গ্রন্থের প্রচ্ছদ
একটি উপন্যাস নিয়ে এই আলোচনা। উপন্যাসটির লেখক আকিমুন রহমান। উপন্যাসের নাম 'অচিনআলোকুমার ও নগণ্য মানবী। এবছর ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় উপন্যাসটি প্রকাশিতহয়েছে। প্রকাশ করেছে গ্রন্থ কুটির। উপন্যাসটির প্রধান আকর্ষক বিষয় প্রেম। তবে আর পাঁচটা উপন্যাসের মতো মানব-মানবীর প্রেমকাহিনি এতে নেই। লেখক এক অদ্ভুতপ্রণয় ঘটনার অবতারণা করেছেন এ উপন্যাসে। একে বলা যেতে পারে একটি অপার্থিব প্রণয়োপখ্যান। কিংবা বলা যেতে পারে, কল্পবিজ্ঞানের ছায়াতলে একটি মানবিক প্রণয় কাহিনি। যদিও প্রণয় অংশটুকুর বাইরে এর পারিপার্শ্বিক কাঠামো নির্মিত হয়েছে স্বাভাবিক বাস্তবতার উপাদানে।
উপন্যাসটির নামকরণের মধ্যে যে নগণ্য মানবীর উল্লেখ আছে,তার নাম মরিয়ম হুসনা জাহান। ডাক নাম হেনা। তাকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। কিংবাবলা চলে,হুসনা জাহানের আত্মকথনের মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি বিবৃত হয়েছে। সে আত্মকথন আবার লেখা হয়ে উঠেছে তার পুরনো খাতাকে বানিয়ে তোলা ডায়রিতে।
উপন্যাসটির মধ্যে একদিকে যেমন পাওয়া যাবে খুব সাধারণ বিশেষত্বহীন একটি পরিবারের খুটিনাটি চালচিত্রের পরিচয়, তেমনি এর মধ্যে পাওয়া যাবে খুব সাধারণ, মাথা নীচু,কষ্ট সয়ে যাওয়া, প্রতিবাদহীন একটি মেয়ের জীবনে ঘটে যাওয়া আকস্মিক ও বিস্ময়কর ঘটনাবলির বিবরণ। আর আমরা তার মধ্যে দেখতে পাব একজন লেখকের অসম্ভব কল্পনাশক্তির প্রকাশ। এ উপন্যাসের ভাষাবৈশিষ্ট্যও লেখকের অন্যান্য উপন্যাসের বিবেচনায় ভিন্নতর। অবশ্য, উপন্যাসটি যেহেতু একটি মেয়ের আত্মকথনের মধ্য দিয়ে বিবৃত হয়েছে,ফলে স্বাভাবিকভাবেই উপন্যাসের ভাষারীতি আলাদা রূপ পরিগ্রহ করেছে।
২.
মরিয়ম হুসনা জাহান ঢাকার কদমতলা নামক এলাকায় থাকে। সেখানে আড়াইকাঠা জমির উপর তার বাবার অনেক কষ্টে নির্মিত চারতলা বাড়ির একটি ফ্লোরের একটি কামরায় তার বসবাস। বাবা মারা গেছে। তার তিনবছর আগে মা মারা গেছে। ছোট বোন রিনার বিয়ে হয়ে গেছে আগেই। জামাই ইটালিতে থাকে। রিনা শ্বশুর বাড়িতে। চারতলা বাড়িটিতে যমজ সন্তান নিয়ে ভাই -ভাবীও থাকে।তবে হুসনা জাহানের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা তার নিজেকেই করতে হয়।
সে ইডেন কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স, মাস্টার্স পাশ করেছে। এম ফিলও করেছে। সে চাকরি করে। আজিমপুর গোরস্থানের পাশে এক গলির ভেতরে অবস্থিত আয়াতুন্নেছা গার্লস স্কুলএন্ড কলেজে সে শিক্ষকতা করে। কলেজটি গভমেন্ট এফিলিয়েশন এখনও পায়নি। একটা বাঁধা রুটিনের মধ্যে হুসনা জাহানের জীবন চলে। কলেজ থেকে ফিরে আসার পর প্রতিদিনই শেষ বিকেল থেকে রাত আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত তাকে নানা কাজেব্যস্ত থাকতে হয়। পরের দিন কলেজে যাবার জন্য ব্লাউজ শাড়ি ইস্তিরি করা,খাতা দেখার থাকলে খাতা দেখা, ছাত্রীদের নোট দেখা,কারেকশন করা,বাংলা ব্যাকরণের এটা-সেটার দিকে নজর দেয়া,কলম খাতা ব্যাগে ঢোকানো ইত্যকার কাজ। রান্নাবান্নার কাজ তো রয়েছেই। এই বাঁধাধরা জীবনের মধ্যে কোনো বিশেষ কিছু পাবার ইচ্ছা তার হয় না। সে ফুলকে ফুলই দেখে,মেঘকে মেঘ। ফুলে ফুলে কোনোদিনই সে কারো হাসির আভাস দেখতে পায় না। তার কখনো নিজেকে ক্রমে ক্ষয়ে আসা বাংলা সাবানের মতো মনেহয়।
হুসনা জাহানের জীবনে প্রথম ছন্দপতনের ঘটনা ঘটে তার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর। তার অনেক ইচ্ছা ভার্সিটিতে পড়ার। সে কথা বাবাকে বলেছেও। তিনি আপত্তি করেননি। কিন্তু মা চিরকাল মেয়েদের বেশি লেখাপড়ার বিপক্ষে। সে মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। একদিন সন্ধ্যায় বাবার আপত্তির মুখেই হুসনাজাহান আর তার দাদাভাই মোতাহার আলীর বিয়ে একসাথে পাকা হয়ে যায়। বড়ো খালার মেয়ে বকুলের সাথে মোতাহার আলীর আর বড়ো ছেলে নূর হোসেনের সাথে হুসনাজাহানের। মেট্রিক ফেল নূর হোসেন আবুধাবিতে চাকরি করে। সে দেশে এসেছিল বিয়ে করার জন্য। এখন ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে যাওয়ায়, তাড়াহুড়া করে সরা-কাবিন সারা হয়। 'কথা থাকে, একবছর পরে নূর হোসেন ছুটি নিয়ে দেশে আসবে যখন, তখনই দুইবাড়ির মেয়ে তুলে আনার বড়ো কাজটা করা হবে।' নূর হোসেন আবুধাবি ফিরে যায়।
হুসনা জাহানের রেজাল্ট হয়। ভার্সিটিতে ভর্তির সময় আসে। আবুধাবি থেকে আপত্তি আসে আর পড়া যাবে না। পড়লেও মেয়েদের কলেজে পড়তে হবে। মা-খালা বলে,'আর পড়োনের কী কাম!' বাবা গোপনে মেয়েকে ইডেন কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ায়। হুসনা জাহানের বাংলায় অনার্স পড়া শুরু হয়। বাবা মেয়েকে শিখিয়ে দেয়, 'লোকে জিজ্ঞেস করলে কইস, তুই ডিগ্রি পড়স।'
বছর যায়,দুই বছর যায়, নূর হোসেন ছুটি ম্যানেজ করে দেশে আসতে পারে না। দাদা ভাইয়ের বউকে তুলে আনা হয়। মা ছেলে বউয়ের মানে বোন-ঝির যতœ-খেয়াল করতে থাকে। এরই মধ্যে হঠাৎ হার্ট ফেল করে মামারা যায়। সংসারের দখল বুঝে নেয় ভাবী। তার যমজসন্তান হয়। হুসনা জাহানের অনার্স হয়। মাস্টার্সও শেষ হয়ে যায়। নূর হোসেন আসে না। বাসায় খালা-খালু আসে। তারা বলে,জামাই না আসুক,বউ স্বামীর সংসারে গিয়ে শ্বশুর-শ্বাশুরীর সেবাকরুক। বাবা রাজী হয় না। তারা রাগারাগি করে ফিরে যায়। বাবা মেয়েকে এমফিল করতে বলে। হুসনা জাহান এমফিল করে।
৩.
হুসনা জাহানের জীবনপর্বের এসমস্তই আমরা জেনে ওঠি তার লেখা ডায়রি থেকে।লেখক অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে হুসনা জাহান চরিত্রটি
পাঠকের কাছে তুলে ধরতে থাকেন।
হুসনা জাহানের বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। শয্যাশায়ী হয়। তার প্রস্টেটক্যানসার।জীবন সংগ্রামী মানুষ তিনি। জীবনের প্রারম্ভেই বাবা-মাকে হারিয়েএতিম আব্দুল আলী লজিং থেকে পড়াশুনা করেছেন। বি.কম পাশ করে রোডস এন্ডহাইওয়েজ ডিপার্টমেন্টে কেরানির পদে চাকরিতে ঢুকেন।এই কেরানির পদে চাকরিকরেই তিনি ছেলে- মেয়ে মানুষ করেছেন,শ্বশুরের দেয়া জমিতে চার তলা বিল্ডিংতুলেছেন।সেকশন অফিসার হয়ে রিটায়ারমেন্টে আসেন। রিটায়ারমেন্টে আসার আগ দিয়েই তার অসুখটা ধরা পড়ে। এতদিন শরীরকে নানাভাবে সামাল দিয়েছেন,এবার আর সামালদিতে পারছেন না। হুসনা জাহান বাবার শুশ্রুষা করতে থাকে।
এদিকে পাঁচ বছরপর নূর হোসনের সুযোগ হয় দেশে ফেরার। দেশে ফিরে এসে বউকে তুলে নিতে চায়।কিন্তু বাবার এরকম গুরুতর অসুস্থতার মধ্যে হুসনা জাহান কীভাবে স্বামীরসংসার করতে যাবে!হুসনা জাহান পরিষ্কার বলে দেয়,সে যাবে না। দুই পরিবারেরমধ্যে প্রচুর ঝামেলা হয়।ওদিকে উকিল দাদাভাইয়ের মুহুরি ডিভোর্সের কাগজপত্ররেডি করে ফেলে।
বাবা আব্দুল আলী এবার যেন বুঝতে পারে তার দিন শেষ হয়েআসছে।সে দিশাহারা বোধ করে। সে তার দুই ছেলে-মেয়েকে কাছে ডাকে। সে তাদেরকেএকটি আমানত দিয়ে যেতে চায়।তার দাদার আমানত।এতদিন তিনি সেই আমানত রক্ষা করেএসেছেন। এখন ছেলে-মেয়ে সেই আমানত রক্ষা করুক।কী সেই আমানত? সেই আমানত একগুপ্ত বিদ্যা ---মোরাকাবা। মানে ধ্যান করা।ইংরেজিতে যাকে বলা চলে মেডিটেশন।বাবা আব্দুল আলী ছেলে-মেয়েকে মোরাকাবার বিধি-বিধান বুঝিয়ে দিতে থাকেন।তিনি একবার বলেই ক্ষান্ত হন না।বারবার ছেলে-মেয়েকে বুঝিয়ে বলতে চান।ছেলেব্যস্ত থাকায় তাকে কাছে পান না।হুসনা জাহান যখনই বাবার শুশ্রুষার কাজে কাছেআসে,তখনই তিনিমেয়েকে পুনঃপুনবার মোরাকাবার নিয়মকানুন বুঝিয়ে বলতেথাকেন।বারবার শুনতে শুনতে হুসনা জাহানের মোরাকাবার নিয়মকানুন মুখস্ত হয়েযায়।
বাবা হুসনা জাহানকে বলেন,মোরাকাবা অন্তর দিয়ে করতে হয়। 'এটা অনেকদামি এক জিনিস! এইটা অতি সাধনারএক বিষয়। যে এই বিদ্যার সন্ধান পায়,তার মতোভাগ্যবান বিরল। ' তিনি আরো বলেন--'লোকে তো কেবল ভাত-কাপড়ের জন্য এই জীবনেরেপায় না। আরো গূঢ় এক সাধনারও জন্য এই মানব-জনম।' তিনি হুসনা জাহানকে বলেন'মোরাকাবার রাস্তা ধরে চলতে থাকলে পথের দিশাখান পাওয়া যায়।...তোমার পথয্যান তোমারে ধরা দিতে দেরি না করে।...মোরাকাবা করায় গাফিলতি দিয়ো না।'
একদিন দুপুরের পর-পর বাবাকে জাউ খাওয়াতে গিয়ে এক বিস্ময়কর ঘটনার সাক্ষীহয়। দেখে,বাবা শান্ত হয়ে শুয়ে আছে,কোনো গোঙানি নাই। হুসনা জাহান ভয় পেয়েযায়। হঠাৎ সে বাবাকে সুস্থ মানুষের মতো কথা বলতে শুনে। বাবা যেন ডাকছে,যেনএকটা পথ দেখতে বলছে। ঘরের মধ্যে পথ আসবে কোথা থেকে!বাবা কী প্রলাপ বকছে!বাবা বলছে, ' কী সুন্দর পথখান! ওই যে রাস্তা! সিধা গেছে গা রাস্তাখান! ওই কতদূরে...দেখো গো মা! ' এবার হুসনা জাহানও যেন পথখান দেখতে পায়। পায়ে-হাঁটাছায়ায় মোড়ানো এক দীর্ঘ পথ। পথের একপাশে দিঘি,দিঘিভরা পদ্ম,পদ্মফুলেরসুগন্ধ! পথের আরেক পাশ দিয়ে সারি সারি আমগাছ,গাছভরা বোল!পথের শেষ মাথায়একটা ভিটি-বাড়ি!ভিটি-বাড়ির মুখে সাদা সাদা ফলেভরা কামিনী ফুলের গাছ! আরঝরে-পড়া ফুলে ছেয়ে আছে সবুজ ঘাস! বাবা হা হা করে কেঁদে ওঠে! 'আহা!এই ভিটিকোন ভিটি!এই রাস্তা কোন রাস্তা! আমি কী চিনি নাই নাকি! '
সেই দুপুরেরচমক-লাগা ঘটনাটির কথা হুসনা জাহান কখনো ভুলতে পারে না। বাবা মারা যায়।বাবার মৃত্যুর পর হুসনা জাহানের উপর ভাবীর গঞ্জনা বেড়ে চলে। হুসনা জাহানেরনিজেকে 'তুফানে আছড়ানী খাওয়া একটা গাছ ' মনে হয়। ঝড়কে সামাল দিতে দিতেহুসনা জাহানের মনে হয় 'এইবার হয় আমারে যেইদিক দুইচোখ যায় চলে যেতে হবে!নইলে নিজেরে শেষ করে দিতে হবে।' হুসনা জাহান চাকরির খোঁজে বেরোয়।শেষমেষকলেজের চাকরিটা পেয়ে যায়।
হুসনা জাহান বাবার রেখে যাওয়া আমানতটির কথাভুলে না।বাবার মৃত্যুর তিনমাস পর একদিন সন্ধ্যায় সে তাদের কোনোরকমে বানিয়েতোলা চার তলা বাড়িটার ছাদে যায়। লেখক ছাদটির একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।যে বর্ণনার মধ্য দিয়ে হুসনা জাহানদের পারিবারিক আর্থিক অবস্থা,তাদের মানসিককাঠামোর পরিচয় ফুটে উঠেছে। ছাদে আসার পর হুসনা জাহানের মনে আরেকটা বিষয়ওরেখাপাত করে। সেটা হলো, মাগরিবের আজানের পরের পনের-বিশ মিনিট সময়েরসন্ধ্যার রূপটা। সে লক্ষ করে,এই সময়টায় মাটিতে 'হুড়মুড়'করে অন্ধকার নেমেআসে। কিন্তু আকাশে তখন অন্য ব্যাপার। আকাশে তখন অনেকখানি ফিকে ফর্সা ভাবথাকে। সেই ফর্সা ভাবটা আকাশ থেকে 'ধুড়মুড়' করে সরে যায় না। যেতে থাকে আস্তেআস্তে। 'কেমন একটা ছাই ছাই বরণের ঢেউ ছড়ায়ে পড়তে থাকে আসমানে।' অনেকক্ষণলাগে অন্ধকার হতে।ব্যাপারটা হুসনা জাহানের খুব ভালো লাগতে থাকে। তারমনেএকটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।বিষয়টা তার লিখে রাখতে ইচ্ছে করে। সেই থেকেহুসনা জাহানের ডায়রি লেখা শুরু।
ছাদে এদিক-ওদিক হাঁটতে হাঁটতেই একসময়হুসনা জাহান সিমেন্টে বাঁধা একটা টবে লাগানো পেয়ারা গাছেরকাছে,ছিঁড়ে-যাওয়া পরিত্যক্ত একটা লোহার কাঠামো সর্বস্ব প্লাস্টিকের চেয়ারেবসে মোরাকাবা করা শুরু করে দেয়।আর বাবা যেন পাশে বসে থেকে নিয়মনীতিগুলো বলেযেতে থাকে।হুসনা জাহানের চোখ বন্ধ হয়ে থাকে একক নিমগ্নতায়।
৪.
এরপর থেকে প্রতিদিন হুসনা জাহান ছাদে গিয়ে মোরাকাবা করতে থাকে।এই মোরাকাবাকরাকে কেন্দ্র করে লেখক হুসনা জাহানের জীবনে এক অভিনব ঘটনার অবতারণাকরেন।আর আমরা ক্রমে এক কল্পবিজ্ঞানের পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়ি। হুসনা জাহানেরডায়রি থেকে আমরা সে ঘটনার কথা জেনে ওঠি।
একদিন হুসনা জাহান সন্ধ্যারঅনেক আগেই ছাদে যায়।পেয়ারা গাছটার কাছে পরিত্যক্ত চেয়ারটায় বসে থাকে।জীবনেরঅনেক কথা তারর মনে আসে।মাগরিবের সময় চলে যায়।ইশারও আজান হয়ে যায়।হঠাৎ তারমনে হয় এখনও মোরাকাবা করা হয়নি। সে মোরাকাবা শুরু করে। মোরাকাবার শেষপর্যায়ে হঠাৎ তার মুখে গলায় মাকড়সার জালের মতো কিছু একটার ঝাপটা লাগে। সাথেসাথে শরীরে চুলকানী শুরু হয়ে যায়।কোনেরকমে হুসনা জাহান মোরাকাবা শেষকরে।সে হাত দিয়ে মুখ থেকে গলা থেকে মাকড়সার জাল সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তুকোনো কাজ হয় না।চুলকানি বেড়ে চলে।সে ঘরে আসে। সে মুখ-হাত ভালো করেধোয়।এরপরেই সে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে দেখে। দেখে,তার কনুই থেকে হাতের পাতাপর্যন্ত অংশে পানি লাগামাত্র একটা লালল রঙ ঝটকা দিয়ে দিয়ে ভেসে উঠছেমাংসের ভেতর থেকে। কিছুক্ষণ পর সেই লাল রঙটা 'ছবলাতে ছবলাতে' কচি কলাপাতারমতো সবুজ হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কে আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠে।কিন্তু তার দাদাভাই এসেকিছু দেখতে পায় না। সে বলে কোনো কিছু লেগে এলার্জি হয়েছে।
হুসনা জাহানশরীরের চুলকানি থামানোর জন্য হাতে গরম সেঁক দেয়।সেঁক দেয়ার সাথে সাথে আরওভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে। সেঁক লাগামাত্র হাতের মাংসের ভেতর থেকে লাল রঙের বলক উঠতেথাকে।তারপর সবুজ বলক। সে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। সে বাতি নিভিয়ে বসেথাকে।অনেকক্ষণ পর আবার বাতি জ্বালায়। আয়নায় মুখ দেখে। আশ্চর্য ব্যাপার সবআগের মতোই ঠিক আছে।শুধু শরীরে চুলকানি রয়েছে।কিন্তু পানি লাগলে, সেঁক দিলেআবার আগের মতো হয়। তারপর আবার ঠিক হয়ে যায়। শুধু চুলকানিটা থাকে। তার মনেহয়, তার ব্লাড ক্যানসার হয়েছে।
সারাটা রাত ভয়ে-দুর্ভাবনায় কাটে হুসনা জাহানের। সে চোখ বুজে বিছানায় পড়েথাকে। ঘুম-অঘুমের মধ্যে যেন সে দেখতে পায়,অনেক দূর থেকে একটা মেঘ ছুটে আসছেতাদের বাড়িটার দিকে। মেঘটা এসে তাদের বাসার উপর থির হয়। তারর মনে হয়, মেঘটা যেন হুসনা জাহান হুসনা জাহান বলে ডাকছে। তার ঘুম ভেঙে যায়। দেখেবাইরে প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির তোড় ঘরে ঢুকেমেঝে, বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছে।সেও ভিজে গেছে। হঠাৎ তার খেয়াল হয় বৃষ্টিরপানিতে তার শরীর ভিজে গেলেও শরীরে কোনো রকমের রঙের বলকানি হচ্ছে না।শুধুচুলবুলানিটা আছে। হুসনা জাহানআশ্চর্য হয়।
পরদিন কলেজে পহেলা বৈশাখেরঅনুষ্ঠান।তার উপর দায়িত্ব পড়েছে মঞ্চ সাজানোর ফুল নিয়ে যাওয়ার।কিন্তু বাইরেতখনও বৃষ্টি। হুসনা জাহান বৃষ্টির মধ্যেই রিক্সায় হাইকোর্টের বটতলায় আসে।এখানে ফুল পাওয়া যায়।এসে দেখে কেউ নাই। তিনটা 'আউলা' মেয়েকে বসে থাকতেদেখে। মেয়েগুলো কাকে যেন ডাকে। কোথা থেকে দুইজনলোক দুইপাতি ফুল নিয়ে আসে।একশ পঁচিশটা লাল গোলাপ। হুসনা জাহান ফুল নিয়ে ভিজে-টিজে কলেজে এসে পৌঁছায়।আসতে দেরি হওয়ায় বড় আপার ভর্ৎসনাও শুনে।
কলেজ থেকে দুপুরে বাসায়ফিরে।ডায়রি লেখে। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে ভাবে।কাঁদেও। তারপর কখন যেন ঘুমিয়েপড়ে। ঘুমের মধ্যে সে শুনতে পায় কেউ যেন তাকে ডাকছে। গতরাতে ঘুমের মধ্যেমেঘটা যেমন করে ডাকছিল তেমন করে।ঘুমের মধ্যেই হুসনা জাহান খেয়াল করে দেখতেপায়, মানুষের ছায়ার মতো দেখতে কিছু একটা তাকে ডাকছে---'হুসনা জাহান,একটুআসবেন? আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। ছাদে কি একটু আসতে পারেন? খুবদরকার!আসবেন?' হুসনা জাহানের ঘুম ভেঙে যায়। ছাদে যাওয়ার জন্য মনস্থিরকরে।সে ছাদে আসে। তখন সন্ধ্যার মাগরিবের আজানের পরের সময়টা।
হুসনাজাহান ছাদে এসে কাউকে দেখতে পায় না।তার মনে ভয় ঢুকে। সে ফিরে যেতে চায়। 'এইযে আমি!একটু সতর্ক চোখে যদি তাকান,দেখতে পাবেন!' এবার হুসনা জাহানদেখে,রেলিংয়ে ভর দিয়ে আধা বসা হয়ে আছে মানুষের মতোই একটা মিহি ছায়া। ছায়াটাতাকে তার কোনো প্রিয় পুরুষের কথা মনে করতে বলে।তাহলে সে তার কাঠামোটা পেয়েযাবে। হুসনা জাহানের হঠাৎ করেই মাহবুব শরীফের কথা মনে আসে। একদিন যাকে তারভালো লেগেছিল। কিন্তু যাকে কিছুই বলা হয়নি। যার জন্য সে খুব কষ্ট পেয়েছিল।যে কষ্টটা তার বুকের মধ্যে রয়ে গেছে।
হুসনা জাহান দেখে ছায়াটা নেই। সেখানে আধা বসা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মাহবুব শরীফ। হুসনা জাহান চমকে ওঠে।লোকটা বলে, সে অনেক দূর থেকে এসেছে। এসেছে হুসনা জাহানের জন্যেই। হুসনাজাহানের শরীরে যে উপসর্গ দেখা দিয়েছে,যার জন্য সে কষ্ট পাচ্ছে,তার ভুলেরজন্যই সেটা হয়েছে। সেটা দূর করার জন্যই তার আসা। এদিকে হুসনা জাহানের মনেহয় তার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে,সে আর বেশি দিন বাঁচবে না।তার চোখ ভরে পানিচলে আসে। সে দেখে লোকটা সেখানে দাঁড়িয়েই তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে তারচোখ বরাবর। তারপর লোকটা হাত মুঠো করে এগিয়ে আসে তার কাছে।কিছু একটা দেয়ারজন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। দ্বিধাগ্রস্ত হুসনা জাহান হাত বাড়ায়। লোকটা মুঠো খুলেকিছু একটা রাখে হুসনা জাহানের হাতের পাতায়। হুসনা জাহান দেখে তার চোখেরটলোমলো কয়েক ফোটা পানি। পলকে সেই পানি সবুজ মুক্তা হয়ে যায়। একটু পরমুক্তাগুলো নীল জোনাক হয়ে উড়ে যেতে থাকে দূর আকাশের দিকে। হুসনা জাহানের মনথেকেও যেন সব ভয় দূর হয়ে যায়। তার খুব ভালো লাগতে থাকে। শরীরের চুলকানিরকথা আর মনে থাকে না। লোকটা চলে যায়।আর হুসনা জাহানের মনে হতে থাকে--- যা ঘটলো তা সত্য না মনের ভুল! কিন্তু তার মনের ভেতরে লোকটাকে মাহবুব শরীফ বলেডাকতে ইচ্ছে করে।
হুসনা জাহান লোকটার জন্য এক ধরণের ব্যাকুলতা অনুভবকরে। রাতে লোকটাকে স্বপ্নে দেখে। কোথায় যেন তারা চলে এসেছে। লোকটা একটাবিশাল স্রোতভরা নদীতে নেমে যায়। মাঝনদীতে গিয়ে আজলাভরে কী যেন তোলে। তারপরতা আবার পানিতে নামিয়ে রাখে। লোকটা কী যেন দেয়ার জন্য মাঝনদী থেকেই আজলাবাড়িয়ে দেয় হুসনা জাহানের দিকে। হুসনা জাহানের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে দেখেতার বিছানাভরে বেলী ফুল।
লোকটার সাথে হুসনা জাহানের আরও দুদিন দেখাহয়। একদিন দুপুরে কলেজ থেকে বেড়িয়ে বড় রাস্তায় এসেছে তখন। আরেকদিন লোকটাইদেখা করার কথা বলে। লোকটা তাকে কোথায় যেন নিয়ে আসে।এমন জায়গায় সে কখনোআসেনি।কিন্তু তার খুব ভালো লাগে। লোকটা অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে,অদ্ভুতঅদ্ভুত ঘটনা ঘটায়। হুসনা জাহান খুব অবাক হয়। কিন্তু তার ভালোও লাগতেথাকে।লোকটাকে আপন মনে হয়।
লোকটা হুসনা জাহানকে তার জীবনের গল্প বলতেবলে। হুসনা জাহান দুঃখ-কষ্টেভরা বিষ-জর্জর জীবনের গল্প বলে। বলতে বলতে তারচোখভরে পানি চলে আসে। লোকটা তার হাতেরপাতা চোখের কাছে এনে বলে 'এসো'। পাতাঝরার মতো করে হুসনা জাহানের চোখের পানি লোকটার হাতের পাতায় পড়তে থাকে।পড়তেপড়তে সবুজ আলোর রূপ নিতে থাকে।লোকটা সেগুলোকে আলগোছে বুক পকেটে রাখে। তারসারা শরীরে নীলচে-সাদা আলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। হুসনা জাহান তাকে 'আলোকুমার' নামে ডেকে ওঠে।
এবার আলোকুমার তার পরিচয় দেয়। এ উপন্যাসে আলোকুমার একটিচমকপ্রদ কল্পচরিত্র।একই সঙ্গে তা লেখকের কল্পনাশক্তিরও পরিচায়ক। আলোকুমারবলে,সে পৃথিবীর সৌরজগতের বাইরে অন্য একটি গ্যালাক্সির গ্রহের বাসিন্দা।তারা পৃথিবীর মানুষের চেয়ে অনেক অগ্রসর। সেখানকার একদল বিজ্ঞানী পৃথিবীরমানুষের ইচ্ছাশক্তি নিয়ে গবেষণা করছে।সে তাদের প্রকল্পের প্রধানবিজ্ঞানী। তারা পৃথিবী গ্রহের ইচ্ছা-শক্তি বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত ও নমুনাসংগ্রহের জন্য তাদের তৈরী ইচ্ছারশ্মি পৃথিবীর দিকে পাঠিয়েছিল।হুসনা জাহানযখন ছাদে মোরাকাবায় ধ্যানে নিমগ্ন হয়েছিল,যখন তার 'ইচ্ছা-শক্তি চরাচরের সকলবস্তু ও শক্তির সূক্ষ্ম ইচ্ছা-কণার সাথে একাকার হয়ে গিয়েছিল' সে সময় তাদেরপাঠানো ইচ্ছারশ্মি তার ভেতরে ঢুকে তার রক্ত কণিকার থেকে তথ্য-উপাত্তসংগ্রহের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ফলে হুসনা জাহানকে শারীরিকভাবে কষ্টেভুগতে হচ্ছে। এটা বুঝতে পেরে সে দ্রুত পৃথিবীতে চলে আসে তাকে নিরাময় করারজন্য। তার ঘরে বৃষ্টি পাঠিয়ে,একশ পঁচিশটা গোলাপের মধ্যে বেদনানাশক রশ্মিদিয়ে,বিছানা ভরে বেলী ফুল দিয়ে,নীল জোনাকের মাধ্যমে সে তার যন্ত্রণা উপশমকরার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে সম্পূর্ণ সফলকাম হচ্ছিল না। সে বুঝতে পারে, তার নিজের শরীর দিয়ে হুসনা জাহানের ভেতরে লেপটে থাকা রশ্মিগুলো শুষে নিতেহবে। সে আরও বুঝতে পারে, হুসনা জাহান তার নিজের অন্তরেলাঞ্ছনা,দুর্গতি,অসন্মান, বঞ্চনার যে শত শত বিষ জমিয়ে রেখেছে,সেটাও তাকেদূর করতে হবে। আর এসব করতে গিয়ে আলোকুমার তার ভেতরে হুসনা জাহানের জন্যব্যাকুলতা,ভালো লাগার মতো মানুষের গুণাবলির অনেক কম্পন টের পায়। কিন্তুতাকে চলে যেতে হবে। সেই সময় চলে এসেছে। তবে সে আবার আসবে হুসনা জাহানেরজন্য। আলোকুমার চলে যায়।
এই হলো আকিমুন রহমানের 'অচিন আলোকুমার ও নগণ্যমানবী'র গল্প। এ আলোচনায় উপন্যাসটির ঘটনাংশ তুলে ধরে উপন্যাসটির সম্পর্কেএকটি সম্যক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।কিন্তু উপন্যাসটিতে আরও চমকপ্রদঘটনা রয়েছে, রয়েছে অসাধারণ বিবরণ-----যার মধ্য দিয়ে লেখকের অসাধারণসৃষ্টিশীল কল্পনাশক্তির প্রকাশ ঘটেছে। উপন্যাসটিতে লেখক বাস্তব চরিত্রেরপাশাপাশি একটি অবাস্তব কল্পচরিত্রের মধ্যে মানবীয় গুণাবলিফুটিয়ে তুলেছেন।যালেখকের উপস্থপনার বৈগুণ্যে অনন্য হয়ে উঠেছে। আকিমুন রহমানের এ উপন্যাসটিতার অন্যান্য উপন্যাসের বিবেচনায় একটি অভিনব উপন্যাস।
আলোচক : আহমদ আজিজ
কবি ও সম্পাদক