বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুই। বঙ্গবন্ধুর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বাংলাদেণের রাজনীতিতে একক এবং অদ্বিতীয় সত্তা। বাংলাূদেশের আপামর সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ অকাক্সক্ষার নাম বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবুর রহমান নামের এই মানুষটি বঙ্গবন্ধু শব্দটির অতলান্তে লীন হয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শব্দটিকে মহিমান্বিত করে মানুষের অন্তরের আর্তির সাথে নিজেকে একাকার করে নিজের স্থানটিকে একটি উজ্জ্বলতর নক্ষত্রের মর্যাদা দান করেছেন। আর এই স্থানটিই তাঁর দেশ, তাঁর জাতি, তাঁর জাতির দুখি মানুষের ক্ষীণ স্পন্দিত হৃৎপিন্ডের সার্বিক চৈতণ্যের চারণভূমি। আর এটি তিনি করতে সক্ষম হয়েছেন এ বাংলার দীন দুখি লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষের খুবই ছোটো ছোটো আকাক্সক্ষাগুলিকে একত্রিত করে নিজ আকাক্সক্ষার সাথে মিশিয়ে একটি একক আকাক্সক্ষায় রূপান্তরিত করে তাঁর হৃৎপিন্ড ধারণ করতে এখানেই বঙ্গবন্ধুর অসাধারণত্ব, অসামান্যতা এবং বহুমাত্রিকতা। বঙ্গবন্ধুকে বহুমাত্রিক বলা হলো এ কারণে যে, অনেক গুণ অতিক্রম করে বিশেষ যে গুণটি তাঁকে বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বে উন্নীত করেছে তা হলো বঙ্গবন্ধু একাধারে যেমন তার্কিক এবং বিতার্কিকও ঠিক তেমনি তিনি সাধারণ দুখি মানুষের কল্যাণে অবিমিশ্র উদার, পাশাপাশি উৎকর্ষিত প্রজ্ঞাবান, সেই সাথে তিনি প্রয়োজনে গাঢ়ত্বে ভরপুর পুরু ইস্পাতের মতো অভঙ্গুর।
উদ্ধৃত বর্ণনাটিতে আমি তর্কিত এবং বিতর্কিত শব্দ দুটিকে ব্যবহার করেছি। এর কারণ বাংলায় তর্ক এবং বিতর্কের মাঝখানে অর্থগত ব্যবধান খুবই সামান্য। তর্কের অর্থ-- বিবাদ, বিসম্বাদ, ঝগড়া ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রশ্নে যুক্তির মাধ্যমে একে অপরের প্রশ্নের উত্তর দেয়া। বিতর্ক শব্দটির অর্থও প্রায় একই রকমের। কিন্তু ইংরেজী শব্দ debate -এর বাংলা অর্থের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যে বাক্যটি প্রয়োগ করা হয়েছে তা “ বিচার-বিবেচনা করা।” অর্থাৎ যুক্তি তো থাকবেই তবে সেই যুক্তিকে বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে উপস্থাপন করা। আর এটি আমরা লক্ষ করেছি যে, যখনই বঙ্গবন্ধু যে কোনো ইস্যুতে; বিশেষতঃ কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে তার প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছেন তখনই তিনি যুক্তির পাশাপাশি বিচার-বিবেচনাকেও সামনে তুলে এনেছেন। শুধু তর্কের জন্যেই তিনি তর্ক করেন নি। এ বিষয়টির প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা পেয়েছি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে। যখন তদানিন্তন পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে ঢাকায় আগমন করে ১৫ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত ঘটান। এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে একটানা প্রায় দশ দিনের আলোচনা শেষে আলোচনার ফল হিসেবে যা উঠে আসে তা হলো বঙ্গবন্ধুর বিচার বিবেচনা প্রসূত যুক্তিকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান গ্রহণ করেন এবং মেনে নেন। কিন্তু ২৫ মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধু তথা গোটা বাঙ্গালী জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং নিরস্ত্র, নিরপরাধ জাতিটির ওপর তিনি অনাকাক্সিক্ষত সামরিক যুদ্ধ চাপিয়ে দেন। আর এখানেই বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করেন বাঙ্গালী জাতির আকাক্সক্ষা পরিপূরণের লক্ষ্যে তিনি সুদৃঢ় ইস্পাতের চাইতেও কঠোর, অভঙ্গুর এবং আপোশহীন। বাঙ্গালী জাতির স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে হিমালয়ের মতো শেষ পর্যন্ত নির্মোহভাবে অবিচল থেকে তিনি আলোচনা চালিয়ে যান। আলোচনা ব্যর্থ হলেও তিনি ইয়াহিয়ার সঙ্গে কোনোক্রমেই বিন্দু পরিমাণ আপোশ করেন নি। যা সিদ্ধান্ত নেবার প্রয়োজন তা বঙ্গবন্ধু আলোচনা ব্যর্থ হবার পর পরই ইতিপূর্বে গৃহীত তাঁর সিদ্ধান্তের আলোকে বাস্তবায়নের প্রস্তুতি গ্রহণের পথে তাৎক্ষণিকভাবে এগিয়ে যেতে শুরু করেন। ইয়াহিয়ার অসংলগ্ন আচরনে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শেষ মূহুর্তে এসে ইয়াহিয়া খান তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন না। আর সে কারণেই তিনি একেবারে চূড়ান্ত মুহুর্তে সিদ্ধান্তটি তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদেরকে জানিয়ে দেবার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
এটি তো গেলো বঙ্গবন্ধুর বীর্যবান আদর্শের একটি দিক। এখানে আমি তাঁর উজ্জ্বলতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আর একটি দিকের বিষয় উল্লেখ করতে চাই। আমি আগেই বলেছি যে, বঙ্গবন্ধুর কোনো বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধুর তুলনা বঙ্গবন্ধু নিজেই। কেন বলেছি তার একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা আমি এখানে প্রদান করছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের দিকে আমরা যদি দৃষ্টি প্রদান করি তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশটি যেভাবে স্বাধীন হয়েছে অন্যান্য অধিকাংশ দেশের স্বাধীনতা ঠিক সেভাবে আসেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সামগ্রিকভাবে একটি সশস্ত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমে যে সশস্ত্র জনযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমেরিকা অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্টের স্বাধীনতা অর্জনের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, সে দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো সামরিক যুদ্ধের মাধ্যমে। জেনারেল জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে সে সময়ের পৃথিবী কাঁপানো সব চাইতে অধিক সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ব্রিটেনকে পরাজিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করেছিল। সে যুদ্ধে জনগণের সমর্থন থাকলেও সরাসরি সম্পৃক্ততা ততটা ছিলো না। ভারত ব্রিটিশ শাসকদের কবল থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে প্রবল অহিংস গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতকে স্বাধীনতা প্রদানে বাধ্য করে। এই আন্দোলনের একটি পর্যায়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। জার্মান নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিরুদ্ধে ব্রিটেন, আমেরিকা, তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য বেশ কিছু দেশ সমন্বিতভাবে পালটা সামরিক জোট গঠন করে জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাডলফ হিটলারের সামরিক জোটের মুখোমুখী অবস্থান গ্রহণ করে। কারণ হিটলার তখন একটি অসদুদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে গোটা পৃথিবীকে জার্মান নিয়ন্ত্রণে আনবার লক্ষ্যে যুদ্ধটি শুরু করে এবং প্রচন্ড গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। এ অবস্থায় ব্রিটেন তখন বাধ্য হয় জার্মান জোটের বিরুদ্ধে একটি কাউন্টার মিলিটারী এ্যালায়েন্স গঠন করতে। এবং সঙ্গত কারণেই ব্রিটেন তখন ভারতীয় জনগণের সাহায্য প্রার্থণা করে। যেহেতু সে সময় ভারতীয় জনগণ প্রচন্ডভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিপুলভাবে রত। যদিও সে সময় ভারতীয় কংগ্রেস দলের প্রথম সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বসু অত্যন্ত গোপনে জার্মান সরকারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে জার্মান সরকারকে সমর্থন দিয়ে ভারতীয়দের সমন্বয়ে একটি পৃথক বাহিনী গঠন করেন। শর্ত থাকে যে, জার্মান জোট যুদ্ধে জয়লাভ করলে ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করবে। সুভাষ চন্দ্র বসুর অধীনে গঠিত বাহিনীটির নামকরণ করা হয় “আজাদ হিন্দ ফৌজ”-হিসেবে। এই নামকরণটিতেও একটি সাম্প্রদায়িকতার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই সময় অর্থাৎ ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তখন ভারতে কেবল হিন্দু ধর্মীয় এবং হিন্দি ভাষাভাষীর লোকজনই বসবাস করত না। বিভিন্ন ধর্মের এবং ভাষাভাষীর লোকজনেরও বাসস্থলও ছিলো ভারত এবং সংখ্যাতেও তারা মোটেই নগণ্য ছিল না। সুভাষ চন্দ্র বসুর ক্রিয়াকলাপ এবং জার্মান সরকারের মনোভাব সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত অবহিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারও এই সুযোগটি গ্রহণ করে। ইতিপূর্বেই ভারতীয় কংগ্রেস দলের সভাপতির পদটিতেও পরিবর্তন আনয়ন করা হয়। সুভাষ চন্দ্র বসুর পরিবর্তে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। গান্ধী ছিলেন অহিংসবাদী। সুভাষ বসুর সশস্ত্র যুদ্ধ-নীতির বিপরীতে গান্ধীর এই অহিংসবাদীতার বিষয়টিকেও একটি মোক্ষম রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্রিটিশ সরকার গ্রহণ করে ভারতীয় কংগ্রেসের কাছে প্রস্তাব উত্থাপন করে এই মর্মে যে, চলমান যুদ্ধে ভারতবাসী যদি ব্রিটেন-নেতৃত্বাধীন জোটকে সমর্থন প্রদান করে এবং ব্রিটেন-জোট যদি যুদ্ধে জয়লাভ করে তাহলে ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করা হবে। কিছু শর্ত সাপেক্ষে প্রস্তাবটি কংগ্রেস গ্রহণ করে। এরপর অনেক ঘটনা প্রবাহের ভেতর দিয়ে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেন-জোট অর্থাৎ যে জোটটি ”মিত্র বাহিনী”-নামেও পরিচিত ছিল সেই জোটের জয়লাভের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। অতঃপর ব্রিটিশ সরকারের সাথে কংগ্রেস এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কথাবার্তা, আলোচনা, সমালোচনা ইত্যাদির পর ব্রিটিশ সরকার সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলির সাথে আলোচনার টেবিলে বসে চূড়ান্তভাবে লিখিত আকারে পক্ষ সমূহের মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তির অধীনে ভারতকে দুটি অংশে অর্থাৎ ভারত এবং পাকিস্তান নামের দুটি অংশে বিভক্ত করে দুটি অংশকেই স্বাধীনতা প্রদান করে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের অগাষ্ট মাসের ১৪ তারিখে। পাকিস্তানের সঙ্গে বর্তমানের বাংলাদেশকেও যুক্ত করে দেয়া হয়। আজকের এই বাংলাদেশের নামকরণ তখন করা হয় ” পূর্ব পাকিস্তান”-হিসেবে যা সে সময়ের পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে গণ্য হয়।
স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী তেইশ বছর ধরে পাকিস্তানের অপশাসন তথা সামরিক শাসন এবং শোষণের যাতাকলে নিস্পিষ্ট হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক জনগোষ্ঠী। এই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী জাতিগোষ্ঠির ওপর পাকিস্তান সরকারের প্রথম আঘাতটি আসে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষার ওপর। বাঙ্গালী জনগণ পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ হবার পরেও পাকিস্তান সরকার উর্দু ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। যা কখনই বাঙ্গালী জনগণ মেনে নেয় নি। আর আন্দোলনের প্রথম স্ফুলিঙ্গটি জ্বলে ওঠে ঠিক তখনই। বাঙ্গালীরা এটিকে বাংলা ভাষার ওপর পাকিস্তানের চরম আঘাত এবং নির্যাতন হিসেবেই গ্রহণ করে। এসব নিপীড়ন, নির্যাতনের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এ দেশের আপামর সাধারণ মানুষ পাকিস্তানের পৈশাচিক শাসনের কবল থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে শুরু করে। এরই এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে পাকিস্তানী শাসন, শোষনের বিরুদ্ধে আন্দালনের জন্যে প্রস্তুত হবার আহবান জানান এবং এরই সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধু এক সময় পুরো আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। নেতৃত্ব গ্রহন করেই তিনি ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ছয় দফা বিত্তিক একটি কর্মসূচী প্রদান করেন ’ছয় দফা’- কর্মসূচীটির অভ্যন্তরে মূলতঃ ছিলো পরোক্ষভাবে এক দফা যা বাংলাদেশের (যা সে সময়ে ছিলো পূর্ব পাকিস্তান নামে অভিহিত) নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। আর সে কারণেই এই ” ছয় দফা” কর্মসূচীটিকে পাকিস্তান সরকার কোনোক্রমেই মেনে নিয়ে গ্রহন করতে পারে নি। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর তাদের আক্রোশ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে এবং তারা সুযোগ খঁজতে শুরু করে। কিন্তু এই ছয় দফার আন্দোলনই ধীরে ধীরে পরবর্তীতে ভেতরে ভেতরে ” নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা আন্দোলন”- হিসেবে মানুষের মনে প্রচন্ডভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে। এই অন্দোলন চলমান থাকা অবস্থাতেই অন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়ে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সাধারণ নির্বাচন প্রদানে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় এবং নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিভিন্ন অপকৌশল গ্রহনের মাধ্যমে কাল ক্ষেপন করতে শুরু করে। মার্চ মাসের তিন তারিখ ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন আহŸান করেও ০১ মার্চ অত্যন্ত আকস্মিকভাবে সে অদিবেশনটি পাকিস্তান সরকার র্কর্তৃক স্থগিত করে দেয়া হয়। ঠিক সে মূহুর্ত থেকেই গোটা পূর্ব পাকিস্তানে একটি চরম অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায়। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে এং সারা পূর্ব পাকিস্তান প্রায় অচল হয়ে পড়ে। এই অচলাবস্থা দূরীকরণ এবং রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের লক্ষে পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আগমন করেন ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ। এবং এই ১৫ মার্চ থেকেই ২৫ মার্চ দুপুর পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সব দাবী মেনে নেবার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন এবং রেডিও, টেলিভিশনে দাবী মেনে নেবার ঘোষনাটি প্রদান ও প্রচার করতে সম্মত হন। কিন্তু সে প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন না করে রাতের অন্ধকারে অত্যন্ত গোপনে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগ করবার আগে তিনি এ দেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে “অপারেশন সার্চলাইট”-নামের একটি সামরিক অভিযান এ দেশের মানুষের ওপর পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করে যান যা বঙ্গবন্ধু তাঁর গোপন সোর্সের মাধ্যমে পূর্বহ্নেই পূরো ষড়যন্ত্রটির কথা অবহিত হয়েছিলেন এবং চূড়ান্ত যা সিদ্ধান্ত নেবার তা তিনি নিয়েই রেখেছিলেন। ২৫ মার্চ রাত্রি বারোটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী “অপারেশন সার্চলাইট ”-শুরু করে। ভারী ট্যাঙ্ক, কামানের গোলা এবং ভারী মেশিনগানের প্রচন্ড শব্দে গোটা ঢাকা শহর প্রচন্ডভাবে কেঁপে ওঠে। ঠিক এর কিছু পরেই অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বকন্ঠে বাংলদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং স্বাধীনতার লিখিত একটি বাণী তিনি বি.ডি.আর ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জনাব জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে প্রেরণ করেন। আর সে কারণেই আমাদের স্বাধীনতা দিবসটির তারিখ হয় ২৬ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে এই স্বাধীনতা ঘোষণাটি প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষনাটি পাকিস্তান নৌ বাহিনীর একটি ফ্রিকোয়েন্সিতে শ্রুত হবার সাথে সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের পুরো সময়টি তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারেই বন্দী জীবন অকিবাহিত করেন। আর ঠিক সে দিনটি থেকেই শুরু হয়ে যায় বাঙ্গালী জনগণের সশস্ত্র যুদ্ধের ক্রমান্বয়িকতা। দলে দলে বাঙ্গালী জনগণ মুক্তি বাহিনীতে যোগদানের লক্ষে প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদ্দেশ্যে ভারত অভিমুখে যাত্রা করে। সেখানে গিয়ে তারা সামান্য প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। এই বিষয়টিও বঙ্গবন্ধু ইতিপূর্বেই ভারত সরকারের সঙ্গে অত্যন্ত গোপনে আলোচনা করে নিশ্চিত করে রেখেছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড গেরিলা এবং সম্মুখ যুদ্ধের আক্রমনের মুখে প্রথম দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের আক্রমনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেও যুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে তাদের সে মাত্রা শিথিল হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে তারা বিভিন্ন ফ্রন্টে পিছু হটতে শুরু করে। এটি মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে উল্লেখযোগ্য গতি সঞ্চার করে। তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে তাদের আক্রমণ। এটি ৭১-এর অক্টোবর এবং নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের চিত্র। এ রকম একটি অবস্থায় এসে পাকিস্তানী সৈন্যরা যখন আর কোনো ফ্রন্টে মোটেই টিকতে পারছিলো না তখন ডিসেম্বর মাসের ০৩ তারিখ হঠাৎ করে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের পাঞ্জাবে অবস্থিত বিভিন্ন বিমানঘাটিতে আক্রমণ করে বসে। এর বিপরীতে ভারতীয় বিমান বাহিনীও ০৪ তারিখ খুব ভোরে পালটা জবাব হিসেবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ১১টি সামরিক এবং বিমান ঘাটিতে প্রবল আক্রমণ করে সে সব ঘাঁটি বিধ্বস্ত করে দিয়ে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মেরুদন্ড এক প্রকার ভেঙ্গে দেয়। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ৭১-এর ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। এই সরকারের অধীনে ৭১-এর ২১ নভেম্বর বাংলদেশের প্রথম সেনাবাহিনী গঠিত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। আর সে দিন থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একযোগে প্রচন্ড আক্রমণ পরিচালনা শুরু করে।
পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারত আক্রমনের পরপরই ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়ে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। ভারত সরকার বাংলদেশ সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। এবং আলোচনা এগিয়ে যেতে থাকে। ডিসেম্বরের ০৬ তারিখ বাংলাদেশকে ভারত সরকার স্বীকৃতি প্রদান করে এবং স্বীকৃতি প্রদানের পরপরই বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনা করে ভারত ও বাংলদেশের সেনাবাহিনী সমন্বয়ে একটি যৌথ বাহিনী গঠন করে যার নামকরণ করা হয় ”মিত্র বাহিনী।” এই মিত্র বাহিনী গঠনের অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আকাশ, নৌ এবং স্থল ভাগে একযোগে প্রচন্ড ক্ষিপ্র গতিতে প্রবল আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সকল অবস্থানের ওপর মিত্র বাহিনী। মিত্র বাহিনীর পদাতিক ডিভিশনের ভারী অস্ত্রের অগ্রগামী গোলা বর্ষণ, বিমান বাহিনীর আকাশ থেকে শক্তিশালী বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনীর ঘাঁটিগুলিকে একের পর এক বিধ্বস্ত করণের ফলে পাকিস্তানী বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে এবং ডিসেম্বরের ১২ তারিখ থেকে তারা সকল ফ্রন্ট থেকে প্রায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে ঢাকাসহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিতে শুরু করে। ১৪ ডিসেম্বর তারা নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে মরিয়া হয়ে উঠে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মেধাবান বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করতে শুরু করে। উদ্দেশ্য একটিই আর সেটি হলো বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করা। এর পরপরই ৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সকল কমান্ড এবং সেনাসদস্য মিত্র বাহিনীর কাছে শর্তহীন আত্মসমর্পণ করে সকল অস্ত্র মিত্র বাহিনীকে নিঃশর্তভাবে অর্পণ করে। বাংলাদেশ পরিপূর্ণরূপে স্বাধীন হয়ে যায়। আর ১৬ ডিসেম্বর তারিখটি হয়ে যায় বালাদেশের মহান স্বাধীনতার বিজয় দিবস। অনেক ঘটনার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ০৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি প্রদান করে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এই বর্ণনা থেকে একটি বিষয় প্রমাণিত হলো যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন কোনো আলোচনার টেবিলে বসে দ্বি-পাক্ষিক অথবা বহুপাক্ষিক সমঝোতার লিখিত চুক্তির মাধ্যমে হয় নি। হয়েছে সশস্ত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমে একটি প্রবল সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের মাঠে পরাজিত করে।
এখানে এতগুলি কথা বলা হলো এ কারণে যে, বাংলাদেশ কেবলমাত্র জনআন্দোলন অথবা সামরিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। বরং দীর্ঘ নয় মাসব্য্যপী সশস্ত্র জনযুদ্ধে বত্রিশ লক্ষ সজীব প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তানের প্রায় এক লক্ষ সুশিক্ষিত দুর্ধর্ষ পেশাদার সেনাবাহিনীর বিরূদ্ধে চরম আত্মত্যাগ এবং যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। এবং বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী থেকেও পাকিস্তান সরকারের কাছে নতি স্বীকার করেন নি। এমন কি তাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের জন্য আহবান জানানো হলেও তিনি সে প্রস্তাব অত্যন্ত ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কারণ তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। সেভাবেই তিনি তাঁর গোটা নেটওয়ার্ক প্রস্তুত করে দিয়ে গিয়েছিলেন আর এখানেই বঙ্গবন্ধু দুরদর্শিতা, কঠোর দৃঢ়তা, আপোশহীনতা এবং উজ্জ্বলতম আদর্শের প্রতীক। এমনকি ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগষ্ট যখন তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন অবস্থায় ঢাকার ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর সড়কে অবস্থিত তাঁর নিজ বাস ভবনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত এবং অসদাচারণের কারণে সেনাবাহিনী থেকে বহিস্কৃত কিছু উচ্ছৃংখল সেনা সদস্য কর্তৃক চরম নিষ্ঠুর এবং নির্মমভাবে স্বপরিবারে তিনি নিহত হন তখনও তিনি হত্যাকারীদের কাছে মাথা নত করেননি। বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের সম্মুখে অটল, অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মাথা উঁচু করেই তার প্রাণটি তিনি অকাতরে দিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে কোনো সঙ্কট মুহুর্তেও তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অটল এবং আপোশহীন আদর্শবান। যে মূহূর্তে তাঁর পবিত্র আত্মাটি তাঁর দেহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে ঠিক সেই মূহুর্তেই তিনি হয়ে উঠেছেন চিরঞ্জীব। কারণ জীবন্ত বঙ্গবন্ধুর চাইতে লোকান্তরিত বঙ্গবন্ধু বহুগুণ শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এটির স্বাক্ষী ইতিহাস। তাঁর শেখ মুজিবুর রহমান নামটি বঙ্গবন্ধু পদবীটির অতলে মিশে গিয়ে একটি একক সত্তা হয়ে এবং বহুমাত্রিক দুর্বার শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু হিসেবে।
আমরা যদি তদানীন্তন রাশিয়া (অক্টোবর বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন) এবং চীনের দিকে তাকাই তাহলেও স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করবো যে, ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ার (বর্তমানের রুশ ফেডারেশন) জারতন্ত্র অর্থাৎ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ভøাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির মাধ্যমে যে গণবিপ্লব সংঘটিত হয় এবং সে বিপ্লবের ভেতর দিয়ে জারতন্ত্রকে উৎখাত করে যে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের যে রাষ্ট্রটির গোড়াপত্তন করা হয় সে বিপ্লবটিও কখনই সশস্ত্র গণবিপ্লব ছিলো না। কেবলমাত্র নিরস্ত্র গণআন্দোলনের তীব্রতর শক্তির জোয়ারে রাশিয়ার জারতন্ত্র খরকুটোর মতো ভেসে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। রাশিয়ার জার বাধ্য হয় বলশেভিক পার্টির সাথে একটি লিখিত চুক্তির মাধ্যমে বলশেভিক পার্টির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে রাশিয়ার জনগনের একটি অংশ ক্ষমতাচ্যুত জারকে হত্যা করে।
চীনের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিক পর্যন্ত চীনও সম্রাট শাসিত একটি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবেই বর্তমান ছিলো। চীনা বিপ্লবের নেতা মাও সে তু যিনি “জনগণ নয় বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস” এই থিওরি প্রদান করেন তিনিও চীনের প্রবল ক্ষমতাধর সম্রাটকে তার সেই থিওরি পুরোপুরি প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন করে সে সময়ের চীনা সম্রাটকে উৎখাত করতে পারেন নি। কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের সমন্বয়ে গণআন্দোলন সৃষ্টি করে তিনি পরাক্রমশালী চীনা সম্রাটকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দেই “ গণপ্রজাতন্ত্রী চীন” নামকরণ করে চীনকে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সশস্ত্র জনযুদ্ধ করেননি।। মূলতঃ সাধারণ জনগণই মূল ভূমিকাটি পালন করেছিলেন ওই আন্দোলনের। যদিও সে সময় সম্রাটের ঘোর অনুগত চীনা সেনাবাহিনীর একটি অংশ জেনারেল চিয়াং কাই শেক-এর নেতৃত্বে চীনের “ফরমোজা”- নামের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপকে গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মূল চীনা ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে “তাইওয়ান”- নাম দিয়ে চরম পুঁজিবাদী একটি পৃথক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন যা এখনও বিদ্যমান। আর গণপ্রজাতান্ত্রিক চীনে এখনও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাই অব্যাহত রয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিষয়টি বিবেচনা করলে সেখানে একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট প্রতিভাত হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা আইনজীবি নেলসন ম্যান্ডলো দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেদের পক্ষে বর্ণবাদ বিলুপ্তির জন্যে সে দেশের শেতাঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে দীর্ঘ সাতাশ বছর ধরে কারাভোগ করেছেন। এই নির্যাতন সহ্য করেও তিনি প্রচন্ড মনোবল ধরে রেখে তাঁর দাবী থেকে এক বিন্দুও সরে এসে শেতাঙ্গ সরকারের কাছে নতি স্বীকার করেননি এটি যেমন সত্যি ঠিক তেমনি তিনি জনযুদ্ধের মাধ্যমে সে দেশকে স্বাধীনও করেন নি এটিও তেমনি সত্যি। মূলতঃ তাঁর আন্দোলনটি যদিও কোনো অবস্থাতেই স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত ছিলো না বলে অনেকে মনে করেন তবুও এটি প্রকারান্তরে স্বাধীনতা আন্দোলনই ছিলো। কারণ যে দেশের শতকরা পচানব্বই শতাংশ মানুষই কৃষ্ণাঙ্গ সে দেশটিকে মাত্র পাঁচ শতাংশ ভিনদেশী শেতাঙ্গ ইংরেজ শাসন করে আসছিলো। তাদের মূল কৌশলটি ছিলো শেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে একটি বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তারা তাদের একক কর্তৃত্ব বজায় রেখে দীর্ঘ দিন ধরে শাসনের নামে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর তারা সীমাহীন নির্যাতন চালিয়ে আসছিলো। যেহেতু তাদের হাতে ছিলো সামরিকসহ সার্বিক ক্ষমতা সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেই তারা এটি করেছিলো। নেলসন ম্যান্ডলো তাঁর দেশ থেকে এই চরম অপমানজনক বর্ণবাদকে বিলুপ্ত করণের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করলেও আন্দোলনের নিগুঢ় গভীরে ছিল স্বাধীনতা অর্জনের তীব্র আকাক্সক্ষা। এই আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষেই নেলসন ম্যান্ডলো সুদীর্ঘ সাতাশ বছর শেতাঙ্গ কারাগারের সকল প্রকার নির্যাতন সহ্য করেছিলেন। আর সাতাশ বছর পর শেতাঙ্গ সরকার গণআন্দোলনের তীব্রতার মুখে টিকতে না পেরে নেলসন ম্যান্ডলোকে বাধ্য হয়ে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে উপায়হীনভাবে বাধ্য হয়। যেহেতু নেলসন ম্যোন্ডলো তাঁর দেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল লক্ষটিকে অন্তরে ধারণ করে বহিরাঙ্গে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করলেও তিনি সশস্ত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমে সেটি করেননি সেইহেতু তাঁকেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মোটেই তুলনা করা যায় না। এটিই প্রকৃত বাস্তবতা। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্টের বর্ণবাদ বিরোধী অবিসংবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিংকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই একটি জনসভায় বর্ণবাদ বিরোধী বক্তব্যরত অবস্থায় নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় যাতে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন কোনোক্রমেই দ্বিতীয়বারের মতো মাথা চারা দিয়ে উঠতে না পারে। সে দিক থেকে বিবেচনা করলে নেলসন ম্যান্ডলো ভাগ্যবানই বলতে হয় এ কারণে যে, তাঁকে অন্ততঃ হত্যাটি করা হয়নি।
কিছুটা দূরত্বে বঙ্গবন্ধুর কাছাকছি আর একজন মানুষকে ভাবা যেতে পারে। তিনি হলেন উত্তর ভিয়েতনামের অসাধারণ জনপ্রিয় নেতা হো চি মিন। দীর্ঘ দিন আমেরিকান শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ভিয়েতনামের জনগণ আমেরিকার অপশাসন এবং শোষনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবার চেষ্টা করতে থাকে। ভিয়েতনাম তখন একক এবং অখন্ড একটি রাষ্ট হিসেবে অক্ষত ছিলো। যখন আন্দোলন ধীরে ধীরে তীব্রতা লাভ করতে শুরু করে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের দক্ষিণাঞ্চলের একটি শহর ‘সায়গন’- থেকে তার সামরিক এবং বেসামরিক কার্যক্রম অত্যন্ত দ্রæত গতিতে শুরু করে। ঠিক সে সময়ই আন্দোলনের পূরো নেতৃত্ব গ্রহন করেন সে দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা হো চি মিন। এবং তিনি সে আন্দোলনের সকল কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলের একটি শহর ‘হ্যানয়’কে বেছে নেন। আর তখন থেকেই ভিয়েতনাম উত্তর এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম নামের দুটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যায়। দক্ষিণ ভিতেনামের সায়গন শহরটি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবল সামরিক অভিযান শুরু করে উত্তর ভিয়েতনামের জনগণের ওপর। এ রকম একটি অবস্থায় ভিয়েতনামের প্রতিবেশী দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী চীন উত্তর ভিয়েতনামের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং উত্তর ভিয়েতনামকে সর্বোত সামরিক, আর্থিকসহ অন্যান্য সাহায্য প্রদান করতে শুরু করে। এর মধ্যে হো চি মিন উত্তর ভিয়েতনামী জনগণের মধ্যে থেকে একটি সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষে জনশক্তি সংগ্রহ করতে শুরু করেন। অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই প্রাথমিক স্তরের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ছোটো খাটো একটি বাহিনী গড়ে তোলেন হো চি মিন। সে সময় থেকেই উত্তর ভিয়েতনামের জনগণ রাজধানী হিসেবে ’হ্যানয়’কে স্বীকৃতি প্রদান করে। সময়ের পরিক্রমায় উত্তর ভিয়েতনামের সামরিক বাহিনীটির আকার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। চীনের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে এই বাহিনীর মাধ্যমেই জনাব হো চি মিনের নেতৃত্বে উত্তর ভিয়েতনামের জনগণ দীর্ঘ এগারো বছরেরও অধিক সময় ব্যপী আমেরিকার বিরুদ্ধে মরণপন সামরিক যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। এই দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে সর্বশেষ পর্যায়ে এসে নিশ্চিত পরাজয় জেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর ভিযেতনাম থেকে তার সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে পরাজয় স্বীকার করে দক্ষিণ ভিয়েতনামে ফিরে যায়। উত্তর ভিয়েতনাম স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু দেশটি উত্তর এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম নামের দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। এখানে ভিয়েতনামের আন্দোলনের এবং বিপ্লবের বিষয়টিকে উল্লেখ করা হলো কারণ ভিয়েতনামের আন্দোলন, বিপ্লব এবং সামরিক যুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আন্দোলন, বিপ্লব এবং সামরিক জনযুদ্ধের মধ্যে প্রকৃতি এবং চরিত্রগত দিক থেকে যথেষ্ঠ ব্যবধান স্পষ্ট ছিলো। এর কারণ পাকিস্তান স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যে বৈষম্য সৃষ্টি করতে থাকে এবং যার প্রথম আঘাতটি বাংলা ভাষার ওপর আপতিত হয় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলার জনগনের পক্ষে কোনেক্রমেই পাকিস্তানের একক কাঠামোর ভেতর থেকে বসবাস করা মোটেই সম্ভব নয়। তখন থেকেই বাঙ্গালীরা তাদের মনের গভীরে পাকিস্তানের কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকামের সুযোগের সন্ধান করতে শুরু করে অন্দোলনের দিকে পা বাড়ায়। যেটি ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে ছিলো না। এবং বাংলাদেশ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় নি।
ইউরোপের ফরাসি বাষ্ট্রটিকে বলা হয় “ বিপ্লবের সুতিকাগার।”এ কাণে যে, এই রাজতান্ত্রিক ফরাসি রাষ্ট্রটি থেকেও রাজতন্ত্রকে উৎখাত করা হয়Ñ যা একটি গণবিপ্লবের মাধ্যমেই ঘটে। এবং ফরাসি সম্রাট লুইকে ( তদানীন্তন ফরাসি সম্রাটতের রাজকীয় উপাধি ছিলো ‘লুই’) মাথা নত করে ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য করা হয় ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই ওই গণবিপ্লবের ব্যাপকতার ভেতর দিয়ে কুখ্যাত ’বাস্তিল দুর্গের’- পতন ঘটিয়ে। এখানে একটি বিষয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, ফরাসি বিপ্লব কিন্তু কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে বিকশিত হয়নি এবং চূড়ান্ত ফল লাভও করেনি। হয়েছিল সে দেশের কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবি, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সমন্বিত প্রয়াস এবং নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে একটি নির্দিষ্ট প্লাটফর্মে আনয়ন করে বিশাল বিপ্লব সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু সে বিপ্লবটিও সশস্ত্র জনবিপ্লব ছিল না। সে দিক বিবেচনা করলেও ফরাসি বিপ্লবকেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবের সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনা করা যায় না। এখানেও বঙ্গবন্ধু একক এবং অদ্বিতীয় সত্তা নিঃসন্দেহে। তাঁর এই একক এবং অদ্বিতীয় সত্তাকে অস্বীকার করবার প্রয়াস-সিদ্ধ প্রকাশ ’উন্মাদ-কথন’-ব্যতীত আর কিছুই নয়। অতএব, অন্তিমে এসে সন্দেহাতীতভাবে বলাই যায় বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক এবং মানবিকতার দিক থেকে বাংলার জনগণের একক এবং অদ্বিতীয় সত্তা এবং সর্বোচ্চ অকাক্সক্ষার বিকল্পহীন অভিধা। (সংক্ষেপিত)।