কবি : রহমান হেনরী
জেব্রা ক্রসিংয়ে
রক্তজবা পিষে দিলে,
ভেতরে যে রং আর রূপ আর রস সুন্দরের চিত্রকলা খোলে; কিংবা খুব নিরিবিলি
পেকে-ওঠা পুঁইফল অফসেট পেপারের ঘঁষা খেয়ে, নিমেষেই যে কবিতা লিখে ফেলে—
অকস্মাৎ, তীব্র আক্রোশে হয় অগ্নিলাল ঈশানের ঝড়ের সংকেত; অন্তরে ফাঁপর লাগা
আনচান সেরকম দিনে— মনে করো:
জেব্রা ক্রসিং ধরে পার হচ্ছি: হৈ-চিৎকার; আর আমার মস্তিষ্কের এলজেব্রা, হিসাবপদ্ধতি ফেলে, মানুষের যাপনরহস্যে ধেয়ে যায়। দু'পাশে, কোথাও কোনও বন নেই; আফ্রিকা বা বতসোয়ানা নয়— তবু দেখো, কোত্থেকে, অবিনাশী জেব্রাজুটি এসে, আমাকে তাগিদ দিচ্ছে:
‘‘জলদি করো— অরণ্যান্ধ নগরীর এইসব ছায়াপথ, ঘুণাক্ষরেও নিরাপদ নয়; অধিক আলোর দিকে যেতে হবে। উদয়নে, মার্তণ্ড সূর্যকেও অনুমতি প্রার্থনায়, যেখানে অপেক্ষা করতে হয়— সে কেমন অন্ধকার? —এই বুঝে, দ্রুত, পা চালাও!’’
তখন, নিশুতি।
রাজপথ, চিন্তারাশি, মানুষ ও বন্যপ্রাণি: খণ্ড-বিখণ্ড ঝরে পড়ে...
এলজেব্রা করতে করতে, চলে যাচ্ছি— ইরাক, ইরান ঘুরে, প্রাচীন মিশরে—
কাঁঠালপাতার আয়না
ওটা আমাদের গন্তব্য ছিলো না। দিন ও রাত্রির মিলিত চক্রান্ত পৌঁছে দিলো—
শৃগাল পরিবেষ্টিত কাঁঠালবনে। উৎস থেকে বহুদূরে, গন্তব্য থেকে বিপরীত
দূরত্বে— সেই এক নির্জন তৃতীয়বিন্দু। নদী, জলাশয় ও লোকালয়হীন অবিরত
কাঁঠালবন। শৃগালবেষ্টিত। আর আছে: কাঁঠালপাতার ভয়ানক আয়না।
চোখ রাখলে, নিজেরই মুখমণ্ডল বিম্বিত হয়: এক শ প্রকারে। নৈঃসঙ্গ্যের কামড়তাড়িত, আমরা, তখন থেকেই, কাঁঠালপাতার আয়নায় দেখতে থাকলাম— নিজেদের মুখ।
উৎস আর গন্তব্য পড়ে রইলো— লোকালয়ে, ভূত-ভবিষ্যতহীন কাঠের দেরাজে। বন্দি। মৃতকাগজের পুঁতিগন্ধময়— পুরনো খাতায়।
নিশিলিপি
যেখানে, নিবিড় হচ্ছে রাত— ঘুম থেকে
উঠে দাঁড়ালাম: সেখানে;
প্রপিতামহের শৈশব থেকে উঠে আসছে
সমগ্র এক বনভূমি
যা কিছু আমার ছিলো না:
মৃত একটা ঘোড়া
রূপসী শিয়ালের কান্না
অষ্টমী কলার চাঁদ—
তৃতীয় গলিতে, নীরবতার ভিতর
শুয়ে আছে— কয়েকটি প্রভুভক্তের মৃতদেহ;
এখন, ভোট দিতে যাচ্ছে— মানুষের বাচ্চারা...
তন্ত্রের গাছে গাছে প্রশান্তি ফুটবে: দুপুর বারটায়।
প্লবতানীতি
আর্কিমেডিসের সমুদয় প্রণয়রুচি আর রতিবাসনা— নিমজ্জিত:
লরেল পত্রাকৃতি সোনার মুকুটের
প্রকৃত ওজন ও আয়তন সংক্রান্ত স্বর্ণসমুদ্রে;
সেদিন
আসঙ্গলিপ্সাকাতর তাঁর স্ত্রী ছিলেন মদমত্তা। নিবৃত্তিপিপাসু, সেই
অচরিতার্থকামা, স্নানের চৌবাচ্চায়, নিরুপায় তার নিতম্ব ডোবাতেই, উপচে পড়লো—
জল;
নিথরপ্রায়, নিস্তেজ আর্কিমেডিস লাফিয়ে উঠলেন, উত্তেজনায়।
ব্যাকুল, উত্তেজনা থরথর, সেই কামিনী অধীরা; কিন্তু হায়!
বিভূষণ হলেন না— আর্কিমেডিস! বরং
দৌড়ে গিয়ে নোটবুক আর কলম আনলেন। শুরু হলো অংক কষা।
যৌবনপ্লবতায় রোদনমুখি প্রেয়সীকে শোনালেন— জলের প্লবতানীতি:
‘‘—এর ফলে, অনেক দরকারী আর স্থায়ী উদ্ভাবনসমূহের দিকে এগিয়ে যাবে, মানুষের সভ্যতা—’’
.
মাননীয় ইবলিশকে
বঙ্গদেশে
আপনাকে স্বাগতম— মহারথি!
ওই তো, পৃথক ও স্পষ্টতর হতে হতে, রাত্রির ভেতর থেকে
ক্রমশ বাইরে আসছে— আপনার ছায়া; আপনার লিঙ্গনিরপেক্ষতার প্রশংসা না-করে পারছি না, জনাব। পরামর্শক হিসেবেও আপনি তো সর্বলিঙ্গগামী!
অথচ গন্ধমপুরাণকে যদি অকাট্য বিবেচনা করি: ওনাদের প্রতি আপনার বিশেষ ঝোঁকের কথা— পক্ষপাতিত্বের মোড়কেও
উন্মোচন করা যায়। কে একজন, আপনার চ্যালা-চামুণ্ডা,
বলছিলো: ‘‘উনি তো ঢাল দিয়া তরোয়াল বাঁকানোর
কৌশল নিছিলেন’’!
—মানলাম। ...কিন্তু কথা হইলো:
আপনি তো জনাব, ভাই দিয়ে ভাই হত্যারও আদি উদ্ভাবক!
মাননীয় ইবলিশ, একুশ শতকে, কার উপদেষ্টা হয়ে, কার মস্তিষ্কে
ভর দিয়ে, দেশে-দশে এইসব গুবলেট
পাকাতে শুরু করলেন?
ছলনাধিরাজ!