শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ৮৪তম জন্মদিন আজ। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে 'আলোকিত মানুষ' তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। গুণী এই ব্যক্তিত্ব স্যার নামেই অধিক পরিচিত।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়; দেশব্যাপী আলোকিত মানুষ তৈরির এক আন্দোলনও বটে, যা দিনে দিনে আলোকিত জাতীয় চিত্তের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। মানবজ্ঞানের সামগ্রিক চর্চা এবং অনুশীলনের পাশাপাশি হৃদয়ের উৎকর্ষ ও জীবনের বহু বিচিত্র কর্মকাে র মধ্য দিয়ে উচ্চতর শক্তি ও মনুষ্যত্ব বিকশিত হওয়ার এক আয়োজন সায়ীদ স্যারের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭৮ সালের কথা। ঢাকা কলেজের মূল ক্যাম্পাসের পেছনে শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্রের (বর্তমান নায়েম) ছোট্ট মিলনায়তনে শুরু হয়েছিল এক পাঠচক্র, যার সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫। ঠিক হয়েছিল প্রতি সপ্তাহে তাঁরা একটি করে নির্ধারিত বই সেখান থেকে বাড়ি নিয়ে পড়ে পরের সপ্তাহের একই দিনে যথাস্থানে এসে মিলিত হবেন তর্কমুখর অন্তরঙ্গ আলোচনায়। বইয়ের মধ্যে লেখকদের যে আত্মার আলো জ্বলছে, তার সঙ্গে নিজেদের বহুমুখী বোধের আলো মিশিয়ে তাঁরা জেগে উঠবেন উচ্চতর মানবিক সমৃদ্ধির দিকে।
পাঁচ বছর পর এই পাঠচক্রের আশাতীত সাফল্য দেখে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ভাবলেন, বোধের বিকাশে এ যখন এতটাই ফলপ্রসূ, তখন দেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনই চক্র গড়ে তুলবেন। এর পর হাজার হাজার পাঠচক্রের সৃজনশীল আনন্দে দেশের কিশোর-তরুণ থেকে প্রতিটি আলোকপ্রত্যাশী মানুষ যুক্ত হতে থাকেন। বই পড়ার পাশাপাশি নানামুখী সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নিজেদের উৎকর্ষ ও পরিশীলন, মেধা ও হৃদয়ের উচ্চতর বিকাশ ঘটাতে থাকেন।
১৯৭৮ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আয়োজনে ১৫ জন সদস্য নিয়ে যে পাঠচক্রটি শুরু হয়েছিল, আজ সারাদেশে এর সদস্য সংখ্যা ২৫ লাখ। এর কর্মকাণ্ড ও অবয়ব এখন বিশাল।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কোনো গৎবাঁধা, ছককাটা, প্রাণহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সজীব পরিবেশে জ্ঞান ও জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ণতর মনুষ্যত্বে ও উন্নততর আনন্দে জেগে ওঠার এক অবারিত পৃথিবী। এক কথায়, যাঁরা সংস্কৃতিমান, কার্যকর, ঋদ্ধ মানুষ- যাঁরা অনুসন্ধিৎসু, সৌন্দর্যপ্রবণ, সত্যান্বেষী; যারা জ্ঞানার্থী, সক্রিয়, সৃজনশীল ও মানবকল্যাণে সংশপ্তক- বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তাঁদের পদপাতে, মানসবাণিজ্যে, বন্ধুতায়, উষ্ণতায় সচকিত এক অঙ্গন।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসে পেরিক্লিসের আমলে, এথেন্সের যুবকদের ১৮ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে একটি শপথবাক্য উচ্চারণ করতে হতো। সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হতো, 'আমি সারাজীবনে এমন কিছু করে যাব, যাতে জন্মের সময় যে এথেন্সকে আমি পেয়েছিলাম, মৃত্যুর সময় তার চেয়ে উন্নততর এথেন্সকে পৃথিবীর বুকে রেখে যেতে পারি।' বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চেষ্টাও তেমনি এক উন্নততর বাংলাদেশের জন্য।
দেশের তরুণ ও আলোকপ্রত্যাশী প্রতিটি মানুষের মাঝে বইয়ের আনন্দ বিলিয়ে দেওয়া আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৩৯ সালের আজকের এই দিনে কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার কামারগাতি গ্রামে। তাঁর বাবা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন শিক্ষক। ১৯৫৫ সালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৫৭ সালে বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৬০ সালে স্নাতক ও ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৪ সালে তিনি র্যামেন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন। দেশে অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য ২০০৫ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। প্রবন্ধে অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি টিভি উপস্থাপক হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
১৯৬১ সালে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খ কালীন প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা শুরু করেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। পরবর্তী সময়ে কিছুকাল সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬২ সালে রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর সরকারি চাকরি জীবন শুরু। এর পর বর্তমান সরকারি বিজ্ঞান কলেজ ও ঢাকা কলেজেও শিক্ষকতা করেন। দেশে পাঠাগারের অপ্রতুলতা অনুধাবন করে তিনি ১৯৯৮ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কার্যক্রম শুরু করেন।
জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা প্রিয় লেখক ও শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
গোলন্দাজ আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন : গোলন্দাজ আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। গতকাল আনন্দ আলো পত্রিকার সম্পাদক রেজানুর রহমান এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান।
আজ সোমবার দুপুর ১২টায় চ্যানেল আইয়ের তারকাকথন সরাসরি অনুষ্ঠানে গোলন্দাজ আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার-'২১ দেওয়া হবে। প্রথমবারের মতো এই পুরস্কার নেবেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। অনুষ্ঠানে প্রয়াত আলতাফ হোসেন গোলন্দাজের ছেলে গফরগাঁও থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলসহ বিশিষ্টজন উপস্থিত থাকেবন।