গল্পকার : রাজীব চৌধুরী
১.
আজ থেকে বছর পনের আগের ঘটনা। দেশের একটি বহুল প্রচলিত দৈনিকের শেষ পাতায় একটি ছোট্ট নিখোঁজ সংবাদ ছাপা হয়েছিল। সংবাদ টি ছিল-
“ নিখোঁজ সংবাদ
ফয়েজ ও তনয় নামে দুই বন্ধু ভ্রমণ করার নাম করে ঘর থেকে বের হয়ে গেছে মাস দুয়েক আগে। এই দুইমাস ওদের কোন খোঁজ নাই। ওদের পরিবার এটা নিয়ে বেশ শঙ্কিত। এই ব্যাপারে পুলিশের কাছে জিডি করা হলেও নিখোঁজ ঘটনার কোন অগ্রগতি হয়নি। তনয়ের গাঁয়ের রঙ কালো। নাক বোঁচা। ক্ষীণ শরীর। মোটা পেট। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ভ্রুতে একটা কাঁটা দাগ আছে। ফয়েজ এর শরীর উন্নত। লম্বা চওড়া শরীর। উচ্চতা পাঁচ ফুট আট। চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা পরে। কপালে একটা ছোট বেলার কাটা দাগ ভ্রু পর্যন্ত নেমে গেছে। উভয়েই হালকা ট্রাক স্যুট পরে হ্যাভারস্যাক নিয়ে বের হয়ে গেছে ঘর থেকে। দুইজনেরই গলায় বাইনোকুলার ঝুলানো। এদের কোন সন্ধান পাবার সাথে সাথে নিচে উল্লেখিত ঠিকানায় যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হল।
প্রযত্নে- ফিরোজ আহমেদ ও বকুল সরকার।
১৩২ সতীশ বাবু লেন-চট্টগ্রাম , বাংলাদেশ” ।
সংবাদটি যখন পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের খদ্দেরের চোখ এড়িয়ে অন্য কোন মুখরোচক সংবাদ খুঁজছিল –তখন সূর্যের তীব্র আলো পড়ে ঘুম ভাঙল তনয়ের।
মোটা একটা গাছের আগায় শুয়ে ছিল তনয়। অবশ্য একে ঝুলে থাকা বললে ও মন্দ হয় না। বেচারা গত দুই দিন যাবত চোখের পাতা এক করতে পারেনি। কারণ আর কিছুই নয় খিদে। কাঁধের ব্যাগে যে শুকনো খাবার ছিল তা দুইদিন আগে শেষ হয়ে গেছে। দুইমাস যাবত আছে সে এই এলাকায়। এই দুইমাস পাকা কুমড়ো কাঁচা খেতে হয়েছে। আর যখনি মুখে অরুচি ধরেছে তখনি খেয়েছে চিড়া আর গুড়। আর বেচারা তনয়ের চিড়া গুড় আর কাঁচা কুমড়া খেতে খেতে চেহারাটা হয়েছে দেখার মত। শুকিয়ে
হাড় বের হয়ে গেছে গলার পাশে। মুখের খোলতাই নেই-সেখানে গাল ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে গেছে।
পানির দেখা পায়নি তনয় পুরো একটা দিন। দুইদিন আগে এক পাহাড়ি ঝর্ণা দেখে সেখান থেকে পানি ভরে নিয়েছিল বোতলে। রাতে সেই পানি শেষ হয়ে গেছে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে এখন জিহ্বাটাকে শক্ত পাথরের মত লাগছে ওর।
গাছের অন্যপাশে ফিরে সে খুঁজতে শুরু করল ফয়েজ কে। কিন্তু সেখানে ফয়েজ নেই। গাছে ডাল গুলো ভাল মত খুঁজল তনয়। কিন্তু খুঁজে পেলোনা কাউকেই। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল তনয়ের। ফজু ওরফে ফয়েজ ওর খুব কাছের বন্ধু দের অন্যতম। সেই ফয়েজ কে সাথে নিয়ে বের হয়েছিল অভিযানে। আর সেই বন্ধু ই নেই-দেখে কেমন যেন করে উঠল তনয়ের মনটা।
গাছের নিচের দিকে চোখ যেতেই মনের অজান্তে হেসে উঠল তনয়। ফয়েজ বেচারা উপুড় হয়ে গাছে ঝুলে ঘুমাতে ঘুমাতে নিচে কখন পড়ে গেছে বুঝতেই পারেনি সে। আর পড়বি তো পর আগের রাতে জ্বালানো আগুনের উপরে। ভাগ্যিস আগুন অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর সেই আগুনের ছাইয়ের উপর পড়ে কালি ঝুলি মেখে একাকার সে।
অনেক ডাকাডাকির পর ফয়েজ এর ঘুম ভাঙল। সাথে কোন আয়না ছিলনা তনয়ের। থাকলে ফয়েজ কে নিজের চেহারা দেখানো যেন। সাদা চামড়ার উপর কয়লা মেখে একেবারেই ভুতের মত দশা হয়েছে তার। হাসতে হাসতে তনয়ের পেটে খিল ধরার দশা তা দেখে।
গাছ থেকে নেমে ফয়েজ কে আগের দিনের জমিয়ে রাখা গাছের মুল পরিবেশন করল তনয়। এই সব খেতে ফয়েজ এর অরুচি থাকলে ও খিদের কাছে সব পরাজিত হল। তাই উদ্ভিদ বিজ্ঞানে দারুণ উৎসাহী তনয়ের নতুন আবিষ্কার কড়ই গাছের মুল খেতে বেশ লাগল তার। যদিও বা খাবারটা গিলতে অনেক কষ্ট হল ফয়েজ এর। কিন্তু পেটে কিছু না পড়লে একেবারেই চলছে না দেখেই খাওয়া।
বেলা বাড়ছে ধীরে ধীরে। তনয় আর ফয়েজ এগিয়ে চলেছে । কেউ জানেনা ওদের গন্তব্য সম্পর্কে। এমনকি ওরা নিজেরা ও জানেনা কোথায় চলেছে ওরা। শুধু একটা পুরনো পেপার কাটিং থেকে এল্ডোরাডো নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ে প্রথম কৌতূহলী হয়েছিল ফয়েজ।
এল্ডোরাডো বা সোনার দেশ আবিষ্কার এর পাশাপাশি অভিযান করার এক নেশা পেয়ে বসেছিল দুইজন কেই। তাই সোনার দেশ আবিষ্কার করার জন্য বেড়িয়ে পড়ল দুইজনেই। তনয় একদিন চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরীর পুরানো বই এর ডিপোতে একটা প্রাচীন বাংলা বই এর মাঝে প্রথম কাহিনীটা পড়ে। কাহিনী আর কিছুই না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হারিয়ে যাওয়া এক জাহাজ নিয়ে একটা গুজব। একসময় এই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতেই ছিল ভারত উপমহাদেশের ক্ষমতা।যে সময়ের কথা সেই সময় লর্ড কর্নওয়ালিস ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তার প্রধান কাজ ই ছিল ভারতের বিভিন্ন রাজা রাজরা দের আক্রমণ করে লুট করা। আর কোম্পানির রাজত্ব বাড়ানো। বেশির ভাগ সম্পদ ই পাচার করতো ব্রিটেন
এ।
সেই সময় বেশ কিছু দামী মাল পত্র সহকারে একটি বিশাল জাহাজ হারিয়ে গিয়েছিল ভারত মহাসাগরে। অনেকে সেই সময় এই জাহাজের আবিষ্কারের খোঁজে বেড়িয়ে পড়েছিলেন। কারণ তাতে ছিল অঢেল সোনা রুপার মুদ্রা।
এই ঘটনার পর লর্ড কর্নওয়ালিস ৫ জনের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সেই তদন্ত কমিটির একজন ছিলেন রমানাথ মজুমদার। তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি। তিনি চট্টগ্রামের বান্দরবন এলাকায় ঐ জাহাজের দুইজনের লাশ খুঁজে পান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তদন্তের কোন অগ্রগতি না হওয়াতে সবাই মিলে ঐ জাহাজ কে খুঁজে পাওয়া যায়নি এই মর্মে স্মারক পেশ করে। এর পর ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়।
কিন্তু এই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত আছে আরেকটা ঘটনা। কর্নওয়ালিস যে সব রাজাদের সম্পদ লুট করেছিল সেখানেই ছিলেন জয়পুরের মির রাজবংশের শেষ রাজা মীর জঙ্গ। মীর জঙ্গ এর অনেক ধন সম্পদ ছিল। সেই সাথে ছিল অতি আশ্চর্য এক সম্পদ। এটি ছিল একটি পাথরের হাত। হাতটি বেশ সাধারণ দেখতে ছিল। সাধারণ গড়ন। শুধু হাতের কব্জির পর থেকে কিছু অংশ পর ভাঙ্গা। পাথরের খোদাই করা ছিল সেটি।
শোনা যায় মীর জঙ্গ ভয়ানক অত্যাচারী ছিলেন। কিন্তু ছিলেন দারুণ যোদ্ধা। একবার তিনি মেবারের রাজপুতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। সেই যুদ্ধে তিনি ডান হাতটি হারান। কিন্তু যুদ্ধে জয়ী হন তিনি। এরপর নাম না জানা এক তান্ত্রিক উনাকে পাথরের তৈরি একটা হাত ঐ কাটা স্থানে পরিয়ে দেন। এবং একটা তান্ত্রিক অনুষ্ঠান করে সেই হাতটাকে পরশপাথর বানিয়ে দেন।
এর পরবর্তী সময়ে মীর জংগ এক মহাধনশালী রাজায় পরিণত হন। কিন্তু ব্রিটিশদের কাছে কয়েকবছর পরেই সিংহাসন হারান । হারান সেই হাত খানা ও। লর্ড কর্নওয়ালিস সেই হাতখানা মহারানী ভিক্টোরিয়াকে উপহার দেবেন বলে অনেক সোনাদানা সহ পাঠান জাহাজে করে। আর সেই জাহাজটিই ছিল সেই হারিয়ে যাওয়া জাহাজ।
এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। জাহাজটির কোন হদিশ কেউ পায়নি। শুধু লোকমুখে শোনা যায় জাহাজের ক্যাপ্টেন কে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছিল চট্টগ্রামের বান্দরবনের আশেপাশে। সেখানেই তাকে এক অজানা স্থানে কবর দেয়া হয়। সেখান থেকে কিছু নাবিক দিল্লি অভিমুখে রওনা দিয়েছিল। কিন্তু ওরা দিল্লি অব্ধি পৌঁছেছে কিনা সেটা জানা যায়নি। এর মাঝে আরও একটা উড়ো গল্প শোনা যায়। শোনা যায় জাহাজের নাবিক সেই হাত খানা চুরি করে পালিয়ে আসে চট্টগ্রাম অভিমুখে। কিন্তু এসে কি হয় তার কপালে সেটা কেউ জানতে পারেনি।
এর প্রায় দুশো বছর পর এক বাঙ্গালী দম্পতি বান্দরবনের পাহাড়ি অরণ্যে এসে আবিষ্কার করে এক লুকানো গুহা। সেখানেই খোঁজ পায় অনেক গুলো সোনার মূর্তির।এমনকি সেই গুহার ভেতর অনেক গাছপালা ও সোনা দিয়ে তৈরি পাওয়া যায়। সোনার তৈরি জিনিস পত্র গুলো চট্টগ্রামের পুলিশ বিভাগের আয়ত্তে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে বিসিএসআইআর এর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন এই সোনার মূর্তি গুলো এক সময় জ্যান্ত ছিল।স্ক্যান করে সেই মূর্তি গুলোর ভেতর সাধারণ মানুষের মত মস্তিষ্ক- যকৃত এমনকি রক্ত নালী পর্যন্ত সোনায় তৈরি।
কিভাবে এই সব মূর্তি বানানো সম্ভব সেটা নিয়ে যখন বিজ্ঞানী মহলে চলছে নানা গুঞ্জন সেই সময় এগিয়ে আসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজিস্ট দল। উনারা অনেক গবেষণা করে বের করেন সেই পাথরের আশ্চর্য হাতের অস্তিত্ব। কিন্তু সেই গুহার ভেতর অনেক খোঁজা খুঁজি করেও কোন পাথরের হাতের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ফলে কিংবদন্তী হয়েই রইল সেই পাথরের হাতের গল্প।
এই কাহিনী ফলাও করে দেশের জনপ্রিয় পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর পরই ফয়েজ আর তনয় বের হয় অভিযানে। কিন্তু পথ বড়ই দুর্গম এই পাহাড়ি স্থানে। চট্টগ্রাম পার হয়ে এই বান্দরবনে ঢোকার পরপরই ওরা খাবার আর পানিয়ের অভাবে পড়ল। সুপেয় ঝরনা ব্যতীত কোন পানির উৎস নেই কোথাও। স্থানীয় জনগণ কে সাহায্যের জন্য বললে ওরা সাহায্য করে বটে- কিন্তু ওদের খাবার দাবার একেবারেই পছন্দ হয়না ওদের। এর মাঝে এক উৎসবে সব পাহাড়ি মানুষজনদের সাথে ওরা পাহাড়ি মদ খেয়ে দুইদিন ঘুমিয়ে ও কাটিয়েছিল। কিন্তু সেই একটা জিনিস ই ভাল বানাতে পারে ওরা। বাকি সব কিছুই হয় কাঁচা না হলে অর্ধেক সিদ্ধ করে খায় ওরা। ফলে পেট খারাপ হয়ে তনয় একবেলা প্রকৃতির ডাককে উপেক্ষাই করতে পারেনি সামান্য ক্ষণের জন্য।
কিন্তু গহীন বনে প্রবেশ করার পর সেই কাঁচা পাকা খাবার ও পানীয় ওদের নাগালের বাইরে চলে গেল। সাধারণত পাহাড়ি মানুষ গুলো – বিশেষ করে খাসিয়া আর গারো রা পাহাড়ের পাদদেশে থাকে জোট বদ্ধ করে। খুব একটা গভীর বনে ওরা সহজে প্রবেশ করেনা। এক সময় ছিল যখন ওরা বনে বনে শিকার করে বেড়াত। কিন্তু এখন ওরা শিক্ষিত হতে শুরু করেছে। তাই গহীন বনে শিকার করতে যাবার বদলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে যায় ওরা। এই পাহাড়ি বনাঞ্চলে সবচাইতে কষ্টদায়ক হল রাত্রি যাপন। বিকেল বেলা যেটা দেখা গেল পরিষ্কার একটা গুহা- রাত হলেই সেখানে সাপ খোপের আড্ডা জমে ওঠে। আবার সবকিছু ঠিকঠাক- হটাত করে কোত্থেকে হাজার খানেক পিপড়া মিলে আক্রমণ শুরু করে ওদের। এভাবেই রাত গুলো কেটে যাচ্ছিল ওদের।
ওদের দুইজনের হাতে একটা ম্যাপ আঁকা। তবে এই প্রথম গবেষণা করে মানচিত্র এঁকেছে ফয়েজ। অনেক দূর হেঁটে হেঁটে আসার পর দুইজনের কাছেই বড্ড ঘোলাটে লাগতে শুরু করেছে ম্যাপটা। তবে দিকপাল বনে যাওয়া ফয়েজের মতে ওরা সেই বিশেষ গুহাটার বেশ কাছাকাছিই আছে। কিন্তু চারদিন ধরে হেঁটে ও সেই কাছাকাছি বেশ দুরেই রয়ে গেল ওদের। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার তনয়ের সাথে ফয়েজের রাগারাগি হয়েছে। কিন্তু আবার মিলে মিশে খোঁজা শুরু করেছে কিছুক্ষণের মাঝেই।
একটা খাড়া পঞ্চাশ ফুটের পাথুরে পাহাড় থেকে খাদ বেয়ে নিচে নামছে দুইজন এমন সময় তনয় একটা উঁচু মত ঢিবির উপর আছাড় খেয়ে পড়ে ডান হাতের কনুই এ আঘাত পেল। কিন্তু আঘাতের চাইতে বেশি যেটা আক্রমণ করল সেটা হল খিদে আর দুর্বলতা। এতই বেশি দুর্বল হয়ে গেল তনয় যে সেই ঢিবিটার উপরেই পড়ে রইল- উঠতে পারলোনা। কিন্তু হটাত করে তনয় আবিষ্কার করল সে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে মাটির ভেতর। সামান্য একটু নড়াচড়া করতেই আরও দেবে গেল মাটির ভেতর। তৎক্ষণাৎ ফয়েজ ব্যাগ থেকে দড়ি বের করে তনয়কে পড়িয়ে দিল ফাঁস তৈরি করে। আর তারপর অনেক খেটে
খুটে বের করে আনল তনয় কে ডুবো গর্তটা থেকে। আর শুরু হল ফয়েজের পেট ফাটানো হাসি। ফয়েজের হাসি দেখে তনয় রেগে গিয়ে ফয়েজের পেটে একটা ঘুসি দিতে গিয়েও আবার না দিয়েই শুরু করল খিল খিল হাসি। কড়ই গাছের শিকড় গুলোকে আপাত দৃষ্টিতে নিরাপদ মনে হলেও দুইদিন ধরে দুইজনের হাসির মাত্রা যে মাত্রা ছাড়িয়েছে সেটা দুজনেই বুঝতে পারল। পাহাড়ি বনের নির্বিষ গাছ গুলোর হাসির বীজ যুক্ত শিকড় গুলো চিনতে তনয়ের অনেক ভুল হয়েছে-তাতেই এই হাসি।
হাসির মাত্রা ছাড়ানোর আগেই দুইজন দুইজনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হাসি থামাল বেশ কষ্টে। তারপর সেই গর্তের কাছে এসে দাঁড়াল দুইজনেই। দেখল তনয় আসলে একটা কাঠের টুকরার উপর হোঁচট খেয়ে পড়েছে ঢিবিটার উপর। তনয় ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট শাবল বের করে খুঁড়তে শুরু করল গর্তটা। যেন কাঠের টুকরোটার শেষ দেখে ছাড়বে সে। এদিকে কাঠের টুকরো টার বেশ নিচে চলে গেল তনয়। ভয়ে গর্তের বাইরে থেকে খুঁড়তে শুরু করেছিল সে। তাই খানিক পরেই বুকে ভর দিয়ে মাটির উপর শুয়ে খুঁড়তে শুরু করল সে।
এদিকে ফয়েজ মনে মনে যেন কি সব চিন্তা করে চলেছে। একবার ভাবছে-আরেকবার হাতের ভাঁজে থাকা ম্যাপটার দিকে তাকাচ্ছে। কিছু একটা মেলাতে শুরু করেছিল এমন সময় তনয়ের খোঁড়াখুঁড়ির যায়গা থেকেই কাঠের উপর আঘাতের শব্দ হতেই ছুটে গেল সে ওখানে।
গিয়েই দেখল তনয় দাঁড়িয়ে আছে একটা কাঠের কফিনের উপর।ধীরে ধীরে অবয়ব পেয়েছে কফিন আকৃতির বাক্সটা। এটাকে পেয়েই যেন তনয় বিশাল গুপ্তধন পেয়ে গেছে মনে করে আনন্দে লাফাতে শুরু করল। এদিকে ফয়েজ বেচারা অনেক আশাহত হল। মনে করেছিল গল্পের বইয়ের মত কিংবা সিনেমার মত কোণ গুপ্ত ধন পেয়ে গেছে। কিন্তু পেল একটা মরার কফিন। ভেবে নিজের কপাল কে দুষতে শুরু করল।
এদিকে কাঠের কফিনটা তনয়ের পঞ্চান্ন কেজি ওজনের শরীরের ভর সহ্য করতে না পেরে মর মর করে নিজের অপারগতা জানান দিল। সাথে সাথে ফয়েজ আর তনয় মিলে কফিনের ডালা খুলতে লেগে গেল। কিন্তু অনেক ভারী সেই কাঠ যেন কিছু একটার সাথে লেগে আছে। শেষে খালি হাতে না পেরে শাবলটা দিয়ে চাড় দিতেই খটাং করে খুলে গেল কফিন টা। আর ডালা খুলে উঠে বসল একটা শতচ্ছিন্ন পোশাক পড়া কঙ্কাল। আর সেটা দেখে চিৎকার করে দুইজনেই পড়িমরি করে দিল এক দৌড়। ফয়েজ গেল উত্তরদিকে। আর তনয় ছুটতে ছুটতে আরেকবার আছাড় খেয়ে তবেই থামল।
খুব একটা ভয় ডর নেই দুইজনের। কিন্তু এই গহীন অরণ্যে ঘুরতে ঘুরতে সঞ্চিত সাহসের অনেকটাই খুইয়েছে ওরা। আর যেই এই কঙ্কাল বাবাজি উঠে বসল- সেই দুইজনে পড়িমরি করে দিল ছুট।
মিনিট দশেক পর দুইজনে দুইদিক থেকে ধীরে ধীরে লুকিয়ে লুকিয়ে আসল কঙ্কালটার সামনে। দেখল কঙ্কালটা আগের মত করেই বসে আছে। ঠিক তখনই ফয়েজের মনে পড়ল – অনেক বছর ধরে লাশ কফিনে রাখলে লাশ পচে যে গ্যাস সৃষ্টি হয় সেই গ্যাস হটাত করে মুক্তি পেলে সজোরে বেরিয়ে আসে আর লাশের বা কঙ্কালের উপরিভাগকে ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে ঠেলে দেয়। এটা ফয়েজ তনয় কে বলতেই তনয় আবার হাসতে শুরু করেছিল। কিন্তু ফয়েজ তনয় কে সজোরে ধাক্কা মারতেই সে থেমে গেল। আর সাথে সাথে চোখ গেল কঙ্কালটার গলায় ঝোলানো একটা লকেটের দিকে। কিন্তু প্রথমেই ছুঁয়ে দেখার মত ভুল করলোনা ওরা।
কঙ্কালটাকে বেশ ভাল মত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল দুইজনে। শরীরে তার শতচ্ছিন্ন ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানির সেই লাল সাদা পোশাক। মাথায় শতচ্ছিন্ন টুপি। আর হাত দুটো ভাঁজ করে বুকের উপর রাখা। হাড় গুলো অনেক নরম হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে পর্যবেক্ষণ শেষ হতেই তনয় কঙ্কালের গলা থেকে লকেট টা খুলে হাত নিলো। সোনা খুঁজতে এসে এই প্রথম সোনার দেখা পেল ওরা। চকচক করে উঠল সোনার তৈরি লকেটটা। কিছু না পেলে এই কঙ্কালের সাথে সোনার লকেটটা নিয়েই বাসায় ফিরবে ভেবে ধেই ধেই করে নাচা শুরু করে দিল ওরা। আরও আনন্দ বেড়ে গেল ফয়েজের যখন দেখল কঙ্কালটার বেশির ভাগ দাঁতই সোনায় বাঁধানো।
কিন্তু হটাত করে আনন্দ নাচ থেমে গেল তনয় ফয়েজের।কারণ কঙ্কালটার দাঁত ছাড়াও দাঁতের মাড়ির বেশির ভাগই অক্ষত আছে কারণ সেগুলো সোনায় বাঁধানো। কেউ দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধালেও মাড়ি সোনা দিয়ে বাধায় না। ভাবতে ভাবতে হটাত করেই ফয়েজ লাফ দিয়ে উঠল। কারণ সেই পরশপাথরের হাত ছাড়া কোনভাবেই এই মাড়ি সোনায় রূপান্তরিত হওয়া সম্ভব নয়। যার মানে এই কঙ্কালের সাথে সেই পাথরের হাতের সংযোগ আছে কোন না কোন ভাবে।
তনয়ের হাত থেকে কঙ্কালের গলা থেকে খুলে আনা লকেট টা হাতে নিলো ফয়েজ। কম করে হলেও তিন ভরি ওজন হবে বলে মনে মনে আন্দাজ করল ফয়েজ। লকেটটা খুলে ফেলল ফয়েজ। আর সেখান থেকে বের হয়ে আসল দুটো ছবি। অনেক পুরানো ছবি দুটো এখন আর অবশিষ্ট নেই। তবে পুরুষ লোকটি এই কঙ্কাল হলে মহিলার ছবিটি এই কঙ্কালের প্রেয়সীর- জাহাজ খানা হারিয়ে যাওয়াতে উনাদের মাঝে বিচ্ছেদ হয়েছিল বলে ধরে নিলো ওরা।
কি মনে করে তনয় কঙ্কালটার সারা শরীরের জামা কাপড় তল্লাসি চালানো শুরু করল। শতচ্ছিন্ন পোশাকটার কিছুই অবশিষ্ট রইল না তনয়ের খোঁচাখুঁচিতে। শেষে এ পকেট ও পকেট খুঁজে পেয়ে গেল একটা পুরনো চামড়ার কেস। আর কেসের ঢাকনা খুলতেই বেরিয়ে আসল একটা পুরনো আমলের বই। তনয় অসাবধানে প্রথম পাতাটা উল্টাতেই ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে পড়ল পাতাটা। দুই নম্বর পাতাটা তে ল্যাটিন ভাষায় কিছু একটা লেখা আছে। ক্রুশ বিদ্ধ যিশুকে আঁকা দেখেই বুঝে নিলো ওরা যে এটা একটা বাইবেল-যেটা এই কঙ্কালটা থেকে ঢের বেশি পুরনো।
বাইবেল টা নষ্ট হয়ে যাবে মনে করে আর উল্টাতে ছিলোনা ওরা। ফয়েজ সেই চামড়ার কেস বন্দী করে নিজের পকেটে রেখে দিল। এবার নিরাশ করল কঙ্কাল সাহেব। আর কিছুই পাওয়া গেলনা কোন পকেটে। উল্টো ভ্যাপসা একটা পচা গন্ধে দুইজনের নাক বন্ধ হবার জোগাড় হল। এবার আর কি করা। কঙ্কাল সাহেব কে উনার শান্তির ঘুমের স্থানে আবার জোর করেই শুইয়ে দিল ফয়েজ। তনয় গর্তের উপরে উঠে এসেছিল। আর যেই না কঙ্কালটাকে শোয়াল ফয়েজ সাথে সাথে ফয়েজ কঙ্কালটা সহ রিভলভিং দরজার মত করে ঘুরে চলে গেল বাক্সের ওপাশে। আর এপাশ থেকে বেরিয়ে আসল আরেকটা কঙ্কাল। এই দেখে তনয়ের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। প্রাণ প্রিয় বন্ধুকে এভাবে উদাও হয়ে যেতে দেখেই বুকের ভেতর ধক করে উঠল তনয়ের। যেন একটা হার্ট বিট মিস করল সে।
২.
“ফয়েজ- ও ফয়েজ !”
ভয়ে ভয়েই চিৎকার করে হাঁক দিল তনয়। কিন্তু কোণ সাড়া শব্দ নেই কফিনের ওপাশ থেকে।
“ ফজুরে- ও ফজু- কই তুই?” বলেই ফয়েজের কণ্ঠ শোনার জন্য অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। তারপর মনের অজান্তেই কেঁদে ফেলল তনয়।
নাহ কোন সাড়া শব্দ আসছেনা। তাহলে কি ফয়েজ কে সারা জীবনের জন্য হারাল তনয়? তাহলে যে এই অভিযান বার্থ হয়ে যাবে।
আবার চিৎকার দিল তনয়-“ ফয়েজ-জ-জ-জ-জ-জ”
চারপাশের পাহাড়ে শব্দটা বাড়ি খেয়ে বার কয়েক প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসল তনয়ের কাছে। আর সাথে সাথে একটা গোঙ্গানির শব্দ শুনতে পেল তনয়। আর সাথে সাথে যেখান দিয়ে ফয়েজ প্রবেশ করেছিল সেখানটায় হাত দিয়ে চাপ দিতেই তনয় কে নিয়েই দরজাটা ঘুরে গেল উল্টো দিকে। আর তনয় গিয়ে পড়ল একটা সিঁড়ির উপর। পিচ্ছিল সিঁড়িটার উপর পড়েই বাচ্চাদের মত গড়াতে গড়াতে একেবারে গিয়ে পড়ল ফয়েজের ঘাড়ে। সবে মাত্র উঠে বসেছিল ফয়েজ। গড়িয়ে পাথুরে মেঝেতে পড়ে অনেক ব্যথা পেয়েছিল সারা শরীরে। আর উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তনয়ের পঞ্চান্ন কেজি ওজনের চাপে একেবারে বেহুঁশ হয়ে গেল সে।
৩.
হাতরে হাতরে ম্যাচ বাক্স থেকে শলাকা বের করে ফস করে আগুন জ্বালাল তনয়। খানিক আগে সে উঠে বসেছে পাথরের চাতালের উপর। নিচে ফয়েজ কে দেখে ঝাঁকি দিল বার কয়েক সে। কিছুক্ষণের মাঝেই দুইজনেই উঠে দাঁড়াল- কাঁধে হ্যাভারস্যাক নিয়ে।
এরমাঝেই তনয় আবিষ্কার করল ওর শরীর ভেজা। গরম পানির একটা ধারা বয়ে চলেছে ওদের নিচ দিয়ে। হটাত করে বাচ্চা কালের বিছানায় প্রস্রাব করার রোগটা ফিরে এসেছে বলে ঠাহর করেছিল সে। কিন্তু ফয়েজের শরীর ভেজা দেখে মনে স্বস্তি ফিরে পেল সে।এত প্রস্রাব তনয় কিংবা ফয়েজের নয় কেবল মাত্র কোন দৈত্যের করা সম্ভব ভাবতে ভাবতে ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে জ্বালাল সে।
টর্চ জ্বালিয়েই দেখল ওদের নিচ দিয়েই বয়ে গেছে হালকা গরম জলের একটা সুপ্ত প্রস্রবণ। পানি কিছুটা গন্ধ যুক্ত। হয়ত কোন ধাতু ধুয়ে আসছে এই পানি।এদিকে তনয়ের দেখাদেখি ফয়েজ ও নিজের ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে নিয়েছে।
দুটো উজ্জ্বল আলোতে অন্ধকার যায়গাটা খানিকটা আলোকিত হল। তাতেই ওরা দেখল এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের হাতের ছাপ, হাতুড়ি, শাবল। কয়েকটা মশাল ও দেখা গেল দেয়ালে। মানুষের এই গুহাতে আসার নিশ্চিত প্রমাণ এগুলো। যায়গাটার দেয়াল মানুষের শাবল আর গাঁইতির আঘাতে এই অবস্থায় এসেছে বলেই ধারনা করল দুইজন।
ফয়েজ দ্রুত দেশলাই দিয়ে দুটো মশাল জ্বালিয়ে নিলো। তনয় কে দিল একটা। এবার পুরো গুহাটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। যদিও দেখার মত কিছুই নেই। উপরে নিচে ডানে বামে চারপাশে শুধু পাথর আর পাথর। আর নিচে ওদের গোড়ালি ডুবে আছে গন্ধ যুক্ত পানিতে। পায়ের নিচের দিকটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল তনয়। তনয়ের দেখা দেখি ফয়েজ ও হাত দিল। দেখল নিচটা একেবারে মসৃণ। আর এর মানে এখানে শখানেক বছর আগেও এই পানির স্রোত ছিলনা। কোন এক প্রাকৃতিক কারণে তৈরি হয়েছে এটা। আর যেহেতু একবার প্রবেশ করেছে সুতরাং কোন না কোন একদিক দিয়ে বের হয়ে ও গেছে এটা।ভাবতে ভাবতে ফয়েজ ওর ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে নিয়ে একটা কাগজ বের করে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলে দিল পানিতে। তারপর সেই কাগজের টুকরো গুলোর পেছন পেছন হাটতে শুরু করল দুইজনে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে ফয়েজ আর তনয়। পাথুরে পথে খানা খন্দ পেরিয়ে ধীরে ধীরে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে কাগজের টুকরো গুলো। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ওরা তিনটা গুহামুখে এসে দাঁড়াল। পানির স্রোত চলে গেছে তিনটা গুহা মুখের ভেতরেই। গুহা না বলে ছোটখাটো সুরঙ্গ বলাই ভাল। কারণ একটাতেও তনয়ের মত পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির লোক সোজা হয়ে দাঁড়ানোর যায়গা নেই।
কিন্তু এখন কোন পথে যাবে ওরা? সামনে তিনটা সুরঙ্গ। জানা নেই কোথায় গিয়ে থেমেছে এগুলো। কি মনে করে তনয় ফস করে একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে ছুড়ে মারল একটা গুহা মুখে। কিন্তু কিছু হলোনা। সামনে থাকা সুরঙ্গ টাতে আরেকটা জ্বলন্ত কাঠি ছুড়ে দিল সে। এবার ও কিছুই হলোনা। তাই বেশ অসাবধানে আরেকটা কাঠি সবচাইতে ডানের সুরঙ্গটাতে ছুড়ে দিল তনয়। আর সাথে সাথে ঘটল ঘটনাটা। গ্যাসের চুল্লির মত করে আগুন জ্বলে উঠল পুরো সুরঙ্গ জুড়ে। সেই আগুন হটাত করেই ছুটে আসল ওদের দিকে। ফয়েজ কোন রকমে মাটিতে পিঠ পেতে শুয়ে পড়লেও তনয় কিছু করার আগেই আগুনটা সজোরে ধাক্কা দিল ওকে। তাতে খড়কুটোর মত উড়ে গিয়ে ধাক্কা খেল অপর পাশের পাথুরে দেয়ালে। আর তনয়ের শরীরে হটাত করেই আগুন লেগে গেল। দ্রুত ফয়েজ উঠে গিয়ে পানি ছিটিয়ে দিল তনয়ের গায়ে। তাতে আগুন নিভে গেল দ্রুত। কিন্তু তনয় বেশ আঘাত পেল ঘাড়ে আর পিঠে।
কিছুক্ষণ তনয়ের সেবা শ্রুশ্রষা করার পর সে কিছুটা সুস্থ বোধ করতেই ওরা রওনা শুরু করল। প্রথমেই বাম পাশের গুহাটাতে এগিয়ে গেল ওরা।যে দুটো গুহাতে আগুন লাগেনি সেই গুহা দুটোকেই নতুন তৈরি হওয়া গুহা বলে ধরে নিলো ওরা। আর তাই এখানে কোণ বিষাক্ত গ্যাস জমে ছিলনা। আর আগুনের কারণ ছিল বিষাক্ত মিথেন। এই মিথেন গ্যাসের কারণে চীনে প্রতি বছর হাজারো খনি শ্রমিক মারা যায়। মানুষ ব্যাবহার করেনি দেখে এই গুহাতে সেই গ্যাস জমেছিল। তনয়ের ব্যাপারটা খেয়াল ছিল বলেই সে আগুন ছুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু মনে ছিলনা যে আগুন লাগলে এই গ্যাস বোমার চাইতেও জোরালো ভাবে বিস্ফোরিত হয়।
প্রথম গুহাতে ফয়েজ আর তনয় এগিয়ে চলেছে দুটো মশাল হাতে। দুইজনেই কুঁজো হয়ে আছে। হাটতে হাটতে দুইপাশের শ্যাওলা পড়া দেয়াল গুলো দেখছিল ওরা। কিন্তু ফুট দশেক যাবার পর হাটার রাস্তা চেপে এলো। একজন মানুষ হাটার যায়গা ও হচ্ছেনা সেখানে। ধীরে ধীরে দুইজনেই হামাগুড়ি দিয়ে হাটতে শুরু করল। আর সামান্য কিছুদূর গিয়েই শেষ হয়ে গেল সেটা। ওরা হয়ত খেয়াল করেনি। করলে দেখতে পেত পায়ের নিচে মাটি শুকনো। পানির ধারা শেষ হয়ে গেছে বেশ খানিকটা আগেই।
৩.
নিরাশ বদনে ফেরত যাচ্ছে দুইজনেই। তবে একটা আশা জাগানিয়া ব্যাপার ঘটেছে। ফয়েজ দেয়ালের পাথরের খাঁজে একটা পুরনো ডায়েরি পেয়েছে। টানা ল্যাটিন ভাষায় পেন্সিলে লেখা ডায়েরি। বিনা বাক্যব্যয়ে সেটা চালান হয়ে গেছে ফয়েজের পকেটে।
বের হয়ে এসে দুই নম্বর সুরঙ্গে হাটা শুরু করল দুইজনেই। এবং এই প্রথম সুরঙ্গের ভেতরে প্রাণের বিস্তার দেখে দুইজনের ই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। কারণ ত্রিশ ফুটের মত যাবার পর দেখল দেয়াল থেকে ঝুলছে শয়ে শয়ে মানুষের কঙ্কাল। বছরের পর বছর ঝুলে আছে কঙ্কাল গুলো। যাদের একসময় প্রাণ ছিল- মায়া ছিল- মমতা ছিল। ছিল কত আশা-হতাশা। কিন্তু আজ ওরা ঝুলে ঝুলে সুরঙ্গের ভেতর শোভা বর্ধন করছে।
যত এগোচ্ছে ওরা ততই হাড্ডির যাদুঘর তার নিজের রূপ শোভা বর্ধন করছে। যতদূর আলো যাচ্ছে তত দুর শুধু হাড্ডি আর হাড্ডি। কঙ্কালের সুরঙ্গে ঢুকে তনয়ের বুক ঢিব ঢিব করে উঠল। সাহসী মানুষের অভিনয় করলে ও অনেক ভীতু সে। কিন্তু ফয়েজের টিপ্পনী কাটা সহ্য করতে হবে বলে দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে যেতে লাগল ফয়েজের পেছন পেছন।
ধীরে ধীরে এই সুরঙ্গটার আয়তন বেড়ে চলেছে। বেড়ে চলেছে দুইপাশের হাড়ের যাদুঘরের কারিশমা। কোথাও দেয়াল থেকে মাটি পর্যন্ত সব মাথার খুলি- কোথাও সব কোমরের হাড়। এসব যখন দেখছিল ঠিক তখন পিলে চমকানো একটা চিৎকারে দুইজনের ত্রাহি অবস্থা শুরু হল। হটাত করেই কে যেন বলে উঠল-
“ এসো ও ও ও ও ও ও”
শব্দ শোনার পর খেয়াল করল একটা বড় হল ঘরের মত স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। আর শব্দ টা এসেছে ওদের সামনে থেকে। একটা গুহা মত যায়গাতে একটা কুপি বাতি জ্বলছে। আলো ছায়ার ভেতর যেন কেউ একজন বসে আছে। আর শব্দটা এসেছে সেই মানুষ কিংবা অন্য কিছু একটার মুখ থেকে।
“ এসো- এসো- ও ও ও ও”
ডাকটা গুরু গম্ভীর। ভয় পাওয়ানোর জন্যই হোক বা বাস্তবেই হোক- এই শব্দ যে করেছে সে পুরোপুরি সফল। ফয়েজ আর তনয়ের ভয়ে শরীরের ঘাম বের হয়েছে। ফয়েজের চোখের উপর গোল ফ্রেমের চশমাটা নাচতে শুরু করেছে। আর তনয়ের পা দুটো কাঁপা কাপি করছে নিজেদের ইচ্ছে মত। কিন্তু এতদূর এসে ভয় পাওয়া কুকুরের মত পালিয়ে যাবার পাত্র ওরা নয়। তাই ফয়েজ দ্রুত মশালের আলোতে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো চারপাশ। যখন দেখল চারপাশে আর কেউ নেই তখন ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মানুষটার দিকে।
৪.
সুরঙ্গের একেবারে শেষ মাথায় চওড়া একটা অংশে বসে আছে লোকটা। ধীরে ধীরে দুইজনেই এসে থামল লোকটার সামনে। বিশাল হলঘরের মত যায়গাটাতে লোকটা যে অভিনেতা-আর ফয়েজ তনয় কে সাথে নিয়ে শয়ে শয়ে কঙ্কাল হল দর্শক।
লোকটার চেহারা ভয়ানক। সারা শরীরে গোঁফ দাঁড়ির জঙ্গল। মুখে বুকে পিঠে নেমে এসেছে লম্বা লম্বা চুল দাড়ি। নির্ধারিত স্থানে যায়গা না পেয়ে ইচ্ছে মত এদিক সেদিক এগিয়ে গেছে সেগুলো।চোখ আর কপালে সিন্দূর দিয়ে ভরে রেখেছে। আলো ছায়ার মাঝে দেখে ভয়ানক লাগছে অনেক। পাশে রাখা একটা ত্রিশূল আর একটা মাত্র প্রদীপের কাঁপানো আলো পরিবেশটাকে ভয়ানক করে তুলেছে। লোকটার পেছনেই পড়েছে ওর বিশাল কালো ছায়া। যেন কেঁপে কেঁপে জানান দিতে চাইছে যে সে তার মালিকের চাইতে ঢের বেশি ভয়ানক।
হটাত করেই ফয়েজ আর তনয় দুইজনেই লোকটার পেছনেই শুনতে পেল একটা গোঙ্গানির মত শব্দ।
“এসো- নেত্র হীনা তান্ত্রিকের রাজ্যে তোমাদের স্বাগতম”।
বাক্যটা শুনতেই ওদের চোখ গেল তান্ত্রিকের চোখের উপর। সেখানে চোখ নেই। চোখের পাতার উপর চোখ আঁকা সুনিপুণ হাতে। হয়ত এর নিচে কোণ অক্ষিগোলক নেই ওর। দেখেই ভয়ে ঢোক গিলল তনয়। ফয়েজের অবস্থা তথৈবচ। দুইজনেই পাই করে ঘুরে চলে যেতে শুরু করবে এমন সময় একরাশ ঘোলাটে ধোঁয়ায় ভরে গেল ওদের চারপাশ। সাথে সাথে দুইজনের একসাথে মাথা ঘুরতে শুরু করল। নেত্র হীনার হা হা করে বিকট হাসি সেই ঘূর্ণনে নতুন মাত্রা যোগ কর। দুইজনেই একসাথে অজ্ঞান হতে শুরু করল। শুধু তনয় অজ্ঞান হবার আগে দেখতে পেল তান্ত্রিকের পেছন থেকে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা কুচকুচে কালো কুকুর। এর পর আর কিছু মনে নেই ওর।
৫.
চোখ পিট পিট করে আলো সয়ে নিলো তনয়। আলো অনেক বেশি। অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল সে। তাই আলোটা চোখে লাগছে অনেক।ধীরে ধীরে চোখ সয়ে আসতেই ডানে বামে তাকাল সে। দেখল সেই সময়েই ফয়েজ ও জেগে উঠেছে। আর ওরা শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে। আর সেটা মনে হতেই ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। দেখল সামনে জড়ো হয়েছে ফয়েজ আর তনয়ের মা বাবা। সবাই উদ্বিগ্ন ছিল ওদের নিয়ে-বেশ ভাল মতই বুঝতে পারল ও। এমন সময় পাশ থেকে পুলিশের পোশাক পরা একজন গম্ভীর চেহারার লোক বলে উঠল-
“ অবশেষে জ্ঞান ফিরল না? কেমন হল অভিযান? আমরা না থাকলে তো মরতে বসেছিলে তোমরা। চোখের পলকে নেত্র হীনা ডাকাতের কঙ্কালের সংগ্রহ শালার অতিথি হয়ে যেতে দুইজনেই”।
ফয়েজ ও উঠে বসেছে কণ্ঠ টা শুনে। আর সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল সাংবাদিক দের ফটো তোলার শব্দ। চারপাশে গুঞ্জন। আর সেই সাথে একের পর এক প্রশ্ন। কর্তব্য রত ডাক্তার অনেক কষ্টে সাংবাদিক দের সেখান থেকে তাড়ালেন। দুইজন কে সেদিন ই ছেড়ে দেয়া হল। কিন্তু ছাড়লেন না পুলিশ ইনস্পেক্টর। দুইদিন পরেই থানায় হাজিরা দিতে হবে ওদের। তবে হাজিরা নেবার ব্যাপারটা পুলিশ নিজেই ওদের বাসায় গিয়ে করে নেবে বলে যেতে দিল ওদের। তারপর দুইজনেই নিজের নিজের বাসায় ভদ্র ছেলের মত রওনা হয়ে গেল। পেছনে পড়ে রইল হাজারো প্রশ্ন। প্রশ্ন গুলো একের পর এক জট পাকাতে শুরু করেছে ফয়েজ আর তনয়ের মনে। কিন্তু কেউ দয়া করে বলে দিচ্ছেনা কি হয়েছিল ওদের। শুধু সাংবাদিক দের প্রশ্নের আঘাতে মনে হচ্ছে বিশেষ কিছু একটা ঘটে গেছে এর মাঝেই।
২ দিন পর:
চট্টগ্রাম এর কোতোয়ালী থানার সাব ইনস্পেক্টর আনিস রহমান বসে আছে ফয়েজের বাসায় লিভিং রুমে। উনার সামনে ভাল ছেলের মত হাত পা গুটি সুটি করে বসে আছে ফয়েজ। তনয় বসে আছে প্রশ্নালু দৃষ্টি নিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুরু করলেন আনিস সাহেব-
“ তোমরা যে কাহিনীর পেছনে ছুটেছ সেই কাহিনী ঘটেছিল আজ থেকে সাড়ে তিনশো বছর আগে।জয়পুরের রাজা মিরজঙ ছিলেন দক্ষিণ ভারতের প্রতাপশালী রাজা। মারাঠি আর গুজরাটি রক্ত মিশে ছিল উনার শরীরে। কেউ কেউ মনে করেন তৈমুর লঙ এর সাথে উনার রক্তের স্রোতের কোণ একটা সম্পর্ক ছিল। তাই হয়ত মনে কোন দয়া মায়া ছিলনা উনার। যদিও এলাকায় মসজিদ মন্দির প্যাগোডা তৈরি করে উদারতার পরিচয় দেন তিনি- কিন্তু খাজনা দিতে না পারলে সোজা শুলে চড়িয়ে দিতেন প্রজাদের। এভাবে দিনের পর দিন রাজার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রজারা বিদ্রোহ করে। রাজাকে রাজ্য হারা করতে রাজা সভাসদ দের মাঝেই ষড়যন্ত্রের শুরু হয়। বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করলে মির জংগ নিজেই বিদ্রোহ দমন করেন। কিন্তু যুদ্ধে নিজের ডান হাত খানা হারান তিনি।
হাত হারিয়ে রাজা একেবারেই মুষড়ে পড়েন। যেন রাজা কথায় কথায় মানুষের চোখ উপড়ে ফেলতেন সেই রাজা হাত হারিয়ে একেবারেই ভেঙ্গে পড়াতে রাজ্যে অস্থিরতা জেগে ওঠে। সেই সময় রাজ্যের মন্ত্রী সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজাকে একটা নকল হাত বানিয়ে দেবার পরামর্শ দেয়া হল।
যেই কথা সেই কাজ। একে একে রাজা কে তামা-লোহা- দস্তা সব কিছু দিয়ে হাত বানিয়ে দেয়া হল। কিন্তু খুশি কোনভাবেই কেউ করতে পারেনা।
হটাত করে এক তান্ত্রিক সারা শরীরে সিন্দূর মেখে রাজার কাছে হাজির। সে এসে রাজাকে বলে যে সে এমন একটা হাত বানিয়ে দিতে পারবে যে রাজা এতটাই খুশি হবে যে নিজের কন্যাকেই তুলে দেবে তান্ত্রিকের হাতে।
নিজের হাতের জন্য রাজা মির জংগ এতই পাগল ছিলেন যে উনি সাথে সাথে তান্ত্রিক যা চায় সব দেবেন বলে কথা দিয়ে ফেললেন। আর তান্ত্রিক শুরুকরে দিল হাত বানানোর কাজ। রাজ্যের সেরা খোঁদাই মিস্ত্রি দিয়ে সেই তান্ত্রিক বানাল একটা সাধারণ কাঠের হাত।
কিন্তু সেই হাত পড়ানোর পর অন্য সব সাধারণ হাতের মতই মনে হওয়াতে রাজা খেপে যান। তখন তান্ত্রিক রাজার কন্যার মাথা চেয়ে বসে। আসলে সেই তান্ত্রিক ছিল কামরূপের শয়তান সাধক। সে সাধনা করত বর্তমানের সিলেট অঞ্চলের গহীন অরণ্যে। সেই আমলে এই এলাকা কামরূপের অধীনে ছিল। সে অনেক ক্ষমতা শালী হলেও আরও ক্ষমতা পাওয়ার জন্য তার রাজ বংশীয় কন্যার মগজ নিয়ে সাধনা করার দরকার হয়ে পড়েছিল। তাই সে রাজা মির জঙ্গের কাছে এসেছিল ছলা কলা করে মির জঙ্গের কন্যা সায়েরা বানুকে নিয়ে যাবার জন্য।
কিন্তু রাজা মির জংগ ছিলেন জাত ক্রোধান্ধ। নিজের মেয়ের মাথা চাইছে শুনেই তিনি তান্ত্রিক কে হত্যার নির্দেশ দেন। কিন্তু রাজার সামনেই কয়েকশো দক্ষ সৈন্যকে শুধু মাত্র মন্ত্র বলে হত্যা করতে দেখে ঘাবড়ে যান রাজা। শেষে নিজের কন্যা সায়েরা বানুকে তান্ত্রিকের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন তিনি।
এর পর এক অমাবস্যা রাতে সায়েরা বানুর মাথা কেটে নিয়ে তান্ত্রিক রাজা মির জঙ্গ সহকারে রওনা হয় জঙ্গলে। সেখানে একটা খোলা যায়গাতে সে সাধনা করতে বসে। সেই রাতেই সে চরম ক্ষমতা লাভ করে। সায়েরা বানুর মাথার রক্ত মিশিয়ে সে একটা আশ্চর্য প্রলেপ তৈরি করে। সেই প্রলেপ রাজার সেই পাথরের হাতে মাখিয়ে দিতেই সেটা প্রচণ্ড ক্ষমতা শালী হয়ে যায়। সেই হাতের ছোঁয়াতে সব কিছু সোনাতে পরিণত হতে শুরু করে। সেই প্রথম পৃথিবীর বুকে প্রথম বার কেউ পরশ পাথরের সন্ধান পান। এর আগে ইউরোপের ডাইনিরা কুমারী কন্যার মগজের সাথে ফসফরাস মিশিয়ে পরশ পাথর আর সোনা বানাতে চেয়েছিল। কিন্তু সবাই অসফল হয়েছিল। কিন্তু এই শয়তানি শক্তি প্রদত্ত হাত রাজার ভাগ্য পরিবর্তন করে দেয়। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে সেই কাহিনী। রাজা হয়ে ওঠেন মহা ঐশ্বর্য শালী। কিন্তু রাজা মন থেকে বেরিয়ে আসে মায়া মমতা।
প্রতিটি ঘরে ঘরে হাহাকার পড়ে যায়। রাজা যা খুশি তাই সোনায় পরিণত করতে শুরু করেন। এতে রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। আর এই সুযোগে লর্ড কর্নওয়ালিস জয়পুর আক্রমণ করে। আর মির জংগ কে হত্যার আগে তার হাত দুখানা কেটে নেয় সে। কারণ শয়তানি শক্তি বলে ধীরে ধীরে পাথরের হাতে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন তিনি। মীর জঙ্গের শরীরের সাথে প্রায় জোড়া লেগে গিয়েছিল হাতটা।এর মাঝে হাতটা কাটতে গিয়ে মীর জংগের স্পর্শে দুইজন ইংরেজ সৈন্য সোনায় পরিণত হলে লর্ড কর্নওয়ালিস রাজার শরীর থেকে হাত দুইটা কেটে সাবধানে একটা কাঁচের কেসের ভেতর পুরে নিয়ে রেখে দেয় নিজের আয়ত্তে।
হাতটা দিয়ে লর্ড কর্নওয়ালিস নিজের উপরে উঠার সিঁড়িটাকে মসৃণ করার চিন্তা করে। রানী এলিজাবেথ কে হাত খানা উপহার দেবে বলে সে বিশাল এক রণতরী সাজায়। আর তাতে অনেক ধন সম্পদের সাথে এই হাতটা ও সে কাঁচের ভেতর করে পাঠায় ইংল্যান্ড অভিমুখে।
কিন্তু সেই জাহাজ ভারত সাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে। অনেক কসরত করে জাহাজের নাবিক দস্যুদের কাছ থেকে রক্ষা করে জাহাজটা। কিন্তু কিছুদিন পরেই বিশাল এক ঝড়ে পড়ে পথ হারায় ক্যাপ্টেন। সে এসে ভিড়ে বনকন্দ ই হরিকেল এ। আজকের চট্টগ্রাম বন্দরে। আর সেখানে এসে বুঝতে পারে ক্যাপ্টেন পথ হারিয়েছে। সবকিছুর মাঝে সেই হাত সমেত কাঁচের বাক্সটা নিয়ে ক্যাপ্টেন বেশ কয়েকজন সৈন্য নিয়ে রওনা দেয় পায়ে হেঁটে দিল্লি অভিমুখে। কিন্তু চট্টগ্রামেই সে আবার পথ হারিয়ে এসে পড়ে বান্দরবনে। আর সেই হাতের জন্য নিজেরাই নিজেদের মাঝে মারামারি করে মারা যায় প্রায় সবাই। এর মাঝে শুধু বেঁচে ছিলেন সেই জাহাজের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ডুরেইন সাহেব। তোমরা যেই লাশকে পাশ কাটিয়ে সেই গুহাতে প্রবেশ করেছ-সেটাই ছিল ডুরেইন সাহেবের লাশ।আর সেই ডুরেইন এসে আশ্রয় নিলো কার কাছে জানো? সেই তান্ত্রিক এর কাছে- যে এই হাতটা তে ক্ষমতা এনে দিয়েছিল। সেই তান্ত্রিক ডূরেইন কে মেরে হাতটাকে নিজের কব্জায় আনে।
এর পরের ঘটনা তো তোমরা জানো। বান্দরবনের মলয় ছড়ির জঙ্গলে সেই খান দম্পতি আবিষ্কার করে অনেক সোনার তৈরি মানুষ। আর আসবাব পত্র। আসলে এই হাত দিয়েই সব মানুষ কে সোনায় রূপান্তরিত করেছিল নেত্র হীনা নামের সেই পিশাচ সাধক।
এর মাঝেই আমাদের ইনভেস্টিগেশন টিম আমাদের জানায় কেউ একজন মূর্তি গুলো পাচারের জন্য সেখানে রেখেছিল কয়েকদিনের জন্য। কিন্তু কে রেখেছিল সেটা আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এর মাস তিনেক পরেই আমরা যখন শুনলাম তোমরা দুইজন গিয়েছ সেই সোনার হাতের খোঁজে তখন আর বসে থাকতে পারলাম না। তোমাদের পেছন পেছন লেলিয়ে দিয়েছিলাম ডিবি পুলিশের বিশাল বাহিনী। আমার মাঝে কেমন যেন একটা আত্ম বিশ্বাস চলে এসেছিল তোমাদের উপর। আমার মনে হচ্ছিল তোমরা পারবে। আর পেরেছ ও তাই। তোমাদের ট্র্যাকিং করে আমরা পৌঁছে যাই নেত্র হীনার আস্তানায়।
সেই নেত্র হীনা তান্ত্রিক ছিল আসলে ভুয়া। তান্ত্রিকের বেশে একটা গুণ্ডা। তার কাছেই ছিল হাতটা। সেই হাতের কারিশমা দিয়ে সে বিভিন্ন প্রাণীকে সোনায় পরিণত করতো। তারপর পাচার করে দিত বিভিন্ন দেশে। এছাড়া ও পার্বত্য চট্টগ্রামে সবসময় সে দাঙ্গা ফ্যাসাদ বাধিয়ে রাখত যেন আমাদের চোখ এড়িয়ে সে চালিয়ে যেতে পারে চোরাচালানি। আসলে ওর কোণ ক্ষমতাই ছিলনা। ছিল আসল নেত্র হীনা তান্ত্রিকের। এই তান্ত্রিক ভুয়া ছিল। নেত্র হীনা সেজে সে এই সব চোরাচালানি করতো। তোমরা যে সব কঙ্কাল ওর গুহায় ঝোলানো দেখেছ ওগুলো সব পাহাড়ি নয়তো বিভিন্ন টুরিস্টের। এই সব মানুষ কে মেরে ওদের চোখ –কিডনি বিক্রির মত কুকাজে ও সে ছিল সিদ্ধ হস্ত।
তোমাদের ও ওর বাহিনীকে দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিল বড় বড় কাঠের চাইয়ের সাথে। ফয়েজের পেটে আঘাত করার আগেই আমি বাহিনী নিয়ে প্রবেশ করি সেখানে। তারপর তো সব জলের মত পরিষ্কার। তোমাদের কে নিয়ে আসলাম মেডিক্যাল এ।
ও ফয়েজ যে ডায়েরিটা পেয়েছ সেটা ছিল ডুরেইন এর। সেই ডায়েরি পড়েই আমি এত কাহিনী জেনেছি। আর যে বাইবেলটা তুমি পেয়েছ সেটার মাত্র দুইটা কপি আছে পৃথিবীতে। মনিষী বেলমন্ড মোট ছয়খানা বাইবেল নিজের হাতে কপি করেছিলেন আজ থেকে আটশো বছর আগে। এর মাঝে মাত্র একটাই আছে রোমের ক্যাথলিক চার্চে। আর আরেকটা আছে তোমার হেফাজতে। আমি সেটাকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করব। কারণ তুমি সেটা পড়তে গেলেই ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে শেষ হয়ে যাবে অমূল্য গ্রন্থটা।
আর নেত্র হীনা ডাকাত কে ধরিয়ে দেবার জন্য সরকারী তরফ থেকে তোমাদের বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সাথে তোমাদের সাহায্যে পাওয়া সেই পাথরের হাত টাকে রাখা হয়েছে জাতীয় জাদুঘরের ঢোকার একেবারে প্রথম ঘরেই। সেখানে তামা খণ্ডে খোঁদাই করা আছে তোমাদের দুই জনের নামও। দুই দিন ধরে নিশ্চয়ই খবরের কাগজ পড়ে বুঝতে পেরেছ সব।
উম ম ম – আর দয়া করে এর পরে কোণ অভিযানে গেলে অন্তত আমাকে জানিয়ে যেও” বলেই উঠে পড়লেন ইন্সপেক্টর সাহেব।
এরপর সেই ডায়েরি আর বাইবেল টার কি হল? উম-ম-ম সেটা আরেকটা গল্প। সেটা জানতে হলে ফয়েজ আর তনয়ের পরের অভিযানের কাহিনী পড়তে হবে কিন্তু। ততদিন না পড়ে থাকতে পারবে তো? ...
(সমাপ্ত)