রোমান্টিক কবি পার্সি বিশি শেলি - মাহমুদুর রহমান খাঁন
রোমান্টিক কবি পার্সি বিশি শেলি - মাহমুদুর রহমান খাঁন

১৭৯২ সালের ৪ আগস্ট ইংল্যান্ডের সাসেক্সে বাবা মিস্টার টিমথি শেলি ও মা এলিজাবেথ পিলফোর্ডের ঘর আলো করে জন্মেছিলো একটি সুন্দর ও ফুটফুটে শিশু। তার আলোতে যেন চারশাপ আলোকিত হয়ে উঠলো। বাল্যকাল থেকেই সে তার প্রতিভা ও বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় দিতে থাকল। তার লেখা, নিজস্ব আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা দ্বারা খুব কম বয়সেই তিনি খ্যাতিমান হয়েছেন। লিখে গেছেন এডোনাইস, ওড টু দা ওয়েস্ট ওয়াইন্ড, ওড টু এ স্কাইলার্ক এর মত বিখ্যাত সব কবিতা। তিনি হচ্ছেন ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে সফল রোমান্টিক কবি পার্সি বিশি শেলি। যার লেখায় রয়েছে বিপ্লব, বিদ্রোহ ও আদর্শের ছোঁয়া।

অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে ঘটে যায় এক বিপ্লব। যেটি প্রজাদের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘোষণা করার বিপ্লব। বুর্জোয়াদের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে পোলত্রারিয়াতদের জেগে ওঠা এবং ধনী-গরীবদের মাঝে ভেদাভেদ দূর হওয়ার বিপ্লব। যেখানে সৃষ্টি হয়েছিলো মানবপ্রেমের নতুন সংজ্ঞা। এ বিপ্লবে ধ্বংস হয়ে যায় রাজতন্ত্র। তৈরি হয় পার্লামেন্টনির্ভর শাসনের প্রয়োজনীয়তা। সবার মাঝে ফিরে আসে সাম্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এ বিপ্লব ফরাসী বিপ্লব নামে পরিচিত। যে বিপ্লবের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে। সমাজ এবং মানুষের জীবন-মান, চিন্তা-চেতনাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই লেগেছিলো এর ছোঁয়া। তেমনি সাহিত্যেও লাগে এর ছোঁয়া। ফরাসী বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া রুশো ও ভলটেয়ারের কথাগুলো প্রভাবিত করে সাহিত্যিকদেরকেও। সাহিত্যিকরাও তখন চিন্তা করলেন শুধুমাত্র উচ্চবিত্তদের নিয়ে সাহিত্য রচনা না করে সাধারণ ও নিম্ন শ্রেণির মানুষদের নিয়েও সাহিত্য রচনা করতে হবে। তাদের জীবনের প্রতিচ্ছবিও ফুটিয়ে তুলতে হবে। সেজন্য সাহিত্যের ভাষাও হতে হবে সহজ ও সাবলীল এবং সবার জন্য প্রযোজ্য। তাই ১৭৯৮ সালে কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ 'প্রিফেইস টু দ্য লিরিক্যাল ব্যালাডস’ নামক একটি বই লিখে সূচনা করেন সাহিত্যের নতুন একটি বিপ্লবী যুগের। যাকে রোমান্টিক যুগ নামে আখ্যায়িত করা হয়। যে যুগের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন শেলি নিজেও। তাঁর লেখার মাঝেও ফুটে উঠেছে এই যুগের বৈশিষ্ট্য।

ছেলেবেলা থেকেই তার চারিত্রিক রূপে ফুটে উঠত সেগুলো। দশ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলেন সিয়ন হাউস একাডেমিতে। এরপর ১৮০৪ সালে তিনি ভর্তি হন ইটন কলেজে। এখানেই প্রথম তাঁর বিদ্রোহী সত্ত্বার প্রকাশ পায়। ইটনের পুরনো প্রথা অনুযায়ী সিনিয়ররা জুনিয়রদের দিয়ে তাদের কাজকর্ম করিয়ে নিত। এছাড়াও বিভিন্ন ফরমায়েশ খাটাত। শেলির সাথে এসব করতে আসলে শেলি এর তীব্র বিরোধিতা করেন। এমনকি এক ছেলের হাতে পেন্সিল কাটার বসিয়ে দেন। তারপর থেকে সবাই সাবধান হয়ে যায়। তাঁর সাথে আর কেউ এমন আচরণ করার সাহস পায় না। সেখানে থাকা অবস্থায় তাঁর লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এর মধ্যে ১৮০৯ সালে একটি লেখা ছাপিয়ে তিনি প্রকাশকের কাছ থেকে ৪০ পাউন্ড পুরস্কার লাভ করেন।

১৮১০ সালে ভর্তি হন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজে। তার মাথায় তখন সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও ধর্মচিন্তা সম্পর্কে বিরূপ চিন্তা ভাবনা কাজ করে। তখনই বন্ধুত্ব হয়ে উঠে টমাস জেফারসন হগের সাথে। দুইজনের চিন্তা-ভাবনা প্রায় একই রকমের ছিল। তাই কিছুদিন পর দুজন মিলে লিখে ফেলেন ‘দি নেসেসিটি অব এথেইজম’ বা ‘নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা’ নামক একটি গ্রন্থ। তখনকার সময়ে ধর্ম বিরোধীদের প্রচুর শাস্তি দেওয়া হতো। তাই এই গ্রন্থপ্রকাশ করার কারণে ১৮১১ সালে শেলি ও হগ দুজনই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হলেন। শেলির কিশোরী প্রেমিকা হ্যারিয়েটের বাবা এসব জানার পর তাদের প্রেমেরও সমাপ্তি ঘটে। শেলির নিজ বাবাও তাঁকে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করেন। পরিবার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তিনি। ফলে জীবনের বাকি সময়গুলো খুব সংগ্রাম করে কাটাতে হয়।

শেলির চিন্তা চেতনায় একাত্মতা পোষণ করার কারণে সবার বারণ সত্তে¡ও ১৮১১ সালের আগস্টে হ্যারিয়েট তাঁকে বিয়ে করেন। তাঁদের ঘরে চার্লস নামে একটি পুত্রসন্তান জন্ম লাভ করে। যদিও সে বিয়ে সুখের হয়নি। কেননা ইতোমধ্যেই তাঁর গডউইন পরিবারের সাথে যোগাযোগ হয়। গডউইনের কন্যা মেরি গডউইনের প্রেমে পড়ে যান তিনি। ১৮১৪ সালে তারা দুজন প্রেমের ঘটনা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন। তার মধ্যে শেলির প্রথম স্ত্রীও অন্য একজনের সাথে সম্পর্কে জড়ান। ১৮১৬ সালে অজ্ঞাত কারণে হ্যারিয়েট আত্মহত্যা করেন। সেই বছরই শেলির বিয়ে হয় গডউইন কন্যা মেরির সাথে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অটুট ছিলো।

রোমান্টিক যুগের কবিরা ছিলেন ক্ষণজন্মা। শেলিও তাই। কিন্তু যতদিন বেঁচে ছিলেন সাহিত্য চর্চা করে গেছেন। তার রচিত কাব্যগুলো হচ্ছে ‘কুইন ম্যাব’ (১৮১৩), ‘অ্যালাস্টার’ (১৮১৫) ও ‘দি রিভোল্ট অব ইসলাম’ (১৮১৭) ইত্যাদি। এছাড়াও ইতালীতে থাকাকালীন লিখেছেন, ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ (১৮১৮-১৯), 'দি চেনসি' (১৮১৯), 'জুলিয়ান এন্ড ম্যাড্ডালো' (১৮১৮), ‘দি মাস্ক অব এনার্কি’ (১৮১৯), ‘দি উইচ অব এটলাস’ (১৮২০), ‘এপিসাইচিডিয়ন’ (১৮২১) এবং ‘এডোনাইস’ (১৮২১) কাব্য ও নাটকগুলো। তার রচিত সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ হচ্ছে ‘দি ডিফেন্স অব পোয়েট্রি’ (১৮২১)। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু গীতিকবিতা লিখেছেন।

তার লেখায় নদ, নদী, পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণাধারা, ফুল, লতাপাতা, আকাশ, বাতাস ও প্রকৃতি জীবন্ত রূপ লাভ করত। ‘ওড টু দা ওয়েস্ট ওয়াইন্ড’ কবিতার মত কখনো কখনো তাদেরকে আহবান করতেন ধরার সকল অশুভ শক্তি জরা-জীর্ণতা সব কিছু যাতে ধ্বংস হয়ে নতুন ও শুদ্ধ প্রাণে চারিদিক ছেয়ে যায়। সেখানে তিনি পশ্চিমা বায়ুকে বলেছেন, ' ঙ, রিহফ, ওভ ডরহঃবৎ পড়সবং, পধহ ঝঢ়ৎরহম নব ভধৎ নবযরহফ?' এখানে শীত বলতে বুঝিয়েছেন পৃথিবীর জরাজীর্ণতাকে আর বসন্তকে নবজীবন এবং জরাজীর্ণতামুক্ত পৃথিবীর সূচনা হিসেবে। সত্যিই তো, শীতকাল এসে গেলে বসন্ত কি দূরে থাকতে পারে?
আবার ‘টু স্কাইলার্ক’ কবিতায় কবি স্কাইলার্কের গাওয়া গান শুনে বিস্মিত হন। স্কাইলার্ক চড়–ইয়ের মত দেখতে এক ধরনের পাখি। কবি এর গানকে চাঁদের আলোর সাথে তুলনা করেন। এর গান থেকে কবি নিজ আত্মার প্রেরণা নেন। মনে ইচ্ছা পোষণ করেন এই পাখিটির অর্ধেক আনন্দও যদি তিনি লাভ করতে পারতেন! কিন্তু পাখিটির মত মানুষের মন এতটা প্রাঞ্জল নয়। শত দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও মানুষ হাসে। তবে তার পিছনে যেন মনের লুকনো বেদনাই প্রকাশ পায়।

তার রচিত ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ গীতিনাট্যটিতে ঈশ্বর জিউসের সাথে দেবতা প্রমিথিউসের বিদ্রোহ দেখা যায়। গ্রীক পুরাণের ঘটনা অনুযায়ী আদিম যুগে আগুন শুধু স্বর্গের দেবতারাই ব্যবহার করতেন। পৃথিবীতে আগুন ছিলো না। জিউসের বারণ সত্তে¡ও দেবতা প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন বয়ে এনেছিলেন পৃথিবীতে মানব কল্যাণের জন্য। তার শাস্তিস্বরূপ জিউস তাঁকে শেকলে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। সেই বিদ্রোহের ঘটনা শেলি দারুণভাবে ছন্দের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছেন।
‘জুলিয়ান এন্ড ম্যাড্ডালো’তে যেন নিজের চরিত্রের রূপই বর্ণনা করেছেন। 'দি চেনসি' নাট্যের নায়িকার নাম হচ্ছে বিট্রাইস। মেয়েটি নিজের বাবার কুপ্রবৃত্তির কারণে সতীত্ব হারায়। পরবর্তীতে পিতাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণতা যেন শেলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘এপিসাইচিডিয়ন’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন একটি মেয়ের কাহিনী। শেলী তখন ইটালীয় এক তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন।

সে সময়ের অন্যতম রোমান্টিক কবি কীটসের মৃত্যু হলে তিনি ‘এডোনাইস’ নামে একটি বিশাল এলিজি বা শোকগাঁথা লিখেন। সেখানে তিনি কীটসের প্রশংসা করেছেন। প্রকৃতি যেন কীটসের মৃত্যুতে শোকাহত। সবাই শোকে কাতর হয়ে গিয়েছিলো। দারুণ সব উপমার মাঝে এঁকেছেন শোকাবহ দৃশ্য। অন্যতম সেরা রোমান্টিক কবি বায়রনকেও হাজির করেছিলেন কীটসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়।

শেলি সারাজীবন অন্যায়, অত্যাচার, ধর্মের নামে শাসন, শোষণ, ভন্ডামি, নির্যাতন ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গেছেন। নিজের আদর্শকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে ত্যাগ করেছেন পরিবার ও পরিজন। প্রতিনিয়ত লড়ে গেছেন অভাব অনটনের সাথে। আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার জ্ঞানসমৃদ্ধ সাহিত্য ভান্ডার। মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৮২২ সালের ৮ জুলাই ইতালীর পিসায় কবি বায়রন ও হান্টের সাথে দেখা করার পর নৌকা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ঝড়ের কবলে পড়ে এ মহান কবি ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। পৃথিবীর অন্যায়, শোষণ ও অত্যাচারকে ঝড়ের মত উড়িয়ে দিয়ে সেই ঝড়ের মাঝেই যেন মিশে যান চিরতরে।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান