যতীন সরকার : মার্কসবাদী দার্শনিক - পাভেল বন্দ্যোপাধ্যায়
যতীন সরকার : মার্কসবাদী দার্শনিক - পাভেল বন্দ্যোপাধ্যায়
যতীন সরকার। একজন মার্কসবাদী চারণ দার্শনিক, একজন প্রাবন্ধিক, একজন শিক্ষক, একজন দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী। কত পরিচয় দেবো আমাদের যতীন দা’র। যতীন দা’র লেখার ভিন্নতা ও বিষয়বৈচিত্র্য সম্পূর্ণ আলাদা।

তাছাড়া তার বিষয়ের বিশ্লেষণের শক্তি এত ভিন্ন, যার তুলনা হয় না। সর্বোপরি জাতীয় বিষয়ের মতো লোকায়ত বিষয় সম্বন্ধে তার পড়াশোনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষমতা সম্পূর্ণ আলাদা। তার পাঠক হিসেবে তাকে দেখার একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। তারপর একবার ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সম্মেলনে আসার সৌভাগ্য হলো।
এ সময় শুনলাম কাউন্সিল শুরু না হওয়া পর্যন্ত ২ ঘণ্টা একটা বক্তৃতা হবে। সেটা শুনতে শুনতে কাউন্সিল শুরু হয়ে যাবে। বক্তৃতা শুনতে ভালো লাগে কিন্তু ২ ঘণ্টাব্যাপী এ-তো একটা অত্যাচার। মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হলাম। কিন্তু করার কি আছে? তারপর বক্তৃতার পর্ব এলো। সাদাসিধা একজন মানুষ কাউন্সিল ভবনে ঢুকতেই সব নীরব হয়ে গেল। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ধারালো মুখাবয়বের মানুষটি মঞ্চে বসলেন। বক্তৃতার আগে তার নাম ঘোষণা হলো। তিনি যতীন দা, মানে যতীন সরকার। খুব শিহরিত হলাম তাকে দেখে। তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন। একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠে এবং পান্ডিত্য মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় তা যতীন সরকারের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বুঝেছিলাম। সেই দুই ঘণ্টা কখন চলে গিয়েছিল জানি না। তবে তার বক্তৃতা সেদিন আমাকে নতুন এক দিকের সন্ধান দিয়ে ছিল। তারপরে আজকের কাগজে চাকরি করা অবস্থায় সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’-এ তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যুর দর্শন’। অপেক্ষায় থাকতাম তার পর্ব কবে আসবে। কম্পোজটা হলেই পড়ে ফেলতাম। ‘পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন’কে বলা যেতে পারে লেখকের স্মৃতিকথা। স্মৃতির আধারেই বিধৃত হয়েছে ইতিহাস। এ ইতিহাস কোনো বইয়ে পাওয়া যাবে না। মানুষের মনোলোকের ইতিহাস উঠে এসেছে এখানে। এ বইয়ের ‘দর্শন’ শব্দটি ‘দেখা’ ও ‘ফিলসফি’-দুটো অর্থই ধারণ করেছে।
পাকিস্তানের জন্ম ও মৃত্যুকে লেখক যেভাবে দেখেছেন তার বর্ণনা যেমন আছে এ বইয়ে, তেমনই আছে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্ম ও মৃত্যুর পেছনে সক্রিয় ছিল যে দর্শন, তারও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। পাকিস্তানের জন্মের দর্শনটি ছিল একান্তই অপদর্শন। অপদর্শন ছিল বলেই পাকিস্তানের মৃত্যু ছিল অপরিহার্য। বাংলাদেশের জন্মের যে দর্শন, সেই দর্শনের মধ্যেই নিহিত ছিল পাকিস্তানের মৃত্যুর দর্শন। পাকিস্তানের এই জন্ম-মৃত্যুর দর্শন সম্পর্কে এরকম মনোগ্রাহী বিশ্লেষণ আর কোথাও পাওয়া যাবে না।

ধর্মতন্ত্র এবং প্রগতিশীলতা সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে আমি বর্তমান সময়ের এ অবস্থার জন্য, একেবারে পরিষ্কারভাবে শিক্ষিত প্রগতিশীল মুসলমানদের দোষ দেই। খ্রিস্টানরাও তো এমন ছিল, তারা তিনশ বছর ক্রুসেড করেছে। তারপর এখন খ্রিস্টানরা হইছে কি, বাইবেল কোনোভাবে পড়তে পারে। এখন তারা যে কোনোরকম ইন্টারপ্রেট করতে পারে। এখন আর জেলেও নেয় না, ফাঁসিও দেয় না, পুইড়াও ফালায় না।

কত রকমের ইন্টারপ্রিটিশন হইতাছে। কারণ, এই রেসপন্স থেকে আর কি। হিন্দুদের ধর্মে, মানে রিলিজিওনে অনেক সমস্যা আছে। রিলিজিওনকে আমি ধর্ম বলি না। কারণ, রিলিজিওন আর ধর্ম এক জিনিস না। রিলিজিওনের মধ্যে হিন্দুরা হচ্ছে পৃথিবীতে সবচাইতে পশ্চাৎপদ। জাতভেদ প্রথার মতো পৃথিবীর সবচাইতে ঘৃণ্য একটা প্রথা নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করে রাখছে। পৃথিবীর আর কোন রিলিজিওনে এইরকম নাই। সেইটা হইল এক দিক। কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টাদিকে আরেকটা ব্যাপার আছে, রিলিজিওন সম্বন্ধে চিন্তা করার সুযোগ, ভাষ্য তৈরি করার, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা চিন্তা করার স্বাধীনতাটা আছে।’ আমাদের এখানে যারা প্রগতিশীল নামে পরিচিত হয়ে, মানে মুক্তবুদ্ধির নামে যে কাজ করে, তাতে মুক্তবুদ্ধির চর্চার সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। এ হলো এখন মুসলমান সমাজে মুক্তবুদ্ধির অবস্থা।

একজন মার্কসবাদী হিসেবে সমাজে তার পরিচয়। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে ঘিরে তার যেমন বক্তব্যের শেষ নেই তেমনি বর্তমানে যে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র চলছে তাতে কি জনগণের সার্বভৌমত্ব রক্ষিত হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, এ প্রশ্নটি উঠেছিল অনেক আগে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভিত্তিটি রচনা করে দিয়েছিলেন যিনি, সেই রুশোই প্রশ্নটি উঠিয়েছিলেন। রুশো অবশ্যই আধুনিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘বিজ্ঞান ও আগামী সমাজ’ এবং ‘গণতন্ত্র ও বিচ্ছিন্নতা’ শীর্ষক দুটি প্রবন্ধ পাঠ করি।

[ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘বিচ্ছিন্নতার ভবিষ্যত’ (কলকাতা ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ) পৃষ্ঠা ৫৬-৬৩] গণতন্ত্রের স্ববিরোধিতা যে রুশোর চিন্তায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, সে বিষয়টির প্রতিই এ যুগের পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ডাক্তার গঙ্গোপাধ্যায় রুশোর লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি চয়ন করেছিলেন- ‘Sovereignty...cannot be represented, it lies essentially in the general will and does not admit of representation.’ অর্থাৎ প্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্ব কোনোমতেই নিশ্চিত হতে পারে না। কারণ, সর্বসাধারণের ইচ্ছার ভেতরেই তো গণতন্ত্রের অন্তঃসার নিহিত। প্রয়াত ডাক্তার ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১১-৯৮) দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদভিত্তিক মনোবিজ্ঞানের আলোকেই সব সামাজিক প্রপঞ্চের বিচার-বিশ্লেষণ করতেন। বিশেষ করে আদিম সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে যাওয়ার পর শ্রেণিবিভক্তির সূচনাকাল থেকেই মানবসমাজে যে বিচ্ছিন্নতার বিস্তার ঘটে চলেছে, সে বিষয়টিই ছিল তার ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কার্ল মার্কসের ‘১৮৪৪ সালের অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’ থেকেই তিনি বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই ধারণার ওপরই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদভিত্তিক মনোবিজ্ঞানের আলো ফেলে সমাজ বিশ্লেষণে নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন। তার মতে, ‘বিচ্ছিন্নতা (Alienation) কথাটি বোধহয় প্রথম ব্যবহার করেন রুশো। জনসাধারণের মনোনীত প্রতিনিধি দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা থেকেই বিচ্ছিন্নতার সূচনা।’

