নাকফুল - শারমিন রহমান
ছবি : গল্পকার শারমিন রহমান
নীরার
বাবা আর মা পালিয়ে বিয়ে করেছিলো। ক্লাসমেট ছিলো দু'জন। নানার অগাধ সম্পত্তি
আর দাদার দারিদ্রতাই ছিল নীরার মা বাবার প্রেমের অন্যতম প্রধান বাধা। নীরার
মা নাজনীন বেগম একদিন তার ছোট বোনকে বাজারে মোড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে,
"কাজটা
সেরে আসছি,তুই একটু দাঁড়া " বলে পালিয়ে গেছিল নীরার বাবার বাইকে চেপে।
নীরার ছোট খালা বোকার মত সন্ধ্যা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল বড় বোনের জন্য।
সন্ধ্যার পর বাড়ি গিয়ে খবর দিয়েছিল বড় বোনকে খুঁজে না পাওয়ার। ততক্ষণে খোঁজ
খবর শুরু করে দিয়েছিল কাশেম শিকদার। এলাকায় তার ক্ষমতা, প্রতিপত্তির কথা
সবার জানা। মেয়ের গরীব ঘরের ছেলের সাথে পালিয়ে বিয়ে করাতে তার সম্মানে
খানিকটা ভাটা পড়ে, তিনি মেয়ের সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। নীরার নানা
বাড়ি আর দাদা বাড়ি পাশাপাশি গ্রাম। ফুলেশ্বর গ্রাম আর বকুলতলি গ্রামের মাথা
কাশেম মিয়ার কানে মেয়ের না খেয়ে থাকার কাহিনী ইনিয়ে বিনিয়ে তুলে দেয়ার
লোকের অভাব নেই গ্রামে। মেয়ের কষ্টের খবর শুনেও কাশেম শিকদারের মুখের
চেহারার কোন পরিবর্তন দেখতে না পেয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে অতি উৎসাহী কিছু
গ্রামবাসি। নীরার নানা বাড়ির অন্দরমহলে পৌঁছে যায় নীরা হওয়ার খবর,সাথে
পৌঁছায় মেয়ের না খেয়ে থাকার ইতিহাস। নীরার নানি চুপিচুপি লোক পাঠায় নীরাদের
বাড়ি।
:" জসীমের মা,তুমিতো ভিক্ষা করতে নাজনীন এর
শ্বশুরবাড়ির গ্রামে যাও। আমার নাতনিরে একটু দেখে আসতে পারবে? কার মতো
হয়েছে? আমার মেয়েটা কেমন আছে? কেউ যেন টের না পায় জসীমের মা। নাজনীন ও যেন
বুঝতে না পারে। পারবে একটা খবর এনে দিতে!" বলেই পাঁচশ টাকার একটা কড়কড়ে
নোট গুঁজে দেয় জসীমের মার হাতে। জসীমের মার চোখ ভিজে আসে, এত নামিদামি
লোকের বউ, গা ভর্তি সোনার গয়না, ফুলের ঘ্রাণ গা থেকে বের হচ্ছে। এমন মানুষ
এসেছে তার কুঁড়ে ঘরে,তার হাত ধরে সন্তানকে চুপিচুপি দেখে আসার আকুতি নিয়ে!
আহা সন্তান! তার দুই ছেলের জন্যও বুকটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। মায়েরা এমনই হয়।
ভাত দিতে যতই অস্বীকার করুক জসীম আর গফ্ফার! তার সন্তান তো। কিছুতেই ওদের
জন্য অভিশাপ আসেনা.. আচ্ছা সন্তানদের কি মা বাবার জন্য এমন লাগেনা?
এরপর
জসীমের মা গিয়ে খবর দেয় নাজনীন বেগমের কষ্টের কথা। কারন জসীমের মা যখন
এসেছিল খবর নিতে তখন নাজনীন বেগম ঢেঁকিতে ধান বানছিলো।
যে মেয়ের খাবার
দেয়ার জন্য কাজের লোক প্রস্তুত থাকত সবসময় সেই মেয়ে ধান বানে,মাটির ঘর লেপে
শুনে আর থাকতে পারেনি কাশেম শিকদারের মত কঠিন হৃদয়ের মানুষটাও। নীরার
জন্মের পরের বর্ষায় ই কাশেম শিকদার বড় নৌকা ভর্তি করে চাল,ডাল,লবন, তেল,
দুধ, বড় বড় ডিমওয়ালা ইলিশমাছ,আখ নিয়ে ঘাটে পৌঁছে গেছিল। নীরাকে কোলে নিয়ে
নাম দিয়েছিল, ঘুচেছিল সকল ব্যবধান। নীরার নামটা ওর নানার দেয়া। এ গল্প শুনে
শুনে মুখস্ত নীরার,যেন নিজের চোখের সামনে দেখেছে সব ঘটতে। শুধু কি
এতটুকুই? না আরো অনেক গল্প শুনে শুনে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে
নীরার। নীরার মায়ের সাথে তার শ্বাশুড়ির সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো। ঠিক বন্ধুর
মতো। নাজনিন বেগম মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি না হয়ে সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। সংসারের জন্য চাকরিটা খুব জরুরী হয়ে পড়ে।
অনেক ইচ্ছে থাকলেও আর পড়াটা চালিয়ে যেতে পারেনা। নীরার বাবা পড়া চালিয়ে
যায়,মা মাধ্যমিক পাশ ই থেকে যান।নীরার দাদীর সাথে কত যে সিনেমা দেখতে গেছেন
সিনেমা হলে তার গল্পও লোকের মুখে মুখে। সব গল্পকে ছাপিয়ে যায় যে গল্প তা
হলো নীরার দাদা দাদী এক ই সাথে পেরালাইজড হয়ে ঘরে পড়ে যায়। বিছানায় পায়খানা
প্রসাব করে। মেয়েরা দুরে সরে গেলেও নীরার মা একহাতে সব সামলায়। ততদিনে
নীরার বোন ইরারও জন্ম হয়। চাকরি,শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে সামলে মেয়েদের যত্ন
নেয়ার সময় পায় না নাজনীন বেগম। নীরার বাবা তখন সংসারের ভার নিতে চাকরির
আশা ছেড়ে দিয়ে সৌদি আরব পাড়ি জমিয়েছে।পুষ্টিহীনতায় ভুগতে থাকে ইরা। বাবা
সৌদি গিয়ে অনেক কষ্ট করেছে,কিন্তু ভালো কোন ফল করতে পারেনি,শুনেছে নীরা সে
কাহিনী। বাবা যখন সৌদি ছিল তখন মা বাবাকে চিঠি লিখত ফুলতোলা সাদা আর
গোলাপী রংয়ের প্যাড এ। বাবার চিঠি আসত সাদা খাম এর ভেতরে গাঢ় নীল রংয়ের
চওড়া প্যাড এ। চিঠির যে অংশে নীরার কথা লেখা থাকত সে অংশ টা বারবার মাকে
পড়ে শোনাতে বলত নীরা। তখন ফোন ছিলনা, চিঠিই একমাত্র ভরসা। চিঠির অক্ষরে
বাবার ঘ্রাণ নিতে চাইতো নীরা। উঠানের উপর দিয়ে এরোপ্লেন উড়ে যেতে দেখলে
বাবা বাবা করে চিৎকার করতো নীরা। ভাবত এই এরোপ্লেনে তার বাবা আছে। মার
পরামর্শে বাবার চিঠির ডাকটিকিটগুলো জমাতে থাকে একটা খাতায়। খাতাটাও খুব
সুন্দর। হালকা সবুজ গাউন পরা একটা পরীর ছবি ছিল খাতাটায়। একদিন রাতে ঘুম
থেকে ডেকে তোলা হয় নীরাকে। নীরা জেগেই বাবাকে দেখে। বাবা এসেছে,আনন্দে
বাবাকে জড়িয়ে ধরে নীরা। ইরা বলে ওঠে-
" বাবা, তুমি বিদেশ থেকে খালি হাতে
এসেছ? আমার চকলেট,পুতুল কই?" বাবার চোখটা ঝাপসা হয়ে ওঠে। নীরা ততদিনে একটু
বুঝতে শিখে গেছে। বাবার আাসাটা যে স্বাভাবিক নয় তা বোঝে নীরা। যে অফিসে
বাবা কাজ করত সেখানকার মালিক খুব খারাপ ছিল,বাবাকে বেতন ঠিকমতো দিত না,তাই
বাবা পালিয়ে অন্য মালিকের কাজ করতে গেলে পুলিশে ধরিয়ে দেয় পুরনো মালিক।
কয়েকদিন জেল খেটে ফিরে আসে নীরার বাবা। তারপর কত অভাব কত সংগ্রামেও বাবা
মার ভালোবাসার বন্ধনকে অটুট থাকতে দেখেছে নীরা। কোন অভাব,কোন ঝড় ই নীরার
বাবা মা কে আলাদা করতে পারেনি। সেই একসাথে পড়া...বন্ধুত্ব! আজ চলে গেল মাকে
একা করে বাবা! পারলো? কার কাছে রেখে গেল? বাবার লাশের পাশে বসে আজ এসব কি
ভাবছে নীরা! নিজের থেকেও মার কষ্টটা খুব বুকে লাগছে। মার মুখের দিকে তাকাতে
পারছে না নীরা।
মাকে ঘিরে আছে পাড়ার কতগুলো মহিলা।
মার কষ্টের থেকে,মার নাকফুলের উপর বেশি আগ্রহ তাদের।" নাকফুল খুলে দাও
নীরার মা"। কেউ বলছে ওনার কি আর সে শক্তি আছে? তুমিই খুলে নাও। বাবাকে তখনো
নিয়ে যাওয়া হয়নি, মায়ের নাকফুল খোলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে একদল।
নীরার
খুব খারাপ লাগল, উঠে গিয়ে বলল",মাকে তোমরা প্লিজ একা ছেড়ে দাও। একটু একা
থাকতে দাও। আর আমার মার নাকফুল খুলবে না কেউ"। ওই ভিড়ের মাঝে সদ্য উচ্চ
মাধ্যমিক দেওয়া নীরার কথা কেউ গুরুত্ব দিলোনা। খুলে ফেলল নাজনীন বেগমের
ভালোবাসার প্রথম উপহার। মা জোরে একটা চিৎকার দিয়ে থেমে গেল। নীরা মায়ের
দিকে তাকিয়ে অচেনা একটা মানুষ দেখতে পেল। এক মুহূর্তে মার বয়স দ্বিগুন মনে
হলো নীরার । এই প্রথম নীরার বুক ফেটে কান্না এলো। মায়ের নাকফুলহীন
চেহারা যেন চিৎকার করে জানান দিচ্ছে তোমার বাবা মৃত, তোমার বাবা মৃত বলে!
একটা নাকফুলের এত ক্ষমতা! হাহাকার করে উঠল নীরার বুকটা। মনে মনে
প্রতিজ্ঞা করলো নীরা, মাকে বাবার দেয়া প্রথম উপহার এই নাকফুল ঠিক পরিয়ে
দেবে,সকল কুসংস্কারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে! বাবা চলে গেছে, বাবার উপহার তোমার
সাথে থাকবে মা!