হাফিজুর রহমান এর কবিতাগুচ্ছ
হাফিজুর রহমান এর কবিতাগুচ্ছ

কবি : হাফিজুর রহমান

তেরোই নভেম্বর

 

গেরুয়া মাটির বারান্দায় শোওয়ানো 

আব্বার নিথর শরীরটাকে

সারারাত আগলে রেখেছিলেন তিনি,

বরাবর যেমন থাকতেন ছুঁয়ে মনে ও মননে,

চেতনাচেতনে অপার মায়ায় !

 

পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাতখানি দিয়ে তাঁর সব জ্বরা-ক্লান্তি

জীবনের দাহ ঢেকে রাখতেন পলকহীন অনন্য অপেক্ষায় --

ক্লান্তি নেই শ্রান্তি নেই

কোন অভিযোগ নেই...

শুধু মধ্যবয়সিনী সেবাব্রতী প্রেম

তাঁকে জাগিয়ে রাখত দীর্ঘদিনরাত !

 

বুঝিবা সেই অগণন দীর্ঘ-পথশ্রমের

হঠাৎ বিশ্রামে সারাটা শরীরে নেমেছিল

আজ ডানাভাঙা ঘুমের পাহাড় !

 

অবশেষে নতুন একটি দিনের শুরুতে

কুয়াশার মতো ভেজা-আলো এসে

জাগিয়ে দিয়েছে তাঁকে কঠিন বাস্তবে !

 

অবশ হাতখানির নির্জীব আঙুলগুলি

মুহূর্তে বুঝিয়ে দিলো ,

'প্রাণপাখি উড়ে গেছে বিগত সন্ধ্যায়...'

 

দিনের আলোয় জড়ো হলে ব্যথাহত সকল স্বজন,

অবশেষে তাঁকে যেতে হলো চলে অনন্ত আড়ালে ;

সেই বীভৎস আঁধারে আম্মার নিষ্কম্প ওষ্ঠ্য

শুধু মৃদু মৃদু উঠেছিল নড়ে --

ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাযিউন !

 

সেই থেকে তাঁর পৃথিবীটা ছিল খুববেশি শব্দহীন !

ইচ্ছে হয়, যাই...

 

রাত-বিরেতে হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে

গভীর জঙ্গল তবু আমার অধিকতর প্রিয়

পথ-হারানোর পথের শেষের নাম কি জঙ্গল

অনন্য বৃক্ষের সারি, ফুল,পাখি,পাতার মর্মর

গোধূলির রঙে আঁকা একটা অনন্ত বিকেলবেলার

হারানো পথের পরে হেঁটে হেঁটে হয়তোবা পৌঁছে যাবো

সত্য-সুন্দরের সেই ভগ্নটিলার মতন পোড়ো-বাড়িটাতে,

যেখানে অনাদি অতীতের রোদ জমে জমে এখন বিবর্ণপ্রায়

ইট-কাঠ-বর্গাগুলি বড্ড ধুলিধুসরিত, বিবর্ণ-মলিন...

 

রাত-বিরেতে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নিয়ে

বড়ো সাধ হয়, একবার নিজেকে নাহয় হারিয়েই দেখি...

কোনটিকে মনে হয় অধিকতর নিজস্ব মানবিক, অনন্য লৌকিক

সভ্যতার বর্তমান বিকৃত ফসিল,

নাকি হারানো-পুরনো সেই দিনের বৈভব

অতীতের কৌটাভরা এক মায়াময় জীবনের হরিৎ সংসারসুখ,

প্রশান্ত নদীর মতো ছোট ছোট ঢেউয়ের হাসি, নৌকার ছপাতধ্বনি

জীবনযাপণে সাধারণ সেই মৌন সুখ-বিহ্বলতাগুলি !

 

ইচ্ছে হয়, একবার হারিয়েই খুঁজে ফিরি হারানো জীবন

ইচ্ছে হয়, একবার ফিরে যাই অতিক্রান্ত জীবন-জোয়ারে

পথে নেমে উল্টোরথে চাপি, হারাতে হারাতে খুঁজি সত্যের শরীর

রাত-বিরেতে হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও, যাই...!

উড়াল-কাহিনী

 

মুখখানি যেন নিটোল জলের দিঘী

ডুব দিয়ে তার অতলে কেইবা যাবে

তবু জল বলে,এসো ডুব দাও শিঘ্রী

গভীর-জলেই অযুত রতন পাবে !

 

দুই হাতে জ্বলে আদিম বেদনাকুসুম

দৃষ্টিতে কাঁপে পুষ্পারতির আকুতি

অচিন অধরে লোভাতুর অগ্নিধুম

জ্বলছে ভীষণ জন্ম-জন্মের স্মৃতি

 

তবু মুখোমুখি ভাবি বসে অন্তহীন

কী হবে আর স্মৃতির বেদনা বয়ে,

নাহয় বরং হই আকাশে উড্ডীন

সকল স্মৃতি ও শ্রুতিমধুরতা লয়ে

 

সেই বুঝি ভালো, অন্যরকম আলো

ইথারে ইথারে বাজুক মধুর ব্যঞ্জনা

পৃথিবী-পৃষ্টের সব বিরূপতা, কালো

মনে হবে যেন দূরতম কোন রঞ্জনা

 

তাই হোক, তবে তাই হোক, কল্পলতা

উড়ে চলি, ভুলে সকল মর্ত্য-বিরূপতা


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান