গল্পকার: আবুল খায়ের
পাঁপড়ি স্থানীয় একটি স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে পড়ে। শহরের স্কুল বলে কথা। ওদের স্কুলে ধনী ঘরের ছেলে-মেয়েরা যেমন আছে আবার মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়োরও আছে। পাঁপড়ি পড়ালেখায় বেশ ভালো। আবার মিশুকও বটে। তাই বন্ধু মহলে তার ভালো কদর। শীত শুরু হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে এমনিতেই শীতের প্রকোপ একটু বেশী থাকে। কেউ কার্ডিগান, সুয়েটার, জেকেট, মাফলার ইত্যাদি শীতের পোশাক পরিধান করে ক্লাশে আসে। কারো পোশাক খুবই দামী, বড় শহর থেকে কেনা। আবার কারোটা একেবারেই রাস্তার পাশ থেকে কেনা। সস্তা হলেও দেখতে বেশ ভালো। বুঝার উপায় নেই যে কম দামে কেনা। শীত আসলেই শহর, উপশহরে রাস্তার দু’পাশে বসে শীতের বাহারী পোশাকের পসরা। পুরাতন, কম দামী শীতের পোশাক সাধারণের জন্য শীত নিবারনের একটি ভালো ও সহজ লভ্য উপায়। অনেক ভদ্র লোককে রাস্তার পাশে দোকান থেকে শীতের পোশাক খুঁজতে দেখা যায়। একটু খেয়াল করে ও সময় নিয়ে কিলনে কম দামে অথচ বিদেশী পোশাক সংগ্রহ করা যায়। পুরাতন হলেও দামের তুলনায় গুণগত মান খারাপ নয়। তবে গরীব ও স্বল্প আয়ের লোকদের জন্য ভালো সুযোগ। আবার কম পুঁজিতে ব্যবসা করে কিছুটা হলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তৈরী করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে কিছু সাহসী যুবকের আত্মপ্রকাশেরও সুযোগ।
পাঁপড়ি বাবা-মা এবং বড় বোন-এর সাথে শীতের পোশাক ক্রয় করতে বের হ’ল। মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে এক দিকে ক্লান্ত। অন্যদিকে মনটাও খারাপ। পরিবারের সবার কেনা-কাটা শেষ। ক্লাশেতো অনেক বন্ধুদের ভালো শীতের পোশাক দেখা যায় না। কারোটা একেবারে পুরাতন। অর্থের অভাবে স্কুলের বেতনও ঠিক মতো দিতে পারে না। শীতে কষ্ট করলেও বন্ধুদের বুঝতে দিতে চায় না ওরা। আবার মন খারাপ হলেও তো কোন উপায় নেই। পাঁপড়ি বুঝতে পারে। তার বন্ধুদের মধ্যে যারা গরীব, তাদের মনের কষ্ট’টা কী? যদি ওদের জন্য কিছু করা যেত....। তবে কতইনা ভালো লাগতো। মাঝে মাঝে পাঁপড়ি ভাবে-সে এটা ওটা বন্ধুদের উপহার দিচ্ছে। আর ওর বন্ধুরা তো খুশিতে আটখানা। ওদের মুখে হাসি দেখে নিজের হাসিও যেন আর ধরে না। এসব শুধু ভাবাই হয়। কিন্তু কোন উপায়তো আর আসেনা। ভাবনাটা স্বপ্নের মতো হারিয়ে যায়।
বড় বোন ‘আফিয়া’ একটা বকা দিল-কিরে পাঁপড়ি তোমার কি হলো? কিছুই তো নিচ্ছ না। নিলে তাড়াতাড়ি করো। বাসায় যেতে হবে। টিচার আসবে। ওর আব্বু বল্ল-চল কিছু খাওয়া যাক। তারপর ওর জন্য দেখব। মা রেগে বলল-বাদ দাওতো খাওয়া। যেমন বাবা তেমনি মেয়ে’রাও। বাহিরের খাবার খেয়ে খেয়ে সবারই এখন গেস্ট্রিক। আফিয়া বল্ল-মা, একটু থামো’তো। প্রতিদিনতো আর মার্কেটে আসিনা। চল’না আব্বু যেহেতু খেতে চাচ্ছে......।
বুঝেছি। আব্বুর নাম দিয়া সবারই খাওয়া হবে। হাসতে হাসতে সবাই একটি হোটেলে ঢুকল। খাবার সামনে আসল। খেতে খেতে একটু গল্প। আলাপ প্রসঙ্গে পাঁপড়ি বলল-দেখ বাবা। আমার শীতের পোশাক লাগবে না। গত বছর যেটা কিনেছ ওটা দিয়ে আমার এবছর কেটে যাবে। তাছাড়া আপু’র জন্য নেপাল থেকে যেটা এনেছ, ওটাও আমি মাঝে মধ্যে গায়ে দিয়ে থাকি, ওটা আপু’র গায়েও হয়, অমারও হয়। সুতরাং আর কেনার দরকার নেই। খালি খালি টাকা নষ্ট করার কী দরকার? তার চেয়ে চল-আমার বন্ধুদের জন্য কিছু কিনতে পারি কিনা? আফিয়া বলল-বলিস কী? ওদের জন্য কিনতে হবে কেন? পাঁপড়ি বলল-আপু জানিস না। আমাদের ক্লাশের কয়েকটা মেয়ে আছে। ওরা খুবই ভালো ছাত্রী। কিন্তু ওদের অনেকেরই কোন ভালো জামা নেই। কারো কারো স্কুলের মাসিক বেতন দিতেও কষ্ট হয়। যদিও ওরা কখনো বলে না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি। ওদের অবস্থা।
দু’বোনের বিতর্ক দেখে বাবা বুঝতে পারে। ‘আসলে মেয়েটাতো আমার যেন সোনার টুকরা’। সে এ বয়সে গরীবদের নিয়ে ভাবছে। যেটা আমাদের সবারই চোখ খুলে দিয়েছে। বাবা বলল-চল, তবে তাই করি। এখন বল-কার জন্য কী কিনবে? কয়টা কিনতে হবে। তবে টাকা বেশী খরচ করা যাবে না।
নিজে না কিনে বন্ধুদের জন্য শীতের জামা কেনার গল্প করতে করতে পাঁপড়ি তার ঘনিষ্ট বন্ধু সুমাইয়াকে জানালো। সুমাইয়াও প্রথমে অবাক হয়। পরে বুঝতে পারে যে, এটা একটা বড় মাপের কাজ হবে। সেও বলল-আমিও আছি তোমার সাথে। তুমি তো তিন জনের জন্য তিনটা কিনেছ। আমিও দেখি আব্বুকে বলে দু’একটা কিনতে রাজি করাতে পারি কিনা। তাহলে আমাদের ক্লাশের আর কারো শীতের সমস্যা হবে না। বেশ ভালো আইডিয়া।
পৌষের প্রথম দিন। সকালে ক্লাশ। শীতের কি যে প্রকোপ! বাসা থেকে বের হলেই শীতল বাতাসে কাঁপুনি না খেলে বুঝা যাবেনা। কুয়াশা ঢেলে স্কুলে যাওয়া যে কী কষ্ট মধ্যাহ্ন বিরতির সময়ে পাঁপড়ি ও সুমাইয়া সিদ্ধান্ত নিল আগামী দিন শীতের জামাগুলি নিয়ে আসবে। কিন্তু ওরা কিভাবে নিবে বিষয়টা, এনিয়ে একটু চিন্তাও আছে। যদি ওরা গ্রহণ না করে উল্টো ক্ষেপে যায়? যদি ওরা বলে-আমরা কেন তোমাদের জামা নেব.... ইত্যাদি দুশ্চিন্তাও মাথায় আছে।
পরদিন শৈত্য প্রবাহ আরো বেড়ে গেল। স্যার ক্লাশে আসতে দেরী হচ্ছে। সবাই যেহেতু রোদের অপেক্ষায় মাঠের এদিক ওদিক পায়চারী করছে। সুমাইয়া বলল-এখনি কাজটা সেরে পেলতে হবে। সে একটু সুন্দর করে কথা বলতে পারে। উপস্থিত বুদ্ধিও ভালো। ও প্রস্তাব দিল। বন্ধুদের ডাকা হলো স্কুলের ছাদে। লোকজনও কম। আড্ডাও হল। কাজটাও হবে। শীতের জামাগুলো বের করে পাঁপড়ি ও সুমাইয়া বন্ধুদের উপহার দিল। অবাক কান্ড! প্রথমে একটু লজ্জা লাগলেও পরে-সুমাইয়ার সাবলিল উপস্থাপনায় সবাই খুশিতেই গ্রহণ করল জামাগুলি। নতুন জামা পরিধান করে সবাই কোলাকুলি, মজা করল। পলি বলল-দু’একটা ছবি হলে কেমন হয়? ক্লাশে যেতে হবে। নতুন শীতের জামা পরিধান করে কী যে আনন্দ!
ক্লাশ শেষ করে বাসায় ফেরা। মাকে বল্লে-মা কি যে খুশি হবে। ভাবতে ভাবতে পাঁপড়ির মনের ভিতর একটি অনুভূতির তরঙ্গ ঢেউ তুলে যাচ্ছে অবিরত। নতুন শীতের জামা পেয়ে বন্ধুদের যে হাসি মাখা মুখ ও উচ্ছ্বাস দেখেছে পাঁপড়ি। তা কোনদিন মন থেকে হারাবে না। পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কটা আরো ঘনিষ্ঠ হলো। আজকে নিজেকে একটু অন্যরকম লাগছে। বন্ধুদের জন্য কিছু করতে পেরে। মনের অজান্তেই পাঁপড়ি তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। ভাবছে এইভাবে সমাজের ধনী লোকগুলো যদি শীতার্তদের পাশে দাঁড়াতো। তাহলে সমাজটাই বদলে যেতো। ধনী গরীবের ব্যবধান কমে যেতো। বন্ধুতো বন্ধুর জন্য। মানুষের জন্য মানুষ।