
নব্বই দশকের অগ্রগণ্য কবি হেনরী স্বপন। নব্বইয়ের লেখকরা যে কযয়কজন পরবর্তীকালে তাদের লেখায় নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন, কবি হেনরী স্বপন তাদেরই একজন। কেননা, বাংলা কবিতায় আধুনিক-আধুনিকোত্তর দ্বন্দ্বের বাইরে হেনরী স্বপনের কবিতায় ‘সাম্প্রতিক নয়’ এমোন অনেক বন্ধুর পথের ঘ্রাণ খুঁজে পাওয়া যায়। কবি পরিচয়ের বাইরে তিনি প্রাবন্ধিক ও শিশুদের ছড়া লেখক এবং ‘জীবনানন্দ’ ছোটকাগজের উল্লেখযোগ্য একজন সম্পাদক এবং জীবনানন্দ গবেষক ও নিরলস সাহিত্যকর্মী হিসেবেই বাংলাদেশে সমধিক পরিচিত।
লেখালেখিটা শুরু হয়েছিল, হাইস্কুলে পড়ার সমটাতেই। দেশপ্রেমের উপলব্ধিতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে। তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন লিফলেটের পেছনে অবসর সময়ে কবিতা/ছড়া লিখতেন এবং সেই লেখালেখি দিয়ে...মধ্য আশির মাঝামাঝি সময় থেকেই কবির লেখালেখি পুরোদস্তুর শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। বরিশালের ছাত্র ইউনিয়নের “জয়ধ্বনি” ভাঁজপত্রে প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছে ওই ৮৫’তেই। এরপর ঢাকা থেকে প্রকাশিত খ্রিস্টান কমিউনিটির সাপ্তাহিক ‘প্রতিবেশি’ পত্রিকায় নিয়মিত ছড়া/কবিতা প্রকাশিত হত। তবে, ১৯৯০ সালে তখনকার সর্বাধিক জনপ্রিয় দৈনিক ‘বাংলার বাণী’র সাহিত্য পাতায় ‘ছায়াসঙ্গী’ শিরোনামের একটি কবিতার মাধ্যমে তার আত্মপ্রকাশ। সেই থেকে কবি হেনরী স্বপন এপারবাংলা ওপারবাংলার উল্লেখযোগ্য সমস্ত দৈনিক এবং লিটলম্যাগে নিয়মিত লিখে চলেছেন। লিখছেন কমবেশি আজও। তার কবিতার বই ও পুস্তিকা গ্রন্থগুলির বাইরে খ্যাতিমান বড়কাগজ-ছোটকাগজ, অখ্যাত বহু চলমান ও বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্র-পত্রিকায় কবির অজস্র কবিতা ও বহুলেখা আজও অগ্রন্থিতই রয়ে গেছে। কবিতা বিষয়ক অসংখ্য গদ্যরচনার অন্তত দুটি পাণ্ডুলিপির প্রস্তুতি থাকলেও, তার প্রকাশনাও অনিশ্চিত। কবির কাব্য ও মননজ্ঞান দ্বারা সম্পাদিত লিটলম্যাগ ‘জীবনানন্দ’ এর সুনাম আজও অনেকের মুখে মুখে শোনা যায়। পত্রিকাটি নব্বই দশকের আন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে দুইবাংলায় সমান আলোচিত ও জনপ্রিয় ছিল। তাই, কবি হেনরী স্বপন বরাবরই নিজেকে নিবেদিত একজন লিটলম্যাগকর্মী ও নিজেকে প্রধানত এই মাধ্যমের লেখক পরিচয় দিতেই খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।
বর্তমানে কবি বরিশালে দৈনিক মতবাদ এর মাসিক ‘ইতিবৃত্ত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য সংগঠন, পত্রিকা এবং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সম্পাদনা, লেখালেখি ও সাহিত্যকর্মের জন্য গ্রহন করেছেন নির্বাচিত কিছু সম্মাননা ও পুরস্কার।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : কীর্তনখোলা (একফর্মা কাব্যপুস্তিকা ১৯৯৪)। মাটির বুকেও রৌদ্রজ্বলে (একফর্মা কাব্যপুস্তিকা ১৯৯৪)। বাল্যকাল ও মোমের শরীরে আগুন (১৯৯৮)। জংধরা ধুলি (২০০১)। কাস্তে শানানো মোজার্ট (২০০৪)। ঘটনার পোড়ামাংস (২০০৯)। হননের আয়ু (২০১১)। উড়াইলা গোপন পরশে (১৪১৮)। শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৫)।মৃত মনিয়ার মতো (২০১৮) আলপথ দূরে (২০২০)। অম্লজান (২০২২)। গাছেদের হিজাব পরালে (২০২৩)। বেহুলা বাংলা নির্বইচত শ্রেষ্ট কবিতা (২০২৩)।
গদ্যগ্রন্থ : ছোটকাগজের ক্রান্তিকাল ও অন্যান্য (২০১৬)। কবিতা অবলোকন ও উন্মোচন (২০২৩)।
লিটলম্যাগ : ‘জীবনানন্দ’ কবিতাপত্রের সম্পাদনা।
হেনরী স্বপন এর সাক্ষাৎকার গ্রহণে সাহিত্যবার্তার সম্পাদক আরিফুল ইসলাম
।
আরিফুল ইসলাম :আপনি মূলত কবিতার মানুষ। আপনার কাছ থেকে কবিতার কথা জানতে চাই। কবিতা আসলে কী?
.
হেনরী স্বপন : কবিতা আমার কাছে একান্ত ঈশ্বরের মতো। আবার এ-ও বলতে পারি, কবিতা হচ্ছে সেই মুড শাসিত হাড়-মাংস কিংবা দূরবিস্তারী এক ধরণের গুঢ় মুগ্ধতার বিনির্মাণ। আবার এই নির্মাণে সর্বদা একাত্ম হওয়ার অপেক্ষাই যেনো কবির অনন্তকাল। শুধু সাধনায়ই নয়, কবিতা কোনও এক সন্ন্যাসী আত্মার উপলব্ধিও বটে। কিন্তু আমি তো এ-ও জানি, কোনোকালেই কবিতা পাঠকের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন মেনে লেখা হয়নি। বরং এখনকার কবিতা পাঠককে বাইরে না রেখে, কবিতা এবং কবিও এর অংশ হয়ে মিশ্রিত হতে চায়। যদিও সময় এবং সময়ের মানুষ তার মিনিং মেনেই এগিয়ে চলে। ফলে কবিতার এই আপাত বিশৃঙ্খলার অভ্যান্তরে শৃঙ্খলার যে অমৃতধারা ক্রীড়াসূত্র রয়েছে। কিংবা প্রকৃত কাব্য বিমানবায়নের মধ্যে মানবায়নের যে বীজপত্র আছে, তাতেই তাহলে, আমরা প্রথমত: ধরেই নিতে পারি যে, একটি জাত কবিতা-- প্রথমেই পাঠককে আচ্ছন্ন করবে। না হয়...তাকে ভাবিত করবে...!
দ্বিতীয়ত: যে কবিতা পাঠককে প্রথমেই আচ্ছন্ন করে তো... ক্রমান্বয় ভাবিতও করবে। আবার প্রথমেই ভাবিত করে থাকলে, ক্রমান্বয় আচ্ছন্নও করবে।
অতএব,
যে কবিতা পাঠককে আচ্ছন্ন করে না, এমোন কি... ভাবিতও করে না...। আমার চিন্তায় সেটি কোনও কবিতাই না। তা-ছাড়া, কবিতা তো কোনও সংস্থা নয় যে, একাডেমিক দুস্থদের জন্য পংক্তি বিশেষ সামাজিক, রাজনৈতিক প্লাটফর্মের নিশ্চয়তা দেবে। কিংবা কবিতা নান্দনিক দার্শনিক সংস্থা হয়ে, তাত্ত্বিক কোন তত্ত্বজ্ঞানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে কেন?
মূলত: কবিতার উদ্দেশ্য হবে, আমার নিজস্ব আনন্দ...। যে কবিতা পাড়ভাঙ্গা তীরে এসে আমার এলোমেলো চিন্তার ঢেউগুলো আছড়ে পড়বে, নিজের ও অপরের আত্মায়। বহুগামী... ব্যাপক ভাবনায় কবি এবং পাঠক উভয়ই তখন যে কাব্য ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন। আমি তো, সেই কবিতাই খুঁজি... যে কবিতা মানুষকে স্থিতধী করবে না। মন্ত্রের ঘেরাটোপে দীক্ষাও দেবে না। আমি কেবল, সেইসব কবিতার অবগাহনেই আমার জীবনানন্দ...এবং ঠাকুর-কে খুঁজে পাই।
কিন্তু পাঠকের কাছে এখনকার কবি ও কবিতা উভয়-ই বিশৃঙ্খল উপাধিতে অভিসিক্ত হয়। তবে, কেনো জানি না, কি কারণে...কাব্যের প্রতি মানুষের এই এতো অবিশ্বাস-অত্যুক্তি। আমার তো মনে হয়, এই সময়ের কবিতা মুড-শাসিত, দূরবিস্তারি এক ধরনের গূঢ় মুগ্ধতা নির্মাণ করছে বলেই হয়তো, এখনকার পাঠকের কাছে আজকের কবিতা কিছুটা বিশৃঙ্খল উপাধিতে অভিষিক্ত। তবুও এই আপাত বিশৃঙ্খলার অভ্যন্তরে যে শৃঙ্খলার অমৃতধারা-- ক্রীয়াসূত্র রয়েছে। কিংবা বিমানবায়নের মধ্যে মানবায়নের যে বীজমন্ত্র আছে, তা প্রায়শই স্পষ্ট হতে হতে যেনো কোনও এক কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকছে এখনকার কবিতার ট্রেন্ডগুলো...।
আরিফুল ইসলাম :আপনার কবি হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছেন?
.
হেনরী স্বপন: পৈত্রিক সূত্রে একমাত্র কৃষিকাজের জ্ঞানই হাতে পাওয়া একমাত্র তালন্ত ছিল। কবিতা লেখার সূচনা পর্বে যে প্রেক্ষিত আমার কবি হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা বা যে অবস্থা আমাকে কবিতা লেখার কথা ভাবতে শিখিয়েছে, তা মূলতঃ বই-বই এবং লাইব্রেরি। প্রথমত পড়ুয়া হয়ে উঠলাম। লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক ছিলাম। সে-সময় কিছু সাহিত্যের কাগজ এবং দৈনিকের সাপ্লিমেন্টগুলোও আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
তবে বই কেনার বিকল্প অন্য কোন পরিবেশের কথা আমার ক্ষেত্রে চিন্তাই করা যায় না। তখন কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধের বই, সাহিত্য-তত্ত্বের কোষভাণ্ডারগুলি ভীষণভাবে পড়তাম। পাশাপাশি অজস্র কবিতার বই তো হামেশাই পড়েছি। বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র, মানবেন্দ্র, শঙ্খ ঘোষ আরও অনেকের অনুবাদ গ্রন্থের সমাবেশ, বিভিন্ন লেখকের সাক্ষাৎকার আমাকে লেখালেখির জন্য এই পর্যন্ত উন্মাদ করে এনেছে।
এরপর এক সময়, লিটল ম্যাগাজিনের বিশাল পৃথিবী আমার কবিতা ভাবনা-- কবিতা লেখার সাথে যুক্ত হয়ে যায়। ফলে আমি কেবল বুঝি ভাল কিছু লিখতে হলে বই এবং লাইব্রেরির পরিবেশই তাকে অগ্রগামী করে। যদি কারো ভেতর সেই লেখক সত্তা থাকে এবং সে যদি বইয়ের এক পৃথিবীর ঘ্রাণ পায়, তবে তার লেখক হয়ে ওঠা, শুধু সময়ের ব্যবধান মাত্র।
আরিফুল ইসলাম:কবিতা কখন অকবিতা হয়?
.
হেনরী স্বপন: টেক্সট এবং বিনির্মাণের তাড়নায় যখোন কবিতা নির্মাণে এক ধরনের কৃত্রিম চাপ তৈরি করে, ছন্দবিহীন ভাষা ও আরোপিত শব্দে নিকট দূরত্ব মোছার ব্যায়াম শুরু করে, সেই কবিতা মাসেলই একরকম অকবিতা হয়। ফলে সেই কবিতার মধ্যে আবিস্কারের মেধা বলে কিছু থাকে না। প্রতিভাহীন তেমন কিছু কবির বিশৃঙ্খল চিন্তা-চেতনা লুপ্ত বস্তু থেকে সময়কে বিচ্ছিন্ন করে, কবিতা নামক এলোমেলো বোধের শব্দকর্মগুলোকে অকবিতা করে তোলে। আর এইসব ইয়োগা ব্যায়ামের অকবিতাই-- আজকের সত্যিকারের কবিতাকে বিভ্রান্তির কবলে ঠেলে দিচ্ছে। নিন্দাও কুড়াচ্ছে আনেক। কল্লোলের কালের ঝড় যেরকম নির্দিষ্ট নিন্দায় মেতে উঠেছিলো।
আরিফুল ইসলাম :প্রথম কোন্ পরিস্থিতিতে কবিতা লিখে কবি জগতে প্রবেশ করেন?
.
হেনরী স্বপন: তখন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার ছিল দেশ। অতি যৌবনের তেজে রক্তের বিলোরোবিনে যে উচ্চ মাত্রা থাকে, দেশপ্রেমের উপলব্ধিটা তাতেই মর্মে মর্মে তখন প্রচণ্ড হয়ে উঠেছিলো। মিছিলে-শ্লোগানে যত্রতত্র ঝাঁপিয়ে-লাফিয়ে পড়তাম। ঠিক এই সময়টাতেই... মধ্য আশির মাঝামাঝি সময় থেকেই কবিতা লেখার আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছি আমি। প্রবল সামরিক চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সেই যে লেখালেখির শুরু-- তা যে আজ পর্যন্ত মর্মান্তিক এক কবি স্বপ্নের অহংকার হয়ে উঠবে-- এমনটি কখনও ভাবিনি।
এরপর ১৯৯৪ জানুয়ারিতে আমার একফর্মার কাব্যপুস্তিকা ‘কীর্তনখোলা’ প্রকাশিত হয়। এটি একটি দীর্ঘ কবিতা। নিজের টাকায় প্রকাশ করেছিলেন এ এইচ এম বজলুর রহমান। নিজে লেখক নন কিন্তু এই মানুষটি বরাবরই শিল্প-- সাহিত্যের পৃষ্টপোষক ছিলেন-- আছেন। এক কথায় এই মানুষটি আমার লেখালেখি কবিতাজীবনে অনেকটাই ঈশ্বর...।
আরিফুল ইসলাম :আপনার অধিকাংশ কাব্যগ্রন্থের নামে বৈপরীত্য। কিন্তু কেনো?
.
হেনরী স্বপন : বৈপরীত্য অর্থে-- বিপরীত, বিপর্যয়, বিরুদ্ধতা যদি এটিকে অভিযোগ বলতে চাও, তবে আমি মানছি এটা একটা সঠিক অভিযোগ। কারণ, এটা আমার কাব্যবিশ্বাসের দায়বদ্ধতা এবং তারই প্রতিফলন বলতে পার। আমার কাছে বিপর্যয়, বিরুদ্ধতা হচ্ছে বিপ্লব। আমার কবিতা, যার প্রকরণ, উপাদান, কাঠামো এভাবেই বৈপরীত্যের তাড়নায় অগ্রে বিস্ফারিত হয়। এরপর বাস্তবে সেটা ক্রিয়া বিক্রিয়ার মাধ্যমে হয়তো বিভিন্নভাবে একেকটি কবিতা হয়ে ওঠে।
এখন তুমি যে কেন এর উত্তর জানতে চাইছ? সেই প্রশ্নই যেন আজ এখন নিজের মধ্যেও কাজ করছে। আর নিজেও ভাবছি, যা এর আগে কখনোই ভাবিনি যে আমার কাজগুলো এভাবে বৈপরীত্যের স্ববিরোধী হয়ে গেল কেন?
আরিফুল ইসলাম :প্রথম কবিতা ও সম্প্রতি লেখা কবিতার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান কী? একটু খুলে বলুন...
.
হেনরী স্বপন : আরিফ, তুমি কি? প্রথম কবিতা ও সম্প্রতি লেখা কবিতা বলতে যৌবনের লেখা এবং বার্ধক্যে লেখা সম্পর্কিত-- পার্থক্য জানতে চাইছ? তাই যদি হয়। তবে আমি বলব, কবিতা আমার ব্যাক্তিগত চেতনার ফসল। কিংবা ধরও কবিতা সঙ্গমের বিষয় নয় যে, যৌবনের জোয়ারে বিছানা কাঁপিয়ে দাপিয়ে লিখে বেড়ানো আর বয়স বাড়লে উত্তেজনার প্রবল ঘাটতি, সময়-- অর্গাজমের সুখ কমে যাওয়া। কবিতা আসলে তা নয়-- প্রকৃত কবির চেতনায় কবিতা কস্তুরিমৃগের গ্লান্ডে থাকা উন্মাতাল কস্তুরির ঘ্রাণ কখনো বাতাসে মিলিয়ে যায়না বরং ঝড়ো বাতাসের উদ্দ্যামতায় সে আরও বেশি করে ছড়ায়। তাই কবির জীবনকে পুরোপুরি উপস্থাপনের জন্য বয়:সন্ধিকালই কিছুটা ভাল। নানা অভিজ্ঞতার পরিসরে তখন প্রেম দ্রোহ একাকীত্বর কবিতা পেড়িয়ে বিচিত্র ভাবনার কবিতা তৈরি করতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে বয়সের ভারে যদি কোন কবির চেতনায় ভাঁটার টান লেগে যায়, কবিতার মননে তরঙ্গের ঢেউ কমে যায়, জীবনের বিশ্বাস হারিয়ে যায়-- তাহলে সেই বয়সি কবিতা চর্চার মধ্যে প্রথমদিকের লেখার চেয়ে সম্প্রতি লেখা কবিতার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকবেই।
আরিফুল ইসলাম :আপনার মতে, আজকের দুনিয়ায় একজন কবির জন্য বিশ্বসাহিত্য জানা কতটা জরুরি?
.
হেনরী স্বপন : একজন কবির জন্য কেন? বিশ্ব সাহিত্যের যে বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার বিশ্বজুড়ে রয়েছে, সেই জ্ঞানের অমৃতসুধা কমবেশি প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষেরই পান করা উচিৎ। আর আমি তো মানুষের প্রকৃত শিক্ষা বলতে সাহিত্যের ব্যাপক পাঠকেই বুঝে থাকি। তুমি জানতে চাইছ, একজন কবির বিশ্বসাহিত্য জানা কতটা জরুরি? দেখ, একজন লেখক বা কবিকে সমাজের আর দশ/ পাঁচটা মানুষের খেকে অনেক বেশি অগ্রসর অন্তভাবের মানুষ হতে হয়। একজন কবির মধ্যে অস্মিতা, মুক্তি ও অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত থাকে। একজন লেখকের পরিপুষ্টি, কল্পনাপ্রবণ অস্তিত্ব, উদ্ভাভিত পিরামিড তৈরি হয় অনেক অভিজ্ঞতা, অনেক জানাবোঝা, অনেক পাঠের মাধ্যমেই। তাই আজকের সময়কে বিভাজিত করার জন্য যে যে পদ্ধতিগুলো বিশ্বসাহিত্যের মধ্যে প্রচলিত আছে যেমন-- ক্লাসিক, মডার্ণ, পোস্টমডার্ণ ইত্যাদি আরও যেসব কাব্যযুগর বিভাজন প্রক্রিয়া আমাদের জানা এবং বোঝাটা যতো জরুরি মনে করছি, ততোটাই মনে করছি একজন লেখক বা কবির জন্য বিশ্বসাহিত্যের ওইসব বিভাজনের পাশাপাশি আমাদের দেশের ক্লাসিকগুলোও নিজস্ব দর্শণের স্তরে স্তরে ভাগ করে চর্যা, বৈষ্ণব, খনা, কাবিগান, লালন এইগুলোও যেমন-- বৈদিক, বৌদ্ধিক এবং জন্মান্তর চিন্তার প্রবণতাগুলোও যেন আমাদের-- আমার চিন্তার ফসল ও বিশ্বাসের অর্ঘ্য মেনেই পাঠ করে নেয়া দরকার...!
আরিফুল ইসলাম :একজন কবি সব থেকে মহৎ ! এতে আপনার প্রতিক্রিয়া কি ?
.
হেনরী স্বপন : একজন লেখকের মানুষসত্তার প্রধান ব্যাখ্যা হচ্ছে, তাকে একজন পুরোপুরি সৎ মানুষ হতে হবে। তারপরে সত্তার প্রশ্নে তাকে অবশ্যই তথাগত (মহৎ) হতে হয়। আবার ইন্ডিভিজুয়্যাল রিয়ালিটির কারণে তাকে কখনো কখনো অবতার রূপেও অন্তর্মুখীন যাত্রার মাধ্যমে চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে নিজের আইডেনটিটিও খুঁজতে হয়। তবে, লেখকসত্তার পরিপ্রেক্ষিতের সাথে সাথে যার যতোটুকু ক্রিয়ার ও চিন্তার পার্থক্য থাকবে এবং নানা পরিপার্শ্বে নানাভাবে নিজেকে নিজের পরিচয়ের জায়গায় দাঁড় করাবে। বুঝতে হবে, স্থান-কাল-ঐতিহ্য মিশ্রিত লেখকের যে সত্তা-- শেকড় ! তার হৃদয় খুঁজে বেরে করবে সে। কারণ, যেখানে কাল নিবিষ্ট ব্যাখ্যার প্রকরণ নিয়ে আজও অনেক প্রশ্ন লেগেই আছে। সেখানে লেখককে তার মানুষসত্তা কিংবা মহত্বসত্তা নিয়ে আরও বেশি প্রশ্নবাণে আক্রান্ত, তীরবিদ্ধ তো আমাদের হতেই হচ্ছে বারংবার নানাভাবেই।
আরিফুল ইসলাম :কবি চরিত্রটি সমাজের চোখে রহস্যময়, এই রহস্যময়তার গোপন রহস্যটা আসলে কি?
হেনরী স্বপন : কবিতার সূত্রটাই অসীম রহস্যময়তার! কবিতার ঘোরে না পড়লে অথবা শব্দ ধরার ফাঁদ নিয়ে না ঘুরলে কোন মুডই কবিকে প্রথম পক্তির অনিশ্চয়তায় ধরা দেবে না। এরপর কবিতার সবচেয়ে মূল্যবান কথা-- আবিষ্কারের হৃদয়াবেগ-- সচেতন মনের আকুতি যে ভাষায় প্রকাশ পেতে থাকে। উৎসারিত ধ্যানের মধ্যেই কবির কবিতার সেই ভাষা আকাশবৃষ্টি থেকে ঝরতে থাকে। কবি তখন সেই ভাষাকে সাজিয়ে উৎকৃষ্ট সামঞ্জস্যের কবিতা লেখেন। আর তখন কবির শরীর থেকে সুলিপির অজস্র ভার কমতে থাকে। সঙ্গম শেষের প্রশান্তির মতো হাল্কা হতে থাকে, কবিতা প্রবর্তিত আবেগে সরল-জটিল-বাস্তব কিংবা পরাবাস্তবের সৌষ্ঠবে-- কিংবা স্থিতি ও গতি-জড়তার বিন্যাস, হঠাৎ ই উপমা, রূপক, অন্বয়ের অলংকারে ম্যাজিকের মতো কবির কবিতা প্রাসঙ্গিক হয়। কবিতা তখন কবিকে গিলে খায়। মানুষ কিংবা সমাজ তখন কবিতার স্রষ্টাকে খুঁজে রহস্যময় প্রফেট ভাবতে থাকে। এই যেমন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সেই রহস্যবাড়ির মহারাজা হিসেবেই ভাবতে পারি আমরা। আর সেই কবিতার খোঁজে আমাকেও নিয়ত অতলের দিকে যাত্রা করতে হয়।
আরিফুল ইসলাম :আপনি একজন কবি, আর কবি হিসেবে কবিতার সংজ্ঞা কি হওয়া উচিত বলে মনে করেন ?
.
হেনরী স্বপন : ব্যকরণই যেহেতু কবিতার প্রাণভোমরা, তখন কোনটি কবিতা আর কোনটি কবিতা নয় তার মাপকাঠি কে কিভাবে নির্ধারণ করবে? আসলে, কবিতা নিয়ে কথা বলার অনেক বিপদ। কি হলে কবিতা হবে ? কি না থাকলে কবিতা হবে না, সেটা বোধহয় কোন কবিই বলতে পারে না। কারণ, কবিতা অনেক রকমের হয়ে থাকে। তাই প্রকৃত শিল্পের কোনো সার্বজনীন সংজ্ঞা নেই। কিন্তু দেখা যায়, আমরা সংজ্ঞার শেকলে বেঁধে থাকি বলেই, আমরা অনেক সময়ে সঠিক কবিতাটি ঠিক বুঝতে পারিনা। এমন কি কখনো কবি নিজেও পারেন না। শুধুমাত্র সত্যিকার পাঠকই বুঝতে পারেন, কোন্টি শুদ্ধ কবিতা হয়ে উঠেছে। কী কারণে শুদ্ধতম! তা সম্ভবত তিনিও জানবেন না। শুধু কবিতাটি ভালোলাগা থেকেই পাঠকের এই সিদ্ধান্ত রচিত হয়। এটা অবশ্য যার যার কবিতা অনুভব করার ক্ষমতা ও তার তার প্রবাহিত হবার ইনার প্লেট থেকেই তৈরি হয়।
আবার সব পাঠকের একই কবিতা-- সকলের ভাল লাগবে, তাও নয়, বরং সবচেয়ে মজার! এই পাঠককূল তার সিদ্ধান্তের কারণ লিখতে পারে না। সম্ভবও নয়।
তবুও, কবিতার সংজ্ঞার ক্ষেত্রে, আমি নই বরং পাঠকই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। যে ভালোলাগা নিয়ে একজন কবি, কবিতা শেষ করেন। তারচেয়ে অধিক ভালবাসায় যদি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তবেই কেবল সেই পাঠকের কাছে, আমার কবিতার সংজ্ঞা স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং এভাবেই একজন কবির ভাল কবিতাটি কালনিরপেক্ষ হয়ে থাকবে।
আরিফুল ইসলাম :একজন কবি হিসেবে আপনি বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা দায়বদ্ধ বোধ করেন?
.
হেনরী স্বপন : একজন কবি হিসেবে কেন? আমি তো এই চলার উপমায়, চলমান যে কোন প্রেক্ষাপটেই নিজেকে মহাপান্থের মানুষ মনে করি। লেখক হিসেবে তো আমার দায়বদ্ধতার গ্রাফটা হয়তো আরও অন্যরকম হয়ে থাকে। হয়তো এক্ষেত্রে আমার লেখার মান কিংবা লেখকসত্তার মান-- স্তরের পরিমাপ-- এটা রাষ্ট্র-সমাজ ও তার নতুন প্রজন্ম, নতুন ভাবনা, নতুন উন্মাদনা লেখার চাপেই... রাষ্ট্রীয় অনেক উপাদানের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আমার ভাবনার সব কিছুই-- যেমন আমার লেখা আমার পাঠ, সবটাই আমার কমিটমেন্টের উপর নির্ভর করবে।
কোনো হতাশা বা নিয়মের বেড়াজালে নয়। বরং ভাবনাটা তখন সামাজিক আর্থ-সামাজিক কাঠামো, রাষ্ট্রের আচরণ, শাসন-শোষণের মাত্রা, সামগ্রিক আকাঙক্ষা, সাময়িক সুস্থতা ও অসুস্থতা সবটাই তখন সময়ের সাথে বাড়বে অথবা কমবে। ফলে লেখক হিসেবে-- দায়বদ্ধতা তৈরির গ্রাফ লাইনটাও আমার দৃষ্টিতে মনুষ্যত্ব ও মানবতার বিষয়... এটা কোনও মবসংস্কৃতির উন্মাদনা কিংবা মৌলবাদী আস্ফালনের মতোও দায়বদ্ধ নয়। তাই দু:স্বপ্নের এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমার দায়বদ্ধতা কেবল... “আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, গাছের মত দাঁিড়য়ে থাকি”... এ রকমটাই। হয়তো এক্ষেত্রে ভূমিকা-ঠুমিকা তাও একরকম বিবেকবিরুদ্ধ নিয় বরং বিবেকবদ্ধ তো বটেই...।
আরিফুল ইসলাম :আপনি কি মনে করেন বাংলা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে যথেষ্ট সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে?
.
হেনরী স্বপন : বাংলা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে কি পারে নাই? সেটা তো ১৯১৩ সালেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। সাহিত্যের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার পাওয়াটাই বিশ্বদরবারে বাঙালির আনন্দদায়ক ও তাৎপর্যপূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবটাই হয়তো তখন অপ্রত্যাশিত ছিল বটে। করণ, রবীন্দ্রনাথের আগে কোনো এশীয়বাসী তো নয়ই, এমনকি তখনো আমেরিকার কোন কবি লেখক এই পুরস্কার পাননি। ভাবা হতো, নোবেল পুরস্কার কেবল ইউরোপীয়দের জন্যই নির্দিষ্ট সম্মানা। এশীয়দের ভাগ্যে এই সম্মান কোনদিনই জুটবে না। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের শিল্পগুণ যে বিশ্বে যে কোনও দেশের তুলনায় কোনও অংশে কম নয়, সে-গুণের উল্লেখ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সনদপত্রে লেখাও ছিল এবং তিনি যে একজন বিশ্বমাপের বাঙালি কবি, তা পুরস্কারদাতাদের পক্ষে অনুভব করতে বেগ পেতে হয়নি কিন্তু...!
আরিফুল ইসলাম :রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পরবর্তীতে বাংলা কবিতা কোন দিকে এগিয়েছে বলে মনে করেন?
.
হেনরী স্বপন : আমি বলব, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতা কোন দিকে এগিয়েছে? হ্যাঁ, যদি তাই হয়, তাহলে আমি বলব,...উল্লেখিত কবিরা হচ্ছেন, বাংলা কবিতার লিজেন্ড! কাব্যজ্ঞানের দিকপাল। এঁরাই আমার শরীরের ফোস্কায় ক্ষতপুঁজ গনগনে করে তুলতে জানে। তুলতুলে মেঘে ঢাকা নক্ষত্র এদেরই ভাবা যায়। ভাবা যায়... ‘ঘনছন্দ মুক্তি নিবিড়’-- যে ব্যথায়, মেধায় ছন্দবিদ্যুতের ক্রম বিবর্তন আছে। কাব্যমথিত ইতিহাস আছে।
সম্ভবত নানা বৈচিত্রে আমাদের কবিতার ভাঙচুর প্রকরণের ক্ষেত্রে তো অনিবার্যভাবেই ঘটেছে। তাই বিভিন্ন লেবেলে আটকে ফেলে, কবিতা ও তার আঙ্গিকের ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্যের অসীম সন্ধানে এগিয়ে চলছে আজও। হয়তো তথাকথিত ব্রান্ডেডের যুগে-- কবিতাকেও ব্রান্ডেড করার ধান্ধা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন অনেকেই। নিজেদের অক্ষমতাকে ঢাকতে, কবিতা কোন দিকে এগুচ্ছে বলে ভাবছেন নানা উপাধিতে? তবে কবিতা এগুচ্ছে কিংবা পিছোচ্ছে এই বিদ্রুপে অগ্রজের ভূমিকা রয়েছে অনেক। তবুও কবিতা হয়তো এগুচ্ছে কোনও কোনও ক্ষেত্রে। আসলে আগ্রজের প্রতি এই আক্রমণ মূলত: আমাদের অজ্ঞতা আড়াল করার কৌশল মাত্র। যদিও এতে কবি ও কবিতায় আধুনিকতার সংকট তৈরির সম্ভাবনা নেই মোটেও। কিন্তু, সাময়িক এই বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হওয়ায়, কবিতার কৃত্রিম চাপ হয়তো কিছুটা বেড়ে উঠতে পারে। তবে, এ কথা সত্যি যে, এই প্রতিক্রিয়াই পূর্বের কবিতার সাথে বর্তমান সময়ের কবিতার মৌলিক পার্থক্য ফুটে উঠছে। যদিও স্পেসে বোঝা যাচ্ছে কবি ও কবিতার প্রায়শ্চিত্তকরণ হচ্ছে এবং পুনরুজ্জীবনের দিকে এগুচ্ছে। একনকার কবিতা হয়তো অতীত সূত্রের বীজমন্ত্র থেকে মুছে ফেলছে দাসত্বের দাগ। কবিতার পূর্বপ্রকরণ, প্যানপ্যানে লিরিক, ছন্দ ও গীতিময়তার-- স্তরে স্তরেও ঘন হচ্ছে। নিজের দিকে ফেরা ইনপ্যাক্ট মেটাফর হচ্ছে। নিজের উপাদানে মিশ্রিত হচ্ছে।
ফলে, বাংলাকবিতার একান্ত নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক মুডগুলোকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে অনেক। তাই, এখন যে ভাষায় কবিতা এগিয়ে যাচ্ছে-- নিজের কাছে-- জীবন উপলব্ধিতে, সময়ের দাগ টেনে-- এগিয়ে যাচ্ছে দাগহীন-- সমষ্টিবিহীন কবিতার দিকে। এই বিপরীত টানের ভারসাম্যে এখন যেমন যা কিছুর মিশ্রণ... সিন্ট্যাক্স-বিন্যাস, সাবজেক্ট, ক্রিয়ার দূরত্ব, বলার ধরন, প্রকাশের অভিনবত্ব তৈরি হচ্ছে বহুগামী, সর্বব্যাপী উপাদানে। নানা মিশ্রণে নিজের কবিতার যে স্থাপত্য নির্মাণ হচ্ছে, তা পাঠককে মুগ্ধতায় কতটুকু-- নতুনত্বের মধ্যবর্তী হয়ে আক্রমণ করছে? সে প্রশ্নের দাবিও কিন্তু বুক পেতে নিতে হচ্ছে...। আমাদের কাব্যভূমিতে কোনও অগ্রজের ভূমিকাও যেমন অবহেলার নয়? তেমনি বিবর্তনের ফর্ম্যাট বীক্ষণ যন্ত্রটিও সুক্ষ্ম ও সর্বদাই পেলবও নয়। তবুও শিল্পের আর্তির নিঃশ্বাসেই বেঁচে আছে কবিতার অগ্রযাত্রা। থামবে না পুনঃবিবর্তনের দূরবিনে দেখা আকাঙ্খার রোষাণল...।
আরিফুল ইসলাম :সাম্প্রতিক ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে আপনার কবিতাকে প্রভাবিত করছে?
.
হেনরী স্বপন : একজন কবিকে সবসময় সবকিছুর অংশ হতে হয়। সেটা কেবল ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতি কেন? বিশ্বের যে কোন রাজনৈতিক পরিস্থিতেই কবির কবিতাকে প্রবাহিত করতে হয়। কবিতা তো রাজনীতির বাইরের বিষয় নয়। যদিও কবির রাজনীতির জায়গাগুলো ভিন্ন রকমের। সেটা দেশ মাটি মানুষ সংশ্লিষ্ট জীবনের রাজনীতি হতে হয়। এক্ষেত্রে মানুষের হৃদয়টা কেমন, মানুষের স্পর্শকাতর জায়গাগুলো কি রকম? সেগুলিই একজন কবির চিন্তা ও লেখায় প্রতিফলিত হয়, এটাই স্বাভাবিক। সম্প্রতি ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ যদি আমার কবিতার আত্মাকে ছুঁয়ে যায়। তাহলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নৃশংসতা, ইসরায়েল ফিলিস্তিন, ইউক্রেন গাজার যুদ্ধ এবং আমাদের জুলাই আন্দোলনের বর্বর গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, মাজার এবং বত্রিশ নম্বর বাড়ির ভেঙ্গে ফেলা লালসুরকি আর পাথর মর্মরের কম্পিত মৃদু শব্দগুলোও আমার হৃদয়ে স্বয়ম্প্রভ হয়। এটাই প্রকৃত কবির সামগ্রিকতা কিংবা একাগ্রতা। যদিও একাধারে বিপ্লবী এবং সামগ্রিক হয়ে ওঠা একজন কবির জন্য খুব কঠিন কাজ। তবুও, কবিতাকে মিছিল শ্লোগান ভিত্তিক চিৎকারের পর্যায় না নিয়ে গিয়ে বরং নির্জণতা ও নৈ:শব্দের কবিতার মধ্যে ব্লেইন্ড হওয়াই অধিক শ্রেয়। কারণ, কবিতার ভাষা এবং মর্মর সর্বদাই বিপ্লবে বিস্ময়ে মিলেমিশে থাকে কবি ও কবিতার আত্মায়...!
আরিফুল ইসলাম :আপনি কি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কবির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন? কারা?
.
হেনরী স্বপন : এই সময় কবিদের এক অসীম সমস্যা-- কে কার সম্পর্কে বলবে। কী বলবে? কতোটা বলবে ? চলছে ভুল প্রশ্নের ভুল ব্যাখ্যা। এর থেকে যে কবিরাও খুব নিরাপদে আছে, তা কিন্তু নয়। একই কালের মধ্যে থেকে অথবা দূরে দাঁড়িয়েও নির্দিষ্টতা নিরুপনে নিস্তার নেই। প্রভাবিতা অস্পষ্টতা ব্যখ্যা করা কঠিন কাজ। তবুও বলব, প্রিয় কবির প্রভাব রিলেটা সময়ের বিবর্তনে হাতে হাতে কাঠি বদল হয়েছে।
তাহলে, প্রিয় কবির তালিকা সম্পর্কে আপাতত নীরব থাকাই ভালো। কারণ নীরবতার মতো শক্তিশালী অস্বীকারের ভাষা, যে কোনও উচ্চারণেই অসম্ভব। এক্ষেত্রে আমি হয়তো একজন মোহাম্মদ রফিক, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, অরুণ মিত্র, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিংবা রবীন্দ্রনাথকেও ভুলে যেতে চাই না। হয়তো এই সময়ের কবিদের অসম্ভব হয়ে ওঠার পিছনে আরো অনেককে এই তালিকা একান্ত করে ভাবা যায় এবং এদের দ্বারাই আমার কাব্যযাত্রা প্রভাবিত হওয়া খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া ছিল। তবে শুধু প্রিয় কেন ? অনেক অপ্রিয় কবির কবিতাও আমাকে প্রভাবিত করছে। হয়তো কখনো কখনো-- সময়ের কবিদের কোনো কোনো কবিতাও আমাকে প্রভাবিত করেছে। অথবা একই মনে হলেও, মূলত তা মৌলিক, যার মধ্যেও পার্থক্য অবশ্যই থাকে। যা সেই কবির স্বত্তা থেকে চুঁইয়ে নামে এবং যে কোনো জেনেটিক কোডের মতই যেন তা সত্য হয়ে ওঠে।
আরিফুল ইসলাম :শিল্পের মধ্যে জীবন থাকে, জীবনে অভিজ্ঞতা থাকে-- আপনার কবিতায় অভিজ্ঞতার কথা কতটুকু ?
.
হেনরী স্বপন: হ্যাঁ, প্রত্যেক শিল্পের পেছনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে কবির নিজের জীবন এবং নিজের জীবনের কাছাকাছি থাকা আরও অন্য অনেক জীবন। তাই অনেক অভিজ্ঞতার জীবন মানেই মানুষের সমস্ত সৃষ্টির উৎস, হয়তো আরও যাবতীয় ভাবের আশ্রয় ও ভাণ্ডার! ফলে যে আশ্রয় ও অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে পঞ্চাশ পরবর্তী কবিতার যে নগরায়ণ শুরু হয়েছিলো। আমি হয়তো এর থেকে মুক্তি খুঁজছিলাম। শেকড়ে যাবার চেষ্টা করেছি কেবল। নগরজীবন নিয়ে কবিতা লেখা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও, নগর নিয়ে লেখা, নাগরিক যন্ত্রণা নিয়ে লেখা আর কবিতার নগরায়ন এক কথা নয়। আমাদের এইসব নাগরিক কবিতার মধ্যে যে শেকড়বিচ্ছিন্নতা, যে বৃহৎ জীবনের অনুপস্থিতি এবং আত্মোপলব্ধির খণ্ডায়নে-- কবিতার যে জীবনকে স্পষ্ট করেনি। বলা যায়, এ একরকম ধ্বস! কারণ এর কোথাও বৃহৎ আমি নেই। যে আমিটি এই জল-হাওয়া কিংবা মাটির অস্তিত্বে জায়মান...কিন্তু, তবুও তো সেইসব প্রাত্যহিক জীবনের অনেক সংগ্রাম ও স্বপ্নের ছবি আজো আমরা অঙ্কিত করতে পারি নি। কেবল সেটার চেষ্টা করছি... ভাই ।
আরিফুল ইসলাম :এপার বাংলার কবিতার ভাষা এবং ওপার বাংলার কবিতার ভাষার মধ্যে পার্থক্য কতটুকু ?
.
হেনরী স্বপন : দুইবাংলার ধর্মীয় বিশ্বাস ঐতিহ্যগত পরিবেশ পরিস্থিতির কারণেই দুই বাংলার সাহিত্যে বাংলাভাষা প্রয়োগের অনেকরকম ভিন্নতা রয়েছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে বাংলার জনপদ, লোকসকল ও ভাষায় প্রাণবন্ততা খুবই ব্যাপক। চরিত্রগতভাবে এমন বৈশিষ্ট্য এসেছে ভূ-প্রকৃতির কারণে, এখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়, জমি খুবই উর্বর। বন্যা, দুর্বিপাক, দুর্যোগে নুব্জ হয়ে পড়ে, কিন্তু আবার উঠে দাঁড়ায়, শেষতক টিকে থাকে সংগ্রামি বাঙালি ও বৈচিত্রময় বাংলাভাষার মাধুর্য। তাও, তথাকথিত প্রমিত ভাষার কনসেপ্ট দিয়ে বাংলা ভাষাকে ছাঁটাই করার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দুই বাংলায়ই বিরজমান।
তবুও, বলা বাহুল্য যে, ওপার বাংলার কবিতায় বিষয় বৈচিত্র আছে সত্য। কিন্তু বিষয়ের সাথে যেসব লেখককুল জড়িত তাদের চিন্তাকাঠামো অনেকাংশেই গতানুগতিক একরৈখিক। যা নতুন পথের উদ্দেশ্যহীন অসম্ভবকে সমর্থন করে না। কারণ যেভাবে যখন থেকে নতুন পথের শুরু হবে, তাদের চিন্তায় সেটা কিছুটা অভিধানিক ভাষার অধিক প্রয়োগের জন্য অনেকটাই অতীত-অক্লাসিক-অপভ্রংশ। মিডলক্লাসের গার্হস্থ্য নিয়ন্ত্রিত ভাষা ও বিষয়গুলোর মধ্যে ওখানকার লেখকের ভাষা ঘুরপাক খায়। তাছাড়া মুড নিয়ন্ত্রিত সাহিত্যের চেয়ে প্রতিবেদন এবং ন্যারেট করার প্রবণতাও এপার বাংলার কবিতার চেয়ে ওপার বাংলার কবিতায় অনেক বেশি।
ফলে ওদের নতুন ক্লাসিক তৈরির ক্ষেত্রে নতুন পথের সন্ধান যতোটা কম, আমাদের দেশে সেটার অবস্থান মুক্তবিশ্বায়নের জোয়ারে টালমাতাল। ফলে আমাদের কবিতার ভাষায় সাংস্কৃতিক সংকরায়ন আছে, সমাজ ও সংস্কৃতি প্রভাবিত বিশ্বায়নের বিভিন্ন উপাদানে মিশ্রিত সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ, সাংস্কৃতিক বৈষম্য, সামাজিক পরিবর্তন প্রভৃতির মাধ্যমে অধুনা সমাজে একটি নতুন আদর্শ, মানদণ্ড এবং প্রথার সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়ত।
তাই, ওদের কবিতায় বিষয়গুলোর মধ্যে বি-মানবায়ন খুব বেশি নেই। এক ধরনের একমাত্রিক জীবনমুখী ভাষা ও ধারা ওখানকার লেখকদের চালিত করছে যতোটা, এক্ষেত্রে আমাদের কবিতার ভাষা ততোটাই আঞ্চলিক আন্তঃসম্পর্কের মধ্য দিয়ে সংযোগ গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় সতত স্বয়ংক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে।
এখন ওপার বাংলার কবিতার ভাষা যেমন আটকে ছিল শারদীয় আগ্রাসনের চাপে-- উন্মুক্ত চিন্তাবিশ্বের বিশ্বায়নে আমাদের কবিতার ভাষাও আটকে যাচ্ছে ঈদুল ফিতরের সাময়িকী ও বোরখাবিশিষ্ট সুন্নতে খাৎনার ভাষায়...! যে চক্রান্তের মধ্য দিয়ে-- এখনকার বিকৃত এই ভাষা ও সুন্নতির ধারায় মৌলবাদী এক মাহমুদীয় সংস্করণও চলছে অমানিষার বাঁকে বাঁকে। চলছে স্বাধীনতা নামক শত্রু সম্পত্তি দখলের ভাষায় কবিতা সংস্কারের প্রসেডিংগুলোও...। তবুও, আপাত দুবোর্ধ্য এই ধ্বংসস্তূপে ঘেরা পথের অলিগলি ফুঁড়েই এগুচ্ছে আমাদের ভাষার দুর্জ্ঞেয় মহাকাল খুঁজে ফেরা-- চিনে নেয়ার ভবিষ্যত।
আরিফুল ইসলাম :‘কবির স্বাধীনতা’ আপনার মূল্যায়ন কী?
.
হেনরী স্বপন : কবির স্বাধীনতা, মানে কিসের স্বাধীনতা! লেখার নাকি জীবনের? আমাদের তো এখন লেখার স্বাধীনতা বলতে কিছু নাই। লেখক জীবনের স্বাধীনতাও সবার ক্ষেত্রে আছে কী? তুমি লালনের কথা ভেবে দেখ, লেখা এবং লেখক জীবনের স্বাধীনতা ছিল তাঁর। ফলে সমাজ রাজনীতি এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বাইরের যে স্বপ্নগুলো তাঁর মধ্যে ছিল, সত্তার দিক থেকে তাঁর যে দরবেশ বা ফকিরি দর্শণ এবং সেই লেখাগুলো লিখতে তাঁর যে পরিমান ফ্রিডম বা ত্যাগ ছিল, সে রকম পরিস্থিতি এখন আমাদের ক্ষেত্রে আছে কী? হয়তো তখনো ধর্মীয় নেতাদের উল্ফন ছিল কিন্তু এখনকার মতো জঙ্গীপনা তো ছিলনা। বলতে পারও লেখকের স্বাধীনতার বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ নজরুলেরও ছিল। হয়তো তাদের স্বাধীনতা ভোগের প্যাটার্ন ভিন্ন ছিল। এখন আমরা কি কেউ লেখার জন্য দরবেশ বাউল ফকির হয়ে উঠতে পারছি? পারছি না তো? না আতআয় পারছি-- ফিজিক্যালিও পারছি না। তবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পেরেছিলেন, “রাতের কল্লোল শুধু বলে যায়-- ‘আমি স্বোচ্ছাচারি’।”
আরিফুল ইসলাম :গদ্য কবিতাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? অনেক তরুণ কবিই গদ্য কবিতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। গদ্য কবিতার ভবিষ্যৎ কী?
.
হেনরী স্বপন : বাংলাকাব্য মানেই-- ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্পের দ্বারা ভাবের বহুবর্ণিলতায় অন্তর্গত প্রাণস্পন্দনের সৃষ্টি। হয়তো এর সঙ্গে কল্পনা চিন্তা ও ভাবের স্বতন্ত্র সমন্বয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন শৈলিগত উপকরণ থাকতে হয়। তবে, হালের অধিক চর্চিত গদ্যকবিতা নামক পয়ারপদ্যের আকৃতি, প্রকৃতি ও প্রকরণগত আঙ্গিক পুরোপুরি টানাগদ্যের মতো বলেই, এর পৈতে সর্বস্ব পরিচয়-- গদ্যকবিতা।
যদিও গদ্যকবিতার সম্পর্ক গদ্যের সঙ্গেই, যা মূলত ইংরেজী পাশ্চাত্যের ’ফ্রি ভার্সীয়’ ছন্দ বিবর্জিত কবিতা হিসেবেই গণ্য হত। আবার আঙ্গিক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও যুক্ত। ফলে ইংরেজী সাহিত্যের ধারায় যেমন ’প্রোজ পোয়েম’ হিসেবে পরিচিত-- তেমনি ফরাসি সাহিত্যে ‘পোয়েম এন প্রোজ’ বলে চিহ্নিত হয়। তাই, গদ্যকবিতাকে পাশ্চাত্যের সাহিত্যধারা হিসেবেই বিবেচিত এবং পাশ্চাত্যকে মনে রেখেই এই ধারায় কবিতা লেখার ব্যাপক উৎসাহ পরিলক্ষ্যিত হচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি, এখনকার অতি তরুণদের অধিকাংশের কবিতা এই বিভ্রান্তির দ্বৈততায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে, এ কথা নির্দিধায় বলতে পারি, এখনকার তরুণ/ অতিতরুণ অনেক কবির শব্দরন্দ্রে গদ্যবেশী কবিতায়-- কাব্যের তীক্ষ্ণনিশ্বাস তেমন টের পাই না। লঘু কিংবা মধুর বিষয়ে যতো গভীরতা দরকার সে-ও পাই না। সরল গল্প, ভাষার ভারহীন বাক্য-- কাটা কাটা সরল- তরল কোনও প্রকার ছন্দাহ্লাদিতোও হচ্ছে না। তবুও তো, প্রতিনিয়তই গদ্য ও কাব্যের ছোপ ছোপ রঙের চিত্রকল্পে আঁকা হচ্ছে বহু গদ্যকবিতার ক্যানভাস জুড়ে ভ্যাঁনগগের প্রিন্ট ভার্সন। বাংলাকবিতা চর্চার ক্ষেত্রে এপার-ওপার দুইবাংলায়ই গদ্য কবিতা চর্চায় এখন সমান উৎসাহ দেখা যায়।
বলা যায়, বাংলা কাব্যসাহিত্যের আধুনিক ধারায়-- টানা গদ্যকবিতার সার্থক ফুলকিটি সর্বপ্রথম ছড়িয়েছেন কবি অরুণ মিত্র এবং আব্দুল মান্নান সৈয়দ। অবশ্য এই ধারার কবিতার আরম্ভটি করতে চেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সয়ং। তিনিও তিনি ‘কবিপুস্তক’ গ্রন্থে কিছু গদ্যকবিতা প্রকাশ করেছিলেন। এরপর বলা যায়, এই মহান জার্নির আভিযাত্রায় একে একে মাইকেল মধুসুদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটিও যুক্ত করতে হয়। কেননা, এই ইতিহাসের ধারায়-- পুস্পাঞ্জলি থেকে-- লিপিকা পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্র এবং রাবীন্দ্রগদ্যের ও কবিতার বিবর্তন ও বাঁক- পরিবর্তনকে যদি সে রকম বিবেচনায় নেওয়া যায়, তাহলে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে টানা গদ্যকবিতার উন্মেষকে ছন্দ-- বিবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে তেমনটা সম্পৃক্ত করা যায় না, যতোটা অঙ্গীভূত করা যায় শিল্প-- আঙ্গিক বিষয়ের অনুসন্ধান ও ভাবনার সঙ্গে।
এখনকার অনেক কবিরই কবিতা সম্পর্কে স্বচ্ছধারণা ও নিবিড় অনুশীলনের প্রজ্ঞা পরিশীলিত জ্ঞানের মসৃণতাও বহু কবির লেখায় দেখা গেছে। এদের আনেকের লেখায়ই ব্যাক্তিগত অভিপ্রয় জড়িত হলেও গদ্য-পদ্য উভয় কবিতা রচনার ক্ষেত্রে নিজস্ব চিন্তা ব্যক্ত করার ফলে গদ্যের ভাষা যতোই দর্বোধ্য হয়ে উঠুক না কেন? পরিচ্ছন্ন গদ্যের চিত্ররূপময়তায়... একদিন এইসব কবিদের ভাবনাই হয়তো গদ্যকবিতার মৌলিক ভাবনারূপে সম্মানিত হয়ে উঠবে অপর কবি ও অগণিত পাঠকের আত্মায়...।
আরিফুল ইসলাম :আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশের সাহিত্যে বর্তমানে অশ্লীলতা বা ‘নোংরামি’ বাড়ছে?
.
হেনরী স্বপন : আমাদের সাহিত্যে বর্তমানে অশ্লীলতা বাড়ছে এটা ঠিক নয়। তবে নোংরামি বাড়ছে এতে কোনও সন্দেহ নাই। আসলে সাহিত্যের মধ্যে অশ্লীল ট্যাগ কারা আরোপ করে? কোন শব্দ শ্লীল আর কোনটি অশ্লীল সেটাই বা ঠিক করছেন কারা? কোন এলিট সোসাইটি, চুতিয়া ব্রাক্ষ্মণ, পাদ্রী পুরোহিত মাওলানারা ঠিক করে তো? কিন্তু আমি তো জানি, এই সমাজে এরাই কাজের মেয়েকে খুব বেশি ধর্ষণ করে, এদের দ্বারাই মাদ্রাসা, এতিমখানা, সেবকালয়ে বলাৎকারের ঘটনা লাগাতার ঘটে থাকে। সমাজের এই রূঢ়বাস্তবতার কথা, সমাজের এইসব নোংড়ামির বিচিত্র বীর্যস্খলেনের কথা লিখলেই, সেটাতে হৈহৈ রৈরৈ শুরু হয়ে যায়, সাহিত্য গেল...গেল বলে নোংরা হয়ে যায়। অশ্লীলতা বলে আখ্যায়িত হয়।
তবে... আমার তো মনে হয়, শ্লীলতা কিংবা অশ্লীলতা যাই বলনা কেন, এর কোনটাই কিছু বাড়েনি আবার কমেওনি। বরং এর সীমারেখার ইলাসটিসিটি হয়েছে যার যার স্বার্থের দিকে। তবে, প্রতিনিয়ত অশ্লীলতার সজ্ঞা পাল্টেছে। করণ, আজকে যা অশ্লীল ছিল কালকে তা শ্লীল হয়েই সমাদৃত হয়েছে। সমরেশ বসুর প্রজাপতি, বিবরÑ কি এখন আর অশ্লীল বলে বিবেচিত হয়। হয় না তো! বরং মহৎ সাহিত্যকর্ম হিসাবে মহাকাল উত্তীর্ণ হয়ে উঠছে। কিংবা ধর...১৯৬১-- ৬৬ সাল পর্যন্ত হাংরি অন্দোলনের সমালচিত অশ্লীলতা কিন্তু আজকে কাউন্টার কালচারাল আন্দোলনের মুকুট পরে ইতিহাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। জয়দেব কিংবা বিদ্যাপতি যে পরিমান যৌনতার চর্চা করে রেখে গেছে, সেরকম করেই বা আমরা কতোটা লিখতে পেরেছি...!
আরিফুল ইসলাম :সাহিত্যে খোলামেলা ভাষা বা যৌনতার প্রকাশ কি ‘নোংরামি’, নাকি সাহসী সত্যউচ্চারণ?
.
হেনরী স্বপন : কাহিনী কামনা ও পরিতৃপ্তির প্রয়োজনে শরীর আর তার কামনার অনুপুঙ্খ প্রকাশের জন্য খোলামেলা ভাষায় সাহিত্যে যৌনতার প্রকাশ কখনোই পর্নোগ্রাফির পর্যায়ে পড়েনা। তবে খোলামেলা যৌনতা প্রকাশের ক্ষেত্রে এক ধরণের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাধিগুলো স্পষ্ট হতে থাকে বলেই, মোড়ল, মাওলানা, পুরোহিত বর্গের কেউ কেউ এবং কখনো কখনো গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও যৌনতার প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। মুক্ত যৌনতাকে কেবল পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কেউই সহ্য করতে চায়না।
ফলে মুক্ত ও স্বাভাবিক যৌনতার খোলামেলা প্রকাশকে যারা খুব বেশি ভোগ করে, কেবল তারাই তাদের নষ্টামিকে মাস্ক পরিয়ে দিতে নোংরামির তকমায় যৌনতাকে এঁটে দিয়ে বিরোধিতা করে। কিন্তু যৌনতা বা ইরোটিকের মধ্যে যে, সৌন্দর্য আছে, সে তো কর্ণাটকের দেয়াল ও গ্রিক স্থাপত্যের মুগ্ধতায় জ্বলজ্বলে হয়ে আছে।
আরিফুল ইসলাম :একটি সাহিত্যিকে আপনি কিভাবে বোঝেন কোনটি শিল্প, আর কোনটি অশ্লীলতা?
.
হেনরী স্বপন : আদীতে স্বর্গোদ্যানের নগ্নতা তো শিল্পই ছিল। ইভ ও আদমের মতো দুজন নরনারী বিবস্ত্র হরিণের মতো বনময় ছুটে বেড়িয়েছে স্বর্গের চিত্ররূপময়তায়। যত্রতত্র অবাধে উলঙ্গ রতিক্রিয়া করেছে। কই?... তখন তো অশ্লীলতার প্রশ্ন ওঠেনি? তখন তো, কেই তাকে যৌণতাও বলেনি, নোংরামিও বলেনি!... না ঈশ্বর, ভগবান কিংবা আল্লাহরও তো এই নিয়ে কোন প্রশ্ন ছিলনা।
তাহলেই ভাবুন তো? এদোন উদ্যানের বৃক্ষরাজি, ফুল, পাখি, প্রাণীকূল, শীতের শিশির স্প্রে জড়ানো পাতায় পাতায় সবুজের উজ্জ্বলতা জড়ানো ইভ এবং আদমের নগ্নতা তখন, কি রকম, কতটা মহার্ঘ শিল্প কিংবা শিল্পের অশ্লীলতা ছিল? সেটা কিভাবে বুঝে নেয়া সম্ভব? এটা নিশ্চই সাম্প্রতিক ওটিটি প্লাটফর্মের হটেস্ট সেক্সিঅ্যাডল্ট কন্টেটের-- ওয়েব সিরিজ' প্লে করে বুঝিয়ে বলার দরকার পড়বে না বোধহয়...!
আরিফুল ইসলাম :অশ্লীলতা বনাম বাস্তবতা-- এই বিতর্কে আপনি কোন অবস্থানে?
.
হেনরী স্বপন : একজন লেখক কবি সাহিত্যিক অবশ্যই ঠিক করে নেবেন, সে কি লিখবে আর কি লিখবে না। তার লেখনির ভাষাই বা কি হবে। সাহিত্যের টেক্সট উপস্থাপনায় লেখক যদি ধর্ষণের বাস্তবতা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে লিঙ্গের কার্যকারিতা প্রকাশ করতে গিয়ে অণ্ডকোষের মতো ভাষা ও বাক্যবন্ধ লিখবেন সেটাই তো লেখকের বাস্তবতা। নাকি এইক্ষেত্রে লেখক ধর্ষকের ভূমিকাকে চন্দ্রপৃষ্টের জোছনা ছড়ানো রতিক্রিয়া বর্ণনায়, এটিকে প্রেমকাব্য করে তুলবেন?
তাই, বাস্তবতার নিরিখে প্রকৃত লেখকের ভাষা সঙ্গম শেষে অর্গাজমের পরিতৃপ্তির মতো আনন্দদায়ক হবে আর ধর্ষণের নেগেটিভ ফুটিয়ে তুলতে সেই ভাষার ভেতরে আগুন জমানো এবং জড়ানো থাকবে ততোটাই কামজর্জরিত বিদ্বেষ। এনিয়ে বিতর্ক কেবল মুর্খতা ছাড়া অর কিছু নয়।
আরিফুল ইসলাম :আপনি কি মনে করেন, পাঠকই ‘নোংরামি’ খোঁজে, নাকি লেখকই তা তুলে ধরে?
.
হেনরী স্বপন : সব লিখিয়ে যেমন লেখক নয়, তেমনি সব পাঠকও জ্ঞানান্বেষণের জন্য পাঠবিশ্বের অমৃত খুঁজে পান করে না। আসলে আমরা যারা ভাড়াকরা যৌনতায় সাময়িক আনন্দ খুঁজি? তার তো বিছানায় কখন কোন মূহুর্তে একজন রমণীর নিপল উত্থিত কামনার সিম্পটম কিসের জন্য সেটা বুঝে পাঠ করে না। কিন্তু প্রকৃত পাঠের আসল আনন্দ হচ্ছে জ্ঞানের আনন্দ গ্রহন। যা কেবল সিম্পটমের উ ৎস থেকেই বুঝে নিতে হয়।
নোংরামি-- যৌনবিকলনের ধরায় লেখা, যেমন-- একদল বিকৃত ভাড়াটে লেখকের কাজ। আর সেইসব নোংরামি খুঁজে খুঁজে পাঠ করেন, তেমনি একপাল অসভ্য ভাঁড়ারের দল।
আরিফুল ইসলাম :একজন কবি ও দার্শনিকের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় বলে আপনি মনে করেন?
.
হেনরী স্বপন : কবির কবিত্বটাই স্বত:স্ফূর্ত বিষয়, দার্শনিকতা তো শ্লোক কিংবা তত্ত্ববিশ্বের বিষয়-আশয়। কবি তার কাব্যজার্নির সবটুকু দম ও পরিশ্রম দিয়ে আবিস্কার করে কবিতার নিজস্ব ভাষা এবং আঙ্গিক। ফলে কবিতা কবির ইন্দ্রীয় জগতের বাসিন্দা হয়ে যতোক্ষণ ভাষা ও আঙ্গিকের মাধ্যমে রূপায়িত হতে চায় ততোক্ষণই কবিত্বতা। এরপর তা পাঠকের মেধা ও মননগ্রস্থ ভাবনায় ঢুকে বসলেই শুরু হয় দার্শনিকতার খেলা। তাই, কবিত্বের সঙ্গে দার্শনিকতার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু দর্শন ও কাব্যিকতা একে অন্যের পরিপূরকও।
তাহলে, কবিতা মায়া, কাম, ভ্রম ভাবনায় জর্জরিত, স্বপ্নে আচ্ছাদিত কবির বিষয় হলে দর্শন সেই পরিশ্রমের প্রবৃত্তি, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিষয়।
আরিফুল ইসলাম :ইদানীং শোনা যাচ্ছে প্রবীণ কবিদের চেয়ে নবীন কবিরাই অনেক ভালো লিখছে। ব্যাপারটা আপনার কাছে কী মনে হয়?
.
হেনরী স্বপন : নবীনদের মধ্যে বরাবরই তারুণ্যের শক্তি তেজ ও স্বভাবের ঔদ্ধত্যও থাকে। মোদ্দা কথায় নবীনদের স্বাভাবিক চাওয়া পাওয়ায়, এটাও মনে হতে পারে যে, নবীনরা যা লিখেছে সেটা প্রবীণদের লেখার থেকে-- তারাই মহান। আমি বলব, এই মহানত্ব নতুনদের উগ্র অহংকার! কারণ, অনেক কিছু ভাবাভাবির পরও বলতেই হবে যে, প্রবীণদের অভিজ্ঞতার সারাৎসার বলেও যেমন অনেক কিছু আছে, যা কখনোই একজন নবীনের পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব নয়।
ইদানীংয়ের এমন শোনা কথা কিংবা এমন অজুহাত আমি মানতে রাজি নই। নবীনরা অবশ্যই আমার কাছে স্বযত্নে স্বস্নেহে পূজনীয়। তাই বলে তারাই যে শ্রেষ্ঠ, এটি যে কিছু অপূর্ণ বোধের প্রতিফলন, তাতে কোন সন্দেহ নাই। আবার প্রবীণদের এভাবে জরাগ্রস্ত, জরাজীর্ণ ভাবারও কোন কারণ নেই।
ভালো লেখা, উৎকৃষ্ট লেখা, মহার্ঘ কবিতা এসব যতোটা অভিজ্ঞতা ও মননের পরিণতিতে পুঞ্জীভূত থাকে। আবার নবীনের তেজেও অনেক ভালো লেখার অপেক্ষা উদ্ভাবন অস্বীকার করা যায় না। আজকের প্রবীণ লেখক কখনও, সেও তো নবীনতর ছিল।
এককালে আমিও তারুণ্যের টগবগে ছোঁয়ায় রবীন্দ্রনাথকে থোরাই জ্ঞান করতাম। কিন্তু এখন প্রতিদিনই আমার মনে হয়, আমার অগ্রজেরাই বাংলা কবিতাকে উৎকর্ষতা দিয়ে গেছেন অনেক। উ ৎকৃষ্টও করে রেখে গেছেন নান্দনিকভাবে।
আর আমরা তো সেই-- উৎকৃষ্ট, উৎকর্ষ, নান্দনিকতার পথ ধরেই আজকের নবীন কবিতার 'ব্রেক থ্রু' পথ মারিয়েই এগুচ্ছি।
তাই, আমি আস্থা বিশ্বাস সবটাই কেবল প্রবীণের হৃদয় নির্ভরতার পক্ষে এবং সেইসাথে আমার সকল, 'বিশ্বাস বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালে, সমভাবে'... গুরুত্বপূর্ণ।
আরিফুল ইসলাম :কবিতার ক্ষেত্রে দশক ভিত্তিক কোন সংজ্ঞা আছে কি? যদি থাকে, আশি থেকে শূন্য দশকের সংজ্ঞাগুলো কি কি বলে আপনি মনে করেন ?
.
