শংকর ফিরে এলো || সাইফউদ্দিন আহমেদ বাবর।
শংকর ফিরে এলো  || সাইফউদ্দিন আহমেদ বাবর।

 

শীতের এক রাত।নিশীথ সম অন্ধকার নিয়েচানবাগচায়ের বাগান স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।চারিদিকে অন্তহীন অন্ধকার।বাগানটার একধারে বিশাল টিলা।টিলার একটা অংশ জুড়েও লাগানো চা পাতার গাছ।

বাগান ছেড়ে লোকালয়ে যেতে হলে এই টি লা পারি দিয়েই যেতে হয়।এখান থেকে,প্রায় মাইল তিনেক গেলে পাকা সড়কের দেখা মেলে।সেই সড়ক ধরে যে যার গন্তব্যের দিকে যেতে পারে।

 

কাল রবিবার।ইংরেজ দের তৈরী করে দিয়ে যাওয়া নিয়ম মতো বাগানের সর্ব স্তরের কর্মী,শ্রমিকদের,সাপ্তাহিক ছুটির দিন।

আলম সাহেব বাগানের ফাইনান্স ডিপার্টমেন্টের সহকারী হিসেবে নতুন জয়েন করেছেন।তিনি প্রতি শনিবার কাজ শেষে,সন্ধার আগেই বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে যান।

আজ হিসাবে বিরাট এক গন্ডগোল লাগায়,হিসাব মিলাতে মিলাতে রাত হয়ে গেছে।

তিনি রাতেই রওয়ানা দিয়েছেন।

 

টিলার একধারে কিছু শ্রমিকের বাস।সারাদিনের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর রাতে এরা খাওয়া দাওয়ার পর,মদ্য পান করে,গাঁজা সেবন করে,হৈ হল্লা করে,গান বাজনা করে।

 

আলম সাহেব নিজেদের কোয়ার্টার ছেড়ে বেরিয়ে,টি লার উপর উঠেই বুঝতে পারলেন-টর্চ না নিয়ে এসে কি বোকামি টা না,করেছেন।

সময়টা যে অমাবস্যার-মনেই ছিলো না।এই ঘুট ঘুটে অন্ধকারে,উঁচু নিচু পথের টি লার ওপাশে যাবেন কি ভাবে?

তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে লক্ষ্য করলেন-

অন্ধকারের চাদরে ঢাকা এই পুরো বাগানটা আজ কেমন যেনো নিস্তব্ধতায় ঝিম ধরে আছে।ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকটা যদিও আছে তবুও অন্যান্য রাতের মতো, পাশের শ্রমিকদের,কুলিদের,হৈ হল্লা,নেশারুদের জড়ানো গলার বিকার,গান,বাজনা,কিচ্ছু নাই!

হলো কি আজ সকলের?

আলম সাহেবের গা টা হঠাৎ ছম ছম করে উঠলো।তিনি কোয়ার্টারে ফিরে গিয়ে টর্চ নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন।

ঠিক তখন একটা বাঁশির সুর ভেসে এলো।কী অসাধারণ সুর!মুগ্ধতায় তন্ময় হয়ে তিনি শোনতে লাগলেন সেই বাঁশির সুর।

হালের জনপ্রিয় একটি সিনেমার জনপ্রিয় গানআমি আছি থাকবো ভালোবেসে মরবো’-গানটি কে যেনো অসম্ভব মিষ্টি করে বাজাচ্ছে।

আলম সাহেবের মনে হলো,এতো সুন্দর বাঁশির সুর তিনি আর জীবনেও শোনেননি।

মন্ত্র মুগ্ধের মতো,স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি বাঁশি শোনলেন।

বাঁশি বাজানো থেমে যাবার পরও ঘোরের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন।ঘোর কাটার পর তিনি ফিরে কোয়ার্টারের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

কয়েক কদম হাঁটতেই হঠাৎ কি একটা ভারী বস্তু তাঁকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে চেপে ধরলো।

ভয়ে তিনি চিৎকার দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন।কোয়ার্টার কাছেই।সেখানে অনেক সহকর্মী আছে।তারা যদি শোনে ভয় পেয়ে তিনি চিৎকার করছেন-সেটি তাঁর জন্য ভীষণ অস্বস্তিকর,অপদস্তের হবে।সবাই পরে নিয়ে আড়ালে অথবা প্রকাশ্যে হাসাহাসি করবে।

তিনি ভয়ে অজ্ঞান হওয়ার অবস্থায়ও এসব ভাবলেন।ভাবতে পারলেন।

 

ভদ্রলোক হওয়ারও নানান যন্ত্রণা!

 

তিনি কিড়িমিড়ি খেয়ে চিৎকার করা থেকে নিজেকে আটকিয়ে মুহুর্তে যতোগুলো সূরা মনে আসলো-সে গুলো জোরে জোরে পাঠ করে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দেবার চেষ্টা করলেন।পারলেন না।

হঠাৎ এভাবে পড়ে যাওয়ায় কোমরে বেশ একটা চোট পেয়েছেন।

কোমরের ব্যথায় আর ভয়ে কাতর আলম সাহেব অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন।শুধু অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখতে পেলেন না।তিনি কোমরে হাত বুলিয়ে-হাড় ভেঙ্গেছে কি না বুঝার চেষ্টা করলেন।

ঠিক তাঁর পায়ের কাছে তখন কী একটা নড়া চড়া করে উঠলো।তিনি সদ্য ভাঙ্গা কোমর নিয়ে এক লাফে অনেকটা দূরে গিয়ে হাঁফাতে লাগলেন।

তখন শোনতে পেলেন,মানুষের গলার মতো একটা আওয়াজ।তবে পরিস্কার ভাবে বুঝতে পারলেন না কিছু।তিনি কান কাড়া করলেন।

এবার তিনি শোনতে পারলেন- দিক থেকে জড়ানো গলার আওয়াজ,

- ক্যায়া হেরে শংকর বাবা,তু জঙ্গল ছে ইধার ভি গ্যায়া?

আলম সাহেব জীজ্ঞাসা করলেন,

- কে!কে কথা বলে?

ওখান থেকে আবার আওয়াজ এলো।

- হামারে পাকাড়কে তোল শংকর বাবা।

মানুষের গলার মতোই।তবে এনারা যে মানুষের গলায়ই কথা বলে-তা কে না জানে?

আলম সাহেব কাঁপা কাঁপা গলায় আবার জীজ্ঞাসা করলেন,

- কে!কে কথা বলে?

- হামি নিখিল রে দাদা শংকর।

তিনি নামটা চিনতে পারলেন।

আর তখন তাঁর ভয়টা,শরীরের কাঁপনটা,আস্তে আস্তে কমতে লাগলো।

নিখিল,কুলির ব্যাটা কুলি,বাংলা মদ খেয়ে,সন্ধার পর থেকেই মাতাল হয়ে,টি লার দক্ষিন দিকের জংলাতে-বেশির ভাগ দিন পড়ে থাকে।আজো নিশ্চয় সেখান থেকে ফিরছে।

আলম সাহেবের সাহস ফিরে আসায় শরীরে বল পেলেন।

এবার শক্ত গলার বললেন,

- ব্যাটা বদের বদ,এই অন্ধকারে ধাক্কা মেরে আমাকে ফেলে দিয়ে ভয় দেখালি?

তিনি নিখিলের শ্বাসের শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলেন।

নিখিল বললো,

- ইয়ে ক্যায়া শংকর বাবা?তুমি বাবুদের মতো ভি বলতা হ্যায়!

আলম সাহেব একটা লাথ্বি মারতে গিয়ে টের পেলেন পা নাড়াতে পারছেন না।

বললেন,

- উঠ হারামজাদা,উঠ বলছি।

সে উঠলো কি না তিনি বুঝতে পারলেন না।তবে তার কথা আরো কাছে শোনতে পেলেন।

- তু শংকর বাবা নেহী?

- আমি তোর বাবা হারামজাদা।

- কে কৌন।

- চল,এই অন্ধকার থেকে কোয়ার্টারে,আলোর মাঝে চল হারামজাদা,আজ চড়িয়ে তোর সব কয়টা দাঁত ফেলে দেবো।

- আপ কৌন বাবু?ক্যাশ বাবু।

 

একাউন্ট ডিপার্টমেন্টে দায়িত্বে থাকায় এরা আলম সাহেব কে ক্যাশ বাবু বলে ডাকে।

 

অবস্থায়ও তাঁকে চিনতে পেরেছে,তাতে আলম সাহেবের  স্বাভাবিকতা পুরোপুরি ফিরে এলো।

তিনি বললেন,

- চল,কোয়ার্টারে চল।আজ বুঝবি মজা।

- মাফি দেন বাবু,আন্ধারে দেখি নাই।মুজে লাগা আপ শংকর।

 

শংকর লোকটা গেলো বর্ষায় বজ্রপাতে মারা গেছে।তাকে জঙ্গলে নিয়ে দাহ করা হয়েছে।

সেই থেকে এই নিখিল যখন নেশা করে জঙ্গলে পড়ে থাকে-তখন গাছের আড়ালে পশু,পাখি নড়া চড়া করলে অথবা বাতাসে গাছের পাতা নড়ে উঠলে সে শংকর,শংকর বলে চিৎকার করে।এবং প্রায় সময়ই-সে শংকরকে দেখেছে,কথা বলেছে বলে সবার কাছে বলে বেড়ায়।কেউ কেউ বিশ্বাসও করে।

বলে-হতেও তো পারে।বজ্রপাতে মারা যাওয়া শংকর ফিরে আসতে তো পারে!

 

আলম সাহেব বললেন,

- চুপ বললাম চুপ।শংকর শংকর  করবি না।ব্যাটা মাতাল,মরা মানুষ দেখে!

- সাচ মুচ দেখেছি বাবু।এই তো ইহা আনেছে পেহলে।ঐ জঙ্গল মে।

আলম সাহেব এবার ধমকে উঠলেন।

- থাম বলছি।আজ কি দিয়ে নেশা করেছিস?গাঁজা না মদ?

- ইতনা ছা সরাব বাবু।লেকিন শংকর কো দেখা।বাত ভি কিয়া।ওর মন মে কতো দুখু।জওয়ান বিবিকো ছুরকে মর গ্যায়া।ই সব বলা।

- তোর সাথে সব নিয়ে গল্প করলো?তোর এতো বড়ো সাহস!আমার সাথে মাতলামি?মাতালের মাতাল।

- ইয়ে রাত কা আন্ধেরা কি কসম বাবু।শংকর  দাদা মন কি দুখ ছে,আজ বাঁশরী ভি বাজায়া।

 

বাঁশরী বাজায়া!

কি বলছে ব্যাটা মাতাল?

আলম সাহেব চমকে উঠলেন।

সে বললো,

- আপ শোনা নাহি বাবু,বাঁশরী?

- বাঁশি শোনেছি।

- আজ ছে পেহলে কভি ইহা বাঁশরী শোনা?

 

আরে তাই তো!

তিনি এখানে আসার পর প্রায় প্রতিরাত,হৈ হল্লা,ঢোলের আওয়াজ,গান শোনেছেন।কিন্তু কখনো বাঁশির সুর শোনে নি।

আজই প্রথম শোনলেন।তাও যেমন তেমন বাঁশির সুর নয়।বাঁশির সুরে তিনি অন্য জগতে চলে গিয়েছিলেন।তাঁর মনে হলো- রকম বাঁশি সাধারণ কোনো মানুষ বাজাতে পারবে না।

তবে কি এই মাতালটার কথাই সত্যি?

বজ্রপাতে মারা যাওয়া,দাহ করা,শংকরই বাজিয়েছে?

 

আলম সাহেবের আবারো গা ছম ছম করা শুরু হলো।তিনি ঘামতে ঘামতে ভাবতে লাগলেন- অন্ধকারে শংকর কি এখন তাঁরই আশে পাশে এখানে আছে?

তাঁর মনে হলো-আছে।

আর তখন তিনি কোমরের ব্যথা ভুলে কোয়ার্টারের দিকে দৌড় লাগালেন।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান