হাসনা হেনা'র তিনটি অনুগল্প
হাসনা হেনা'র তিনটি অনুগল্প
১. মৃৎপাত্রের সুধা


আকাশ জুড়ে মেঘের দাপাদাপি , বাতাসে মন্থর গতি। মেঘশাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটা পরে টুকটুকে লাল সূর্যটা ডুবতে বসেছে । লক্ষী কুপি জ্বালাতে গিয়ে দেখে -কুপিতে কেরোসিন নেই । 
 বৃষ্টি- বাদলের দিন কখন আকাশ ভেঙে অঝোরে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করবে ,বলা মুশকিল । দু'চালা টিনের  খুপড়ি ঘর । ঘরটিতে এক সময় নগেনের ঠাকুরদাদা থাকতেন । তারপর পালাক্রমে নগনের বাবা ।নগেন পেয়েছে তাঁর বাবার কাছ থেকে । ঘরের চালের টিনগুলোর এখন বুড়ো বয়স ।

 জং ধরে ফুটো হয়ে একদম বেহাল অবস্থা । একবার ঘরের চালের ফুটো টিনগুলো বদলাতে অনেক কষ্টে ত্রিশ হাজার টাকাও জমিয়েছিলো নগেন । বড় মেয়েটার পেটের টিউমার অপারেশন করাতে পুরো টাকা টা খরচ হয়ে যায় । তারপর শত চেষ্টা করেও কোন টাকা জমাতে পারেনি সে ।বৃষ্টি হলে ছেলে মেয়ে নিয়ে বিছানা পত্র গুটিয়ে বসে থাকতে হয় । কুপি না থাকলে কোথায় জল পড়ে কী ভিজে যাবে কিচ্ছুটি ঠাহর করা যাবে না । ছোট মেয়েটাও আবার আন্ধার দেখে ভয় পায় । তাই লক্ষী দ্রুত পা চালায়  ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে, পাশের বাড়ির ফঁচুর মায়ের কাছ থেকে কেরোসিন ধার করতে । 
অভাব অনটনের সংসার স্রোতধারায় নগেনের ভালোবাসার খড়কুটো আকড়ে ধরে বহাল তবিয়তে ভেসে আছে লক্ষি ।ওদের সংসারে ভালোবাসার কোন অভাব নেই । সেই যে কিশোরী বেলায় নগেনের হাত ধরে এ'ভিটেয় পা রেখেছিলো লক্ষী । সেই থেকেই এ' ভিটের সাথে নগনের সাথে নিজেকে আষ্টে পিষ্টে বেঁধে নিয়েছে সে ।

নগেন নানা রকম মাটির জিনিস বানায় । এক সময় ভালই আয় হতো । প্লাস্টিকের প্রাত্র বাজারে আসার পর থেকে আস্তে আস্তে মৃৎপাত্রের কদর কমতে শুরু করেছে।  প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। সময়ের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন বিলীন হতে চলেছে এ'শিল্প । আয় কম হলেও বাপ, দাদার  কাছ থেকে শেখা কাজ ছাড়তে পারে না নগেন।নগেন , লক্ষী দুজনে মিলেই মাটির জিনিস বানায়। ছেলে মেয়েরাও হাতে হাতে মা বাবাকে সাহায্য করে ।

 উঠোন জুড়ে ছড়ানো ছিটানো মাটির পাত্র । সন্ধ্যের পর এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে ।মাটির পাত্রে জল জমে আছে ।বৃষ্টিধোয়া শীতল বাতাস হুড়মুড় করে ডুকে পড়ছে লক্ষীর খুপড়ি ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে । ছেলে মেয়েরা গভীর ঘুমে । মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ উঁকি দিয়েছে। প্রকৃতি জুড়ে জ্যোৎস্নার মাখামাখি । নগেন জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় । অবাক করা  চাঁদটা যেন জানলা দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল চোখে ওদের দিকেই  তাকিয়ে আছে । নগেন খাটো স্বরে লক্ষীকে ডাকে -
-"এই ...বউ দেখ দেখ আকাশে কেমন ফকফকা চান্নি উইঠছে। চল বাইরে গিয়্যা চান্নি দেহি । 
লক্ষি আহ্লাদের স্বরে বলে 
-" চান্নি দেইখবার যাইবার পারি , এক শর্তে  !
-" আইচ্ছা !!! ক দেহি তোর শর্ত খান কী ?
-" তুমি যদি দাওয়ায় বইস্যা সুন্দর একখান গান হুনাও 
লক্ষীর হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে নগেন বলে চল হুনামো নে! মাথার ওপর অবাক করা চাঁদ ঝুলছে, নগেনের কাঁধের ওপর লক্ষীর মাথা । নগেন গাইছে লক্ষীর প্রিয় গান ।দুজন বসে বসে চাঁদ দেখছে । সামনেই ছড়ানো ছিটানো  মাটির পাত্রে  ঝলমল করছে জ্যোৎস্না সুধা । আহা !আমার মতো  সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টিও নেই ,লক্ষী বিড়বিড় করে একাই ।






২. নেশা 


রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। লাশের চারপাশে মাছি উড়ছে । শোকের প্রলেপ মেখে এলোপাথারি বাতাস বইছে ।আকাশটাও অদ্ভুত মেঘে গম্ভীর হয়ে আছে। জোর শোরগোল ,মানুষের উপচে পড়া ভিড় । 
অধীক শোকে পাথর এক মা ছেলের লাশের পাশে বসে আছে , নির্বাক নিথর ।এক যুবতি বোন ভাইয়ের জন্য আহাজারি করছে । পুলিশ এসেছে রমজান মিয়ার কোমরে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে ।হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ফুলী ও বাজান ... বাজানরে তুই কই গেলি ? আমারে বাঁচাইতে গিয়া নিজে কেন জীবন দিলি ?

এই তো শেষরাতের দিকে নেশায় বুঁদ হয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরে রমজান মিয়া। । দরজায় জোরসে কড়া নাড়ার শব্দ ।ফুলী আৎকে ওঠে ।
: কে ?
: ঐ খানকির বেটি দরজা খোল ।
 শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে দরজায় লাত্থি দেয় রমজান ।
রমজান মিয়ার বউ ফুলী চটজলদি দরজা খুলে দেয় ।চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ করতে থাকে রমজান ।
 ফুলী চিৎকার করে ওঠে 
: আহ্...লাগতাছে চুল ছাড়ো.... চুল ছাড়ো!
: আগে বল রাইতের আন্ধারে কোন নাগরের লগে ফষ্টি নষ্টি করবার গেছি লি ?জামাইল্যা কইলো তুই নাকি রাইত এগারোটার পর গেন্দুর বাড়ি গেছস  ? 
 
: হ গেছি , তোমারে খুঁজতে গেছি ।মাইয়াঢা সারামাস গার্মেন্টসে কত কষ্ট কইরা মাস শেষে বেতন পাইছে সেই ট্যাকা কটাও  তুমি  চুরি কইরা নিয়া গেছ নেশা করতে।  ট্যাকার অভাবে এই হাঁটুর বয়সী পোলাঢাও পড়াশোনা ছাইড়া দিয়া ওর্য়াক শপে কাম লইছে ।এসব তোমার চোখে পড়ে না !  কেমন বাপ তুমি ? 

: মাগীর তো দেখছি খুব তেজ হইছে মুখে মুখে তর্ক করে। দাঁড়া মজা দেহাইতাছি- এ'বল  মুঠি ছেড়ে দিয়ে , লাঠি দিয়ে ইচ্ছা মত বউকে পিটাতে থাকে রমজান । এসব  যন্ত্রণা ফুলীর  নিত্যদিনের । অনেক বার বাপের বাড়ি চলে গিয়েও থাকতে পারেনি ফুলী। নিষ্পাপ মুখদুটো চোখের দর্পণে দুলতে থাকে ।দুটো রিনরিনে কন্ঠ পথ আগলে দাঁড়ায়  আমাগোরে ছাইড়া যাইও না মা! 

 চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ছেলে মেয়েরা জেগে যায় ।  কতবার বাবার হাত থেকে  মাকে বাঁচাতে এসে যুবতী মেয়েটাও বাবার হাতে মার খেয়েছে হিসেব নেই । ছেলেটাও আজকাল মায়ের উপর অত্যাচার দেখে চুপ থাকে না ।  ফুলীকে মারতে মারতে চুল ধরে টেনে হিচড়ে বাইরে নিয়ে যায় রমজান । মেয়েটা মাকে বাঁচাতে ব্যর্থ  হয় ।মায়ের ওপর হওয়া অত্যাচার সহ্য করতে  না পেরে ।ছেলেটা ঢাল হয়ে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় । বাবাও মাতাল অবস্থায় সাত পাঁচ না ভেবেই জোরসে লাঠি দিয়ে আঘাত করে ছেলের মাথায় । সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছেলে । 
১২-০৫-১৮খ্রী:


৩. চেনা -অচেনা

অফিস থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে মনযোগহীন হাঁটছে লিলি । হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে কারো সাথে জোরসে ধাক্কা খেল সে । বুকের ভেতরটা কেমন ধক করে ওঠলো। একটু অপ্রস্তুত ভাবে ফিরে তাকালো -
চোখে মুখে অদ্ভুত সারল্য নিয়ে সুদর্শন সুঠাম দেহী এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে । 

: আরে ...আরে .. কোন দিকে তাকিয়ে  পথ চলেন ?
কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি এনে লিলি  বলল -
সুদর্শন । সুপুরুষ টি , চুপসে যাওয়া মুখ করে বলল ।
 : স্যরি ! আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি। এটা কিভাবে হলো ঠিক বুঝতে পারি নি ।
: অস্ফুট শব্দে দুকদম পিছালো লিলি । কেন যেন ছেলেটির ওপর রাগ করতে পারলো না সে !চেহারা বেশ আলোকিত করে একগাল হেসে আবার হাঁটা ধরলো ।

পাত্রপক্ষ কাল দেখতে আসছে চিন্তায় লিলির ক'দিন ধরে ঘুম হাওয়া । ছুটির দিন বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠে সে। তবে আজ কিছুটা ব্যতিক্রম সারা রাত আউলা ঝাউলা ভাবনার ঘোরে কেটেছে ।

সোহানের প্রতারণার পর ।  লিলির বেশ সময় লেগেছে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ,বিয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে । তবে ,আঘাতের ক্ষত এখনও শুকোয় নি । খুব প্রিয় কাউকে ভুলে যাওয়া টা সত্যিই কঠিন ।

দুজন পাশাপাশি বসে আছে নির্বিকার!  কারো মুখে কোন কথা নেই । হঠাৎ ,রাফি ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এনে  বলল- 
: এই যে ম্যামসাহেব ! আমাদেরকে একা রেখে সবাই চলে গেছে । এবার আমার দিকে একবার তাকানো যায় কী ?সকালে সোহানকে মনে করে অক্লান্ত কেঁদেছে লিলি ।চোখদুটো এখনও কিছুটা লাল ।  লিলি অবাক চোখে একবার তাকালো রাফির দিকে । আরে ...এ তো গতকালের সেই ছেলেটি !
: আপনি ?
অদ্ভুত ভঙ্গিমায় মাথা নেড়ে রাফি বলল-
: জী আমি ! 

অনেক সময় ধরে দুজনার আলাপ চলল। রাফি আস্বস্ত স্বরে বলল আপনার অতীত নিয়ে কোন আগ্রহ নেই আমার । আপনার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সুযোগ দেয়া যাবে কী  ?লিলি লাজুক ভঙ্গিমায় মুচকি হাসলো ।

প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিলো রাফি ছেলেটার মধ্যে এক অদ্ভুত সারল্য আছে ।  সত্যিই কাউকে চিনতে হলে দীর্ঘ কাল পাশে থাকার প্রয়োজন আছে কী ?
বছরের পর বছর পাশে থেকেও কাউকে চেনা যায় না । কখনও কখনও আবার মুহূর্তেই অচেনাকেও ভীষণ চেনা মনে হয় ।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান