সুবর্ণ আদিত্য এর কবিতা
সুবর্ণ আদিত্য এর কবিতা

গন্ধ চুরি হাওয়া নিরঙ্গম

ঘুমের ভেতরেও ঘুমিয়ে গেছিলাম...দেখি, একটা স্বচ্ছ সাদা কাঁচ ঘেরা ঘর। চারপাশে সৈন্য-সামন্ত। বেয়াড়া শতশত ফাইল এনে রাখছে আমার সামনে। কে আমি? সামনের বিশাল মার্বেল পাথরের টেবিলে নেমপ্লেটে আমার নাম। মাথার উপরে ফটো বাধাই করা। বিভিন্ন ট্যাগ বলছে আমি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। 

 

 

অন্তত কুড়ি বছর এগিয়ে এসেছি জীবন থেকে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও একজন কৃষক হিসাবে সফল ছিলাম। সেই অভিজ্ঞতাই কাজে লাগিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। ভাল বীজ বাছাই করে, জমি প্রস্তুত করেফসল বুনতে থাকলাম। সব চারারই সমান যত্ন-আদর পরিচর্যার পাশাপাশি উপড়ে ফেললাম সব আগাছা।

 

 

সারাদেশ আমাকে দেখে হেসে উঠলোআমি ফসলের হাসি দেখে কেঁদে ফেল্লাম।

 

০২

দুম করে একটা পানশালায় ঢুকে পড়লো আমার মাথা। হাত বলছে বোতল ছোঁবো না, জিহবা বলছে স্বাদ নাও। মস্তিষ্কের দাবি তার পান করা জরুরি। সরাইখানার শেষপ্রান্তে রবীন্দ্রনাথের সাথে শেখ মুজিব, আইনস্টাইন, জুলিয়াস সিজার, নিউটন, ম্যারাডোনা, পেলে, হোমার, সক্রেটিস আর চে গুয়েভারাকে দেখতে পেলাম। একটেবিল থেকে আরেক টেবিলে ছুটে চলেছে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। আমাকে দেখেই থমকে গেল, থমমত খেল। ওর কান মলে দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই সামনে পড়লো মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ- সজোরে থাপ্পড় মেরে দিলাম। নেহেরু, প্যাটেল আর গান্ধী কাচুমাচু করে পায়ে পড়ার অবস্থা। চে হাসতে হাসতে ঠোঁট থেকে চুরুটটা বের করে হাত বাড়িয়ে দিল, কাঁধে হাত রেখে আরেক হাতে মদের গ্লাস নিয়ে উল্লাসে ঝাপিয়ে পড়লাম। ওপাশ থেকে মেরিলিন মনরোকে দেখা যাচ্ছেতার টিপটা, ফ্রকটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখেই কেন্ট উইন্সলেট নার্গিস ফাকরিকে সাথে নিয়ে আমাদের আড্ডায় এলো...

 

 

হঠাৎই কলকল স্বরে মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেনআমার চোখে-মুখে হিমশীতল জল।

.

০৩

ইতিহাসের সাথে সাথে ঘুমিয়ে গেলে বাংলার সাতশ শতক রিল্পে হচ্ছে চোখে। চোখ মেলে দেখি আমি রাজা শশাঙ্ক। ধুধু, শুধু গাছপালা, বনে-অরণ্যে, নদীতে শিকার করছে মানুষ। একটা হাই তুলে আবার ঘুমিয়ে গেলাম।

 

 

১২শ শতকে আমি ইংল্যান্ডের এক মজুর। দরদামে, কমদামে কিনে নিল এক তাতার। রাজার সিংহাসনে বাতাস করি। রাজকন্যার জন্য বাগান থেকে ফুল এনে দেই। রাতে যুবরাজের হেরেমে সুরা পরিবেশন করি। বিজ্ঞান তখনো অন্ধ। আবার ঘুমিয়ে যাই।

 

 

১৭শ শতকে ঘুম ভাঙতেই দেখি পৃথিবীতে আলো ফুটতে শুরু করেছে। আমি বড় রাষ্ট্র পত্তন করে ফুটনোট হয়ে উঠছি সংবিধানে। সাগর দাপিয়ে যাচ্ছি জাহাজে, আকাশ কাঁপিয়ে হয়ে উঠছি রাইট ভাতৃদ্বয়। দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধ শেষে ক্ষতবিক্ষত হয়ে এখন আমি ফেইসবুকের চ্যাটিংবক্স।

 

 

এখন মসজিদের ইমামের কাছে ছুটতে হবেপানিপড়া না খেলে পরীক্ষায় নির্ঘাত ফেল করবো।

.

