সম্ভবত মধ্য নব্বই এ মোস্তফা সরোয়ারের " থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার " নামক ছায়াছবির তুমুল জনপ্রিয়তা, বক্স অফিসে সুপার হিট। প্রশ্ন জেগেছিল - কেন লিভ টুগেদার সংস্কৃতি বিশেষত তরুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করেছিল? প্রশ্নটা এই একুচ শতকে এসে মনের মাঝে একটি প্রশ্ন জাগায়- তবে কি বিয়ে প্রথা ভাঙনের প্রথা? আরও একটি কারণ আছে- ইদানীং বিয়ের প্রতি তরুণ সমাজের একধরনের ভীতি । পারিবারিক বন্ধন - বিয়ে নামক চুক্তিতে একসাথে বসবাস- সবকিছু মেনে নিয়ে সংসারধর্ম পালন এসব মূল্যবোধের নিরব একটা পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। নানা কারণে বিয়ের প্রতি আগ্রহ কমছে।বরং বিয়ে ছাড়া একসাথে বসবাস সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
বিভিন্ন সময়ে নানা পরিসংখ্যানে পুরো দেশেই উদ্বেগজনক ভাবে তালাকের হার বাড়ছে।কারণ ইগো সমস্যা, পরকীয়া, সন্দেহ প্রবণতা,যৌতুক সমস্যা, বিয়ের পরে অনেক স্বামীর দেশের বাইরে গিয়ে ফিরে না আসার সাথে বিশেষত যুক্ত হয়েছে উচ্চ শিক্ষিত নারীর ভেতরে ত্যাগ বা সমঝোতার অভাব । তবে পারিবারিক সহিংসতা ও অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে । যদিও দেখা যাচ্ছে - পশ্চিমা বিশ্ব ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার সাথে যুক্ত হয়েছে নারীর আর্থিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ ও স্বেচ্ছাচারিতা ও অন্যতম অনুসঙ্গকে অনেকে দায়ী করছেন। অনেকের মতে "বিয়ে দাসত্ব নয়।নারীর তালাক দেওয়ার অধিকার আছে - তবে এটি বেড়ে গেলে সমাজের জন্য এক অশনিসংকেত। আবার অনেকের মতে "যুগের পরিবর্তনে নারীরাও তালাক দিচ্ছে। যা অতীতে কম হতো, তাই এটি এখন একটা ধাক্কার মতো।" তাই ভাবি- বিয়ে নামক পরাধীনতার শেকল অনেকে মানতে চাইছেনা।তাহলে-এতে কি প্রেম নেই?, প্রেম কি প্রতীক? প্রেম কি স্নায়ুর দর্শন? প্রেম কি পারিজাত?
আদিম সমাজে নারী-পুরুষের জীবনে ছিল অবাধ যৌনাচার কিন্তু বিয়ের মাধ্যমে তৈরি হল শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন - নারী ও পুরুষের পবিত্রতম বন্ধনে গড়ে ওঠে পরিবার - আর দাম্পত্য নামক নদীতে কখনো অনুকূল বা কখনো প্রতিকূল স্রোতে সাঁতার কাটে নারী ও পুরুষ, কেউ শান্তিতে, কেউ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বা কেউ গড্ডারিকা প্রবাহে।সারেং বৌয়ের নায়িকার মতো সংলাপে হয়তোবা -" দুজনে একই ছাদের নিচে থাকি, বুকের সাথে বুক মিলিয়ে কাজ করি অথচ সে আমাকে বুঝলোনা। "
বিয়ে! এ শব্দটি ছোট হলেও এর ব্যপ্তি দীর্ঘ। বিয়ের মাধ্যমে সূচিত হয় পরিবার এবং পরিবার হচ্ছে সমাজ গঠনের প্রাথমিক বুনিয়াদ । তাই এর গুরুত্ব অনেক । বিয়ে পরবর্তী প্রারম্ভিক সময়ে উচ্ছ্বলতা পরবর্তীতে নির্ভরতা অতঃপর সন্তান তৈরি করে এক নিবিড় সেতু মানে জীবনের নতুন প্রবাহ, প্রজন্মের ধারাবাহিকতা আর এভাবেই টিকে থাকে মানব সভ্যতা। বেশির ভাগ মানুষ জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এটিকে আকড়ে রাখে - যদিও একত্রে বসবাসের কারণে বেশির ভাগ সময়ে একঘেয়েমি তিক্ততা, ঝগড়া বিবাদ, পারস্পরিক দোষারোপ এবং হয়তোবা একটা সময়ে আঘাত - যা নারীর জীবনে বেশি আর অনেক পুরুষের ক্ষেত্রে জন্ম নেয় পরকীয়ার মতো ভেন্টিলেশন অথবা আজীবন বিবাহহীন একত্রে বসবাসের মতো একটা ক্ষতচিহ্ন যা সমাজের জন্য চরম লজ্জার। একই সাথে দেখি শিক্ষিত তরুণ তরুণীরাও অনেকে সমকামীতার আশ্রয়ে।যা সত্তর দশকে বিস্তৃত লাভ করেছিলো পাশ্চাত্যের মতো নানাদেশে।সিমন দ্য বেভোয়ার- জাঁ পল সাত্রে বা আরও অনেক খ্যাতিমান ব্যাক্তিদের অনেকে বা বর্তমানে বিশেষত হলিউড বা বলিউড বা টালিউড বা আমাদের দেশের সেলিব্রিটিদের অনেকে লিভ টুগেদার এ ঝুঁকে পড়ছেন। যদিও অবাক লাগে হিটলার ও ইভা ব্রাউন কেন মৃত্যুর পূর্বে বিয়ে করেছিলেন?
আর বর্তমানের অনেক তরুনবা তরুণীর মানসিকতায় দেখছি,বিয়ের প্রতি একধরনের অনাগ্রহ বা ভীতি।
কারণ হিসেবে আমার মনে হয় এর কারণ স্বাধীনভাবে বসবাসের আকাংখা,ক্যারিয়ার সচেতনতা, উচ্চ শিক্ষার প্রতি আগ্রহ, সহবাসে অনীহা, প্রেমে প্রত্যাখ্যান, নারী পুরুষ উভয়ের ই বহুগামীতার প্রতি আসক্ত এবং নিজেকেই বড়ো করে দেখা অর্থাৎ পারস্পরিক সম্পর্কে সমঝোতার অভাব এবং নিজের মতের প্রাধান্য। সুতরাং লিভ টুগেদার ই বরং একধরনের কোন বাধ্যবাধকতার বাইরে স্বাধীনভাবে একত্রে বসবাস, শুধুমাত্র শারীরিক প্রয়োজন এবং মানসিক নিঃসঙ্গতা দূরীকরণের উপায়।
বিয়ের প্রতি অনাগ্রহে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের হার এবং তা আশংকাজনক ভাবে।এর কারণ হয়তোবা একসাথে বসবাসের কৌশল না জানা, ছাড় না দেওয়া যে কারণে অনেকে মনে করছে দাম্পত্য জীবন মানে শত্রুর সাথে বসবাস অথবা রেললাইন বহে সমান্তরাল সুতরাং ভাঙছে সংসার, ভাঙছে কতো কতো স্বপ্ন! কতো কতো সন্তানের জীবনযাপনে মা ও বাবার এই ভাঙনে নেমে আসছে হতাশা।অনেক সময়ে ঘটছে হত্যা, আত্মহত্যা, অপমৃত্যু বা সহিংসতা।
সাধারণ প্রাচ্যে একটা মেয়ের জীবনের গতিপথের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও জটিল বিষয় হচ্ছে নারীত্ব। আর এই নারীত্বের নানাধরণের মানসিক বা শারীরিক অবহেলাকে পাশ কেটে নারীরা বিবাহিত জীবনের নানা জটিলতাকে একপাশে রেখে বৈবাহিক জীবন তথা মাতৃত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন অনেকে বা দিচ্ছেন। কিন্তু সেই মূল্যবোধে চিড় ধরছে। যতো বেশি নারী উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছে ততো বেশি বিয়ের পরিবর্তে বেছে নিচ্ছে লিভ টুগেদার নামক অপসংস্কৃতিকে।এমন কি আমার সামনের বস্তীতে দেখি গার্মেন্টস কর্মীদের অনেক মেয়ে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে লিভ টুগেদার করছে। সমাজের অনুশাসন এখানে নেই বরং অনেকেই নির্লিপ্ত। যা আমাদের মতো এই দেশে একটা সময়ে অকল্পনীয় ছিল।
খেয়াল করে দেখুন। মেরিলিন ফ্রেন্স এক অসাধারণ নারীবাদী লেখক- তাঁর ব্লিলিডিং হার্ট উপন্যাসে মার্কিন নারীদের প্রেম ও বিয়ের প্রহসন নিয়ে লিখেছেন, নারীর নিজের একান্ত জীবনের আবিষ্কার ও ভিন্ন মাত্রায় গড়ে তোলার বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন।আধুনিক সমাজে বিবাহিত নারীর ছদ্মবন্দিত্ব, পরিচয় সংকট, পারিবারিক পিছুটান ইত্যাদি অনুসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন। আবার প্রায় দুইশত বছর আগে একজন বেগম রোকেয়া যেমন নারী রাজ্যের কথা বলেছেন তাঁর সুলতানার স্বপ্ন উপন্যাসে আবার পদ্মরাগে একজন বিদ্রোহী নারী সিদ্দিকার কথা লিখেছেন। একইসাথে বলেছেন-"বিয়ে একমাত্র লক্ষ্য নয়।কন্যাগুলোকে শিক্ষিত করিয়া ছাড়িয়া দাও - তারা নিজেরাই অন্ন,বস্ত্র উপার্জন করুক "।এভাবে নারীদের আমিত্বকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন।এও একধরনের বিয়ের প্রতি অনীহার প্রকাশ। আর এই একুশ শতকে এসে নারীরা তো অর্থনৈতিক ভাবে অনেকে স্বাবলম্বী। সুতরাং!!! বিয়ের প্রতি অনাগ্রহ বা ভীতি কিন্তু সমাজের ভারসাম্যহীনতার একটা অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
