নোবেল পুরস্কার। বিশ্বের সবচেয়ে সুপরিচিত ও মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। কিন্তু আমরা ক’জনই বা জানি, সংবাদপত্রে একটি ভুল শিরোনাম প্রকাশিত না হলে হয়তো সৃষ্টিই হতো না সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ এই নোবেল পুরস্কার। ফ্রান্সের একটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল এই ভুল সংবাদ শিরোনামটি। প্রকাশকাল ১৮৮৮ সাল। শিরোনামটি ছিল একটি মৃত্যুসংবাদের। খবরটিতে বড় ভুল ছিল, খবরে যে ব্যক্তিটি মারা গেলেন, তার কথা নয়, বলা হলো মারা গেছেন অন্য আরেকজন। শুধু ভুল ব্যক্তিটির মারা যাওয়ার খবরই ছেপে পত্রিকাটি থেমে থাকেনি, পাশাপাশি ওই ব্যক্তির কঠোর সমালোচনাও করা হলো ।
আসলে ১৮৮৮ সালে মার্চে মারা যান Ludvig Nobel, তিনি কিন্তু নোবেল পুরস্কারের জনক Alfred Bernhard Nobel নন। লুদবিগ নোবেল ছিলেন তার বড় ভাই। লুদবিগ ছিলেন তুখোড় এক প্রকৌশলী, ভালো ব্যবসায়ী ও অসাধারণ মানবিক। তিনি মারা যান ফ্রান্সের ক্যানসিসে। অথচ স্থানীয় একটি সংবাদপত্র খবর ছাপল এই বলে যে, আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল মারা গেছেন। কিন্তু তিনি তখনো যথারীতি বেঁচে ছিলেন। তিনি বিখ্যাত এক আবিষ্কারক ও বিখ্যাত রসায়নবিদ। সংবাদপত্রটি আলফ্রেড নোবেল বেঁচে থাকলেও, তিনি মারা গেছেন বলে প্রচার তো করলই, পাশাপাশি তাকে আখ্যায়িত করল ‘মার্চেন্ট অব ডেথ’ অভিধায়। তার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উদ্ভাবনের কথা এতটুকু উল্লেখ করেনি এই সংবাদপত্রটি। অথচ আলফ্রেড নোবেল ১৮৯৬ সালে ১০ ডিসেম্বরে ৬৩ বছরে ইতালির স্যান র্যামোতে তার বাড়িতে মারা যান, তখন তার আবিষ্কার উদ্ভাবনের পেটেন্ট সংখ্যা ছিল ৩৫৫।
বেঁচে থাকা অবস্থায় তার বড় ভাইয়ের
মৃত্যুকে আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুসংবাদ হিসেবে প্রচার করে তাকে ‘মার্চেন্ট
অব ডেথ’ হিসেবে আখ্যায়িত করায় আলফ্রেড খুবই মর্মাহত হন। আলফ্রেড এই ভেবে
মর্মাহত হন, তার সারাজীবনের কর্ম-অবদান হিসেবে মানুষ থাকে কি মানুষের
মৃত্যুতে অবদায়ক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে? যেমনটি এই পত্রিকাটি তাকে
আখ্যায়িত করেছে ‘মার্চেন্ট অব ডেথ’ হিসেবে।
আসলে
আলফ্রেড নোবেল প্রকৃতিগতভাবেই ছিলেন একজন শান্তিবাদী মানুষ। মেধাবী এ
মানুষটির জন্ম সুইডেনের স্টকহোমে, ১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবরে। সেখানেই তিনি বড়
হন মা-বাবা আর ভাইবোনদের সাথে বসবাস করে। মা-বাবাও ছিলেন সফল মানুষ। বাবা
ইমানুয়েল নোবেল ছিলেন একজন স্থপতি, নির্মাতা ও উদ্ভাবক। রাশিয়ার সেন্ট
পিটার্সবাগে তার ছিল যন্ত্রপাতির একটি দোকান। প্রতিরক্ষা-অস্ত্র নির্মাণে
রুশ সরকারের সাথে তার খুব সুসম্পর্ক ছিল। বেশ সাফল্যের সাথে তিনি এ কাজ করে
যাচ্ছিলেন।
এ দিকে নোবেল পুরস্কারের জনক আলফ্রেড নোবেল প্রধানত ছিলেন স্বশিক্ষিত মানুষ। তবে তিনি কালক্রমে হয়ে ওঠেন একজন প্রশিক্ষিত রসায়নবিদ। বিজ্ঞান ছাড়াও আলফ্রেড নোবেল ছিলেন সাহিত্যের এক লোভাতুর পাঠক। পাশাপাশি খুব ভালো করে জানতেন ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, সুইডিশ ও রুশ ভাষা। তরুণ আলফ্রেড নোবেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে। এর মাধ্যমে তিনি আবিষ্কার করেন তার প্রথম বিস্ফোরক। তিনি তার এ আবিষ্কার ঘটান ১৮৬২ সালের গ্রীষ্মের শুরুতে। এ বিস্ফোরকের বিস্ফোরণে তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম হন অভাবনীয় মাত্রার তাপ ও চাপ। তিনি আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন এ বিস্ফোরণকে আরো স্থিতিশীল করে তুলতে। ১৮৬৩ সালের অক্টোবরের দিকে আলফ্রেড পান তার চতুর্থ পেটেন্ট। তিনি পেটেন্ট লাভ করেন তার percussion detonator-এর জন্য, যাকে বলা হতো ‘নোবেল লাইটার’। আরো পরে একে বলা হতো blasting cap।
তার একটি ছোট্ট কারখানা ছিল স্টকহোমের লাগোয়া হেলেনবুর্গে। এ কারখানায় উৎপাদিত হতো নাইট্রোগ্লিসারিন। দুর্ভাগ্য, এই নাইট্রোগ্লিসারিন খুবই বিপজ্জনক পদার্থ। এটি নিয়ে কাজ করাও খুবই জটিল। ১৮৬৪ সালে এই কারখানা এক বিস্ফোরণে উড়ে যায়। এতে তার ছোট ভাই এমিল নোবেলসহ কয়েকজন মারা যায়। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন আরো উন্নত ও নিরাপদ বিস্ফোরক যৌগ তথা blusting campound তৈরির ব্যাপারে। তিনি তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য তার যন্ত্রপাতি বসান একটি ফ্যাটবোটে। আর এ বোটটি রাখা হয় লেইন ম্যালোরনে।
১৯৬৬ সালের মে’র দিকে নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে থাকার সময় আলফ্রেড নোবেল নাইট্রোগ্লিসারিনের বিস্ফোরণ ক্ষমতা ও এর নিরাপদ ব্যবহার প্রদর্শন করেন। এই বিস্ফোরণ প্রদর্শন করা হয় নবম ও দশম এভিনিউয়ের মধ্যবর্তী ৮৩ নম্বর স্ট্রিটের একটি ঢালু পর্বতময় স্থানে। তখন তিনি আবিষ্কার করছিলেন গানপাউডারের উন্নত বিকল্প। ১৮৬৭ সালের দিকে আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করেন নিরাপদে ব্যবহারযোগ্য একটি নতুন বিস্ফোরক। তিনি এর নাম দেন ‘ডিনামাইট’। তিনি গ্রেটব্রিটেনে এর পেটেন্ট লাভ করেন ১৮৬৭ সালে মে মাসে। পরের বছর মে মাসে এ পেটেন্ট পান যুক্তরাষ্ট্রে। এর আগে ১৮৬৭ সালের সেপ্টেম্বরে এটি পেটেন্টভুক্ত হয় সুইডেনে। ১৮৬৯ থেকে ১৮৭২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি ব্যাপক উন্নতি ঘটান নাইট্রোগ্লিসারিন কম্পাউন্ড বা যৌগের। এর ফলে নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহার আরো অনেক বেশি নিরাপদ হয়। এ সময় তিনি এর পেটেন্টও লাভ করেন।
আলফ্রেড নোবেল এসব বিস্ফোরক পদার্থ নিয়ে
কাজ করছিলেন একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে : সব ধরনের যুদ্ধের ইতি টানার
লক্ষ্যে। তার বিশ্বাস ছিল, ডিনামাইট ও নাইট্রোগ্লিসারিনের ব্যবহার বিশ্বে
শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তার ভাবনা ছিল, যেদিন দু’টি
সেনাবাহিনী এক সেকেন্ডে একে অপরকে ধ্বংস করার ক্ষমতা অর্জন করবে, সেদিন
পৃথিবীর সভ্য জাতিগুলো যুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং তাদের সেনাবাহিনীর
বিলুপ্তি ঘোষণা করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মানুষ তার বিস্ফোরক আবিষ্কারকে
দেখল মারাত্মক মারণাস্ত্র হিসেবে।
তিনি
বিশ্বব্যাপী ঘুরে বিক্রি করেছেন তার আবিষ্কৃত বিস্ফোরক। কারণ, এর চাহিদাও
ছিল প্রচুর। তার ৯০টি কারখানায় তৈরি হতো ডিনামাইট। এই ডিনামাইট ছিল সবচেয়ে
বেশি চাহিদার বিস্ফোরক অস্ত্র। এই ডিনামাইট বিক্রি করে তিনি হয়ে ওঠেন
প্রচুর সম্পদশালী।
আলফ্রেড বরাবর
ছিলেন একজন রোগা মানুষ। কোনো সময়ই সুস্থ থাকতে পারেননি। তিনি ভুগেছেন
মাইগ্রেনের মাথাব্যথা ও মনমরাভাব রোগে। প্রায়ই বন্ধ হয়ে যেত সেই শিরা, যা
দিয়ে হৃৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালিত হয়। আবিষ্কার-উদ্ভাবনের কাজে সময় দেয়াই ছিল
তার অগ্রাধিকার। সামাজিক কাজকর্মে খুব একটা যোগ দিতেন না। জীবনে কখনো বিয়ে
করেননি। লাজুক প্রকৃতির আলফ্রেডের বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা ছিল খুবই কম।
যখন ফ্রান্সের একটি পত্রিকা ভুল করে ১৮৮৮ সালে তার মৃত্যুসংবাদ ছাপে এই শিরোনামে : Le marchand la mort (The merchant of death is dead), তখন তিনি উপলব্ধি করলেন তিনি ইতিহাসে নিজেকে এমন পরিচয়ে, অর্থাৎ ‘মৃত্যু ব্যবসায়ী’ হিসেবে পরিচিত করে মরতে দিতে পারেন না। মানুষের মনে তার সম্পর্কে সম্মানজনক ইতিবাচক পরিচয় রেখেই তাকে মরতে হবে। কী করে তা করা যায়? সে ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। ১৮৯৫ সালে এসে তিনি এ প্রশ্নের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধানটি খুঁজে পান।
১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বরে লেখা হয় আলফ্রেড বি. নোবেলের চূড়ান্ত উইল। সে উইলে বলা হয়, তার রেখে যাওয়া বিপুল সম্পদের ৯৪ শতাংশ দিয়ে সৃষ্টি করা হবে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসা বা শারীরবিদ্যা, সাহিত্য ও শান্তি এই পাঁচটি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানকারী ব্যক্তিদের এ পুরস্কার দেয়া হবে। আর এ পুরস্কার হবে তার নামে। কারণ, তিনি ধরে নেন নোবেল পুরস্কার আলফ্রেডের নামের সাথে ‘মার্চেন্ট অব ডেথ’ ধরনের নেতিবাচক ধারণা মুছে দিয়ে বিশ্বের মানুষকে তার সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবতে শেখাবে। তিনি তার এ উইল সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কাউকে কিছু জানাননি। তার লিখিত এই উইল তিনি কঠোরভাবে গোপন রাখেন। উইলে স্বাক্ষর করে তা নিজের কাছেই রেখে দেন।
মেধাবী রসায়নবিদ ও আবিষ্কারক আলফ্রেড নোবেল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৩৫৫টি উদ্ভাবনার প্যাটেন্ট লাভ করেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ইতালির স্যান র্যামোতে তার বাড়িতে মারা যান ১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর। তখন তার বয়স ৬৩ বছর। তিনি মারা যান মস্তিষ্ক বৈকল্যে; অর্থাৎ cerebral hemorrhage-এ। তার মৃত্যুর কয়েক বছর পর কিছু ব্যক্তি এক তত্ত্ব দেন যে, সম্ভবত নাইট্রোগ্লিসারিনের বিষ তার দেহে এক ধরনের ব্যথার জন্ম দিয়েছিল। আর এর ফলেই তিনি মারা যান। নয়তো মাত্র ৬৩ বছর বয়সে তিনি মারা যেতেন না।
আলফ্রেড নোবেলের শেষকৃত্য সম্পন্ন করে তার উইল প্রকাশ করা হয়। তখনই মানুষ জানতে পারল পাঁচটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার চালু করার ব্যাপারে নোবেলের ইচ্ছার কথা। তিনি তার উইলে উল্লেখ করেন, আমি চাই বিশ্বের সেইসব ব্যক্তিবিশেষকে সম্মানিত করতে, যারা মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম কল্যাণকর অবদান রাখবেন।
আলফ্রেড নোবেলের ছিল প্রচুর অর্থ। তিনি বার্ষিক নোবেল পুরস্কারের জন্য দান করে যান সাড়ে ৩ কোটি সুইডিশ ক্রোনার। আজকের দিনের ডলারের হিসেবে ২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এই অর্থের বিপরীতে পাওয়া সুদের অর্থ দিয়ে এখন প্রতি বছর নোবেল পুরস্কারের অর্থের যোগান দেয়া হয়।
নোবেল পুরস্কারের এই উইলের কথা শুনে তার আত্মীয়স্বজনেরা কিছুটা মর্মাহত হয়। কিন্তু তাদের করার কিছুই ছিল না। তারপরও নোবেলের শেষ ইচ্ছা পূরণের কাজ সম্পাদন খুব সহজ ছিল না। দ্রুত সমস্যা এসে হাজির। প্রথমত, তার স্বজনরা তার এ ইচ্ছার কথা কিছুই জানত না। কেউ কেউ এই উইলের সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে চেষ্টা করেন। তা ছাড়া তিনি বসবাস করে গেছেন বিভিন্ন দেশে। কোনো দেশেই তার স্থায়ী কোনো বাসস্থান ছিল না। ফলে প্রশ্ন ওঠে : কোন দেশ ফ্রান্স, সুইডেন না ইতালিতে তার উইল বৈধ বলে বিবেচিত হবে? সেই সাথে প্রশ্ন দেখা দিলো, কোন দেশ পরিচালনা করবে এ ধরনের পুরস্কার ফাউন্ডেশন? এ ধরনের নানা প্রশ্ন নিয়ে চলল নানা চিন্তাভাবনা, পাঁচ বছর ধরে। এরপর এই পুরস্কারের অর্থ সুইডেন ও নরওয়ের কাছে তুলে দেয়া হলো, আর গড়ে তোলা হলো ‘নোবেল ফাউন্ডেশন’।
১৯০১ সালের ১০ ডিসেম্বর ছিল আলফ্রেড নোবেলের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। এই দিনে সুইডেনের স্টকহোমের রয়েল একাডেমি অব মিউজিকে ঘোষণা করা হয় প্রথম বার্ষিক নোবেল পুরস্কার। ১৯০১ সালে সূচিত এ পুরস্কারে প্রথম নোবেল বিজয়ীরা ছিলেন : রসায়নে জ্যাকোবাস এইচ ভ্যান’ট হফ, পদার্থবিদ্যায় উইলহেম সি রঞ্জেন, চিকিৎসা বিদ্যায় এমিল এ ভন বেহরিং, সাহিত্যে বেন এফ এ সুলি প্রুধমি এবং শান্তির ক্ষেত্রে জিন এইচ ডুনান্ট এবং ফ্রেডারিক প্যাসি। উল্লেখ্য, ১৯৬৮ সালে অর্থনীতি বিষয়ে ষষ্ঠ নোবেল পুরস্কারের সূচনা করা হয়।