হেনরী স্বপন: থেকে আংশিক এবং কিছুটা অধ্যাপকীয় আলোচনার, দৈনিকের তোষণ চিন্তা এবং পোষাকবি তৈরির চিন্তা, লিটল ম্যাগাজিনের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং বেনিয়াবৃত্তিক দশকওয়ারি সংকলন প্রকাশের ধারা থেকেই আজকের এই দশক চিন্তার তৈরি হয়ে চলেছে। যা আজকে আমাদের কবি এবং কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করছে। কিন্তু দশকের প্রয়োজন হলো কেন? পাঠকের বোঝার স্বার্থে! কবি না কবিতাকে বোঝার স্বার্থে? এই প্রশ্নগুলো এখন আরও জরুরী। কবি কতোটা ভার্জিন বোঝানোর প্রয়োজনে পাঠক অথবা কবিতা কারোরই প্রয়োজন নেই। আমাদের মনে রাখা উচিত-- কবি অথবা সময় নিঃশেষ হয়, কিন্তু টিকে থাকে কবিতা।
অথচ কবিরা কেবল নিজেদের গায়ে দশকের এই লেবেল এঁটে, এক ধরনের বিচ্ছিন্নতায় মেতে উঠছে। আর এই লেবেল ধরেই চলছে অস্বীকার পর্ব। যেনো দশকটাই এক মহাকালের রাজত্ব। ফলে এই কালকে সর্বস্ব তৈরি করে, বিচ্ছিন্নতা আরোপ করে, অন্যকে অন্ধত্ব আরোপ করে, নিজেকে মূর্খ আলোয় আলোকিত হয়ে দেখাতে চান-- তিনিই আশি, নব্বই, শূন্যের ভাড়ারে সবচেয়ে উজ্জ¦ল এবং অবিনশ্বর কবি। অথচ, যেখানে কবিতা কাল নিরপেক্ষ হয়ে ওঠার কথা অথবা সম্মুখ সময় মনে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে স্পষ্ট থাকার কথা। সেখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের সংকীর্ণ করে, আত্মঘাতী এই দশকীয় খেলায় মেতে উঠছি।
সজ্ঞা হচ্ছে কাঠামোমাত্র, আমি মনে করিÑ দশক বিচারের ঘেরাটোপে ফেলে কবিকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন নেই। কারণ, কবিতার কাঠামো, দর্শন, মেধা ও চিন্তা... এতোসব দশক ধরে আগায় না। বিচার/ বিভাজন যদি করতেই হয়, তবে এখন সেটা কবিতা বিভাজনের সময় এবং সময়ের যে কোনো সুবিধাজনক ব্যাখ্যা যেন কবিতাকে ঘিরে, তার সৃষ্টিকে ঘিরেই হয়। হওয়া উচিত...। কেননা, দশক-তারুণ্য, লিটল ম্যাগাজিন কেন্দ্রিক গোষ্ঠীবদ্ধতা, অস্বীকারের তত্ত্ব, ব্যক্তি আক্রমণ-- এসবই প্যারাসাইড কাঠামো। যা কেবল আমাদের কবিতা নির্মাণে প্রভাব ফেলে, ক্ষতি বাড়িয়ে গ্যাংগ্রিন করে তোলে...।
আরিফুল ইসলাম :আপনি এক সময় লিটল ম্যাগ বের করতেন। সেই সম্পর্কে জানতে চাই।
.
হেনরী স্বপন: একটি ছোটকাগজ-- সত্যিকারের ছোটকাগজ কি না, তা নির্ভর করে ঐ কাগজটির সহ্য ক্ষমতা এবং সম্পাদকের মেধা ও মনন মিশ্রিত দূরদর্শিতার উপর। কাগজটিকে হরেক রকম বানানো তর্কের সাচে ফেলে ‘প্রতিষ্ঠান/ অপ্রতিষ্ঠান বিরোধী...ছোট কাগজের লেখক/ বড় কাগজের লেখক...’ এইসব প্রলাপে প্রবাহিত হয়ে লিটল ম্যাগাজিন করা মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। মেধা ও বোধ কোনো সম্পাদকের নিজস্ব হতে পারে। কিন্তু এর সহ্য ক্ষমতা বলতে, আরও অনেক কিছুকে বোঝায়। আর তা বোঝাতে, ওই কাগজটি শিল্পমান সম্পন্ন হয়ে ওঠার নতুনত্বে এবং অভিনবত্বে-- যে কোনো রকমের প্রাণস্পর্শী লেখা প্রকাশের জন্য তার দরজা কতটা খোলা রাখে। কতবেশি লেখককে নয়, লেখাকে আমন্ত্রণ জানায়। ফলে এ-রকম একটি প্লাটফর্ম থেকেই তৈরি হয় ছোটকাগজের পরিচয়...। তাই, আমাদের ছোটকাগজ কনসেপ্ট মানেই : সে লেখকের ভাল লেখাটি ছাপতে চায়। নিজেদের সাথে প্রথম সংযোগের আনন্দ খুঁজে নিতে। যার কোন রুদ্ধতা নেই। মেনিফেস্টোও নেই...। তার মানে লিটল ম্যাগ কেবল বহুগামী নয়। সমৃদ্ধ-- বহুগামী ! কারণ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা এখন তো ফ্যাশনে আটকে গেছে। কিংবা পাঠক যোগাযোগের বদলে-- লেখক যোগাযোগের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। যা অনেক লেখকের ক্লাসিক নির্মাণের নীরবতাকে ভেঙ্গে দেয়। নৈ:শব্দের ধাঁধায় ফেলে...।
ছোটকাগজ লেখক জন্ম দেয় আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকৃত লেখকের মৃত্যুর জন্যও ছোটকাগজকে দায়ি করা যায়। অনেক ছোট কাগজের সম্পাদককে দেখেছি, লেখক/ কবিকে মুখ্য করে, লেখাকে নয়। আমি দীর্ঘদিন যাবৎ ‘জীবনানন্দ’ করেছি। আমরা জীবনানন্দ’কে পুরোপুরি কবিতার কাগজ করেই এর চরিত্র গড়ে নিতে চেষ্টা করেছি। জীবনানন্দ--: ছোট কাগজ/ বড় কাগজ এই খেলায় মেতে ওঠেনি। যে সকল কবি/ লেখক প্রবল বড় কাগজ বিরোধী, তাদেরই তো আবার বড় কাগজে হজম হতে দেখেছি। প্রতিষ্ঠান/ অপ্রতিষ্ঠান এই তকমায় বিরোধী হতে হতে সেই কাগজই-- মানসিকতায়, প্রতিষ্ঠান হয়ে সীমিত কেন্দ্র, গোষ্ঠীবদ্ধতায়, আত্মকেন্দ্রিক ভূত হয়ে যেতেও অনেক দেখেছি। এই যে নক্ষত্র পতন চলছে, এর মূলে কোনও লিটল ম্যাগাজিন কাউকে নক্ষত্র হতে উসকে দিতে আসে নি। জীবনানন্দ’ কবিতাপত্র... সেই নক্ষত্র নির্দিষ্ট করতে পেরেছে কি, পারে নি, আমাদের জানা নেই। তবে কবিতা হয়ে ওঠার বাইরে কোন রকম খণ্ড দর্শনে শক্তিক্ষয় করতে চাইনি। জীবনানন্দ’ কবিতাপত্র সব কবিকেই অবলীলায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে।বয়স-ব্যক্তি কোন কিছুই মুখ্য ছিল না জীবনানন্দ এর প্লাটফর্মে। তবুও আমরা বহুরকরম বহু প্রতিষ্ঠিত কবির লেখা যেমন মনে রাখি নি। ছাপিও নি, আবার বহু তরুণের কবিতা ছেপে ‘জীবনানন্দ’ কবিতাপত্র নিজেকে সমৃদ্ধ মনে করেছে। তারপরও আমাদের ডাস্টবিন ছিল অনেক বড়। অনেক লেখক, অনেক কবির ভুল লেখা আমরা ছাপিনি। যদিও তরুণদের বেলায় কিছু কিছু ভুল থেকেই যায়। থেকেও আছে...। তাছাড়া প্রতিশ্রুতিশীল সব লেখকেরই সত্যিকার শিল্প-- মানসম্পন্ন লেখাটি প্রথম ছোটকাগজেই বেরোয়। এরপরে সে পাঠকের কাছে পৌঁছোয়। যদিও বই পাঠককে সুবিধা দেয় কিন্তু সংযোগটা ঘটায় ছোটকাগজই।
আরিফুল ইসলাম :একজন কবির লেখালেখির পূর্ব প্রস্তুতি কি হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন ?
.
হেনরী স্বপন : লেখক হওয়ার পূর্ব প্রস্তুতির অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে, নিজের অন্তরে প্রথম প্রেমে পড়ার মতো ঘোর তৈরি করা। এক্ষেত্রে লেখক তার প্রেমিকাকে জানতে বুঝতে যতোটা ইনভলবমেন্ট পুষে রাখেন। লেখালেখির পূর্ব প্রস্তুতিতে একজন কবিকেও ততোটাই সাহিত্যের সমস্ত ক্লাসিকগুলোর পাঠ নিজের আত্মায় স্থান করে দিতে হবে অবলীলায়। পাশাপাশি নিজেকে রীতিমতো গ্রাস করে ফেলতে হবে পাঠবিশ্বের হাঙর মুখে।
তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, একজন লেখকের পাঠবিশ্ব কি হতে পারে? শুধু কি পুস্তক পাঠেই কবিতার প্রেম গদগদ হয়ে উঠবে। মোটেই না, এই পাঠ নিজের জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়া, প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পিত হওয়া, বৃক্ষ ফুল পাখি পশু, মানুষের এনাটমি, এনথ্রোপলজি, এমন কি সারি সারি ছুটে চলা পিঁপড়ের চুমো খাওয়াও পাঠ করে নিতে হবে, প্রেমিকাকে জাপটে ধরা ভালোবাসার মতো...।
তই, লেখক হয়ে ওঠার জন্য য়েমন, মহাকাশ- মহাকাল ইতিহাস ঐতিহ্যকে জানার নিমিত্তে আধ্যাত্মিকতার মতো ধ্যনি হতে হয়। তেমনি লেখালেখির বিষয় যে যতো বেশি সিরিয়াস! সত্যিকার অর্থে তার/ তাদের লেখাগুলোই পাঠকের জন্য মন্ত্র হয়ে উঠবে।
আরিফুল ইসলাম :নতুন যারা লিখছেন তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন ?
.
হেনরী স্বপন : আসলে এই যে তোমার, নতুন যারা আসছে? তারা তো প্রাইমারির ছাত্র নয়। আমি তাদের শিক্ষকও নই। তাহলে এই নতুনেরা কারা? এরা যেহেতু লেখক-- ক্রিয়েটর। ফলে, আমিও একজন নূন্যতম লিখিয়ে হিসাবে, প্রত্যেক নতুন ক্রিয়েটরকে ভালোবাসা জানাই। অভিনন্দন সবাইকে।
...