বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ এর জন্মদিন
সূত্র : বাংলাপিডিয়া
আজাদ, হুমায়ুন (১৯৪৭-২০০৪) কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী। বিক্রমপুরের রাড়িখালে ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল জন্ম। পিতা আবদুর রাশেদ স্কুল শিক্ষক, মাতা জোবেদা খাতুন গৃহিণী। তাঁর পূর্ব নাম হুমায়ুন কবির। ১৯৮৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি হুমায়ুন কবির নাম পরিবর্তর করে বর্তমান হুমায়ুন আজাদ নাম গ্রহণ করেন।
হুমায়ুন আজাদ রাড়িখাল স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশন থেকে মাধ্যমিক (১৯৬২), ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক (১৯৬৭) ও স্নাতকোত্তর (১৯৬৮) এবং এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা করে ১৯৭৬ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
হুমায়ুন আজাদের পেশাগত জীবন শুরু হয় চট্টগ্রাম কলেজে যোগদানের (১৯৬৯) মধ্য দিয়ে। পরে তিনি ১৯৭০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৭২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালের ১ নভেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এবং ১৯৮৬ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।
১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য অলৌকিক ইস্টিমার এবং প্রবন্ধগ্রন্থ রবীন্দ্রপ্রবন্ধ: রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা। এ সময় তিনি ভাষাবিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি কবিতা লেখাতেও মনোযোগ দেন। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ জ্বলো চিতাবাঘ। তাঁর ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক তিনটি গ্রন্থ যথা, বাংলা ভাষার শত্রুমিত্র (১৯৮৩), Pronominalization In Bengali (১৯৮৩), বাক্যতত্ত্ব (১৯৮৪)। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ: বাঙলা ভাষা (দু-খন্ড, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫), আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৯৪), মুহম্মদ আবদুল হাই রচনাবলী (তিন খন্ড, ১৯৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান কবিতা (১৯৯৭); তাঁর ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক দুটি গ্রন্থ, তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান (১৯৮৮), অর্থবিজ্ঞান (১৯৯৯)।
হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য-সমালোচনা ও মননশীলতার প্রকাশ লক্ষ করা যায় শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা (১৯৮৩) বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৮৮), ভাষা-আন্দোলন : সাহিত্যিক পটভূমি (১৯৯০), নারী (১৯৯২), নরকে অনন্ত ঋতু (১৯৯২), প্রবচনগুচ্ছ (১৯৯২), সীমাবদ্ধতার সূত্র (১৯৯৩), আধার ও আধেয় (১৯৯৩), আমার অবিশ্বাস (১৯৯৭), নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৯৯), আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম (২০০৩) প্রভৃতি গ্রন্থে।
ভাষাশৈলীতে তিনি বুদ্ধদেব বসু-র দ্বারা প্রভাবিত হলেও তাঁর স্বকীয়তা অনস্বীকার্য। সাহিত্যে ভাবের ও ভঙ্গির প্রকাশে তিনি স্বতন্ত্র। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল (১৯৯৪), সব কিছু ভেঙে পড়ে (১৯৯৫), মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ (১৯৯৬), যাদুকরের মৃত্যু (১৯৯৬), শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার (১৯৯৭), রাজনীতিবিদগণ (১৯৯৮), কবি অথবা দন্ডিত অপুরুষ (১৯৯৯), নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু (২০০০), ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ (২০০১) ও শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা (২০০২) উপন্যাসগুলিতে তাঁর নিজস্ব ভাবনা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলের সমাজ ও সংস্কৃতির নানা সংঘাতের কথা বিধৃত হয়েছে।
সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে তাঁর প্রতিভা ও মননের এক অসাধারণ দিক উন্মোচিত হয়েছে শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা কিছু গ্রন্থে, যেখানে তাঁর ব্যঞ্জনাধর্মী ভাষা সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। লাল নীল দীপাবলি (১৯৭৬), ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না (১৯৮৫), কতো নদী সরোবর (১৯৮৭), আববুকে মনে পড়ে (১৯৮৯), বুকপকেটে জোনাকিপোকা (১৯৯৩), আমাদের শহরে একদল দেবদূত (১৯৯৬), অন্ধকারে গন্ধরাজ (২০০৩) প্রভৃতি বইয়ে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। হুমায়ুন আজাদের কবিস্বভাব ফুটে উঠেছে নিম্নলিখিত কাব্যগুলিতে, যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল (১৯৮৭), আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০), কাব্যসংগ্রহ (১৯৯৮), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮)।
সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন।
হুমায়ুন আজাদকে দেশের প্রধান প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক লেখক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। গতানুগতিক চিন্তাকে তিনি সচেতনভাবেই পরিহার করেছেন। তিনি জনপ্রিয় তবে অতি বিতর্কিত সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি যা ভাবতেন তাই সাহসের সঙ্গে লিখতেন ফলে তিনি অনেকেরই বিরাগভাজন হন। এক পর্যায়ে তিনি মৌলবাদীদের কর্তৃক মারাত্মকভাবে আহত হয়ে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েন। তাঁর নারী (১৯৯২), দ্বিতীয় লিঙ্গ (২০০১), পাক সার জমীন সাদ বাদ (২০০৩) গ্রন্থ তিনটি বিতর্কের ঝড় তোলে এবং এরই এক পর্যায়ে সরকার বই তিনটিকে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। ‘কবি হাইনরিশ হাইনের জীবনী ও তাঁর কবিতার বাংলা অনুবাদ’ বিষয়ে গবেষণার জন্য জার্মানির পি ই এন কর্তৃপক্ষ হুমায়ুন আজাদকে এক বছরের (১ আগস্ট ২০০৪-৩১ জুলাই ২০০৫) ফেলোশিপ প্রদান করলে তিনি জার্মানিতে গমন করেন। সেখানকার মিউনিখ শহরে ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।