০৪

সেদিন, দিন পেরিয়ে রাত আসবেএমনটাই হবার ছিল কিন্তু ঝলমলে রোদ্দুর নিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে হেঁটেছিলাম বাগানে। বাগানের কোনো ফুল ঝরে পড়েনি, কোনো পাতাএমনকি গাছগুলিও ছিল বিপুল প্রাণ শক্তিতে স্বচ্ছন্দ।

 

 

আমি ফুলের দিকে এগিয়ে যেতেই তীব্র সুবাস নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিল থকথকে শিউলি। নাকে ঘ্রাণ নিতেই পৃথিবী পরিবর্তন হয়ে গেল। দেখলামভালোবাসা ছাড়া আর কোনো সত্যি নেই। পৃথিবীতে কোনো জড়া নেই, দূর্ঘটনা নেই-খবরের কাগজেও মন খারাপের কোনো সংবাদ নেই। এমন সময়েই চা-পাতারা জোনাকের মিছিল নিয়ে কাপে চলে এলো। চুমুক দিতেই আমি হয়ে গেলাম প্রাচীন অরণ্য।

 

 

আমার ভেতরে বয়ে যেতে থাকলো ম্যানগ্রোভ, তামাম বৃক্ষরাজি, পাখিকূলের কলতান, কলকল স্বরে রোদ, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডসহ সব শাদা শাদা দৃশ্য। বুকের মধ্যে অরণ্য নিয়ে আমিই পৃথিবী হয়ে উঠলাম...আমার নতুন পৃথিবীতে মানুষ অন্যের ভেতর বাঁচে, পশুপ্রাণীর ভাষায় সুর, গাছেরা-মাছেরা একসাথে হাততালি দেয়।

 

 

চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমি আরও বৃহৎ অরণ্য হয়ে উঠছি...

.

০৫

পাথর বিছানো এক পথ দিয়ে হাঁটছিলাম। পথটা সোজা নদীতে মিলিয়ে গেছে। অন্ধকার একটা নদী, স্রোত নেই, আলো নেই। পার হবার নৌকো নেই। মা, ওপাড়ে। ছড়ি নিয়ে দুলে দুলে ঢেউ পাঠিয়ে দিচ্ছেন আমাকে। কাগজের ফুলে মায়ের নাম লিখে ছেড়ে দেই পানিতে। পানি 'মা'- হয়ে ওঠেন।

 

 

একদিকে যুদ্ধ চলছে। আমার গায়ে যুদ্ধের পোশাক। কোমরে তলোয়ার। আমি যুদ্ধ করতে পারি না। হেরে যাই। যুদ্ধ নিজে আমার কাছে হেরে যায়। একটা ফুলবিক্ষিপ্ত স্বর নিয়ে কথা বলতে পারেকেউই জানতে চাইলো না।

 

 

স্বপ্ন থেকে স্বপ্ন হয়ে, মায়ার ভেতর দিয়ে যাই। মা আমার যুদ্ধ বোঝেন না। আমি যুদ্ধ চিনি। নীল চিঠি নিয়ে আসে এক টিয়াবন্ধু। আর কোনো যুদ্ধ যেন না হয় এমন প্রত্যাশা রেখে ঈশ্বর লিখেছেন আমাকে।

 

 

ভোরের আযানের সাথে সাথে সিরিয়ায় সিরিজ বোমা হামলার বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংবাদ সম্মেলন দেখি...

.

০৬

ঘুমাবো বলে চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো পৃথিবীর বাইরে চলে গেলাম। মেঘের একটা ভেলা নরম করে ভাসিয়ে নিচ্ছে আমাকেচোখ মেলে তাকালাম সাদা আসমানে...ভেসে ভেসে গিয়ে থামলাম সবুজ পাহাড়ে। পাহাড়ের বুকচিতিয়ে বইছে কান্নার ঢেউ, ফুলের গুঞ্জনে মৌপাখিদের সম্ভাষণ...এখানের সব পাখিই সাদা। এমনকি ফুল-পাতা, ঝিড়ি পথের নীল পানিতে নূড়ি পাথরের নিক্বণমনে হচ্ছে কেউ মাদল বাজিয়ে যাচ্ছে ধ্যানে। সুর এমনই তীর্যক যেকোনো সময় হাতের ভাষায় জেগে উঠবে নদী। আমি নিজেকে নদী ভেবে মিহি হয়ে গেলাম।

 

 

আমাকে ভালোবেসে পাহাড়ের চূড়ায় কান্নার তুফান ছড়িয়ে একের পর এক বাঁধা পেরিয়ে ঝর্নাটা এঁকেবেঁকে নান্দনিক বিস্ময়ে আমার বুকে আছড়ে পড়তে লাগলো। আমরা প্রেমী হয়ে উঠলাম। এক ধ্যানমগ্ন শুকনো পাতালিখে চলেছে আমাদের গন্তব্যের ইতিহাস...


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান