মোহাম্মদ ইকবাল ।। গুচ্ছ কবিতা
মোহাম্মদ ইকবাল ।। গুচ্ছ কবিতা
অস্তিত্বের প্যারাডক্স

প্রতিটি রাত যেন ভাঙা জোছনার রহস্যময় আয়নায় আটকে থাকা এক অস্তিত্বের প্যারাডক্স,
আমি সেই আয়নার কিনারায় দাঁড়িয়ে তোমার নিঃশ্বাসের তপ্ত কুয়াশায় অপেক্ষার নাম লিখি।
অদেখা হরফে।
অশ্রুভেজা কাব্যে।
স্পর্শের অলিখিত অনুভব
নৈঃশব্দ্যের পাণ্ডুলিপিতে ধীরে ছড়ায় অনন্ত আত্মার কাব্যরেখা।
ঘুমন্ত তোমার চোখের পাতায় জেগে ওঠে সহস্র দেবদূতের ডানা,
ঝাপটায় যার থেমে যেতে থাকে মহাকালের ঘড়ির কাঁটা।
নক্ষত্রের মুগ্ধতায় রঙিন মহাকাশ ,
যেন সৃষ্টির সূচনালিপি নতুন করে লেখা হচ্ছে তোমার মাহাজাগতীক অস্তিত্বে।
তোমার কপালের অদৃশ্য পটভূমিতে জ্বলে উঠে প্রাচীন কোনো গ্রন্থের শেষ বর্ণমালা।
যা কেবল হৃদয় দিয়ে পড়া যায়,
চোখে নয়।
প্রতি রাতের দেহে যতনে আঁকি অলীক বাগানের স্বপ্ন ইলিউশন,
যেখানে পাপড়িগুলো নিঃশব্দে উচ্চারণ করে তোমার উষ্ণতার ব্যাকরণ।
সেই ব্যাকরণ।
যা কোনো ভাষাতেই লেখা হয়নি।
তবুও হৃৎপিণ্ড মেপে নেয় তার প্রতিটি স্তবকের গভীরতা।
আমরা পাশাপাশি।
তবু এক নাক্ষত্রিক দূরত্বে বন্দি।
একই আয়নায় প্রতিচ্ছবি,
অথচ দুলে যাই বিপ্রতীপ তরঙ্গে।
যেখানে আলো ছুঁয়ে যায় কেবল নিঃশ্বাসের অন্তরাত্মা।
তোমার ত্বকের ছায়া বেয়ে ঝরে পড়ে এক আনকোরা প্রেমের মহাকাব্য।
যার ভাষা বোঝে কেবলই স্বপ্নেরা।
অতঃপর ঘুমাও তুমি,
তোমার নিঃশ্বাসে ছড়ায় প্রার্থনার সুর,
আর আমি জেগে থাকি নিঃশব্দের প্রহরে,
যেখানে ভালোবাসা নিদ্রায়ও অম্লান থাকে
নৈঃশব্দ্যের পরম্পরায় আঁকা সরলরৈখিক এক জটিল সমীকরণে।

সময়ের অসমাপ্ত ঘড়ি

তুমি ছিলে সময়ের এক অলিখিত ব্যুৎপত্তি,
আমার প্রতিটি ঘড়ির কাঁটায় গাঁথা এক লুকোনো নাম।
আমি সময় গুনিনি,
শুধু অপেক্ষা করেছি তোমার পদধ্বনির ছায়া শুনতে।
দেওয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়িটিও বলে ;
"প্রেম কখনো ঠিক সময়ে আসে না!"
সে আসে বিকেলের রোদ হয়ে,
ছাদের কোণ ঘেঁষে ঝুলে থাকা স্তব্ধ বাতাসে।
তুমি এসেছিলে কি না জানি না,
তবে তোমার অনুপস্থিতি আমার বুকের ক্যালেন্ডারে প্রতিদিন ছাপ ফেলে গেছে ছায়ার অক্ষরে।
প্রেম এখানে উপস্থিত নয়,
সে এক প্রাচীন অনুবাদ।
যার মূল পাঠ আমি কখনো পাইনি,
শুধু প্রতিটি অনুচ্ছেদে তোমার নামের ধ্বনি শুনেছি।
আমি এখন সময়ের গভীরতম সরণিতে
চুমু খাই প্রতিটি হারানো ক্ষণের গায়ে,
যেখানে তুমি নেই,
তবুও প্রেম থেকে যায়,
একটি অসমাপ্ত ঘড়ির মত,
চিরকাল নিঃশব্দ,
চিরকাল তোমার জন্য।

পরিযায়ী চাঁদ

রাতের পাঁজরে গেঁথে থাকা একফালি রুপালি ক্ষত,
ঈদের চাঁদ বলে কেউ কেউ ডাকে তাকে।
সে কি সত্যিই চাঁদ?
নাকি শুধু এক মায়ার প্রতিফলন?
নগরজুড়ে জ্বলে থাকা নৈঃশব্দ্যের ল্যাম্পপোস্ট?
আমরা কি ঈদের মানুষ?
নাকি কেবল আলোর নিচে দীর্ঘতর ছায়া?
একটা সম্মোহনী ঘোড়দৌড়ের ভেতর
অপার্থিব পাখির মতো ঘুরে বেড়াই,
সময়ের জানালায় চোখ রেখে খুঁজি;
ধোঁয়াশার ওপারে মা এখনও কি পিঠে বানাচ্ছেন?
বাবার কণ্ঠে দরগা মসজিদের তাকবির ভাসে কি না,
রিকশার চাকার শব্দে ঈদের সকাল জাগে কি না!
শহর জুড়ে ফোটে নকল আতশবাজির আলো,
আকাশে ঝুলে থাকে এলইডি চাঁদ।
আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি
হলোগ্রাফিক হাসির ফাঁকে,
ইমোজির মতো সংবেদনশূন্য।
আমাদের ঈদ নেই,
আমাদের উৎসব নেই—
শুধু এক শূন্যপদ,
শুধু এক পরিযায়ী চাঁদ,
যে ঘর চিনতে ভুলে গেছে বহু আগে।

নৈঃশব্দের চিৎকার

ঈশ্বর,
ভুলেও এসো না আর বুড়িগঙ্গার জলে,
শীতলক্ষ্যার ঢেউয়ে আজ কান্নার শব্দ,
লাল বৃত্ত আঁকে রক্তমাখা শঙ্খচিলের ডানা।
জলজ প্রাণীরা আজ নীরব নয়,
তাদের চোখে জমে থাকা নোনাজল
বিদ্রোহের আগুন হয়ে ওঠে প্রতিটি জোয়ারে।
ঈশ্বর,
মনে পড়ে সহাস্য তনুর কথা?
তোমার আশির্বাদে সে পরেছিল রাতের তারা,
গায়ের গন্ধে ফুটেছিল শিউলি আর বেলিফুল।
তবু একদিন নরপিশাচদের কালো হাত
ছিঁড়ে নিয়েছিল তাঁর সমগ্রতা,
প্রাণপণে ডেকেছিল তোমাকে,
তুমি আসোনি!
চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের মূর্তিগুলোও
তাকিয়ে ছিল নিশ্চুপ চোখে,
এগিয়ে আসা কাউকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল বুলেটের তপ্ত সীসা।
তনুর রক্তে রাঙা হয়েছিলো শহরের পথ
সূর্য সেদিন অস্ত যায়নি,
সূর্য ঢেকে দিয়েছিল দুর্বৃত্তের কুৎসিত ছায়া।
ঈশ্বর,
আজ এই শহর, এই নদী , এই দেশ আর একটি আর্তনাদও সহ্য করবে না।
জলজ প্রাণেরা আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে,
জলে ধর্ষকের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
প্রবেশ নিষেধ সর্বত্র।
তোমাকেও, ঈশ্বর!
তুমি নিরব দর্শকের মতো থাকলে,
তবে তোমারও জায়গা নেই এই প্রবাহে।
আজ বুড়িগঙ্গার ঢেউয়ে শপথ,
আর একটিও আছিয়া হারাবে না সম্ভ্রম,
একটিও মৃদুলা সম্ভ্রম খোয়ানোর লজ্জায় সলিলে আত্মবিসর্জন দিবে না।
এ শহর, এ নদী , সমস্ত বাংলাদেশ আজ জেগে উঠেছে
যারা রক্ত ঝরায়, তাদের জন্য নেই ক্ষমা,
তাদের জন্য নেই জল, নেই আকাশ, নেই আশ্রয়।
ঈশ্বর,
এসো না আর এই জলে,
জলজ প্রাণেরা আজ অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে তোমাকেও।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান