দিনবদল - আনোয়ার রশীদ সাগর
সেদিন
ছিল চৈত্রের বিকেল।ধীরে ধীরে সূর্য পাটে বসছে। ক্রমেই গরম বাতাস শীতল হয়ে
আসছে। এক ধরনের উষ্ণ অনুভূতিতে আমি মুগ্ধ হচ্ছি। হঠাৎ চোখ পড়ে কমলার দিকে।
ও আসছিল মুক্তযোদ্ধা মঞ্চের দিকে। ঝিরিঝিরি বাতাসে কৃষ্ণচূড়ার পাতাগুলো
দোল খাচ্ছিল। কমলাসুন্দরীকে দেখে দর্শকরা জোরে জোরে হাত তালি দিয়ে চিৎকার
করছিল। আমি নীরবেই দাঁড়িয়েছিলাম। আমার মনে উতালপাতাল ঢেউ উঠছিল ওর গানের
সুরে।
নীরবতা নাকি জয়ের
লক্ষণ। তাই নীরবই থাকি। ভালোবেসে ফেলি, লাস্যময়ী যৌবনা কমলাসুন্দরীকে।
চাঁদপনা ওই মুখটি ভুলতে পারি না। দেখতে থাকি মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চে ওর বাবার
সাথে সেজেগুজে একতারা হাতে ওঠে, টংটংটিংটিং সুর তুলে গান করছিল।
খুব
ভালো লালণ গীতি গান করে কমলা। সেদিন ছিল বিজয়দিবস। ওকে দেখার পর থেকেই
নীরবেই ঘুরি মুক্তিযোদ্ধাদের পিছনে পিছনে। সে কথা আমি ছাড়া কেউ জানে না।
তারপর থেকে প্রতিভোরে এবং বিকেলে এসে বসি মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে পাশে।
সাংবাদিকতার সুত্র ধরে উনারা আমাকে বেশ সম্মান ও স্নেহও করে।
আলোচনা-সমালোচনায় অংশ নিই।
একটি জরুরী সংবাদের খাম বাসে হেল্পারের হাতে দিয়ে এসে, বসি চা'র দোকানে। তখন তুমুল কথা কাটাকাটি চলছিল।
শালাদের কাজকর্ম দেকলি মেজাজ তিড়িক্কি হইয়ি যায়,রক্ত মাতায় উইটি পড়ে।
দু'জন মুক্তিযোদ্ধা চা'র দোকানে এ রকম কথায় বেশ অঙ্গভঙ্গি করে, জোরে জোরে উচ্চারণ করেই বলছিল।
ভাবছিলাম,বাবাজীদের হলোটা কী?
সাত্-সকালে মেজাজ গরম হয়ে রক্ত মাথায় ওঠে পড়েছে?
একজন
চিৎকার করে বলতে থাকে,দেশ ভাগ হইছিল বইলিই তো একাত্তরে যুদ্ধ কইরি দেশডা
স্বাধীন করতি পারছি। হিন্দুদের মাইর তো খাওনি। খালি বুঝতি। পিটির উপর দাও
দিয়ি কুপাচ্ছিল, আর আমি মা'র সাতে দৌড়াচ্ছিলাম। ভাইডাকে ধপাধপ কুবিয়ি কাইটি
ফেলছিল।
অপরজন বলে,দূর শালার পাগল। ভাগ না হলি তো দৌড় মারতি হইত না।
- সাধে হয়নি,ঠাপে হয়িছে। ঠাপ খাওনি তো?
- ক্যান, এইযি স্বাধীনের সময় এত খাতি দিল,অস্ত্র দিল!
- দিল-দিলো, পাকিস্তানীদের তাইড়ি দি,একুন কুকুরশিয়েল দি রোজ গুলি করে মারে।
- তুই যুদ্ধ করলিও, স্বাধীনতা বিরোধী।
- ওই শ্লোগান আর বেশিদিন থাইকবি নানে।
-আকতার শালা তোর মাতাডা খাইয়ি ফেলেয়িছ্?
- সে তো শিক্ষিত ছেলি। তুই আর কি বুঝিস,সে তোর চাইয়ি অনেক বেশি বোঝে।
- বোঝে বোঝে। শালার সুবিধাবাদী হারামখোর-চামচা। একুন চেতনা চেতনা কইরি,সামনের চেয়ারে বসে।
যকুন
যুদ্ধে গেনু তকুন ভালো ছেলি সাইজি,বাড়ি বইসি থাইকলু। আর যেই জীবন-দি দেশ
স্বাধীন করনু, সেই সামনে আইসি জয়বাংলা বুইলি মিছিল কইরলু। লেকাপড়া শিকি
বড়পদে চাকুরি নিলো। আর আমরা উর চাইয়ি ভালো ছাত্র হয়িও লেখাপড়া শিকতি
পারনুনি। দুঃকু হয়-কষ্ট হয়।
-তোর দুঃখু নি থাক্। আম গেনু।
-যা-যা...।
কুতুব আলী চলে যাওয়ার পর রজব আলী এসে হালিম আলীর কাছে বসলো। আমিও উনাদের পাশে বসে, চা'র দোকানদারকে চা দিতে বললাম।
রজব আলী তার দু'পা বেঞ্চির উপর তুলে ন্যাটাগাড়ি বসতে বসতে বলে,দে-রে দে,বাবাজির চা দে। আমাগের বাপু কেউ চা-টা খাওয়ায় না।
হালিম আলী বলে,ওই যে গিদ পাইয়িছ্,মুক্তিফৌজরা ভাতা পায়, বইসি বইসি খায়।
রজব আলী বলে, আরে বাবা ক-ট্যাকাই বা দেয়। এই শেখের বেটি আইসি তো চারডি ট্যাকা পানু।
আমি হাসতে হাসতে বলি,চাচা আপনাদের জন্যি ভালো খবর আছে।
দু'জনই একসাথে বলে,বলোদিন বাপ বলো।
-চাচা সরকার আপনাদের ভাতা আগামী জুলাই থেকে দ্বিগুণ দেবে এবং ছেলেমেয়েদের চাকুরিও দেবে।
দুমুক্তিযোদ্ধা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, তাই নাকি! সেই জন্যি বুলি শালারা, শেখের বেটিরে ভোট দে, উন্নতি হবে।নৌকায় ছাড়া সিল মারবিনি।
২
প্রতিদিন
সকালেই কিছু মুক্তিযোদ্ধা মর্নিংওয়ার্ক শেষ করে এসে চা খায়,গল্প করে।
মুক্তিযোদ্ধা কম্পেলেক্সের সামনে বাবুলের চা'র দোকানে আড্ডাটায় বসে। কোথা
থেকে দুটি কাক ডাকতে ডাকতে কর্কশ গলায় কাকা শব্দ করে এসে, চারতলা
কম্পেলেক্সের কার্ণিশে বসে।
তবে সূর্য ধাইধাই করে
উঠে আাসার সাথে সাথে পাশের বাড়ি থেকে মূরগীর বাচ্চাগুলো আসতে ভোলে না। তারা
দল বেঁধে আসে। খেয়ে বেড়ায় রাস্তার দু'পাশ,চিচি শব্দে মিষ্টি সুরে সুর
তোলে।এমন সময় একটি কাক উড়ে এসে ছোঁ মেরে ধরে,নিয়ে চলে যায়। বাচ্চাগুলো
ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। মা মূরগীটা কাকের পিছনে তেড়ে গেলেও কাককে ধরতে পারে না।
সকালে
এখানে কিছু কুকুরও আসে।দুটো কুকুর কান খাড়া করে কয়েকবার তাকালো ওই দিকে।
কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার পোষাকুকুরও রয়েছে। সে কুকুরগুলো লেজ নাড়তে থাকে।
যখনই লেজ নাড়ে,তখনই মুক্তিযোদ্ধা রজব আলী কয়েক পিছ্ পাউরুটি ছিড়ে ছিটিয়ে
দেয়। আর শুরু হয়ে যায় গরম আবহাওয়া, হুঁহুঁ-গুঁগু করতে থাকে, ঘাড় ফুলাতে
ফুলাতে একে অপরকে গরম দেখায়। কামড়াকামড়িও করে।
কুতুব
আলী তখন রজব আলীকে বলে,তুই আর কাজ পাইসনি ;কুকুর আইনি কামড়াকামড়ি বাধাইস।
রজব আলী হাসে, সব শালা নেমকহারাম জানিস?-আমার এই কুকুরগুলো নেমকহারাম
না,বেঈমানী করতি পারে না।
আমি বলি,জানেন চাচা হিটলার মানুষকে বিশ্বাস করতো না। তার দেহরক্ষী ছিল একদল কুকুর।
তখন আমার সাপোর্ট পেয়ে, খুশি হয়ে গর্বে গদগদ করে। বলে, এই বাবুল দে বাবাজীসহ সকলকে চা -দে। এ হচ্ছে যুক্তিতর্কে জয়ের চা।
কুতুব আলীও হাসতে থাকে,দেলদার মানুষ,আল্লাহ তোর ভালো করুক।
রজব আলী আরো খুশী হয়।
তখন
ইন্টারনেট চালু হয়নি। জরুরী নিউজগুলো টেলিফোনে অথবা ফ্যাক্স করে পাঠাতে
হতো। আর ফিচার নিউজগুলো ভোরবেলা খামে পুরে, বাসে হেল্পারের হাতে দিয়ে
দিতাম। তারা খুলনা পৌঁছিয়ে বাস কাউন্টারে দিয়ে দিতো। আমি তখন খুলনার এক
পত্রিকার রিপোর্টার ছিলাম।
যাহোক কাউন্টার থেকে
পত্রিকার পিওনরা নিয়ে গিয়ে সম্পাদকের হাতে দিতো। দীর্ঘদিনের এ অভিজ্ঞতার
কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের
সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বীর এই যোদ্ধারা খুবই স্নেহ করে।
রাজনীতির
মারপ্যাঁচে অনেক মুক্তিযোদ্ধা জামাতেইসলামকেও সমর্থন করে। চৌদ্দ দল
ক্ষমতায় আসার পর পরিবর্তন হচ্ছিল। তবে দু'হাজার চৌদ্দ সালের পর সেই
পরিবর্তন থেমে গেছে। যুক্তিতর্কে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মুক্তিযোদ্ধারা
পেরে ওঠে না। মাঝে মাঝে উনাদের কথার মধ্যে কথা বলতে বলতে আমিও
মুক্তিযোদ্ধাদেরই একজন হয়ে গেছি। একদিন না গেলেই খোঁজ নেয়,বাবাজী গেলো
কোথায়?
সকলেই বাবাজী বলে সম্বোধন করে।
জীবনের
বিচিত্র অভিজ্ঞতা এ সব মুক্তিযোদ্ধার। কেউ সম্মূখ সমরে যুদ্ধ করে
মুক্তিযোদ্ধা,কেউ গ্রামে গ্রামে পালিয়ে থেকে মুক্তযোদ্ধা,কেউ ভারতে গিয়ে
ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে দেখে,দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা। আবার
কোনো মুসলিমলীগ পরিবারের ছেলে জানের ভয়ে, জাসদের গণবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল।
আশির দশকে এসে তারাও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়। অন্যদিকে গরীব অসহায় দিনমজুর,
যারা শহর চেনে না,তারা যুদ্ধ করেও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেনি। এখন
মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে,ময়লা একটা সাদালাইলচে গেঞ্জি গায়
দিয়ে,চিটিগুড়ের মত আকড়াওয়ালা গামছা ঘাড়ের উপর দিয়ে এসে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে
থাকে,ভাই আমার নামডা দি দেওদিন।
অন্য মুক্তিযোদ্ধারা হাসলেও তারা বলে সলিম মুক্তিযোদ্ধায় ছিল,বড় সাহসী মানুষরে-আগে আগে থাইকতু।
কিন্তু
সলিম মুক্তিযোদ্ধা আর হতে পারে না। বিভিন্নমুখী স্বজন প্রীতির কারণে,এ
ধরনের গরীব ও অসহায় দরিদ্ররা আর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নামটা লেখাতে পারে
না। কেউ কেউ চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফেরে। আবার অনেক মৃত মুক্তিযোদ্ধার
দরিদ্র বউটি ছেলেমেয়ে সঙ্গে করে এসে,ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফেরে। কে কার খোঁজ
রাখে? টাউট বাটপাড়দের দখলে থেকে যায় ক্ষমতার দড়ি। সে দড়ি দৌড়ায় ফুলবাগানের
দিকে,যেখানে টাকা নামের কাগজগুলো ফুল হয়ে ওড়ে।
৩
কত,কত
রাজাকার ও রাজাকারের ছেলে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চেতনা বলে চিৎকার করে!
কত কত মুসলিমলীগের ছেলে অথবা মেয়ের বিয়ে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে বা
মেয়ের সাথে। চাকুরির কোটা পদ্ধতি কিভাবে বণ্টন হবে?
মুক্তিযোদ্ধা কুতুব আলী বিয়ে করেছে কুখ্যাত রাজাকার মসলেম উদ্দিনের মেয়ে। তার ছেলেমেয়েরও তো কোটায় চাকুরি হবে।
মুক্তিযোদ্ধা
রজব আলীর ছেলের বিয়ে হয়েছে, পিচকমিটির চেয়ারম্যানের মেয়ের সাথে। তার
সন্তানেরাও চাকুরি পাবে। তাহলে যুদ্ধের সময় যারা মুক্তিযোদ্ধাদের খেতে দিল
পরতে দিল তাদের ছেলেমেয়ে কেন বঞ্চিত হবে?
একটি দৈনিক
পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে এ রকম প্রশ্ন করেই লেখা পাঠিয়েছিল,পাশের মহল্লার
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নকিব শেখ। সে চিঠি পড়ে শহরের মধ্যে বেশ মিশ্র
প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আজ সকালে কুতুব আলী এবং রজব আলী আমাকে খুঁজতে থাকে। আমার একটু দেরি হয়েছিল আসতে।
আমাকে পেয়ে দুই মুক্তিযোদ্ধায় এক কণ্ঠে আমাকে আক্রমণ করে,বাপু তুমি থাকতি এসব আজেবাজে কতা লেখে কারা?
আমাকে
তারা নির্ভরযোগ্য সাংবাদিক মনে করে। আমি বলি,চাচা ওই ছেলেটা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ওইযে আজম শেখের ছেলে। আজম শেখের কথা তাদের কানে
যাওয়াতে, মনে হলো তারা চোখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
কুতুব আলী বলে,নে বাবা লেখক-লেখক।
রজব আলী বলে,ক্যান লেখবি?
কুতুব আলী বলে,দ্যাকদিনি! -যুদ্ধের সময় আজমের মা'র হাতে কত খাইয়িছি। ওরা ভালো মানুষ।
আমি বলি,চাচা নকিব শেখকে চেনেন নাকি?
কুতুব
আলী বলে,না বাপু। তে আজম শেখের মাকে চিনি। যুদ্ধের সময় নিজি না খাইয়ি,
আমাগের খাতি দিতো। একদিন কাক্লিদুয়া যুদ্ধ শেষে সন্ধিবেলা, খুব খিদে পেটে
আমরা দশবারো জন ওদের বাড়ি আসি। তখন ওই চাচীমা তাড়াতাড়ি খেচুড়ি ভাত রাইনদি
আমাগের খাতি দিয়ি,বাইরে যাইয়ি দাঁড়ি-দাঁড়ি পাহারা দিচ্ছিল। সে রাতিও আমাগের
যাতি দেয়নি। আজম শেখ আর ওই চাচী সারারাত আমাগের জন্য জাইগি ছিল। ভারি ভালো
মানুষ ওরা।
আমি বলি,তাহলে তো সত্যিকথায় লেখিছে নকিব।
রজব আলী বলে, নে বাবা ও সব লেখাটেখা বাদ দেদিন বাপ। চা দিতি বল...
আমি বাবুলকে বলি, এই বিস্কুট আর চা দে।
বাবুল চা'র কাপ পরিস্কার করতে থাকে।
টিংটং শব্দ হয় চা'র কাপ আর চামচের।
৪
ছুঁই
ছুঁই করে ছুঁতে পারি না কমলাকে। কয়েকবার কাছে পেয়েও কিছু বলতে পারিনি। যা
যা বলবো বলে মনে করি,তার সবগুলো বিষয় এসে এমন ভাবে ভিড় করে যেন আর কিছুই
বলা হয় না। জনপ্রিয় কোনো ফিল্ম দেখার জন্য, সারা এলাকার মানুষ যখন টিকিট
কাউন্টারে এসে ভিড় করে থাকে,কেউই কোনো টিকিট কাটতে পারে না,শুধু ঠেলাঠেলি
করে, সে রকম অবস্থা হয় আমার সাজানো কথামালার ভিড়গুলোর।
এক সময়,কুমারী গ্রামে শীতের সময় গান করতে আসে মমতাজ। যিনি বর্তমানে সংসদ সদস্য। রাতের গান শেষে মমতাজ এসে রেস্ট হাউজে ছিল।
কমলাকে কল্পনা করতে করতে আমার রাত কাটে জেগে জেগে। কী করে ওর সান্নিধ্য পাবো, সে বুদ্ধি খুঁজতে থাকি।
এদিকে কমলার বাবাও প্রতিদিন আসে চা'র দোকানে, কথা হয়। অথচ বলতে পারি না, 'চাচা আমি কমলাকে ভালোবাসি'।
সহজ-সরল বেচারা চা খেয়ে আড্ডা দিয়ে,গল্প করে চলে যায়। আমি স্বাভাবিক কারণেই একটু বেশি বেশি ভক্তি ও শ্রদ্ধা করি।
যাহোক
সকাল হলে নাস্তা করি বাবুর হোটেলে। তারপর ক্যামেরাটা সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ
করি রেস্ট হাউজে। ঢুকেই দেখি কমলা বসে আছে শিল্পী মমতাজের পাশে। আমি যেন
খেই হারিয়ে ফেলি। তারপরও নিজেকে স্বাভাবিক করে নিই।
সালাম
দিয়ে শিল্পী মমতাজের কাছে পরিচয় দিই,আপা আমি সাংবাদিক। আপনার একটা
সাক্ষাৎকার নিবো। অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে তিনি সম্মতি জানায়। অনেকগুলো প্রশ্নের
উত্তর এবং ছবি নিয়ে নিই। বাইরে থেকে চা আসে,চা খাই। লক্ষ করি কমলা বার বার
আমার দিকে তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়াতে ও বলে,আপনি সাংবাদিক?- বলেন নি তো?
আমি
বলি,একদিন তোমার একটা সাক্ষাৎকার নিবো। মনে হলো,,কমলা খুব খুশি হলো। আমি
সুযোগ নিই।বেশ কয়েকটা ছবি নিই। ছবিগুলো আমার হৃদয়পুজা। ক্যামেরাটা ঘুরিয়ে
ঘুরিয়ে দেখে নিই। দারুণ হয়েছে ছবিগুলো। মনে মনে ভাবি বেঁধে রেখে দিবো ঘরের
দেওয়ালে।
ছবি নেওয়ার পর কমলা গাল কুঁচকিয়ে হাসে, আমি চেয়ে থাকি। মনে মনে বলি,আমার কমলা; কমলা সুন্দরী।
এরপরই
কুতুব আলী আসে। আমাকে দেখে হোঁহোঁ শব্দ করে হেসে বলে,আরে বাবাজী যে?- নাও
নাও ছবি নাও,আমাকে সমেতো নিবা। তুমি আমাগের বাড়ি যাবা, আমার কমলা মা'র
ছবিসহ পত্রিকায় দিবা।
আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে
যায়,হয়তো এবার কমলাকে কাছে পাবো। কল্পনা করি,অভিসারে হারাই। দৌড়াই
কামালপুরের মাঠে,নদীর ধারে গল্প করি,ঘুরে বেড়াই কমলাকে সঙ্গে নিয়ে। এ মাঠ
থেকে রেলস্টেশন দূরে নয়,কাছেই। এই স্টেশন থেকে দু'জন মুক্তিযোদ্ধা
পাকহানাদারদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিল,জাতির মুক্তির জন্য সে অস্ত্র
ব্যবহার করেছিল শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে।
রেস্ট হাউজের
পাশেই বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কম্পেলেক্সের জায়গাটা খালি ছিল। এখানে দু'জন
মুক্তিযোদ্ধা জীবন দিয়েছিল হানাদার বাহিনীর বুলেটে। পাশের বাড়ির বজলুল হক
ডাক্তার গুলিতে শহীদ হয়েছিল। গোবিন্দপুর গ্রাম থেকে আবুল হোসেন নামক এক
শিক্ষককে পাকহানাদাররা তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল। তিনিই নাকি এই এলাকায়
প্রথম শহীদ হয়েছিলেন।
কমলাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ভাবনার
জগত অন্যদিকে মোড় নিতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলিই আমার এমন হয়। আমার
দূর্বল জায়গাগুলো ফুলেফেঁপে ওঠে। যখন আমি খুব ছোট ছিলাম, তখন যুদ্ধ চলছিল।
পাকহানাদার বাহিনী ভরা নদী পার হয়ে,রবজেল রাজাকারের সাথে এপারে আসতো।
আব্বা-চাচা এবং বড় ভাইরা পালিয়ে থাকতো। কেউ কেউ অস্ত্র ধরেছে,যোগ দিয়েছে
মুক্তিবাহিনীতে। সেই ভয়ে দাদি কান্নাকাটি করতো।
আমাদের
খানকা-ঘরের সামনে একটা বেল গাছ ছিল।ওরা ওপার থেকে এসে বেলগাছ তলায়
দাঁড়াতো। তখন দাদি কাসার ঘড়ায় পানি আর ধামায় করে মুড়ি-মূড়কি দিতো। আমি
ওগুলো বাড়ির ভিতর থেকে নিয়ে এনে ওদের দিতাম। পাকহানাদার বাহিনী খেতো আর
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো লড়কি বেশ শক্ত হগা।
তখন রবজেল রাজাকার আমাকে বলতো,দাদাভাই তুমার বাপচাচারা কনে?
আমি ভয়ে ভয়ে বলতাম,জাইন্নি তো।
আমার কথা শুনে সকলেই হাসতো,লড়কির সাহস আছে।
আমি খাঁড়া দাঁড়িয়ে থাকতাম। তারপর ওরা পায়ে পা মিলিয়ে সারিসারি হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যেতো গাঁয়ের পথে।
একরাতের
গুলির শব্দে ওরা ক্যাম্প ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তখন আমরা ছোটরা দলধরে, কাগজের
পতাকা বানিয়ে পাটকাঠির আগায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে, মিছিল করেছিলাম। নেচে নেচে
শ্লোগান দিয়েছিলাম জয়বাংলা,বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো -বাংলাদেশকে স্বাধীন করো।
এই শ্লোগান কোনো এক রাতে শুনেছিলাম, গাঁয়ের বড় ভাইদের কাছে। তখন চারিদিকে
পানি আর পানি,নদীতে বুকভরা কান্নার ঢেউ বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল। ভাসিয়ে নিয়ে
যাচ্ছিল বিদ্রোহের জোয়ারে সকল আবর্জনা।
৫
বুঝতেই পারিনি কখন কী ঘটে গেছে। নজর কাড়ার মত চিহারা নিয়ে,মাথায় পাগড়ি বেঁধে এক তারা হাতে গান করতে শুরু করেছে এক তরুণ।
দর্শকের
নজর কেড়েছে। কেড়েছে আমার নজরও। অবাক না হয়ে আর পারিনি। ছেলেটির নাম নাকি
নজর মণ্ডল। গান শেষে দর্শকেরা ওয়ান মোর ওয়ান মোর করে চিৎকার করছে। এরই
মধ্যে মাইকে ঘোষণা আসতে থাকে,এইগুণী শিল্পী নিজেও গান লেখে। বাউল সঙ্গীতের
পাশাপাশি অন্যান্য গানও গায়। অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে,একতারার
তারে আঙ্গুল দিয়ে টান দিতে দিতে, হঠাৎ বামহাত বাড়িয়ে,মঞ্চের কোণে বসে থাকা,
কমলার হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে,দু'জনে একসাথে গান শুরু করে। কেন যেন আমার
মনের মধ্যে যন্ত্রণাটা বেড়ে যায়।
এরই মধ্যে
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মঞ্চে উঠে মাউথপিচ হাতে নিয়ে দুটি কথা বলতে থাকে।
মঞ্চের একপাশে দাঁড়িয়ে নজর মণ্ডল আর কমলা আলোর ঝলকানির মধ্যে হাসতে থাকে।
মনে হতে থাকে, এ যেন কোনো সিনেমার পর্দা।
মুক্তিযোদ্ধা
কমান্ডার তার বক্তব্যে বলতে থাকে, আজ বারই নভেম্বর। আলমডাঙ্গা শহরে
পাকহানাদার বাহিনীর সাথে এদিন সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছিল। সে যুদ্ধে জামাল উদ্দিন
কমান্ডারসহ কয়েকজন আহত হয়েছিল।
মঞ্চে ডেকে নিয়ে তাদের সংবর্ধনা দেওয়ার কথা বলে নেমে আসে।
তারপর শুরু হয় গান, তুমি কী দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়...। কমলা আর নজর মণ্ডল হাত ধরাধরি করে গানটি গায়।
আমার
ভাবনার জগত বিরহে ভরে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা
আশু-টগর-নান্নুর কথা। মানুষের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছিল মহান
মুক্তিযুদ্ধে।অথচ মানুষের মুক্তি কী হয়েছে? বহুল প্রচলিত কথা, যে যায়
লঙ্কায় সেই হয় রাবণ।
আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায়
ধনীরা ধনী হয়,গরীবরা গরীব হয়। শোষণ আর শাসণে পিষ্ট বাঙালি জাতির মুক্তি কোন
পথে আসবে? এ রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনের মধ্যে।
নিজের মনের হতাশার মধ্যে রাষ্ট্র ও সমাজ একাকার হয়ে যায়।
পরে
জানতে পারি নজর মণ্ডল একটা ভালো চাকুরি করে। যার নির্দিষ্ট আয় আছে। অথচ
আমার বেকার জীবনে নির্দিষ্ট কোনো আয় নেই,নেই মাসিক বেতন। দুটো বিজ্ঞাপন
অথবা একটা রাজনৈতিক মিটিঙের খবর ছাপালে কেউ হাত বাড়িয়ে কিছু টাকা দিলে,
তাই দিয়ে চলি।
কমলা তো যাবেই নজর মণ্ডলের সাথে। সে সুদর্শন এবং ভালো শিল্পীও।
ভাবতে
ভাবতে, হঠাৎ মঞ্চটা বিশ-পঁচিশ জন তরুণ সোনার ছেলে এসে, দখল করে নেয়। তারা
সকলেই সরকারি দলের ক্যাডার। ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা সভাপতি
হচ্ছে,পিচকমিটির চেয়ারম্যানের সন্তান।
অথচ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষদল ক্ষমতায়। কমলা আর নজর মণ্ডল মঞ্চ ছেড়ে উত্তরে অন্ধকারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমার চোখের আড়াল হয়ে যায়।