শুধু নারীর কথা কেন বলছি! পুরুষেরাও বিয়ের প্রতি নানাকারণে আগ্রহ হারাচ্ছে। যা এক অশনিসংকেত।
তবে বলতে হয় - এটি কাম্য নয় কোন ভাবেই। এটি অনস্বীকার্য যে বিয়ে যে কোন মানুষের উত্তরণ বা পতনের কারণ।তবু ও সমাজের টিকে থাকার জন্য দরকার বিবাহ প্রথাকে টিকিয়ে রাখা। নারী ও পুরুষের সম্পর্কে বলতে হয়,কেন সম্পর্কই স্বার্থহীন নয় ।ডি লরেন্স এর মতে - "হয় বন্ধুত্ব না হয় প্রেম " । কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস " রাত ভর বৃষ্টি" এক অংশে -"ভালোবাসায় শরীরটাই আসল - আরম্ভ - শেষ সব ওই শরীর।"।তাই মাঝবয়সে এসে স্বামী স্ত্রীর এতো টানাপোড়েন- এ যেন শরীরের কারণে - প্রকৃতির ওপর একধরনের প্রতিহিংসা। "বস্তুতপক্ষে দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রে আর্থিক, সামাজিক ও মানসিক, এগুলো সমান্তরালভাবে চলে কিছুদিন,এরপর! কোন ক্ষেত্রে ঘাটতি হলে শুরু সংঘর্ষ এবং বিচ্ছেদ বা সহিংসতা বা বিপর্যয়। অতঃপর কেউ বা একাকি বা কেউ বা লিভ টুগেদার সংস্কৃতিতে।
শেষ কথায় বলতে হয়।এটি কেন ভাবেই কাম্য নয়। তাই দরকার বিয়ে নামক পারিবারিক বন্ধনকে টিকিয়ে রাখা। এক্ষেত্রে কি করণীয়! খলিল জিবরানের কথাই বলি।যিনি বলছেন- " নারী পুরুষ সম্পর্কের মাঝে একটা করিডর দরকার। "আধিপত্যবোধ কোন পক্ষের জন্য শুভ নয়।তাই প্রয়োজন খোলামেলা আলোচনা আর তা হতে হবে গভীর উদারতা ও মমত্ববোধে । স্বামী বা স্ত্রী - একসময়ের হয়তো বন্ধু, কিন্তু বিয়ের পরে অচেনা। কেন! প্রেমের চাইতে সম্পর্কে বন্ধুত্ব দরকার। এমন বন্ধুত্ব যে একজন যদি ভুলও করে,তাহলে খোলামেলা আলোচনা করা,সাথে থাকবে উদারতা আর মহত্ত্ব। দাম্পত্য জীবনকে তো একটা তানপুরার মতো -আানাড়ি হাতে নয়,বাজাতে হবে নিপুণ কৌশলে,যাতে জীবন ভরে ওঠে মধুরাগে।পারস্পরিক বোঝাপড়া দরকার,খুবই দরকার এবং সহানুভূতি আর সমবেদনায়।
হয়তো অনেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে পারেন - বিবাহিত জীবনে শুধু অভিনয় করছি,সুখের ভান করছি,সমাজ ও সন্তানের কারণে,এরপরে ও লিভ টুগেদার নামক বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলা দরকার। সেটা সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজের জন্য এবং নানাধরণের সামাজিক সমস্যা রোধের জন্য।
জীবন তো একটাই। শান্তি, ভালোবাসা এবং ভারসাম্যের জন্য বিবাহ নামক প্রথা বা সামাজিক চুক্তি বা বন্ধন এটি অপরিহার্য। তাই প্রত্যাশা - ক্ষণিকের এ বসবাসকে পারস্পরিক সম্পর্কের সৌন্দর্যে ফুলের বাগানের মতো কি সাজানো যায় না! বলতে কি পারা যায়না! হামিনাস্ত হামিনাস্ত! এখানেই স্বর্গ! এখানেই স্বর্গ!!!!