সেলিনা শেলী । গুচ্ছ কবিতা
সেলিনা শেলী । গুচ্ছ কবিতা
অলোখঝরা

 

 

ছুঁতে গেলে মনে হয় কী দূরত্ব তোমার!

বুকের ভেতর কাঁদে একা ইহকাল

কুড়িয়ে পাওয়া নদী কোথায় যে হারায়

ব্রহ্মাণ্ড হাই তুলে কেবলই ঘুমায়!


নক্ষত্র নদীর মতো কেনো ভেসে যায়!


আঙুলে ত্ষ্ণৃা ছিলো পারি নি ছুঁতে

গোপন আংটি কেবল মসলিন লুকায়

স্বর্গগঙ্গা দেখার ছলে রাত্রি বুনে যাই

হয়তো প্রেম নয় দেহ কলস উছলায়।

 

যে মেঘ ঝরার আগে দিয়েছে শূন্যতা

ভেতরে ভাঙেনি ভাঁজ আড়মোড়া কাম

দূর কোন্  দিগন্তের রঙশালা হতে

রঙ নিয়ে সূর্য যায় মুছে তার নাম।


প্রেমের মতো ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে

নিদ্রাকুসুম মেখে  কে কোথায় জাগে!


 

উদ্ভাসন

বরফখচিত গাছের মতো নিরাজন হয়ে ছিলাম।

জানি--যুদ্ধ যতো না বাইরের তারও বেশি অন্তর্গতে

মানুষের শব্দশর বিঁধে নিজকে ভেঙে নেবো

এমন কখনও হবে না।

সময়ের লেগে থাকা ক্ষতে,প্রলেপে-প্রতাপে

কতো যে বাহানা!

তবু যাকে নির্মাণে নিয়ত নিবেদিত এতোগুলো  বছরে-- সে আমি অক্ষয় জেনো।


তবে মানুষের বিষমাখা তীর কাঁকড়াশব্দ

আঁকশির মতো বিঁধে গেলে

আমিও নিরাজন হই--

শান দিয়ে তুলি তাকে,সে তো নয়

রিপ ভ্যান উইংকেলের রাইফেল--

যে  ঘুমিয়েই থাকবে!

নিজের মনোলগে অচূর্ণিত চিতা হয়ে নিজেকে পোড়াই।


প্রত্যাবর্তন

 

 

তোমার কাছে একটা ক্লান্ত বিকেল জমা রাখতে এসেছি

এফোঁড় ওফোঁড় কাঁটা চামচে পুরো বিকেলটা গেঁথে নিয়ে তুমি শুধু পাহাড়ের কথা বললে!

আমি উচ্ছ্বাসী নদী নিয়ে পাহাড়ের বুক চিড়ে ভেতরে যেতে পারি নি।

পাথরের পাহাড় পরিসীমার বাইরেই তছনছ করে দিলো স্রোতের আকুতি!

ভেঙে আছড়ে ফিরে যেতে যেতে দেখি--

তোমার প্লেটের কাঁটা চামচে তখনও লেগে আছে আমার ক্ষতবিক্ষত অস্থি মজ্জা মেডুলার কণা!


 

মাতাল মহিমা


রাত তার সবটুকু মহিমা মেখে

আদেহ চুম্বন করে যায়

অন্ধকার অলোখঝরার মতো

বেদনার দানাগুলো মদিরায় জড়ায়।

মাতাল গ্লাসে ছড়িয়ে পড়া বরফের স্বেদ যেনো জমে ওঠে শরীরে আমার!


ব্রহ্মাণ্ডও দু'পেগ অন্ধকার গিলিয়ে বলে

কামেতে রাখতে নেই কোনো লাজ লজ্জা

 

আর আমি গলে পড়ি গলে পড়ি

দালির ঘড়ি, নাকি বেশ্যার শাড়ি!

সময়ের সময় জেনে কী লাভ আমার

ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো কেবলই আন্ধার।


একটা প্রেম এসে তারুণ্য তাপের দিনে

সেই কবে ছুঁয়েছিলো বুকের কুসুম!

সেই কবে!

স্মৃতির ধুলো ঝেড়ে আজ বুঝি

সেও আসে নবীন যুবক!

সেই যে চোখের চমক

আর

আঙুলের ভাষা--

আঁধারের অধিক আজ তারও সম্মোহন!


আজও সেই চোখের তীরে বিদ্ধ করি দেহ

অন্ধকার গিলে ভাসি অন্ধ উজানে

থাকে না কিছুই আর,

না আমি না আন্ধার।

দেহ জুড়ে খেলে যায় চুম্বন বাহার।

আমি কী আমার থাকি!না থাকি তাহার!



শ্রীশ্যামা চরণ ভবন



পুরোনো শার্ট কিম্বা বইয়ের মতো একটা মেদুর ঘ্রাণ লেগে আছে আত্মায়। কখনও মনে হয় শ্রীশ্যামা চরণ কবিরাজ ভবন উড়ে উড়ে এসে দু'পেগ চেতনাবর্ধক গিলিয়ে দিয়ে গেছে!দূরে কোনো ঘরকুঠুরিতে বেজে চলেছে রুনু বিশ্বাসের পায়ের নূপুর। দুপুর হলে কোথাও গোঙানি- কান্না;সেই বেদনা ছুঁয়ে বেশিদূর পারি নি যেতে।আঁখি দাশ গুপ্তার তরুণী দেহ বেরিয়ে যাচ্ছে--চিতাদাহে!কিছু পোড়া ঘ্রাণ ছাই এখনও ওড়ে!মলিন শাড়ির মতো প্যাঁচিয়ে থাকা সিঁড়িগুলো বৃত্তাকার ভবনে ডেকে আনে পাঁড় পথিক।আর কোনো কোনো ঘরের ভেতর বেজে চলে বেগম আখতার,মুশতারী বাঈ!রাতের নৈঃশব্দ্য ভেঙে নাটকের সংলাপ আওড়ে হেলেদুলে বাড়ি ফেরেন মিলন চৌধুরী।আর মাসিমা তার নকশিকাঁথায় বুনে চলেন আরও  কিছু স্বপ্নবিভূঁই।এশহরের সবচেয়ে কালো কবিতার তলপেটে জমে ওঠে রক্তের দানা,-- কবিতার ডালিমকুমার যার নামাঙ্কিতে নামায় সকল শব্দের মোকাম,একদিন কালোমেয়ের আলো হয়ে আসে তূর্যসুষমা!কোথাও বেজেই চলে ভাঙা হারমোনিকা!শেফালি ঘোষের সাথে আসে শ্যামসুন্দর।তবক দেয়া পানের মৌ মৌ ঘ্রাণ বাতাসের গুমোট কাটায়।দু'প্রস্থ গানে পানে কর্ণফুলীর সাম্পান ভেসে যায়।নাটকের মহড়া জুড়ে পাশের কুঠরি ঘরে সাফায়াত খান,ফারুক ইকবাল, শাহিদ আনোয়ারের খুনসুটি শোনা যায়!
শ্রী শ্যামা চরণ ভবনের ভাঙা পাঁচিল ঘিরে ঘৃতকাঞ্চন আর ফার্নের ঝোপে রোদ ছলকে পড়ে।দূরে দোভাষ বাড়ির পিছে মাতাল কর্ণফুলী  ডাকে--আয়।
শহরের এইসব অলৌকিক বিভূতি আজও কেনো দুষ্কালের পর্দা সরায়, মনোসঞ্জিবনীতে বেজে বেজে যায়--
বেজে বেজে যায়--
হায়!

 


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান