পেঁচা
একটি পেঁচা প্রায় রাতে ডাকে তোমাদের বাড়ির জলাঙ্গলায়।
তুমি কেঁপে ওঠো অজানা অশংকায়
থু থু দাও বুকে
আর ভাবো
সংসারে কোনো অমঙ্গল এলো বুঝি নেমে!
তোমার সংসার অমনি ভরে উঠেছে আকাশের তারারাজির মত
কোথাও কোনো অসুখ অন্ধকার নেই।
তবু তুমি মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ভাবো
কেন পেঁচা ডাকে তবে?
সেই ক্ষণে তুমি একটু একটু ব্যথা পাও
গভীরে কোথাও
চেনা চেনা মনে হয় পেঁচার কণ্ঠখানি
আর আমি এইখানে এই শব্দে
নিশিডাক লিখে চলি।
যাত্রা, মহিষ পিঠে
মহিষ পিঠে চলেছি বহুকাল জল- জলাজঙ্গলা পেরিয়ে ।
আমি কি রাখাল তবে ছিলাম বাথানের, নাকি দূর কোনো গাঁয়ে
বদ হাওয়া লেগে অসার দেহ। লোকে দিয়েছে তুলে
সাপে কাঁটা চাঁদ সওদাগর, মহিষডিঙায়।
মনে নেই কিছু। শুধু একটু একটু লোকালয় স্মৃতি, অস্পষ্ট মানুষের মুখ
হয়ত মায়ের, হয়ত প্রেমিকার।
চলেছি এই রাতে যেন জলাধারের ওপারে আছে স্বাস্থ্যসদন
আছে সবুজ গ্রাম, বৃক্ষশোভা, নগর কিনারে
কোনো ওঁ নিরাময়া।
কী অসুখ জানা নেই কারো- আমার কিংবা মহিষের
চলেছি বহুকাল যেন দূরত্বই আরোগ্য অথবা পথের ধারেই আছে
পথ্য সব বনৌষধি।
জলাজঙ্গলার পথে মহিষের খুরের জল আর কাদা ভাঙার শব্দ আর
আমার গোঙানি
অখনে এইখানে সাদা পৃষ্ঠা হতে কালো অক্ষরে, মৃদু শোনা যায়।
মনুষ্যসমাজ ছেড়ে
মনুষ্যসমাজ ভাল লাগছে না বলে পালিয়ে
মেঘের উপর শুয়ে আছি।
সাদা সাদা মেঘ উড়ছে চারপাশে। পাখিরা
গাইছে গান। কিচির মিচির।
বেশ শান্তি শান্তি লাগছে
উপরে নীল। মহাশূন্য।
মেঘে মেঘে কথা হচ্ছে
কথা হচ্ছে পাখিতে পাখিতে।
নীলে নীলেও কথা হচ্ছে হয়ত!
কিন্তু কেউই তাদের দলে
আমাকে নিচ্ছে না।
আমিও বেশ শুয়ে আছি একা একা
মেঘের বালিশে হেলান দিয়ে নির্বিকার
উতলা হয়েও কোনো লাভ নেই কোনো
পাখি
মেঘ বা নীলের ভাষা বুঝতে পারছি না।
মনুষ্যসমাজ ছেড়ে একা একা লাগছে খুব
মেঘের উপরে।
সাদা ফুল, করোনায়
কবর ফুটে উঠতে শুরু করেছে চারপাশে
যেন অন্ধকারের ভেতর ফুটে ওঠা টগর
সাদা সাদা, ঝোপ ঝোপ, সারি সারি।
আমি মৃতের ঘৃাণ পেতে শুরু করেছি
প্যাকেট মোড়ানো সাদ সাদা কফিন হতে
আর আশ্চর্য
আমার চুলও সাদা হয়ে উঠছে দ্রæত
কফিন ও কবরের ঘ্রাণে।
কেউ যেন হাঁটছে বারান্দায়
মৃত্যুর গন্ধমাখা নরম, শতপায়।
এই সাদা সাদা ফুলে, ফুলের ভেতর জেগে ওঠা কবরগুচ্ছে
একদিন কালো হয়ে উঠবে ইতিহাসের সাদা সাদা পৃষ্ঠা
লোকে বলবে, মানুষ সেবারও মানুষ মরেছিল হাজারে হাজারে
করোনায়।
আমিও।
টগর ফুলটি যেন ফুটে সে অচেনা সাদা কবরের শিয়রেও।
মহামারী শেষে
মরে গেলে এই মহামারী শেষে
অমনি বৃষ্টি হবে
ও বন জুড়ে
ঝুম।
অমনি ফুটবে বনে বনে
কষ্ণচূঁড়া লাল
বুম।
অমনি তরুণী হবে কিশোরীরা
এই রূপসী রমণী দেশে
চুম।
অমনি জোৎন্সা ছড়াবে পূর্ণিমা রাতে
আকাশ ফাটিয়ে চাঁদ
ধুম।
শুধু আমি থাকবো না
বুঝলে হে করোনা
হুম।
গাছটি এখনো নুয়ে আছে
গাছটি এখনো নুয়ে আছে
নুয়ে আছে পুকুরের জলের দিকে
অন্ধকার রাত্রিরে, তারাময় রাতে
শীতের সকালে কুয়াশা ভিজে
ভিজে ভরা বর্ষায়
ঘুঘু ডাকা চৈত্রের নিঃসঙ্গ দুপুরে
নুয়ে আছে।
তার গায়ে এসেছে ভরা যৌবন
ফুল ফুটে চলে গেছে ফলেরও মৌসুম
গাছটি কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই
ফুলময়, ফলবান হয়ে ওঠায়
ভ্রæক্ষেপ নেই ঝড় ও বৃষ্টিতে
তার কোনো কাজ নেই আর
জলের দিকে নুয়ে থাকা ছাড়া।
অথচ এই জলে আর কতকাল ওঠে না ঢেউ
ডুব দেয়ার আগে তোমার সাদা
দুহাতে সরানো আজলাটুকুর।
তুমি স্নান করে পৃথিবীর সব রাঙা রাজকন্যার রূপ নিয়ে
চলে গেছো দূরে
শুধু
শুধু
তোমার একদার স্পর্শের মায়া মিশে আছে
এই ভেবে
গাছটি নুয়ে আছে জলের দিকে।
দীর্ঘপথ পার হয়ে
গন্তব্যের দীর্ঘপথ পার হয়ে এখন
এক ভাঙ্গা ব্রিজের পাশে পাকুড়গাছের ছায়ায়
বসে আছি।
মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে
প্রপিতামহের জটার মতো বৃক্ষের শেকড়
আশ্রয় জাগানিয়া।
দীর্ঘপথ পার হওয়ার ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে
অবসাদ মনে পথে কথার কষ্ট দেয়া মানুষের
পায়ে জমেছে রক্ত কাঁটা ও পাথরের আঘাতের
ধুলোও সারাতে পারেনি।
এই ব্যথা এই ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে ইচ্ছে করছে।
সামনে ভাঙ্গা ব্রিজ।
পার হলেই হয়ত শেষ করা যাবে বাকী পথটুকু।
তারপর গন্তব্যে হয়ত পৌঁছা যাবে
ঘুম ঘুম মাঠ পার হয়ে
নীল দিগন্তের ওপারে
না ফেরার কোনো গন্তব্যে।