শ্রেণিবিভক্ত সমাজের সূচনায় সাধারণ জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয় ‘সামান’ বা পুরোহিত শ্রেণির হাতে। তবে সে সময়ে বিচ্ছিন্নতা খুব প্রকট হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে সামন্ততন্ত্রের যুগে ‘জনগণ-প্রতিনিধি ঈশ্বরের প্রতিনিধিতে রূপান্তরিত’ হওয়ার ফলে শ্রাসক শ্রেণি থেকে জনগণের বিচ্ছিন্নতা প্রকটতর রূপ ধারণ করে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাতা খুলে এ বিষয়টিকে একটু পরখ করে নেয়া প্রয়োজন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে, ইউরোপে ধনতন্ত্রের বিস্তৃতি লাভের যুগে, রুশোর (১৭১২-৭৮) অগ্রজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্টেস্কু (১৬৮৯-১৭৭৫) প্রতিনিধি শাসিত গণতন্ত্রে ‘ক্ষমতা পৃথকরণের নীতিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে সামনে নিয়ে আসেন। এই নীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রের ক্ষমতা তিন ভাগে বিভক্ত- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। তিনটি বিভাগ স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকে স্ব-স্ব কর্ম সম্পাদন করে গেলেই ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত হবে এবং জনগণের প্রতিনিধিরাও জনগণের সার্বভৌমত্ব হরণ করে নিতে পারবেন না- এরকমই মন্টেস্কুর প্রত্যয়। অনেক পূর্বকাল থেকেই অবশ্য রাষ্ট্রচিন্তকরা ক্ষমতার পৃথকরণ সম্পর্কে ভেবে এসেছেন। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল, রোমান আইন প্রণেতা সিসেরো ও পলিবিয়াস এবং মধ্যযুগের মার্শিলিও পদুয়ার কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে। তবে সপ্তদশ শতকে ধনতন্ত্রের ঊষালগ্নেই জন লক প্রমুখ কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত ঘটান এবং অষ্টাদশ শতকে মন্টেস্কুর লেখাতেই এটি পূর্ণাবয়ব ধারণ করে। ‘রোমের মহিমা ও পতনের কারণ বিষয়ে ভাবনা’ এবং তার প্রধান গ্রন্থ ‘আইনের মর্মার্থ’তেই মন্টেস্কুর মতের স্পষ্ট অভিব্যক্তি ঘটেছে। প্রজাতান্ত্রিক, রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী-এই তিন ধরনের শাসনব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। তার মতে, ‘প্রজাতান্ত্রিক শাসন, যাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকে সমগ্র জনগণ কিংবা তার অংশের হাতে; রাজতান্ত্রিক শাসন, যাতে শাসন করে একজন লোক, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত অপরিবর্তনীয় আইনের মাধ্যমে; স্বৈরাচারী শাসনে সবকিছু চলে আইন ও নিয়মের বাইরে, একজন ব্যক্তির মর্জি ও স্বেচ্ছাচার অনুসারে।’

এরপরই তার বক্তব্য- ‘সর্বোচ্চ ক্ষমতা যদি থাকে সমগ্র জনগণের অধিকারে, তাহলে এটা হলো গণতন্ত্র। যদি তা থাকে জনগণের একাংশের হাতে, তাহলে এরূপ শাসনব্যবস্থাকে বলা হয় অভিজাততন্ত্র।’  কত গতিশীল এবং পাণ্ডিত্যেভরা লেখা যতীন দা’র। তাছাড়াও তরুণদের তিনি যেভাবে গ্রহণ করেন তাতে এক


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান