সুনীতি দেবনাথ এর কবিতাগুচ্ছ
কবি : সুনীতি দেবনাথ
আ ব্ল্যাক পোয়েট ফ্রম দ্য ক্যারিবিয়ান
আ ব্ল্যাক পোয়েট ফ্রম দি ক্যারিবিয়ান '—
নিজের ও দেশের আইডেনটিটি সন্ধানী
অতলান্তিক সামুদ্রিক দুটি চোখ,
তৃণগুচ্ছের শিশির বিন্দুর বিন্যাসের বিলাস থেকে
কৃষ্ণগহ্বরের বিপুল গভীরতা দর্শনে সক্ষম।
আকাশের বিষণ্ণ নীল আর
সমুদ্রের গম্ভীর গর্জন দেখে নিতে
অনুভবে তন্নতন্ন করে গেঁথে নিতে
শুধু সেই কবিই সক্ষম ছিলেন।
এ এক বহুমাত্রিক চেতনার প্রকাশ!
সমুদ্রশাসিত কবি অতলান্তিক চেতনায়
ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটি ছোট্ট দ্বীপ
সেন্ট লুসিয়ার ক্যাস্ট্রিজ শহরে জন্মেছিলেন,
বিশ্বকে বিস্মিত করে পেলেন নোবেল পুরস্কার,
ক্যারিবিয়ান কবি ডেরেক অনটন ওয়ালকট।
আজন্ম সমুদ্র - প্রেম পার্থিব দর্শন
ইংল্যান্ড আফ্রিকীয় শিকড়ের টান
ছিঁড়েখুঁড়ে নতুন সত্তা গড়েছিলেন,
জীবনকে দেখেছেন কত না বিচিত্র আবহে,
তাঁর বর্ণিল চেতনার বিস্তারের পরিধি বহুমাত্রিক।
সেই দ্বীপ সাম্রাজ্যে ঔপনিবেশিক শাসন ছিলো ,
সৃষ্টির আখ্যানে বিরল জাদুর একক চেতনা
গড়ে উঠেছিল ঈশ্বরের মত স্বয়ম্ভূ এককে।
'আ ব্ল্যাক পোয়েট ফ্রম দ্য ক্যারিবিয়ান '
অমরত্ব - আইডেন্টিটি দিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে,কলম্বাসের আবিষ্কৃত সে দেশ আমেরিকার উপনিবেশ হয়েছিল।
ইতিহাসের পরিব্রাজক তিনি আফ্রিকা ইংল্যান্ডের শিকড় ছিঁড়ে খাঁটি ক্যারিবিয়ান!
দ্বীপজ মৃত্তিকার অতল গভীরে শিকড়ের জাল পেতে ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান জেলে,বেশ্যা, ভূমিপ্রভুদের নিখুঁত
টাটকা তুলে এনেছেন সুদক্ষ জেলের মতন।
অথবা এ যেন ইতিহাসে মহা পরিভ্রমণ, তীর্থযাত্রা।
'ওমেরস '(Omeros) মহাকাব্যিক কবিতা
ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান ইতিহাস পরিভ্রমণের
সেই মহান তীর্থযাত্রার কবিতা,
আলোড়ন তুলেছিলো নোবেল প্রদান কমিটিতে।
সমগ্র পৃথিবীর বিচিত্র সংস্কৃতি যাত্রার প্রভাব আবিষ্কার
আর হালের ক্যারিবিয়ান
আইডেনটিটি গঠনে এতে কতখানি প্রভাবিত
তারই সন্ধানী ছিলেন ওয়ালকট।
ইতিহাসের বিবর্তন আর ক্যারিবিয়ানদের প্রতি
সমুদ্র সমুুদ্র ভালোবাসা কবিতার পূণ্যশ্লোক হয়ে
কবিকে আন্দোলিত করেছিল, কারণ তিনি জানতেন
কবিতা জীবন সাধনার মার্গ ও মন্ত্রোচ্চারণ,
ক্যারিবিয়ানদের উন্মত্ত সামুদ্রিক তরঙ্গের
অভিঘাত মুখর নোনা মৃত্তিকায় শিকড় মেলে
পূর্বজ অত্যাচারী ইংরেজ আফ্রিকানদের
ঘৃণা করেছেন নোবেলজয়ী কৃষ্ণাঙ্গ কবি ওয়ালকট।
কবিতার শরীরে অনুরণন কেবলই
ঐতিহাসিক বর্ণিল ঘটনার,
নিয়ামক এরা কাব্যিক সৃজনে।
আফ্রিকায় পূর্বপুরুষদের ক্রীতদাসদের আক্রমণ,
ইউরোপীয় আক্রমণ নেটিভ আমেরিকানদের, ফ্রান্সের যুদ্ধজাহাজ ব্রিটেনের ওপর —
এসব আরো কতসব কুৎসিত
হত্যা মৃত্যু প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়,
ধাক্কা দেয় তাঁকে শোণকারী উপনিবেশের পত্তন।
হায় ক্যারিবিয়া! হায় ক্যারিবিয়ান!
দ্বীপ- সমুদ্র সঙ্গমজাত বিচিত্র সংস্কৃতির জনগণ, ক্লিন্ন ক্লেদাক্ত পরিচিতির,
মৌলিক সত্য মিস্টিক জাদুময়তা,
তাঁর সৃষ্টির চত্বরে চত্বরে অভিনব অনুরণন তোলে ।
কবি আইডেনটিটির সন্ধানী,
ক্যারিবিয়ানদের মাঝে জন্ম আইডেনটিটি হারিয়ে গেছে তার ঘৃণ্য পরিচয়ে।
কলোনিয়াল সম্মোহনী ঐতিহ্য ওয়েস্ট ইণ্ডিজের
আকাশে বাতাসে সমুদ্রে মাটিতে প্রবাহিত দুরন্ত গতিতে,
ক্যারিবিয়ানদের নিখাদ ভালোবাসাই নিয়ন্তা হলো,
ঔপনিবেশিক ইংরেজ শঠতায় ঘৃণ্য হলো ত্যাজ্য হলো।
ওয়ালকট দ্বীপজ জাদুবাস্তবতা থেকে
সৃষ্টির ঔদ্ধত্যে প্রতিভার সুকঠিন প্রাবল্যে
বেরিয়ে এলেন দুরন্ত পদে—
কারণ তিনি জানতেন ভাষা তার প্রভু ভৃত্যের চেয়ে উচ্চে,
আর কবিতা শ্রেণী, জাতি, অহমের বিরুদ্ধে শাণিত অস্ত্র,
এই অস্ত্রবলে সব সীমা পেরিয়ে কবি স্বকীয় আইডেনটিটি গড়ে তুলতে সক্ষম।
কৃষ্ণকায় দুর্ধর্ষ কবি, ডেরেক ওয়ালকট,
'আ ব্ল্যাক পোয়েট ফ্রম দ্য ক্যারিবিয়ান ',
সমুদ্র বেষ্টিত দ্বীপজ ক্যারিবিয়ানদের আইডেনটিটি, পরিচিতি, সংস্কৃতি, জীবন ও যাপনের কঠোর বেদনা,
অত্যাচারিত নোনা জলের ইতিহাস নিয়ে কবিতা লিখলেন।
নির্যাতিত সেই আদিবাসী জনের ডায়ালেক্ট স্বচ্ছন্দে
ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার করে সাবলীল মহান সৃষ্টি করলেন।
ওয়ালকট বিশ্ব কবিতার সুমহান একক স্রষ্টা জাদুকর।
তাঁকে কবিতার কোন স্কুলের বা গোষ্ঠীর বলা যাবে না।
নোবেল বিজেতা তাঁকে মৃদুকণ্ঠে হয়তো কেউ কেউ বলেন —ন্যাচারালিস্টিক, এক্সপ্রেশনিস্টিক, সুররিয়ালিস্টিক, ইমেজিস্টিক, হারমেটিক অথবা কনফেশনাল কবি, বা মেটাফিজিক্যাল রিয়ালিস্ট।
একটা কথা কিন্তু সবার জানা
বিশ্ব কবিতার অবিসংবাদিত মহান জাদুকর তিনি।
ভবিষ্যতের ছায়ালিপি
রোদ্দুরে রোদ্দুরে আজো কিছু ছায়া দোলে
আলপথে ধানের শিষে পা মাড়িয়ে কারা যায়
অতীত হারিয়ে বর্তমানে আগামীর স্বপ্ন দেখে
শক্ত চোয়াল চোখে আগুন ভবিষ্যতের কথা বলে
আগামী অবশ্যই ফুলেল হবে না আগুন খেলা চলবে
শিরা ধমনীতে রক্তের ঢেউ উথলে উঠবে জানি
পৃথিবীর পাঁজরে কত ইতিহাস লেখা হয়েছিল
আরো লেখা হবে আমরা তা জানি
শিলাস্তরের ভাঁজে ভাঁজে রক্ষিত সেসব
একদিন প্লেটোনিক স্তরের দামাল বিক্ষোভে
বিক্ষিপ্ত হবে কোথায় কেউ তা জানিনা
শুধু জানি বহু বিপ্লব হবেই হবে
তুমি এলে
বন্ধুর পথ হেঁটে ক্লান্ত যখন
দুদিনের জন্য পান্থশালায়
বিশ্রাম নিতে থেমেছি
তুমি এলে এক ঝলক আলো
আমার দশদিক যখন আঁধারে কালো
জানি তুমিও বড়ো ক্লান্ত
তবু তোমার মুখে হাসি মাখামাখি
শুকতারার মত উজ্জ্বল স্পষ্ট দুটি চোখ
এলে তবু আমি অভিমানী
জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো
এতোদিন কোথায় ছিলে
অজানা তুমি মুহূর্তে মনে হলো
বহুকাল আগে তোমাকেই তো
পাশে পেতে চেয়ে আকুল হয়েছি
আজ বেলাশেষে এলে
একমুঠো জুঁই ফুলের গন্ধ
আজ বেলাশেষে এলে
অবারিত নীলাকাশ নিয়ে
চলো দুজনে মিলে ডানা মেলি
বড় একা মনে হয়
বড় একা মনে হয়
সমুদ্র স্রোতে ভেসে আসা ফেনিল বেলাভূমে
মৃত্যু ঘুমে শুয়ে থাকা শিশু আইলানের মত
আমার অগ্নিলা নেত্রপল্লবের অন্দর থেকে
দুর্ধর্ষ স্রোতে বু্দবুদ স্বপ্নের অবিরল ধারা
আজন্ম চেনা প্রিয়দের ছেঁড়াখোঁড়া সমাধির
ঘাসে ঢাকা মাটির অলিন্দে ছায়া ছায়া
ঘুরপাক খায় কঙ্কালের আবছা শরীরে।
যে দুজন মানব মানবীর রোদেলা স্বপ্ন আমি
এই পৃথিবীর হলুদ স্বপ্নিল ঘাসের অরণ্যে
ঘাসের সংসারে জন্ম নিয়ে খেলেছি বেড়েছি
বহুদিন হল তারা ঘুম ঘুম সমাধির অন্ধকার ঘরে
ঘুমিয়ে পড়েছে ন্যাতানো ঘাসের গন্ধহীন অবর্ণিল
আকারে তারপর মাটিতে মিশে মাটি হয়ে গেছে।
মাটি হয়ে গেছে সে পুরুষ সঙ্গী
একটা জীবনের স্বল্প পরিসর বাদে
সবটা নিয়েই যে বড় স্পষ্ট হয়ে ছিল,
এই হয় এমনই হয় ঘাসের সংসারে।
বড় একা হয়ে যেতে হয়
একদিন অতীতের দুর্ভাগা স্বপ্নদের জঞ্জালে,
আমি এক পৃথিবী মৃত্যুর মুখ দেখেছি
ইচ্ছে হয় একটি একটি করে সব নাম
প্যাপিরাসের পাতায় লিখে মিশরের পিরামিডে
সংরক্ষণ করে রাখি আগামী পৃথিবীর জন্য
কঠিন বটে বড় সুকঠিন।
পিরামিডগুলোও তো জমকালো সমাধিসৌধ
বহু বহু কাল বহু বহু জনের শ্রমে হয়েছে নির্মাণ
নির্মিতি কৌশল সংরক্ষিত হয়েছে পরম্পরা ক্রমে,
সেই সব শ্রমজীবীদের সমাধি ছিল
নদীকূলে ঘাসেদের সংসারে
বহতা নদীর তীব্র স্রোতে গিয়েছে হাড়গোড়সহ
সবই কোথায় ভেসে কে জানে!
এইতো পৃথিবীর সরল ধারাপাত।
ভবিষ্যৎ
আমার দু ' মুঠো আলতো করে ধরেছে
অনেকগুলো হামিংবার্ড
দুটি হাত উপচে ঝরছে সুরের ঝর্ণাধারা
আমার দুুটি চোখের পাতা আবেশে মুদে গেলো
পরতে পরতে স্বপ্নের মসলিন
নরম করে শুয়ে পড়লো
আছে আমার একটা পৃথিবী
তাতে মানচিত্র আঁকা কত না দেশ
আছে আমার স্বপ্ন মোড়া একটাই দেশ
সবুজ শ্যামল কোমল মধুর
পারিজাতের মতো নকশাদার এ দেশ
ছিলো একদিন
তোমার মুঠো ভর্তি ছিলো কত না সংকেত
রাশি রাশি গাণিতিক জটলা স্বর- ব্যঞ্জনবর্ণের
অগুনতি ঝোপ ঝাঁড়
স্বপ্নের মত কোমল দেশটিতে
উঠলো আচমকা ঝড়
আগুনের মত ঘূর্ণিঝড়
মানুষগুলোর শরীর কুঁচকে দুর্গন্ধ বেরোল
বুনো পশুর মত আর
কোন সংকেতে দেশটাকে মুহূর্তেকে
ধূসর মরুভূমিতে বদলে ফেললো
সব বদলে যাচ্ছে
নীলকণ্ঠ পাখি আর কোথাও নেই
দোয়েলের গান কান্না শোনায়
সারাটা পৃথিবী বদলে যাবার ষড়যন্ত্রে মগ্ন
তৃতীয় বিশ্ব শোষণের শিকার
এই আমার পৃথিবী তোমার ভবিষ্যৎ