তৃষ্ণার উপান্তে দাঁড়িয়ে অন্তের সীমানা প্রত্যক্ষ করবার অভিলাষ পূরণ কল্পে আত্ম-প্রয়াসের যে ব্যর্থতা তা গভীর তৃষ্ণার আনুক্রমিক আতিউচ্চ মাত্রাকে স্পর্শ করবার অক্ষমতাকে বারবার প্রকট করে তোলে। ফলে অন্ত উদ্ধারের অন্তিম আকর্ষন এতক্ষনের সমগ্র কল্পিত সুখমযোতাকে অলীক আচ্ছন্নতার মতো স্ফুর্তিহীন, উত্তাপবিহীন অতিজড় কোনো কিছুর সাথে যেন তুলনীয় করে তোলে। আর যখনই এরকম ঘটে ঠিক তখনই স্পৃহার অনির্বাপিত শিখা কল্পনাকেও অতিক্রম করবার দূর্বারতা লাভ করে। অর্থাৎ সমগ্র তৃষ্ণা পরিক্রমনে স্পৃহা তিলে তিলে তৃষ্ণার বিন্দুসম অঞ্চল উদ্ধারে প্রতিক্ষণে যে শক্তি অপচয় করে উপান্ত্য-স্পর্শের স্থিতির লগ্ন পর্যন্ত সেই শক্তির প্রতিটি পরমাণু যেন আবার একই বৃত্তে কেন্দ্রীত হয়ে অন্তের বিরুদ্ধে স্পৃহাকে দ্বিগুণ মাত্রায় কার্যকর করে তোলে। কিন্তু যখন এ দ্বিগুণ শক্তির প্রচন্ড আক্রমণ রচনা করেও অন্ত উদ্ধারের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের মিছিলে বীর্যহীন হয়ে পড়ে তখনই স্পৃহার উন্মাদনা রূপান্তরিত হয়ে যায় অসহায় বিলাপ মিশ্রিত সকরুণ ব্যাকুলতায়। রবীন্দ্রকাব্যের নির্দিষ্ট কতগুলি সৃষ্টি যেন এ সকরুন ব্যাকুলতার নক্ষত্র-প্রতিভাস। তৃষ্ণার উপান্তে দাঁড়িয়ে তিনি যেন শুধু অন্তকে অবলোকনই করেছেন, উদ্ধার করতে পারেননি। আর না পারবার দূর্বলতা যেন চূর্ণ অনুভূতি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার সৃষ্টির অঙ্গ প্রত্যঙ্গে
‘হেরো তমোঘন মরুময়ী নিশা
আমার পরান হারায়েছে দিশা,
অনন্ত ক্ষুধা অনন্ত তৃষা করিতেছে হাহাকার।
আজিকে যখন পেয়েছি রে তোরে
এ চিরযামিনী ছাড়িব কী করে,
এ ঘোর পিপাসা যুগ যুগান্তে মিটিবে কি কভু আর!
বুকের ভিতরে ছবির মতন, মনের মাঝারে বিষের মতন,
রোগের মতন শোকের মতন রব আমি অনিবার \
জীবনের পিছে মরণ দাঁড়ায়ে আমার পিছনে ভয়-
ডাকিনীর মতো রজনী ভ্রমিছে
চিরদিন ধ’রে দিবসের পিছে
সমস্ত ধরাময়।
যেথায় আলোক সেই খানে ছায়া এইতো নিয়ম ভবে-
ও রূপের কাছে চিরদিন তাই এ ক্ষুধা জাগিয়া রবে।’ ছবি ও গান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং স্বীকার করেছেন অনন্ত ক্ষুধা, অনন্ত তৃষ্ণার যন্ত্রণা অনুভূত তার সমগ্র অনভূতির ব্যথাতুর নীল রক্তকণিকা য়। অথচ যন্ত্রণার বেদনা অনুভব-স্পৃহা কবির নিজের বশীভূত নয়। আর এ জন্যই সমগ্র ক্ষুধা, তৃষ্ণার বৃশ্চিক-সমুদ্র অনুভূতির তরীতে সঞ্চরণ করে এসে তৃষ্ণার কাছেই আত্মসমর্পণ করেন শেষ লগ্নেÑ
‘যেথায় আলোক সেই খানে ছায়া এই তো নিয়ম ভবে
ও রূপের কাছে চিরদিন তাই এ ক্ষুধা জাগিয়া রবে।’ এভাবে।
এ তৃষ্ণার ব্যাকুলতা, তৃষ্ণা অতিক্রমণে স্পৃহার দূর্বলতা ( অগ্রাহ্য করা সত্বেও) রবীন্দ্রনাথকে যেমন অন্তর্লোকের অন্তঃসলীলে অবগাহন করবার প্রশ্বস্ত পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে তেমনি এরই ধারাবাহিকতার সূত্রে গাঁথা তার কিছু কিছু অস্বচ্ছ ইঙ্গিত কবি জীবনানন্দ দাশকেও স্পর্শ করেছে। তবে তৃষ্ণায় আকন্ঠ ডুবে থেকে রবীন্ত্রনাথ যেভাবে তাত্বিকতাকে উদ্ভাসিত করেছেন, জীবনানন্দ যেন সে তাত্তি¡কতা থেকে পুরোপুরি দূরবর্তী অঞ্চলেই থেকে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ যখনÑ
‘পুরব মেঘ মুখে পড়িছে রবি রেখা
অরুণ রূপ চূড়া আধেক যায় দেখা।
তরুণ আলো দেখে পাখির কলরব,
মধুর আহা কিবা মধুর মধু সব।।
‘আকাশ ‘এসো এসো’ ডাকিছে বুঝি ভাই
গেছি তো তোরই বুকে আমি তো হেথা নাই।
প্রভাত আলোÑ সাথে ছড়ায় প্রাণ মোর,
আমার প্রাণ দিয়ে ভরিব প্রাণ তোর \
ওঠ হে উঠ রবি আমারে তুলে নাও,
অরুণ তরী তব পুরবে ছেড়ে দাও।
আকাশ পারাবার বুঝি হে পার হবে-
আমারে লও তবে, আমাকে লও তবে।
প্রভাত সঙ্গীত / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তার আকাক্সক্ষার চিত্রকল্পকে সমর্থন করেন উদ্ধৃত আংশিক কবিতাটির সম্পূর্ণ মর্মার্থের তত্ত¡ সর্বস্ব অর্থ উদ্দীপক আঙিকের মধ্যে দিয়ে, জীবনানন্দের কন্ঠস্বর তখন যেন শ্রুত হয় ভিন্ন স্রাতের কলগুঞ্জনে। যে কলগুঞ্জনের বিললিত অধর সমুচয় দ্বিধাহীন চিত্তে স্পষ্ট ঘোঘণা করে রোমান্টিকতার মধুময় স্বপ্নবিলাসকে।
“কে আমায় ব্যথা দেছে, - কে বা ভালোবাসে, -
সব ভুলে,- শুধু মোর দেহের তালাশে
শুধু মোর স্নায়ু শিরা রক্তের তরে
এ মাটির ’পরে
আসিব কি নেমে!
পথে পথে,- থেমে থেমে থেমে
খুঁিজব কি তারে,-
এইখানে আলোয় আঁধারে
যেই জন বেঁধেছিল বাসা । -
. ---- আর একবার! শুনিব কি গান
ঢেউদের! জলের আঘ্রান
লব বুকে তুলে
আমি পথ ভুলে
আসিব কি এ পথে আবার!
ধুলো বিছানার
কীটদের মতো
হবো কি আহত
সুখের আঘাতে !
বেদনার সাথে সুখ পাবো!
লতার মতন মোর চুল,
আমার আঙুল পাপড়ির মতো,-
হবে কি বিক্ষত
তোমার আঙুলে চুলে!
লাগিবে কি ফুলে
ফুলের আঘাত! আর বার
আমার এ পিপাসার ধার
তোমাদের জাগাবে পিপাসা!
ক্ষুধিতের ভাষা
বুুকে ক’ের ক’ের
ফলিব বলিব কি! পড়িব কি ঝ’রে
পৃথিবীর শস্যের ক্ষেতে
আর একবার আমি
নক্ষত্রের পানে যেতে যেতে।’
ধূসর পান্ডুলিপি ঃ জীবনানন্দ দাশ।
শুধু “ধূসর পান্ডুলিপি”এর এ কবিতাটির মধ্যেই নয়, জীবনানন্দের প্রেমাশ্রিত পিপাসার উত্তাল গর্জন তার অন্যান্য অনেক কবিতাতেই বর্তমান। রবীন্দ্রনাথ যেখানে স্বর্গীয় দীপ্তির আজন্ম অন্বেষণে অনন্তলোকের অনন্ত সীমা অতিক্রম করে নিজেকে আবিস্কার করেছেন ঐ দীপ্তির উদ্ভাসনকে চরম মুক্তির অবলম্বন বিবেচনা করে সেখানে জীবনানন্দ যেন মুক্তি খুঁজেছেন চিরন্তন প্রেমের সুগভীর, অবিনশ্বর আত্ম প্রজ্জ্বোলনের সুখ স্পর্শনে। ( অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সর্বদীপ্তির অন্বেষণ যেন প্রেম বর্জিত তা নয় তবে যেহেতু শুধু তার আলোচ্য বিষয়ে তাত্তি¡ক দিকটিই গৃহীত হয়েছে এবং যেহেতু তার তত্ত¡ প্রাধান্যের মুখোমুখি প্রেম নিতান্তই স্তিমিত সেই হেতু তার তাত্তি¡কতাকে বিসর্জন দিয়ে তার একক প্রেমকে গ্রহণ করা হলো না) জীবনানন্দের উদ্ধৃত কবিতাটি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। রবীন্দ্রনাথ তার প্রেমিক মানসের কাছে সর্বৈব অর্পিত ছিলেন সিদ্ধ এ যুক্তি এবং ধারণার সংস্পর্শে না এসে ভিন্ন দৃষ্টি দিয়ে ভিন্ন স্রাতে ধাবিত তার তৃষ্ণাধারাকে অবলোকন করবার প্রাণপন প্রচেষ্টা চলিষ্ণু এ আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য। এবং তার সফল প্রেমিক চিত্তের ঋদ্ধিমান আকুতি পাশাপাশি তার তৃষ্ণাপূর্ণ সৃষ্টিমানসে কতটা বিম্বমান তারই অতি সীমিত কিছু বিশ্লেষণের নিমিত্তে । প্রেমিক মানসের অন্তজ কামনা যে অশেষ পিপাসায় আশ্রিত তা নব-প্রশ্ন নির্মিতির অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রেমের দুর্নিবার পিপাসাকেও লঙ্ঘন করে যে সৃষ্টি মানসের আর্তনাদ পিপাসার নিবিড় আলিঙ্গনে ধন্য হতে পারে তারই কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপক বিশ্বাসকে স্বতঃসিদ্ধ করবার প্রয়াসমাত্র এ আলোচনা। প্রসঙ্গের স্বার্থেই রবীন্দ্রনাথের-‘নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ’কেই প্রথমত আলোচিতব্য বিষয়ভুক্ত করা যেতে পারেÑ
‘কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,
চারিদিকে তার বাঁধন যেন!
ভাঙরে হৃদয়, ভাঙরে বাঁধন,
সাধরে আজিকে প্রাণের সাধন ,
লহরীর প’রে লহরী তুলিয়া আঘাতের পরে আঘাত কর।
মাতিয়া যখন উঠেছে পরান
কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ !
উথলি যখন উঠেছে বাসনা
জগতে তখন কিসের ডর।
কী জানি কী হল আজি জাগিয়া উঠিল প্রাণ
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
ও কে চারিদিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর ,
ভাঙ, ভাঙ, ভাঙ, কারা , আঘাতে আঘাত কর!
ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
এসেছে রবির কর।।
প্রভাত সঙ্গীত ঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমজঃ তৃষ্ণা এখানে দৃশ্যমান। অথচ প্রেমের সান্নিধ্যে না এসেও সৃষ্টির পিপসা উন্মাদনায় রূপান্তরিত। কিন্তু ‘ আঘাতের পর আঘাত ’ করবার দুর্দমনীয় বাসনা যে দূঢ় প্রত্যয়ের ঘোষণা করলো তা যেন লক্ষ্যে পৌঁছেও পৌঁছুতে পারলো না । অর্থাৎ প্রত্যয় শুধু নির্দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল, নির্দেশের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ হলো না। ‘ ভাঙ , ভাঙ, ভাঙ কারা, আঘাতে আঘাত কর’ এ এসে শক্তি যেন আর সংহত থাকতে পারলো না চূর্ণিত হয়ে গেল- ‘ওরে আজ কি গান গেয়েছে পাখি, এসেছে রবির কর’ এর মধ্যে দিয়ে। তৃষ্ণা তৃপ্ততায় উদ্ধারিত হবার ঠিক পূর্ব মুহুর্তেই যেন তৃপ্ততা হারিয়ে তৃষ্ণাকে বিজয়ীর অর্ঘ্যে পুরস্কৃত করে দিলো। এখানে কাজী নজরুল ইসলামকে স্মরণ করলে অসঙ্গত হবে না বোধ করি
‘আমি মৃন্ময় আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চিরদূর্জয়,
জগদীশ্বর- ঈশ্বর আমি পুরুষত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ পাতাল মর্ত !
আমি উন্মাদ ।।
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!
অগ্নিবীনা ঃ কাজী নজরুল ইসলাম।
কাজী নজরুল ইসলাম এখানে চূড়ান্তভাবে আত্ম-তৃপ্ত। অবশ্য যদিও আবেগের বেগবান প্লাবনে তার তৃপ্ততা জ্ঞান-শুণ্যের মতো ভেসে গেছে কিন্তু তবুও এ ভেসে যাওয়াতেই তিনি তৃপ্ত। সৃষ্টি-স্বপ্নে উন্মাদ হয়ে যে তৃষ্ণা সমুদ্রে তিনি নিজেকে সঞ্চরিত করেছেন শেষ মুর্হতে সে সঞ্চরণের স্বার্থকতা থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েননি। যেখানে তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন-‘ আমি তাথিয়া তাথিয়া মাতিয়া ফিরি স্বর্গপাতাল মর্ত’ সেখানে তার তৃপ্ততা সম্পর্কিত সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশটিও চিহ্নহীন। কিন্তু ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ-এর রবীন্দ্রনাথ নজরুলের বিপ্রতীপ বলয়ে আবর্তিত বিপুল তৃষ্ণা লালন করে, বিশাল পিপাসা-নির্ঝর পাড়ি দিয়েও তীরের কাছাকাছি এসে গতি অবসন্ন। আর এ গতি ¯ স্রাতের অবসন্নতার ভারই তার নিজের আত্মঅনুশীলন এবং অনুসন্ধানের একনিষ্ঠ উৎসাহদাতা। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গে প্রেমের সাথে সাথে (সাধারণভাবে) তাত্তি¡কতাও অনুপস্থিত। কিন্তু তার অন্যান্য বহুসংখ্যক কবিতা বর্তমান যাতে তাত্তি¡ক মহিমা একই অঙ্গে আশ্রিত প্রেমকে দারুনভাবে লঙ্ঘনকারী। এবং এ লংঘনের উৎসাহ তিনি প্রাপ্ত ঐ অনুশীলনের ব্যাকুলিত আর্তি থেকে।
‘সহায় মোর না যদি জুটে নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা,
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।
আমারে তুমি করিবে ত্রান, এ নহে মোর প্রার্থনা
তরিতে পারি শকতি যেন রয়।
আমার ভার লাঘব করি না-ই বা দিলে সান্ত¦ না,
বহিতে পারি এমনই যেন হয়।
নর শিরে সুখের দিনে তোমারই মুখ লইব চিনে
দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয় \
গীতাঞ্জলি ঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঈশ্বর প্রেমে নিমগ্ন থেকে নিজেকে অনুশীলন করবার দুরন্ত প্রয়াস উদ্ধৃত কবিতাটি একদিকে ঈশ্বর প্রেমের অপ্রতিহত পিপাসা অন্যদিকে প্রেমের সে আলোকেই নিজেকে চিনবার অকল্পনীয় স্পৃহা। ফল স্বরুপ প্রেমের ¤ ্রয়িমান দ্যুতি প্রকাশিত তাত্তি¡কতার উজ্জ্বলতা। ঈশ্বরকে সংশয় না করবার ইচ্ছা তার সম্পূর্ণ শরীরে মূর্তিত এবং কবিতাটির মূল বক্তব্য কিন্তু ইচ্ছার পরিপূর্ণ সফলতা সমগ্র কবিতাটির কোথাও দৃষ্ট নয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনন্ত পিপাসার কাছে এক অপূর্র্ণ আত্মনিবেদন যেন।
এ আত্মনিবেদনের অসীম আকাক্সক্ষা তাকে যেন তার নির্দিষ্ট কতগুলো সৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক জগতের অধিবাসী করে তুলেছে। তৃষাতুর আত্মা নিয়ে তিনি ডুবে গেছেন আধ্মাত্মিকতার অতল অন্ধকারে অথচ অনুভব করেছেন তিনি সে অন্ধকারেও উজ্জ্বল আলোকমালার বিপুল সমারোহ। কিন্তু তার প্রায় সব আধ্মাত্বিকতার সৃষ্টির মর্ম সন্ধানের ফল এমন দাঁড়িয়েছে যে, এখানে মনে হয়েছে তিনি যেন সে অত্যুজ্জ্বল আলোক-সাগরে অবগাহন করতে পারেন নি। শুধু অনুভব করেই আত্মহারা হয়েছেন, স্পর্শ করতে পারেননি। পিপাসা তার পিপাসাই থেকে গেছে
০১.
‘তখন করিনি নাথ কোন আয়োজন।
বিশ্বের সবার সাথে হে বিশ্ব রাজন,
অজ্ঞাতে আসিত হাসি আমার মন্দিরে
কত শুভ দিনে, কত মুহূর্তের পরে
অসীমের চিহ্ন মিশে গেছে! লই তুমি
তোমার স্বাক্ষর আঁকা সেই ক্ষণ গুলি
দেখি তারা স্মৃৃতি মাঝে আছিল ছড়ায়ে
কত না ধুলির সাথে আছিল জড়ায়ে
ক্ষণিকের কত তুচ্ছ সুখ দুঃখ ঘিরে।।
...খেলা-মাঝে শুনিতে পেয়েছি থেকে থেকে
সে চরণ ধ্বণি, আজ শুনি তাই বাজে
জগত সংগীত সাথে চন্দ্র-সূর্য্য- মাঝে।।
০২.
ওরে মূঢ়, জীবন সংসার
কে করিয়া রেখেছিল এত আপনার
জন্ম মুহূর্ত হতে তোমার অজ্ঞাতে,
তোমার ইচ্ছার প’রে। মৃত্যুর প্রভাতে
সেই অচেনার মুখ হেরিবি আবার
মুহূর্তে চেনার মত। জীবন আমার।
এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়,
মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়।।
জীবনের সিংহ দ্বারে পশিনু যে ক্ষণে
এ আশ্চর্য সংসারের মহা নিকেতনে
সে ক্ষণ অজ্ঞাত মোর। কোন শক্তি মোরে
ফুটাইল এ বিপুল রহস্যের ক্রোড়ে
অধিরাত্রে মহাশুণ্যে মুকুলের মতো \
নৈবেদ্য ঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আধ্যাত্মজাত সৃষ্টির রন্ধ্রহীন দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত তিনটি কবিতার আংশিক মর্মার্থ অনুযায়ী কবিতা তিনটির মধ্যে দিয়ে স্রষ্টার ঈশ্বর- উন্মুখ প্রবণতাকে অনায়াসেই হৃদয়ের নিবিড়তায় আবিস্কার করা যায়। কিন্তু ‘কোন শক্তি মোরে ফুটাইল এ বিপুল রহস্যের ক্রোড়ে অধিরাত্রে মহাশুণ্যে মুকুলের মতো’ কবির নিজের এ প্রশ্নটির সঠিক উত্তর তিনি নিজেই খুঁজে পান না। তিনি অন্ধকারকে উপলব্ধি করতে পারেন, অন্ধকারের চিত্রকল্প নিজের মনের গহীনে অঙ্কন করে সে চিত্রকল্পের সাথে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারেন কিন্তু সে রহস্যাবৃত অন্ধকারের গর্ভে প্রবেশ করতে পারেন না যেখানে সে ফুটিত মুকুলের অবয়ব নির্মিত হয়। অথচ সেখানে প্রবেশের জন্যই তার আপ্রাণ প্রচেষ্টা তার সৃষ্টির প্রতি কোণে কোণে জড়ানো।
উদ্ধৃত তিনটি কবিতাতে আরত্ত একটি বস্তুর অবশ্য অবস্থিতি স্বীকার্য যা তত্ত¡মূল। অবশ্য আধ্যত্মিক নিসর্গের দুর্বার আকর্ষণই মূলত এ তাত্তি¡কতার জন্যে দায়ী। যেহেতু আধ্যাত্ম জগতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাত্তি¡কতাও তার ওপর ভর করেছে হয়ত বা তার অজান্তেই তার সৃষ্টিতে চিরকালের জন্যে স্থান করে নিয়েছেÑ এক রকম প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় এবং এ সিদ্ধান্তের সমর্থন তার কবিতার চরিত্রেই নিহিত।
রবীন্দ্রনাথ তার প্রেমিক সত্তার সচলমান ক্রিয়াশীলতার ওপর যতটা তুষ্ট এবং স্বার্থক, ঈশ্বর প্রবণতা অথবা আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতিতে তিনি ততটা নন। এসব ক্ষেত্রে তিনি যুক্তিনিষ্ঠভাবেই তৃষ্ণার উপান্তে দন্ডায়মান। এই তৃষ্ণার পরিধি অতিক্রমণ তার কাছে সুদূর পরাহত বলেই কল্পিত। আর এই অতিক্রমণ-অভিস্পা পূরনে তার ব্যর্থতা আত্মদুর্বলতার লজ্জায় অস্থির চিত্তে ব্যকুলিত। তাহলে উদ্ধৃত আলোচনার সম্পূর্ণ চরিত্র বিশ্লেষণ করে যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ তৃষ্ণার হলাহলে মুহুম্র্্ুহু জর্জরিত থেকেও শক্তিধর নীলকন্ঠের শীর্ষ মর্যাদায় উন্নীত হবার যোগ্যতা অর্জন করেছেন যদিও তবুও নীলকন্ঠ হয়েও তিনি অতৃপ্তই রয়ে গেছেন। নীল কন্ঠ হবার সৌভাগ্যে ভাগ্যবান তারাই হতে পারেন যারা অতি সহজেই হলাহল গলধঃকরণ করেও তার যন্ত্রণাকে আয়ত্তাভুক্ত করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ সেদিক থেকে আরো বেশী কিছু দূর পর্যন্ত অগ্রসর সম্ভবতঃ। যেহেতু তিনি যন্ত্রণাকে তো আয়ত্ত করেছেনই অতিরিক্তের পর্যায়ে তিনি ওই যন্ত্রণা থেকে লাভ করেছেন আত্মানুসন্ধান করবার অনুপ্রেরণাকে। কিন্তু তারপরেও তিনি অতৃপ্ত থেকে গেছেন এ প্রেক্ষিত বিবেচনায় যে, ওই আত্মানুসন্ধানের ফল প্রাপ্তি তার কাছে অধরাই রয়ে গেছে বলেই তিনি নিজে মনে করেছেন। তাহলে ইতিবাচক ওই আত্ম অনুসন্ধানকে মূলীভূত বিবেচনা করে অগ্রসর হলে স্বাভাবিকভাবেই তার অতৃপ্ত থেকে যাবার সম্ভাবনা যুক্তিগ্রাহ্য অবশ্যই যে, রবীন্দ্রনাথ তার নিজের সৃষ্টিতেই পূরোপুরি তৃপ্ত হতে পারেন নি অতৃপ্তই থেকে গেছেন অনন্তর। এবং এ কথাই স্বাভাবিক এবং স্বতঃসিদ্ধ যে, একজন স্রষ্টা তার সমগ্র সৃষ্টি-কর্মে কখনই শতভাগ তৃপ্ত হতে পারেন না যা প্রকৃত অর্থেই চিরন্তণ। এ প্রেক্ষিতে স্রষ্টার অনন্ত পিপাসা পূরনের আর্তি অবিনাশী।