সুহৃদ আকবর : ছোট্ট বন্ধুরা আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন পড়ালেখা শেষ করে মা বা দাদুর সাথে যখন ঘুমাতে যেতাম, তখন আমরা আমাদের মা’দেরকে গল্প বলার জন্য বিরক্ত করতাম। তখন মা, দাদু গল্প শুরু করতেন, রাজা-বাদশাহ, ময়ূর সিংহাসন, রূপকথার পরীর রাজ্যেও কাহিনী শুনতে শুনতে আমরা হারিয়ে যেতাম ঘুমের রাজ্যে।
আমাদেও প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনও এমন ছিল। তিনি ছোটবেলায় মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতেন, গল্প শুনতেন। একসময় হারিয়ে যেতেন ঘুমের রাজ্যে। সে রাজ্যের যেন তিনিই একমাত্র রাজা। কত মুক্তা মানিক সংগ্রহ করতেন তিনি। সকাল হলে পাখিরা জাগার আগে তিনি ঘুম থেকে উঠতেন। গাঁয়ের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি চলে যেতেন-দূর বহুদূর। বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে রাখালিয়া বাঁশির সুর তুলতেন। সে সুর চলে যেতন গ্রামের পল্লী বধূও কানে। মসজিদে ইমামতি, লেটো দল, পালাগান, নাটক, কবি গান এসব নিয়ে ছোটবেলায় কতই না মেতে থাকতেন। ফলে গাঁয়ের এসব স্মৃতি-অভিজ্ঞতা ভারি করে দেয় তার শিশু সাহিত্যেও ঝুড়ি।
শিশুরা হলো জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। বলা হয়ে থাকে আজকের শিশু আগামীদনের নাগরিক। তাই শিশুদেরকে সঠিক পরিচর্চার মাধ্যমে গড়ে তোলা আমাদেও নৈতিক দায়িত্ব। আর আমরা যদি আমাদের এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করি তবেই আমাদের সার্থকতা। ইতিহাস অধ্যয়ন করে জানতে পেরেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও সময় হিটলার গোটা ইংল্যান্ডের সকল মানুষের জন্য জনপ্রতি একটি করে বোমা নিক্ষেপ করছিল; তখন ইংল্যান্ডের জ্ঞানীরা ভাবতে লাগলো এত ভীষণ বিপদ! কী করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। যেভাবেই হোক তাদেরকে তো বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। অতঃপর তারা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে, আমরা আমাদের শিশুদেরকে এবং শিক্ষকদেরকে আমাদেও ঔপনিবেশ অস্ট্রেলিয়ায় প্রেরণ করবো। আর আমরা থাকবো যুদ্ধের ময়দানে। আমরা মারা গেলেও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মতো বেঁচে থাকবে। শিক্ষকরা আমাদের শিশুদেরকে উইজডম শিক্ষা দিবে। যারা আগামীতে নেতৃত্বের যোগ্যতা লাভ করবে। তাই শিশুদেরকে নিয়ে চাই সঠিক ভাবনা আর চিন্তা। না হয় আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গঠন করতে ব্যর্থ হবো। তাইলে আমাদেও কপালে আরো লাঞ্ছনা অপেক্ষা করছে।
প্রমথ চৌধুরী শিশু সাহিত্যকে সোনার পাথর বাটির সঙ্গে তুলনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথও পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছিলেন কথাটা। কিন্তু একটু ভিন্ন ভাষায়; সরাসরি শিশু সাহিত্য প্রসঙ্গে না হলেও তিনি বলেছিলেন- ‘‘সহজ কথা লিখতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে। তিনি আরো বলেছিলেন : ‘‘পৃথিবীতে সোজা কাজটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। পুকুরের জল কি পারে ঝর্ণার জলের মতো সহজে ফেনার নূপুর পরে নাচতে’’। রবী বাবুর কথার উপরে তর্ক করা যায় না। বিদ্যাসাগর থেকে ঠাকুর পরিবার, ঠাকুর পরিবার থেকে রায় পরিবার পর্যন্ত বহু বিদগ্ধ কবি-সাহিত্যিক বিভিন্ন রচনায় সমৃদ্ধ করেছেন শিশু সাহিত্যকে। এদের মধ্যে কেউ পেশাদার, কেউ বা নিতান্ত শখের বশে এসেছেন শিশু সাহিত্য ভুবনে। আমাদের নজরুলের আগমনটা অনেকটাই এরকমই। নজরুল মূলত কবি শিশু সাহিত্যিক নন। তারপরও শিশুদের জন্য যা লিখে গেছেন; অনেক প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকও তা পারেননি। তার শিশু সাহিত্য রচনার কোন সঠিক কালপঞ্জি নেই। কবে থেকে তিনি এ কাজে উৎসাহী হয়ে উঠেন তার কোন সঠিক নির্ঘণ্ট নেই। তবে গবেষকদের লেখা থেকে জানা যায় তার শিশু সাহিত্য জগতে প্রবেশের ঘটনাটা বেশ মজার।
১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। নজরুল তখন তের মাস জেল খেটে সবে ছাড়া পেয়েছেন। থাকতেন ইন্দ্রসেন পরিবারের সাথে কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকায়। সেখান থেকে কিছুটা দূরে মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে বাস করতেন কবির এক বন্ধু নাম ছিল আলী আকবর খাঁ। সে বন্ধুর কিছুটা ছড়া লেখার বাতিক ছিল। রোজ বিকেলে তিনি একগাদা ছড়া নিয়ে হাজির হতেন কবির কাছে। কবির ভাষায়- ‘‘সেসব ছড়া ছিল অখাদ্য এবং চরমভাবে কর্ণ ও মর্মপীড়ার কারণ’’। কবি প্রায়ই তাকে ছড়া নিয়ে আসতে নিষেধ করতেন কিন্তু কে শোনে কার কথা। পরে একদিন বাধ্য হয়ে বন্ধুকে ঠেকাবার জন্য লিখলেন ‘লিচু চোর' নামক ছড়াটি।
‘‘বাবুদের তাল পুকুরে
হাবুদের ডাল কুকুরে
সেকি বাস করলে তাড়া
বলি থাম, একটু দাঁড়া।’’
গবেষকরা মনে করেন ‘লিচু চোর' ছড়াটির মাধ্যমে নজরুলের শিশু সাহিত্য রচনার হাতেখড়ি হয়।
কোন বিশেষ কারণ ছাড়া নজরুল কোন শিশু সহিত্য রচনা করেননি। এই ধরুন ‘খাদু দাদুর ছড়া'। খান বাহাদুর আনোয়ার হোসেন তিনি ছিলেন বৃটিশ সরকারের একজন কর্মচারী। তার এক মেয়ের সাথে লেখালেখির সূত্রে পরিচয় ঘটে নজরুলের। মাঝে মাঝে তিনি বেড়াতে যেতেন তাদের বাড়িতে। কিন্তু নজরুল ছিলেন আপাদমস্তক বৃটিশবিরোধী। তাই তিনি সঙ্গত কারণেই পছন্দ করতেন না আনোয়ার সাহেবকে। একবার কি এক কারণে বাপ আর মেয়েতে ঝগড়া লাগে। রাগের মাথায় একমাত্র শিশু কন্যাকে সাথে নিয়ে খান সাহেবের মেয়ে চলে এলেন কবির বাসায়। নজরুল একদিন খেয়াল করলেন ছোট্ট মেয়েটির মন খারাপ। কবির বুঝতে বাকি রইল না যে, দাদুকে না দেখতে পেয়েই এমনটি হয়েছে। তখন মেয়েটিকে খুশি করার জন্য প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বসলেন খাতা কলম নিয়ে। লিখলেন চমৎকার একটি ছড়া। নাম ‘খাদু দাদু'। ছড়াটির মূল বিষয় ছিল খান বাহাদুর সাহেবের নাক। তার নাকটি ছিল একটু খাড়া। আর সেটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি লিখলেন-
‘ওমা, তোমার দাদুর নাকে কে মেরেছে ল্যাং...।'
এরপর আসি ‘ঝিঙেফুল' এর কথায়। নজরুল তখন মোগলপুর লেনের বাসিন্দা। পাশের বাসায় একটি ছেলে তার বাসায় খেলতে এসে রোজ ঘুমিয়ে পড়ত। ছেলেটির প্রিয় ফুল ছিল ঝিঙেফুল। তাই লিখলেন এই কবিতাটি।
‘ঝিঙেফুল ঝিঙেফুল
সবুজ পাতার দেশে
ফিরোজিয়া ঝিঙেফুল।'
১৯২১ সালের কথা। নজরুল একবার কুমিল্লায় বেড়াতে গেলেন। উঠলেন ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে। তার ভারি দুষ্টু আর মিষ্টি একটা মেয়ে ছিল। নাম ছিল অঞ্জলি। বিকেল বেলায় মেয়েটি পেয়ারা খাওয়ার জন্য গাছতলায় গিয়ে গাছের উপর কাঠবিড়ালি দেখতে পেত। প্রত্যহ মেয়েটির এমন আচরণ থেকে নজরুল লিখলেন- ‘খুকী ও কাঠবেড়ালি' কবিতাটি।
কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি
পেয়ারা তুমি খাও?
গুড় মুড়ি খাও?
দুধভাত খাও?
বেড়াল বাচ্চা? কুকুর ছানা? তাও?
নজরুল দু’তিনবার চট্টগ্রামে যান। সেখানে গেলে হাবীবুল্লাহ বাহার ও তাঁর ছোট বোন শামসুন্নাহারদের বাড়িতেই উঠতেন কবি। সেখানেও তিনি শিশু সাহিত্য রচনার প্রেরণা পান। শামসুন্নাহার মাহমুদের জ্যেষ্ঠ সন্তান তিন মাসের ছেলের জন্য লিখলেন- ‘শিশু যাদুকর' কবিতাটি। এদিন হাবীবুল্লাহ বাহার কবিকে বললেন, এবার শিশুদের জন্য কিছু লিখুন না। পরদিন সকাল বেলায় কবির খাতায় পাওয়া যায় ‘সাত ভাই চম্পা' নামক বিখ্যাত কবিতাটি।
বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত, নজরুল স্মৃতি বইতে সুখলতা রাও ‘প্রভাতী' কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘মানুষের জীবনে প্রত্যেক দিনই প্রভাত আসে। ভোর হয়। সুন্দর একটি সকাল দিয়ে প্রতিটি দিনের কাজ হয় শুরু। তা নজরুল তাঁর ‘প্রভাতী' কবিতা দিয়ে সব শিশুদের সম্মুখে যেন এক চির-চেনা প্রভাতকে নতুন সাজে এনে মেলে ধরেছেন। তার এই কবিতায় নানা রঙে রাঙা প্রভাতের ছবিটি কী মনোমুগ্ধকর! পাহাড়ী ঝর্ণার মতো শীর্ণ, অথচ চঞ্চল গতিতে চলছে এগিয়ে-
ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি উঠো রে!
ঐ ডাকে জুঁই শাখে ফুল খুকি ছোটো রে!
খুমুমণি ওঠো রে!
রবি মামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ঐ,
দারোয়ান গায় গান শোনো ঐ, রামা হৈ।....সত্যিকারের সাড়া জাগাবার মতো কবিতা ঐ একটিই ঐ ‘প্রভাতী'। (পৃষ্ঠা-১২৬)
শিশুদেরকে নজরুল খুব ভালবাসতেন। তাদের সাথে খেলা করতেন। গল্প করতেন। ফলে ছন্দমাধুর্যে ও বর্ণনাভঙ্গির গুণে বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে তার শিশু রচনা। তিনি বলেন-
‘খোকার মনে ঠিক মাঝখানটিতে
আমি যদি পারি বাসা নিতে।' হাস্যরসপ্রবণ কবিতা রচনাতেই নজরুল প্রতিভা অধিক সার্থক। একদিকে-
‘আমি হব সকাল বেলার পাখি'
কিংবা
‘আমি যদি বাবা হতুম,
বাবা হ'ত খোকা,
না হলে তার নামতা পড়া, মারতাম মাথায় টোকা।'
নজরুলের বিখ্যাত শিশু-সাহিত্যগুলো কখন প্রকাশিত হয়েছে। এবার আসি সে আলাচনায়। নিচে সাহিত্যগুলোর নাম ও প্রকাশকাল উল্লেখ করা হল -
ঝিঙেফুল। কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল-১৯২৬।
পুতুলের বিয়ে। কবিতা ও নাটিকা। প্রকাশকাল-১৯৩৩।
সঞ্চয়ন। কবিতা ও নাটিকা। প্রকাশকাল-১৯৫৫।
পিলে পটকা-পুতুলের বিয়ে। কবিতা ও নাটিকা। প্রকাশকাল-১৯৬৩।
ঘুম জাগানো পাখী। কবিতা। প্রকাশকাল-১৯৬৪।
ঘুম পাড়ানী মাসী পিসী। প্রকাশকাল-১৯৬৫।
সাত ভাই চম্পা। প্রকাশকাল-১৯৮২।
ফুলে ও ফসলে। প্রকাশকাল-১৯৮২।
ভোরে পাখী। প্রকাশকাল-১৯৮২।
তরুণের অভিযান। প্রকাশকাল-১৯৮২।
মটকু মাইতি। প্রকাশকাল-১৯৮২।
জাগো সুন্দর চির কিশোর। প্রকাশকাল-১৯৮২।
এছাড়াও ১৯৩০ সালে নাটক ‘ঝিলিমিলি' প্রকাশিত হয়। এতে ‘সেতুবন্ধন' ও ‘ভূতের ভয়' নামে যে দু'টি রূপক নাটিকা আছে তা শিশুদেরও ভালো লাগবে।
কাজী নজরুল ইসলাম শিশুদের উপযোগী শুধু কবিতা আর নাটকই রচনা করেননি। তিনি শিশুদের জন্য গল্পও লিখেছেন। পদ্মগোখরো, জিনের বাদশা, অগ্নিগিরি এই তিনটি গল্প ‘শিউলী মালা' গ্রন্থের অন্তর্গত। এটির প্রকাশকাল-১৯৩১ ইং। জিনের বাদশা ও অগ্নিগিরি এই গল্প দু'টিতে নজরুলের কৈশোর জীবনের কিছুটা স্মৃতির প্রভাব রয়েছে।
নজরুল স্বভাবত বিদ্রোহী কবি হলেও তার মন ছিল শিশুর মত সরল এবং কোমল। কবি নজরুলের শিশু সাহিত্যগুলো পড়লেই বোঝা যায়, তিনি ছোট্ট ছেলেমেয়েদের কত ভালবাসতেন। যার ফলে একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে এ সকল মহৎ শিশু সাহিত্য রচনা করা। পল্লীকবি জসীমউদ্্দীনকে এক চিঠিতে তিনি লিখলেন, ‘আমি দখিনা হাওয়া। ফুল ফুটিয়ে যাওয়া আমার কাজ। তোমাদের মতো শিশু কুসুমগুলোকে যদি আমি উৎসাহ দিয়ে আদর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারি, সেই হবে আমার বড় কাজ। তারপর আমি বিদায় নিয়ে চরে যাব আমার হিমগিরির গহ্বর বিবরে।' বিধাতার অমোঘ নিয়মে তিনি আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। তার রচিত শিশুদের প্রতি ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ শিশু সাহিত্যগুলো চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমাদের সাহত্যি কাননে একগুচ্ছ গোলাপ হয়ে তার লেখাগুলো খুশবু ছড়াবে প্রতিটি শিশুর মনে-মননে।