আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর আলো দেখেন জনপ্রিয় বাঙালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
তাকে জীবনানন্দ-পরবর্তী সময়ের আধুনিক বাংলা কবিতায় অন্যতম প্রধান কবি। লেখক জীবনে তিনি নীললোহিত, সনাতন পাঠক ও নীল উপাধ্যায় ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক বাংলাদেশের মাদারীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চার বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে যান। সেখানই শুর হয় তার শিক্ষাজীবন।
শিক্ষাজীবন শেষ করে কিছুদিন চাকরি করেন। তারপর শুরু করেন সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতা করার সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যান তিনি। ডিগ্রি হয়ে গেলে কিছুদিন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপগ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করেন। সেই চাকরিতেও বেশিদিন ছিলেন না। চাকরি কলকাতা আসেন। আবার শুর করেন সাংবাদিকতা।
সুনীলের প্রথম কবিতা
১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সুনীলের কবিতা। তখন কবির বয়স ছিল ১৭। ‘একটি চিঠি’ শিরোনােমের ওই কবিতায় করিব নাম ছিল সুনীল কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। এভাবে কুমার নাম নিয়েই চলতে থাকে তার লেখালেখি। তবে ১৫ জানুয়ারি ১৯৫৫ সালে ‘কুমার’ শব্দটি খসে পড়ে কবির নাম থেকে। নাম হয় শুধুই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
মেয়ে পটাতেই প্রথম কবিতা
সুনীল প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন পছন্দের মেয়েটির মন পাওয়ার জন্য। গোপনে গোপনে তিনি জানতে পেরেছিলেন তার পছন্দের মেয়েটির বাসা দেশ পত্রিকা রাখা হয়। তাই তার মন পাওয়ার জন্য অথবা নিজের অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করার জন্য বের করলেন অভিনব এক বুদ্ধি। নিজেকে কবি হিসেবে কিশোরীর কাছে পৌঁছানোর অন্য কোনো উপায় না পেয়ে এ রকম পথ বেছে নেন তিনি।
সুনীলের নিজেই এসব কথা স্বীকার করে লিখেছেন- “একটি রচনা ঝোঁকের মাথায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ‘দেশ’ পত্রিকায়। কবি-খ্যাতির আশায় নয়, শুনেছিলাম, কোনো লেখা ছাপা হলে সেই পত্রিকা বিনামূল্যে পাওয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয়, সত্যিই ডাকযোগে একদিন ‘দেশ’ পত্রিকার একটি প্যাকেট পেলাম। আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় ১৯৫১ সালের কোনো এক মাসের ‘দেশ’ পত্রিকায়, কবিতার নাম ‘একটি চিঠি’ (দেশ পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক হর্ষ দত্তের হিসাবমতে ১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যা; সূত্র : ‘প্রিয় ‘দেশ’, প্রিয় ‘মানুষ’, হর্ষ দত্ত, দেশ, ১৬ কার্তিক ১৪১৯, ২ নভেম্বর ২০১২, ৮০ বর্ষ, ১ সংখ্যা, পৃ ৪০)।
তবে অনেকেই জানতো না ওই কবিতা সুনীলের লেখা। সুনীলের ভাষায়- ‘বন্ধুবান্ধব এবং সেই কিশোরী আমায় বলেছিল দেখেছ, দেশ-এ একজন একটা কবিতা লিখেছে। ঠিক তোমার সঙ্গে নাম মিলে গেছে। আমিই যে ওটা লিখতে পারি কেউ কল্পনাও করেনি, আমিও বলিনি।’
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের চোখে সুনীল
‘চলে গিয়েও সুনীল রয়ে গেল’ শিরোনামের লেখায় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তার লেখাটি শুরু করেছেন এভাবে– ‘যখন এ লেখা লিখছি, তখন সুনীল বড় একা হয়ে শুয়ে আছে ঠান্ডা ঘরে, পিস হ্যাভেনে। ডোরবেল বাজিয়ে কেউ আসবে না আজ। সুনীল উঠে গিয়ে দরজা খুলে প্রসন্ন মুখে বলবে না, আরে, এসো এসো! … বেড়াতে যেতে বড় ভালোবাসত সুনীল। নতুন অচেনা কোনো জায়গায় যাওয়ার কথা শুনলেই উজ্জ্বল হয়ে উঠত চোখ। আজও সুনীল চলল নতুন এক দেশে।’ (‘চলে গিয়েও সুনীল রয়ে গেল’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দেশ, সংখ্যা : প্রাগুক্ত, পৃ ২৩)
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর চোখে সুনীল
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সুনীলকে নিয়ে লেখেন- ‘সুনীল খুব বড় মাপের লেখক, আবার খুব বড় মনের মানুষও বটে। ওর সমসাময়িক যাঁরা সাহিত্যিক, ও চেয়েছে তাঁদের প্রাপ্যটা যেন তাঁরা পান। ওর মধ্যে কখনো ঈর্ষা, হিংসা দেখিনি। ওর চেয়ে বয়েসে যারা ছোট, তাদের দিকে ও সবসময়ই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু যে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক, তা নয়, সংসার চালানোরও একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া! যাতে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে। এসব ব্যাপারে প্রখর নজর ছিল সুনীলের। … এখান থেকেই বলা যায়, সুনীল ভালোবাসাকেই তার ধর্ম বলে মেনে এসেছেন। ও বিশ্বাস করত, ভালোবাসার ওষুধ প্রয়োগ করে মানুষের সব অসুখ সারিয়ে তোলা যায়! ধর্মে বিশ্বাস না করুক, ঈশ্বরে বিশ্বাস না করুক, কিন্তু ভালোবাসায় বিশ্বাসী। আসলে, কবিদের কাছাকাছি পৌঁছতে হলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের একটা মইয়ের প্রয়োজন হয়, নইলে নাগাল পাব না তো! … সুনীল ঘোষিত নাস্তিক। … সুনীল নাস্তিক হলেও, মানুষের কল্যাণ কামনা করত সব সময়। যদি আমরা ঈশ্বরকে মঙ্গলময় বলে ভাবি, তবে মানুষও তো সেই ঐশ্বরিক দায়িত্বটা নিতে পারে। সুনীল তো মানুষে বিশ্বাস হারায়নি কখনো, অনেক মানুষের অনেক কুকীর্তি সে প্রত্যক্ষ করেছে, তা সত্ত্বেও মানুষের প্রতি ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল। সে দুঃখবাদীও নয়, হতাশাবাদীও নয়, সুনীল অত্যন্ত আশাবাদী মানুষ এবং মানুষ সম্পর্কে তার আশা ভরসাকে সে শেষদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল।’ (‘কখনো মানুষে বিশ্বাস হারায়নি’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দেশ, সংখ্যা : প্রাগুক্ত, পৃ ২৮-৩০]
সুনীলের সম্পাদনা এবং প্রথম বই
১৯৫৩ সালে ‘কৃত্তিবাস’ সম্পাদনা শুরু করেন সুনীল। এটি ছিল কবিতা বিষয়ক পত্রিকা। ১৯৫৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’ ও ১৯৬৬ সালে প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয়।
বিখ্যাত কয়েকটি বই
সুনীলের বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’, ‘শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা’, ‘অর্ধেক জীবন’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘অর্জুন’, ‘প্রথম আলো’, ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব পশ্চিম’, ‘ভানু ও রাণু’, ‘মনের মানুষ’ ইত্যাদি। লিখেছেন ‘কাকাবাবু’ নামে জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ।
সুনীলের গল্পে চলচ্চিত্র
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া কাকাবাবু চরিত্রের তিনটি কাহিনী ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’ ও ‘মিশর রহস্য’ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
সম্মাননা
২০০২ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা শহরের শেরিফ নির্বাচিত হন। ১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮৫ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। এ ছাড়া অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন।
বিয়ে ও পরিবার
সুনীলের স্ত্রীর নাম স্বাতী বন্দোপাধ্যায়। তারা ১৯৬৭ সালে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র ছেলের নাম সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়।
দেহাবসান
২৩ অক্টোবর ২০১২ তারিখে হৃদযন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৩ সালের ৪ এপ্রিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার ‘গণদর্পণ’কে সস্ত্রীক মরণোত্তর দেহ দান করে যান। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছেতে তার দেহ দাহ করা হয়।