মতিন রায়হানের একগুচ্ছ কবিতা
মতিন রায়হানের একগুচ্ছ কবিতা
বাংলাদেশ

প্রত্নমায়াজালে আজ জড়িয়ে ধরেছি তেতে-ওঠা দেহমন

 

শীতের উষ্ণতা যেন ধোঁয়া-ওঠা প্রেম, বুকের গহিনে

মিশে আছে হাজার বাতির আলো; শত শতাব্দীর

সভ্যতার বিজুলি চমকে খুলে যায় যত রুদ্ধদ্বার!

বরষার বৃষ্টিজলে ধুয়ে নিই তোমার শরীর; রজঃস্বলা

হয়ে ওঠো পুণ্যতোয়া জলে! কী গভীর অস্তিত্বের মূলে

সুর তোলে শরীরের ভাষা, সম্ভাবনার দিগন্তে নেচে

ওঠে কুহকী-সময়! আহা, বসন্ত বাতাসে পোড়ে মন

পুষ্পবেণুবনে; তোমার প্রেমের কাছে নতজানু আজ

হাজার নদীর ঢেউ, শিশিরের শব্দের মতন ঘুম

নেমে এলে চোখের পাতায়... মন যেন শ্রাবণের

থইথই নদী! বৈশাখের রুদ্র ঝড় থেমে যায় যদি

সজল মাটির সোঁদাঘ্রাণ টেনে আনে গত জনমের

প্রিয়তমা রূপসিকে! শাপলাফোটা ভোর, ব্যঞ্জনার

রোদে তোমার সুবাস যেন নেশাতুর প্রেমের গুঞ্জন!

 

প্রত্নমায়াজালে আজ জড়িয়ে ধরেছি তেতে-ওঠা দেহমন!

 

নতুন ধান, মা দুলদুল ঘোড়া

নতুন ধানের গন্ধে জেগে ওঠে ঘোর মাতৃমন

 

ফেলে আসা দূর গাঁয়ে বিলের বাতাসে দোলে

সোনালি ধানের শিষ; খর রোদে আমি পুড়ি;

আমার বুকের কোণে ভিজে ওঠে কার মুখ!

মায়ের আঁচল থেকে পরম স্নেহের মতো ঝরে

পড়ে তপ্ত মুড়ি-গুড়! চোখ বুজলেই টের পাই

এমন মধুর স্মৃতি তোলা আছে নকশি শিকায়!

আজ মনে পড়ে, কেন জানি সন্ধ্যার আঁধার

নেমে এলে হোসেনের দুলদুল ঘোড়া মায়ের

চোখের জলে ভাসে! আমিও বিষণ্ন হয়ে উঠি!

বলি : মা, চলো তো দেখে আসি ফুরাতের তীর;

কারবালা! সিমারের ছুরি কেন রক্তের নহর

বয়ে আনে! দূরদেশে কে বাজায় বাদ্য ঝনঝন!

 

চোখ মুছে মা, আমিও, দৃশ্যপটে চলে ঘোরতর রণ!

 

 

 

 

 

জন্মদিন

কত শত সত্য-মিথ্যা আর ছায়াচ্ছন্ন ভুলের প্রকাশ

 

জীবন তো এরকমই : রোদের শৈশব থেকে তুলে

আনা ফালি ফালি স্মৃতি, কৈশোরের জংধরা

লাটিমের অনন্ত ঘূর্ণন, বৈঠা হাতে বেয়ে চলা

জল-থইথই জীবনের নৌকো! পাল আছে কি

নেই, তা তো খুঁজিনি কখনো! যৌবনের রং ফিকে

হয়ে এলে শরতের সাদা সাদা মেঘপুঞ্জ কড়া নাড়ে

স্মৃতির চৌকাঠে; ফুটে থাকা কাশফুল খুব যেন

প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে! শুভ্রবসনা নারী কি মৃত্যুরেখা!

উঁকি দেয় চেতনার বিলবোর্ডজুড়ে! সব পথরেখা

যেন হয়ে যায় ক্রমশ ধূসর...সমূহ রঙিন পাখা

মেলে উড়ে গেলে প্রজাপতি, বুকের ভিতর বাজে

পাতার মর্মরধ্বনি আর সুদূরের নাড়িছেঁড়া গান;

বেণুবনে কারা তবে ফালি করে বাঁশ দুঃখভরা মনে?

জন্মেছি যখন যেতে তো হবেই! কী করুণ দীর্ঘশ্বাস!

 

কত শত সত্য-মিথ্যা আর ছায়াচ্ছন্ন ভুলের প্রকাশ!

 

 

পোশাকের গল্প

পোশাক, তোমার আড়ালে কারা আজ মৃদু হাসে?

 

হাসি কি বিদ্রুপের? নাকি লজ্জা থেকে তুলে আনা

গোপন সন্দেশ? যাই হোক, অঙ্গে দোলে দূরবর্তী

হাওড়ের ঢেউ, বৃষ্টিভেজা শরীরে মনে মিলনের

ষোলোকলা বাজে! বাজুক নদীর মতো খরস্রোতা

দেহবীণা, ভাসুক উতল স্রোতে নিবেদিতা দেহতরি...

রাধা, বৃন্দা, কে বাজায় বৃন্দাবনে প্রাণহরা বাঁশি?

কদম্ব বৃক্ষ তুমি, দেখো, তোমার ফুলের মোহন

পাপড়ি-খোলা দেহে কী দারুণ নাচে পূর্ণা-রূপসি!

আর বাহুলতা পরস্পরে ভাঁজে সুরের বেহাগ;

এমন অঝোর দিনে ক্ষণপ্রভা-দীপ্তি চোখে-মুখে!

কবির কলমে যেন হেসে ওঠে নগ্না ষষ্টপদী; কারা

যায় সঙ্গোপনে প্রিয় অভিসারে? নগর বড়ো

বেশি স্পর্শকাতর, ঈর্ষালু আর ছিদ্রান্বেষী!

না জেনে তথ্যানু রটায় অধিক, গড্ডল প্রবাহে ভাসে!

 

পোশাক, তোমার আড়ালে কারা আজ মৃদু হাসে?

 


কোড়াপাখির গল্প

খাঁচাবন্দি কোড়াপাখি ছেড়ে দাও বনে, তুমি তো শিকারি!

 

চতুর কোড়াটা দেখি শেখানো কৌশলে ডেকে আনে

বুনো কোড়াদের, অতঃপর বন্দি করে নেয় লোহার

খাঁচায়! তুমি ক্রূর হাসি হাসো! এমন খেলায় তুমি

মেতে আছো বহুদিন; ওরে নিদয়া শিকারি! দ্যাখো,

বিপুল বিষণ্ন মনে কোড়াশিশু দিগন্তে হারায়! হায়!

বিলে-ঝিলে জলে জঙ্গলে কী করুণ বেদনা

ছড়ায়! শ্রাবণের মেঘঘন এই দিনে রঙিন পিনিস

ছোটে যেন শখের সন্ধানে... তুমি মনে মনে রাজার

কুমার! আমরা তো প্রজাসাধারণ! আমাদের চিত্তে

বাজে বিত্তহীনতার সুর, শ্রমে আর ঘামে ভেজা

বেদনাবিধুর! তোমার ভাগ্য তো চন্দ্রলেখা, বলিহারি!

আমাদের দিন পোড়ে সূর্যের প্রখর তাপে! কখনোবা

ধোঁয়া ওড়ে, ধূলিঝড় অন্ধকারে খুঁজি আপনা সাকিন

হায়! পোড়াদগ্ধ মন নিয়ে কেন আজ পথে পথে ঘুরি?

 

খাঁচাবন্দি কোড়াপাখি ছেড়ে দাও বনে, তুমি তো শিকারি!

 


 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান