যতীন সরকার তার ‘মুক্তবুদ্ধির চড়াই-উতরাই’ বইটির জন্য প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণ ও অনুবাদ শ্রেণিতে, কবিতা ও কথাসাহিত্য শ্রেণিতে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তার ‘একাত্তর ও অন্যান্য গল্প’ বইয়ের জন্য এবং পিয়াস মজিদ তার ‘মনীষার মুখরেখা’ বইয়ের জন্য ‘হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার’ বিজয়ী হয়েছেন।
‘মুক্তবুদ্ধির চড়াই-উতরাই’ বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ, ‘একাত্তর ও অন্যান্য গল্প’ প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ এবং ‘মনীষার মুখরেখা’ প্রকাশ করেছে মাওলা ব্রাদার্স।
শুক্রবার (৩০ নভেম্বর) সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে এক হয়েছিলেন দেশসেরা সাহিত্যিক, কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিল্পী, সংস্কৃতিসেবীসহ সাহিত্যমনস্ক বিজ্ঞজনেরা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বিজয়ীদের উত্তরীয় পরিয়ে ও হাতে পুরস্কারের সম্মাননা স্মারক এবং চেক তুলে দেন বিচারকমণ্ডলীর তিন সদস্য হাসান আজিজুল হক, হেলাল হাফিজ ও আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং সমকালের প্রকাশক এ কে আজাদ ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি এবং ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর এফ হোসেন।
এবারের পুরস্কারে প্রথম দু’টি শাখার প্রত্যেক বিজয়ী পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন দুই লাখ টাকা, ক্রেস্ট ও সম্মাননা। আর তরুণ লেখক পেয়েছেন এক লাখ টাকা, ক্রেস্ট ও সম্মাননা। পুরস্কারের জন্য তিন শাখায় এবার ৪৬৭টি বই জমা পড়ে। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত বই পুরস্কারের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়। ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, কবি হেলাল হাফিজ ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের সমন্বয়ে গঠিত বিচারকমণ্ডলী পুরস্কারের জন্য সেরা তিনটি বই নির্বাচন করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান পুরস্কারপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, কালের হিসেবে এ পুরস্কার খুব বেশিদিন না হলেও, এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে পরিণত হয়েছে। যারা এ পুরস্কার পাচ্ছেন, তারও সম্মানিত হচ্ছেন।
পুরস্কারপ্রাপ্তদের সম্পর্কে তিনি বলেন, যতীন সরকার মার্কসবাদী লেখার মধ্য দিয়ে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যত্নশীল বুদ্ধিদীপ্ত নানা কাজ করেন, যা অন্য লেখকদের কাছে অনুকরণীয়। পিয়াস মজিদ তার পূর্বগামী লেখকদের ক্ষেত্রে গবেষকের মধ্যে দৃষ্টিপাত করেছেন।
বিচারকমণ্ডলীর প্রধান হাসান আজিজুল হক বলেন, আজ যারা পুরস্কৃত হয়েছেন, তারা সবাই আমার ঘনিষ্টজন। তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। এর ফলে কোনো পক্ষপাতিত্ব হয়েছে কি-না আমার জানা নেই। নির্মোহভাবে বিচার করার চেষ্টা করেছি। ঘনিষ্ট কোনো সম্পর্কের কথা মাথায় রাখিনি।
আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, যেসব বই জমা পড়েছে, তার প্রতিটিই ভালো। যারা পুরস্কার পেয়েছেন, যারা পাননি-তাদের মধ্যে খুব বেশি ফারাক নেই। যারা পুরস্কার পাননি, তাদের লেখা পড়েও উপকৃত হয়েছি।
যারা পুরস্কার পাননি তাদেরও লিখে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে এ কে আজাদ বলেন, সমকাল আমাকে যতটা আনন্দ দিতে পারে না, ততটা আনন্দ আমি এ সাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে এসে পাই। আপনারা লিখে যান। লেখক স্বীকৃতি পেলে যেমন অনুপ্রাণিত হন, তেমনি দায়িত্বও বাড়ে।
সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ব্র্যাংক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কারটি এরই মধ্যে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সে সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে পৌঁছেছে। লেখকদের বিশেষ করে তরুণদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করছে এ পুরস্কার।
আয়োজনে নিজের বক্তব্যে কবি হেলাল হাফিজ পাঠ করেন স্বরচিত কবিতা।
পুরস্কার পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে যতীন সরকার বলেন, আমার অনুভূতি জানানোর ভাষা নেই। শুধু বলতে চাই, আমি অভিভূত। আমি দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ। বসে থাকতে পারি না, কলম চালাতে পারি না। আপনাদের আর্শিবাদ নিয়ে কবিগুরুর মতো বলতে চাই- ‘দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল’।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শুরুতেই রসিকতা করে বলেন, বন্ধু হেলাল হাফিজ পক্ষপাত করে আমাকে এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেছেন! কারণ, এ পুরস্কার পেতে পারি, এটা কখনও ভাবিনি। কারণ, আমার চেয়ে অনেকে ভালো লেখেন। সে হিসেবে এ পুরস্কার পাওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ।
হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী লেখক পিয়াস মজিদ বলেন, হৃদয়ের ভেতরের গুঞ্জরিত অনুভূতিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি। তা যে কোনো শিল্পমাধ্যমেই হতে পারে। আমি সব মাধ্যমকে একসঙ্গে উদযাপন করছি।
আয়োজনের সাংস্কৃতিক পর্বে অতিথিদের স্বাগত জানান পূজা সেনগুপ্ত ও তার নাচের দল তুরঙ্গমী রেপার্টরি ড্যান্স থিয়েটার। দলটি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে। এরপর সংগীত পরিবেশন করেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ইফ্ফাত আরা দেওয়ান। তিনি শুরুতেই গেয়ে শোনান ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে’। এর পর তিনি একে একে গেয়ে শোনান ‘আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন’, ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে’সহ বেশ কিছু গান।
বাংলা সাহিত্যের মৌলিক সৃষ্টিকর্মকে উৎসাহিত করার জন্য ২০১১ সাল থেকে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। পরে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তরুণ সাহিত্য পুরস্কারটির নামকরণ করা হয় এই বরেণ্য লেখকের নামে।
এর আগে ২০১১ সালের ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার পান সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক ও দ্রাবিড় সৈকত, ২০১২ সালে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বুলবুল চৌধুরী ও শুভাশিস সিনহা, ২০১৩ সালে মঈনুল আহসান সাবের, মাসরুর আরেফিন ও বদরুন নাহার, ২০১৪ সালে হরিশংকর জলদাস, সুস্মিতা ইসলাম ও মুজিব ইরম, ২০১৫ সালে নির্মলেন্দু গুণ, রাজকুমার সিংহ ও স্বকৃত নোমান এবং ২০১৬ সালে এ পুরস্কার পান ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও মাজহার সরকার।