা তো একটা মানুষ কে এভাবে উপস্থাপন করা
যায় না।
ঘটনা ঘটেছে ট্রেন ছাড়ার মিনিট পাঁচেক পরে। আমি এই সীটে বসে আশ পাশ দেখছি৷
আমার সামনে লাল গেঞ্জি পরা এক ছেলে বসে একটা বই পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ৩
টা মাছি কোন ভাবেই তাকে পড়তে দিচ্ছে না। ৩ টা মাছি ৩ দিক থেকে তাকে বারবার
আক্রমন করছে। আমি দেখে খুব মজা পাচ্ছিলাম। এমন ভাবে দেখছিলাম যেন উনি
বুঝতে না পারেন যে উনার আর মাছির ভেতরে বেধে যাওয়া যুদ্ধের একমাত্র দর্শক
আমি ৷ সেই সময় আকাশী শার্ট পরা লোকটি এসে ছেলেটিকে বললেন "এই জায়গা থেকে
ওঠ, অন্য কোথাও যা"। কথা টা কোন সংকোচ ছাড়ায় বলেই লোকটি ছেলেটির মুখের দিকে
তাকিয়ে থাকলেন। ছেলেটি বললো, এটা আমার সীট আমি কেন উঠবো? লোকটি তখন চোখ
ছোট ছোট করে বললেন টিকিট দেখা তো দেখি। ছেলেটি বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বললো আপনি কে
যে আপনাকে টিকিট দেখাবো? আমি এই ট্রেনে এই বার দিয়ে ১৬ বার যাচ্ছি আর আমি
তোকে চিনিনা? বলেই লোকটি হাত উঁচিয়ে এক থাপ্পড় তুললো৷ সাথে সাথে ছেলেটি
উঠে হনহন করে চলে গেল। আমি ভারি অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। লোকটি
আমার দিকেও এমন ভাবে তাকাতে লাগলো যে এবার আমাকে থাপ্পর দিবে। আমার মেজাজ
চড়চড় করে খারাপ হতে লাগলো৷ যার ফল স্বরূপ লোকটা কে নিয়ে এসব ভাবছি।
ট্রেনে উঠেছি সান্তাহার রেল জংশন থেকে। গন্তব্য কমলাপুর। কমলাপুরে দুলাভাই
আসবে আমাকে নামিয়ে নিতে। আপুর বাসায় থাকবো তিন মাসের মতো। এর ভেতরে ঢাকায়
যতো গুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে সব গুলোতেই পরিক্ষা দিব৷ আমার
প্রিপারেশন ভালো৷ উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষাই রের্কড নাম্বার পেয়েছি। গত কয়েক
মাস অনেক কষ্ট করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার জন্য। কে জানে কি
আছে কপালে ৷ আমার অনেক গুলো ভালো অভ্যাসের মধ্যে একটা হলো আমি যখন খুব
একলা অনুভব করি তখন আমি নিজের সাথেই গল্প করি৷ এই যে যেমন এখন করছি।
ট্রেন চলছে, ভালো গতিতেই চলছে বলা চলে। ট্রেনের পাশেই ছোট নদীর মতো দেখা
যাচ্ছে। মনে হচ্ছে নদীর ভেতর দিয়েই ট্রেন যাচ্ছে। আমি একটা বই হাতে নিয়ে
পড়ার চেষ্টা করছি কিন্তু বাইরের দৃশ্য দেখার লোভ সামলাতে পারছি না বলে
সমস্যা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত লোভ টা কে সামলে নিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলাম। আমার
সামনে বসে থাকা লোকটা এখনো ঘুমাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ ক্লান্ত । সামনের
দিকে হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। কি হয়েছে কে জানে। সবাই হৈ চৈ করে এদিকেই আসছে
বুঝতে পারলাম। দু জন পুলিশ একটা মানুষ কে টেনে হিঁচড়ে এদিকে নিয়ে আসছে আর
তার পেছনে পেছনে আসছে উৎসুক জনতা। পুলিশ আমার কাছাকাছি আসতেই যা দেখলাম তা
বিশ্বাস করতে একটু সময় লাগলো আমার। ঐ লাল গেঞ্জি পরা ভদ্র ছেলেটা এক
মানুষের মোবাইল মেরে দিতে গিয়ে ধরা পরেছে। আমি শুধু হা করে তাকিয়ে আছি৷
আসলে কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তার মানে এই আকাশী শার্ট পরা লোকটি
জানতো যে এই ভদ্র চেহারার ছেলের ভেতর কিছু সমস্যা আছে। লোকটির ব্যপারে
এতোক্ষন কি না কি ভেবেছি ভেবে নিজেই লজ্জা পেলাম। লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে
বুঝতে পারলাম তিনি মুচকি হাসছেন। আমার কি উনাকে কিছু বলা উচিত? বুঝতে
পারছি না৷ লোকটি চোখ বন্ধ করেই বললো আপনার নাম কি? আমি একটু ভাব নিয়ে
বললাম, নাম জিজ্ঞাসা করছেন কেন? কি দরকার? লোকটি আবার হেসে জানালার দিকে
তাকালো। লোকটা এক ধরনের রহস্য তৈরি করতে চাচ্ছে। আমি এভাবে একটা উত্তর
দিলাম। তিনি কোন কিছুই বললেন না। এই আচরন থেকেই বোঝা যাচ্ছে ব্যপার টা।
কোথায় যাচ্ছেন আপনি? কথাটা জিজ্ঞাস করে আমি নিজেই চিন্তায় পরে গেলাম। আমি
কেন উনাকে জিজ্ঞাস করতে গেলাম? তিনি চোখ না নামিয়েই বললেন ঢাকা যাচ্ছি৷
এর পর ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা
করলাম৷ আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছে আমি চাচ্ছি এই লোকটা আমার সাথে কথা বলুক।
কিন্তু হঠাৎ করে এমন চাওয়ার কারন আমি নিজেই খুজে পেলাম না।
লোকটি আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ আর আমি চাচ্ছি
উনি আমার সাথে কথা বলুক। একটা বাদাম ওয়ালা অনেক ক্ষন ধরে ছেলা বাদাম ছেলা
বাদাম বলে চেঁচাচ্ছে। বাদাম খেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু তাকে চুপ করানোর
জন্যই দশ টাকার বাদাম নিয়ে বললাম ভাই দয়া করে ওদিকে যান। এখানে আর চেঁচাবেন
না। বাদাম ওয়ালা ৩৬ দাঁত মার্কা হাঁসি দিয়ে আবার ছেলা বাদাম ছেলা বাদাম
বলতে বলতে চলে গেল।
কেন জানিনা বিরক্ত লাগছে৷ খুব বিরক্ত লাগছে। কেন লাগছে ঠিক বুঝতে পারছি
না।ট্রেনে উঠেছি ৩-৪ ঘন্টা আগে। মাঝখানে কয়েকবার ট্রেন থেমেছে৷ লোকে মুখে
শুনলাম সামনের একটা স্টেশন পার হলেই নাকি যমুনা সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন যাবে।
কথাটা শোনার পর থেকেই বেশ উত্তেজনা অনুভব করছি। কি অদ্ভুত লাগবে ! বিশাল
নদী। তার উপর দিয়ে ট্রেন যাবে। রাজ্যের বাতাস এসে লাগবে আমার গায়ে৷ চুল
গুলো পতাকার মতো উড়বে। ভাবতেই গা শিরে ওঠে। আমার সামনে বসে থাকা লোকটি একটা
বই হাতে নিয়ে বসে আছে৷ শরৎ বাবুর শ্রীকান্ত মনে হচ্ছে। লোকটি বেশ মনযোগ
দিয়েই বইটা পড়ছে। আমি হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম। ৪ টা বেজে ৩৮ মিনিট। "আপনার
নাম টা কিন্তু বললেন না" শীতল কন্ঠে কথা টা শুনেই সামান্য চমকে উঠলাম। আমি
লোকটির দিকে তাকিয়ে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করলাম। লোকটা আমার সাথেই কথা বলছে?
আমি গলা খাঁকরে বললাম, মৃন্ময়ী, আমার নাম মৃন্ময়ী। ডাক নাম মিনু। আপনার?
লোকটি আমার কথা শুনে বইটা রেখে দিতে দিতে বললো, তীর্থ।
বাহ, এরকম একটা মানুষের এতো সুন্দর একটা নাম? ভাবা যায় না৷
লোকটা বললো, আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
আপুর বাড়িতে, আসলে এবার এডমিশন দিব তো। সে জন্য কিছু দিন আপুর সাথে থাকবো৷ কথাটা শেষ করেই আমার মনে হলো আমি কি বেশি কথা বলছি?
ও আচ্ছা বলেই লোকটি আবার বই বের করতে লাগলো।
আমি পানির বোতল হাতে নিয়ে বললাম, আপনি কি করেন?
লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি তে পড়ছি, ২য় বর্ষ।
আমি ভালো মাপের একটা ধাক্কা খেলাম। মনে হচ্ছে আমার মুখ কিছুটা হা হয়ে
গেছে। আমি যে মানুষটা কে এতোক্ষন গুন্ডা বা খারাপ লোক ভাবছিলাম সে আসলে
একজন ভালো স্টুডেন্ট? আসলে আমারও দোষ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে
কেউ যদি কোন রকমের একটা প্যান্ট এর সাথে আকাশী রঙের ফুল হাতা শার্ট গায়ে
দিয়ে চুল এলো মেলো করে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে শুষ্ক মুখে ট্রেনে ওঠে
তাহলে নিশ্চয় বোঝা যাবে না। কিন্তু লোকটা এমন ভাবে কেন ট্রেনে উঠেছে?
জানতে ইচ্ছা করছে। আমার আবার অনেক গুলো ভালো গুনের মধ্যে একটা হলো আমার
কিছু জানতে ইচ্ছা করলে সেটা না জানা পর্যন্ত ঠিক শান্তি পাইনা। কিন্তু
লোকটা কে কিভাবে প্রশ্ন টা করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমি লজ্জার মাথা
খেয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম কিন্তু শেষ মূহুর্তে আর পারলাম না।
লোকটা মনযোগ দিয়ে বই পড়ছে। এলোমেলো হয়ে থাকা চুল গুলো উড়ছে৷ মুখে হালকা
খোচা খোচা দাড়ি। মুখটা এতো শুকিয়ে আছে কেন কে জানে। হয়তো সকাল থেকেই কিছু
খায়নি । আমার কাছে টিফিন ক্যারি ভরা খাবার আছে। আমি সামান্য দূরে কোথাও
গেলে মা এক টিফিন ক্যারি ভরে আমাকে খাবার দেয়৷ আমি কি টিফিন ক্যারি খুলে
লোকটা কে; না লোকটা কে না, ছেলেটা কে৷ এখন লোকটা কে ছেলেটা বলা যায়৷ ছেলেটা
কে টিফিন ক্যারি খুলে খাবার দেব? কি না কি মনে করবে কে জানে। সাধারণত
এধরনের ছেলেদের খুব আত্মস্মমানবোধ থাকে৷ আমি খাবার দিতে চাইলে উনি কিভাবে
যে বিষয় টা নিবেন!
আমি খানিক্ষন ভেবে টিফিন ক্যারি বের করলাম। উনি শীতল চোখে এদিকেই তাকিয়ে
আছেন৷ আমি টিফিন ক্যারি খুলে একটু নাটক করার চেষ্টা করলাম। মাথায় হাত দিয়ে
বললাম, বাপরে! আমার মায়ের কান্ড দেখেছেন? এতো গুলো খাবার কিভাবে খাবো
আমি? আমাকে রাক্ষস ভাবে মনে হয়। এতোগুলো খাবার নষ্ট হয়ে যাবে এখন। কোন
মানে হয়?
ছেলেটা জানালার দিকে তাকালো।
আমি অনুরোধের সুরে বললাম, এই যে! একটা হেল্প করবেন?
উনি জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে তাকালেন।
আমি গলা নিচু করে বললাম, আমার সাথে খাবার খাবেন? তাহলে খাবার গুলো নষ্ট
হতো না। আমি কথাটা বলে মাথা নিচু করে থাকলাম। উনি কি বলে সেটা শোনার
অপেক্ষা। উনি হাল্কা গলায় বললেন, আচ্ছা।
আমি তাড়াহুড়ো করে খাবার দিতে লাগলাম। একটু ঝোল উনার শার্টে পরে লাল হয়ে
গেল। প্রচুর লজ্জা লাগছে কেন জানি। সাধারনত আমার লজ্জা খুব কম। কিন্তু
এখানে এমন লাগছে কেন কে জানে? আমি স্যরি বলে খাওয়া শুরু করতে বললাম৷ উনি
ধিরে ধিরে খাচ্ছেন। খুব গোছালো খাওয়া যাকে বলে। শার্টে যে ঝোল লেগেছে এদিকে
উনার কোন খেয়াল নেই৷ উনি আরামে খাচ্ছেন। কোন কথা নেই চোখে ৷ দেখাতে ভালো
লাগছে। হয়তো খুব খিদে পেয়েছিল।
খাবার শেষে আমি টিফিন ক্যারি ওই অবস্থা তেই রেখে দিলাম। আর ছেলেটি পানি
নিয়ে ধুতে লাগলো। আরে আরে লাগবে না, এরকম-ই রেখে দেন। বাসায় গিয়ে পরিষ্কার
করে নিলেই হবে। কথা টা বলতে বলতে ছেলেটির হাত থেকে আমি টিফিন ক্যারি নিয়ে
নিলাম। ছেলেটি হাঁসি হাঁসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও হাঁসি হাঁসি
মুখ করে বললাম।
আপনার গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়? ছেলেটি মাথা নেড়ে বললো, না । আমার দিকে তাকিয়ে বললো নওগাঁ তে আমার চাচার বাড়ি। ওখানেই গিয়েছিলাম।
ও আচ্ছা, তাহলে গ্রামের বাড়ি কোথায়?
ছেলেটা একটু হেঁসে জানালার দিকে তাকালো। উনি আমাকে বলতে চাচ্ছে না। আচ্ছা
না বলুক, সমস্যা নেই। কিন্তু নিজের থেকে কোন প্রশ্ন ও করছে না। খানিক্ষন
পর ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে বললো, গ্রামের বাড়ি নওগাঁ তেই।
হঠাৎ বাবা মারা গেলেন। আমি আর মা একলা হয়ে গেলাম। বাবা মারা যাওয়ার পর
শুনলাম প্রচুর ধার দেনা । সে জন্য বাড়িটা আমার চাচার কাছেই বিক্রি করে
দিলাম। মা ওখানেই থাকেন, চাচার বাড়িতে৷ আর আমি ঢাকায় পড়ছি৷ এইতো! কথা গুলো
বলে ছেলেটা হাঁসি হাঁসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি কিছু বলতে যাব
ঠিক তখনই খেয়াল করলাম ট্রেন যমুনা সেতুর কাছাকাছি চলে এসেছে।
দৌড়ে গিয়ে দরজা ধরে দারালাম। ওই তো সেতু দেখা যাচ্ছে। চরম উত্তেজনা অনুভব
করছি। এভাবে ট্রেনে কখনো ঢাকা যাওয়া হয়নি । ট্রেন যখন সেতুর উপরে চলে আসলো
তখন উত্তেজনায় আমার বুক কাঁপছে। আমি শুধু হা করে সুন্দর্য উপভোগ করছি৷
যতদূর চোখ যায় পানি৷ উপর থেকে পানির ঢেউ দেখতে যে এতো সুন্দর লাগে তা আমার
জানা ছিল না। ঠান্ডা বাতাসে আমার লোম দাঁড়িয়ে গেল। আমি কয়েকবার চিৎকার
করলাম। আকাশে সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব আসতে শুরু করেছে। নদীর পানি তে আলো ছায়া
খেলা করছে। মনে হচ্ছে আমি এই বিশাল নদীর একটা অংশ৷ আমি নদীর উপর দিয়ে উড়ে
যাচ্ছি। প্রকৃতি কে জানতে হলে, প্রকৃতির সুন্দর্য কে উপভোগ করতে হলে নিজেকে
প্রকৃতির অংশ করে নিতে হয়৷ আমি সেই চেষ্টায় করছি৷ সব কিছু চুপচাপ৷ ট্রেন
চলছে যমুনা সেতুর উপর দিয়ে৷ ডুবন্ত সূর্যের আভা নদীর গায়ে লেগে চিকচিক
করছে৷ ঠান্ডা বাতাস আমাকে ছুয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বড় বড় করে সুন্দর্য উপভোগ
করছি। আমার মন আমার কানে কানে বলছে, আহ, কি সুন্দর ! কি সুন্দর !
সূর্য ডুবতে না ডুবতেই ট্রেনের বগি তে থাকা লাইট সব জ্বলে উঠলো। আমি পা
উপরে উঠিয়ে পড়ছি। সাধারন জ্ঞান জিনিস টা খুব বিরক্তিকর। এ বিষয়ে আমার নিজের
তৈরি একটা থিউরি আছে। সেটা হচ্ছে, সাধারন জ্ঞান এর গায়ে প্রচুর তেল মাখা
থাকে। আপনি এটা কে যতই আকঁড়ে ধরতে চাইবেন ততই আপনার হাত ফসকে চলে যাবে।
আমার সামনে বসা ছেলেটি এই যাত্রায় প্রথম পকেট থেকে ছোট একটা ফোন বের
করেছে৷ কাকে যেন ফোন দিচ্ছে। কিন্তু সে রিসিভ করছে না। ছেলেটি রাগে কটমট
করছে। অবশেষে ও পাশের মানুষটি ফোন রিসিভ করেছে মনে হচ্ছে। ছেলেটি কড়া গলায়
খুব ধমকাচ্ছে । ওই তুই ফোন রাখস কই রে? থাবরে মাড়ির সব কটা দাঁত ফালায়ে
দেব ফাজিল কোথাকার। আবার কথা বলে? তোর কাজ আমি তোরে গুলায়ে খাওয়াবো শয়তান।
এতোটুকু বলে ফোন রেখে দিল। ছেলেটি রীতিমত কাঁপছে। অত্যাধিক রাগের কারন মনে
হয়৷ আমি ভীত চোখে একবার উনার দিকে তাকাচ্ছি আর একবার বইয়ের দিকে। উনি এবার
নিজেকে একটু ঠান্ডা করে নিয়ে আবার ফোন দিলেন। এবার ঠান্ডা গলায় বললেন,
বাবু কে কোচিং এ ভর্তি করানো জন্য তোকে যে টাকাটা দিয়েছিলাম। সেই টাকা থেকে
একটা পয়াসা উল্টা পাল্টা হলে পরিস্থিতি অনেক খারাপ হবে বলে দিলাম। এরপর আর
কিছু না বলে ফোন পকেটে রেখে দিলেন। রাগে উনি প্রায় লাল হয়ে গেছেন । কে এই
বাবু? আর ওকে এই ছেলেটায় বা কোচিংয়ে কেন ভর্তি করাবে? খুব জানতে ইচ্ছা
করছে কিন্তু ইনি যে পরিমানে রেগে আছেন। আমার মনে হচ্ছে এখন উনাকে কিছু
বললেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবেন । আমি আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম।
ট্রেন কমলাপুরে এসে যখন থামালো তখন কেবল গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরছে৷ চারদিকে
বেশ হৈচৈ। আমি ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে দুলাভাই কে খুজতে লাগলাম। কিন্তু খুজে
পাচ্ছি না। দুলাভাইকে ফোন দিয়ে জানলাম উনি জ্যামে আটকা পরেছেন। আমাকে কোন
একটা দোকান বা বেঞ্চে বসতে বলে বললেন "আমার আসতে আরো ১৫-২০ মিনিট লাগবে"।
আমার ভয় ভয় করছে। একটা ফাঁকা বেঞ্চে বসলাম। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলাম তীর্থ
নামের ছেলেটা একটা চায়ের দোকানে চা খাচ্ছে। উনাকে ডেকে কিছুক্ষন গল্প করা
যায়। আমি গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, এই যে মিষ্টার তীর্থ, হ্যালো। উনি পেছন ফিরে
তাকালেন। আমি হাঁসি মুখে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।উনি এদিকে আসছেন। আমার
সামনে এসে মাথা ঝারতে ঝারতে বললেন, কি ব্যপার এখানে বসে আছেন কেন?
আপনাকে তো বলেছি দুলাভাই নিতে আসবে। দুলাভাই জ্যামে আটকা পরেছে। আসতে আরো ২০ মিনিট এর মতো লাগবে। আপনার কি কোন কাজ আছে?
না, সে রকম কোন কাজ নেই। তবে হলে ফরতে হবে।
যদি আপনার কোন সমস্যা না হয় তাহলে কি আমার সাথে একটু বসবেন। একা একা ভয় ভয় করছে আর কি ৷
ছেলেটি ঠোট লম্বা করে হাঁসলো। আমার পাশে বসতে বসতে বললেন। হ্যা, বসা যায় ৷
আমি খানিক্ষণ চুপ থাকার পরে উনার দিকে তাকালাম। আরাম করে বসে আছেন উনি। আমি
গলা খাকরে বললাম, আচ্ছা ট্রেনে যে বাবুর কথা বললেন। বাবুটা কে? আপনার ছোট
ভাই?
হুম ছোট ভাই।
আপনি বলেছিলেন আপনি আপনার বাবার একটায় ছেলে।
মায়ের পেট এর ভাই ছাড়া কি আর ভাই থাকে না?
আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম৷ মিষ্টি করে হেঁসে দেয়ার চেষ্টা করলাম।
আমি আবারো বললাম, বাবু কি রকম ভাই হয় আপনার? এবার ছেলেটি ভাবলেশহীন চোখে
আমার দিকে তাকালো। আমি একটু বিব্রতবোধ করলাম। ছেলেটি শীতল গলায় বললো, বাবুর
কেউ নেই। রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে সবাই। শুধু বাবা না থাকাটাই যে কত
কষ্টের তা আমি জানি। তাহলে ছোট একটা ছেলে বাবা মা ছাড়া কিভাবে বাঁচতো?
ভাবতেই আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমি জীবনে যে কষ্ট পেয়েছি, আমি চাই না সে রকম
আর কেউ কষ্ট পাক ৷ সে জন্য অনেক ঝামেলার পরেও বাবু কে নিজের কাছে রেখে
দিয়েছি। এখন আমিই ওর মা বাবা সব কিছু।
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। আমি বললাম, আপনি আমাকে আপনার পরিবারের কথা যে
ভাবে বলেছেন তাতে বুঝেছি আপনার পরিবার বেশ অভাবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাহলে
কিভাবে চালাচ্ছেন সব কিছু?
ছেলেটি একটু হাঁসলো। আগের মতোই শীতল গলাই বললো, টিউশনি করছি কয়েকটা। ওখান
থেকে কিছু টাকা মা কে পাঠাই। বাকি টা দিয়ে বাবুর খরচ আর আমার সে রকম কোন
খরচ নেই।
কেন জানিনা বেশ মায়া হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে এখনি কেঁদে ফেলব। আমি গলা নিচু করে বললাম, সমস্যা হয় না আপনার?
ছেলেটি আবার আমার দিকে তাকালো। মুখ হাঁসি হাঁসি করে বললো, এক সময় মুরগির
মাংস ছাড়া ভাত খেতাম না। এখন সপ্তাহে এক বেলা হোটেল থেকে চার পিচ মুরগির
মাংস কিনি। বাবু কে তিন টা দিই আমি একটা নিই। বাবু যখন খুব আরাম করে খায়
তখন কেন জানিনা বুকের ভেতর দুমড়ে মুচরে ওঠে৷ ইশ ছেলেটার বাবা বেচে থাকলে
হয়তো তিন বেলা মুরগি খেত৷ এখন খেয়ে না খেয়ে আমার সাথে থাকছে। ডাল ভাত হোক
পান্তা ভাত হোক, নিশব্দে খেয়ে যাচ্ছে৷ জানেন, মাসের শেষের দিকে কোন কোন
বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। বাবুকে যতটুকু পারি খাইয়ে আমি না খেয়ে থাকি। ছোট্ট
ছেলেটা কত কষ্ট পাচ্ছে। আল্লাহ কেন মানুষের মা বাবা কে তুলে নেই বলেন তো?
ছেলেটির চোখ ভিজে ওঠে৷ চোখ মুছতে মুছতে ছেলেটি বলে, জানেন আমি কষ্ট করে
বাবু কে মানুষ করছি। আমার এতেই শান্তি। আমার আর কিছু লাগবে না। একদিন আমি
চাকরি করবো। বাবু বড় হবে, তখন ওর সকল আবদার আমি মিটাবো। যখন দেখি বাবুর
একমাত্র শার্ট টা তেলাপোকা কেটে কানা করেছে। আর বাবু হাঁসি মুখে সেই শার্ট
গায়ে দিয়ে কানা হওয়া যায়গাটা ঢাকতে ঢাকতে কোচিংয়ে যাচ্ছে। আমার বুক কেঁপে
ওঠে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আমিও এভাবেই ছেড়া শার্ট গায়ে দিয়েই প্রাইভেটে
যেতাম। ছেলেটা নিজেকে সামলে নিতে নিতে বললো, এগুলা গল্প কারো সাথে করা যায়
না। কিন্তু আপনার সাথে কেন করলাম আমি জানিনা। মন হালকা লাগছে। ভালো
থাকবেন, আসি,,,,
ছেলেটি নিশব্দে হেঁটে
চলে যাচ্ছে। হয়তো যেয়েই বাবুকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। এরকম মানুষ কে কিভাবে
সম্মান দিতে হয় আমার জানা নেই। এরা নিজের সপ্নের পাশাপাশি অন্যের সপ্ন পূরন
করার জন্য ছোটাছুটি করে। ছেলেটি ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে৷ হঠাৎ
করে কারেন্ট অফ হয়ে গেল। চাঁদের আলো যেন চুয়ে পরছে। মৃন্ময়ীর হাতের নীল
চূড়ি গুলো চিকচিক করছে। কারেন্ট আসার সাথে সাথে একটা বছর সাতেক এর বাচ্চা
এসে মৃন্ময়ীর সামনে দাঁড়িয়ে বললো "আফা খুব খিদা লাগছে.